যেখানে মুসলমান পটুয়াদের তুলিতে মূর্ত হয়ে ওঠেন হিন্দু দেব-দেবীরা

"রাজার পাপে রাজ্য নষ্ট, প্রজা কষ্ট পায়/ গিন্নির পাপে গিরস্ত নষ্ট, ঘরের লক্ষ্মী উড়ে যায়। / মহারাজের দেশে দেখ জল নাইক হ’ল/ রাজার প্রজাগণ কষ্ট পেয়ে পলাইতে লাগিল।’’


কৃষ্ণের অবতারবিষয়ক একটি পটের গানে এমনই সামাজিক ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায়। 


পটুয়াদের পট এবং গানের বিষয় বিচিত্র। তার মধ্যে যমলোক, বৌদ্ধ জাতক, গাজী পীর, রামকাহিনি, কৃষ্ণকাহিনি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। অনেক সময় সামাজিক কোনও ঘটনা নিয়েও পটুয়া গান রচিত হত। পটুয়া সংগীত এক প্রকার লোকগীতি। আজ সেই সংস্কৃতি প্রায় বিলীনের পথে। পটুয়ারা এই গানের রচয়িতা ও পরিবেশক বলে এর নাম হয়েছে পটুয়া সংগীত। পটুয়ারা পৌরাণিক ও লৌকিক কাহিনি অবলম্বনে বিভিন্ন ধরনের পট তৈরি করতেন এবং সেইসব পটের বিষয় অনুযায়ী গান রচনা করতেন। এই গানগুলো তাঁরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে পট প্রদর্শনের সময় উপস্থাপন করেন। গানের সঙ্গে কখনও কখনও নৃত্যও পরিবেশিত হত। এর মাধ্যমে তাঁরা জীবিকা নির্বাহ করতেন।
বাংলার লোকশিল্পের অন্যতম উপাদান পটচিত্র। ভারতে নানা রকম পটচিত্র প্রচলন ছিল বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক পর্যন্ত। তখন পটচিত্র দেখিয়ে গ্রাম-গঞ্জের মানুষকে ধর্ম ও লোকাচার নিয়ে নানা শিক্ষা দেওয়া হত। পটচিত্র দেখিয়ে পটের গান গ্রাম-গঞ্জের মানুষের বিনোদনও ছিল। কাগজ আবিষ্কার হওয়ার আগে সকল পটচিত্র কাপড়েই আঁকা হত।

আরও পড়ুন: চৈতন্য মহাপ্রভুর চরণচিহ্ন রয়েছে বাংলার এই তীর্থক্ষেত্রে


রামায়ণ, কৃষ্ণলীলা, মনসামঙ্গল, শক্তি, যম, দশাবতার, চণ্ডীমঙ্গল, গাজীর পটের প্রচলন ছিল এদেশে। ব্রিটিশ আমলের ময়মনসিংহ মহকুমার ম্যাজিস্ট্রেট গুরুসদয় দত্ত ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ২৬৩টি পট সংগ্রহ করেছিলেন। তার বেশিরভাগই সংগ্রহ করেছিলেন বীরভূম, বাঁকুড়া, বর্ধমান, মেদিনীপুর, মুর্শিদাবাদ থেকে। গুরুসদয় দত্ত তার মধ্যে আটটি পট সংগ্রহ করেছিলেন বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলা থেকে। এই আটটি পটই ছিল গাজীর পট। গুরুসদয় দত্ত বাংলাদেশ থেকে অন্য কোনও পট সংগ্রহ করেননি বা পাননি।


গুরুসদয় দত্ত ‘পটুয়া সংগীত’ নামে একটি বই লেখেন ১৯৩৯ সালে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত বইটিতে ২৯টি পটের গান রয়েছে। সেখানে কোনও গাজীর পটের গান নেই। তবে পটে আঁকা ছবি দেখিয়ে গাওয়া হত গাজীর গান। এই পটের গানও আমাদের লোকসংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এক সময় গাজীর পট দেখিয়ে গাওয়া গান ছিল বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের মানুষের বিনোদন। সম্ভবত পীর গাজী তখন জনপ্রিয় ছিলেন। আচার্য বংশের প্রতিমা শিল্পীরা তৈরি করতেন এই পট। তাঁদের থেকে পট কিনে নিয়ে পটের গান গাইতেন বেদে সম্প্রদায়ের লোকরাও। আধুনিকতার দাপটে জনপ্রিয় এই লোকসংস্কৃতি এখন বিলীনই বলা চলে।


সংস্কৃত ‘পট্ট’ শব্দ থেকে পট কথাটি এসেছে। ‘পট্ট’ শব্দের অর্থ কাপড়। পটচিত্র হচ্ছে একখণ্ড কাপড়ের উপর হিন্দু দেবদেবী কিংবা মুসলিম পির-ফকিরদের বিচিত্র কাহিনি-সংবলিত চিত্র। এই পটচিত্রের শিল্পীদেরই বলা হয় পটুয়া। পটুয়ারা সংগীত সহযোগে পটচিত্র দেখিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তাঁরা গানের সুরে দর্শক ও শ্রোতাদের পটচিত্রের আখ্যানভাগ বুঝিয়ে দেন। কাপড়ের ওপর পট আঁকার রীতি ছিল প্রাচীনকালেও। তা থেকেই সাধারণভাবে কাপড়ে বা অন্য স্থানে আঁকা সব ছবিকেই পট বলার রীতি প্রচলিত হয়। যারা ছবি আঁকতেন, তাঁদের বলা হত পটুয়া। এভাবেই পট ও পটুয়া কথার সঙ্গে পরিচিত হয়েছে বাংলার মানুষ। 


প্রাচীন বাংলায় যখন কোনও দরবারি শিল্পের ধারা গড়ে ওঠেনি, তখন পটচিত্রই ছিল বাংলার গৌরবময় ঐতিহ্যের ধারক। আর এই চিত্র যাঁরা অঙ্কন করতেন বা এখনও পট রচনা করছেন, তাঁদের বলা হয় পটুয়া। সপ্তম শতাব্দীতে রচিত বানভট্টের হর্ষচরিতে যমপট ব্যবসায়ীর কথা উল্লেখ রয়েছে। গুরুসদয় দত্ত এ প্রসঙ্গে লিখেছেন- "রাজা প্রভাকর বর্ধনের পীড়ার কথা শুনিয়া হর্ষবর্ধন শিকার হইতে ফিরিয়া রাজধানীতে প্রবেশ করিয়াছেন। হর্ষবর্ধন নগরে প্রবেশ করিয়া দেখিলেন দোকানের পথে অনেকগুলি কৌতুহলী বালকদ্বারা পরিবৃত একজন যমপট্টিক বা যমপট ব্যবসায়ী পট দেখাইতেছেন। লম্বা লাঠিতে ঝুলানো পট বাঁ হাতে ধরিয়াছে, ডান হাতে একটা শর কাঠি দিয়া চিত্র দেখাইতেছে। ভীষণ মহিষারূঢ় প্রেতনাথ প্রধান মূর্তি। আরো অনেক মূর্তি আছে। যমপট্টিক গাহিতেছে-
‘মাতাপিতৃ সহস্রানি পুত্র দার শতানি চ
যুগে যুগে ব্যতিতানি কস্যতে কস্যবা ভবান’।।"


বাংলায় বৈষ্ণবীয় ধারায় পটচিত্র অঙ্কন করার রীতিও যথেষ্ট। নিমাইয়ের সন্ন্যাস গ্রহণ থেকে শুরু করে নগরকীর্তনের বিভিন্ন অনুষঙ্গ নিয়ে পট আঁকা হয়েছে। এই সকল পটচিত্র আবার কাহিনি আকারে মানুষের মধ্যে পরিবেশিত হওয়ার কথাও জানা যায়। বিশেষ করে শ্রীচৈতন্যের ভক্তি আন্দোলনের পরবর্তীতে বৈষ্ণবীয় ধারার পটের প্রসার ঘটে বেশি। নগরকীর্তনের মতো পটের গানও গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রসারে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিল। 


পটের গানের নানা প্রকারভেদ আছে- যেমন, লীলা কাহিনি, কৃষ্ণলীলা, গৌরাঙ্গলীলা, রামলীলা, শিবপার্বতীলীলা ইত্যাদি লীলা কাহিনিমূলক সংগীত। 


পঞ্চ বা পাঁচ কল্যাণী

এই পর্যায়ের সংগীতগুলি কোনও বিশেষ লীলা কাহিনি বা আখ্যায়িকা অবলম্বনে রচিত হয় না। এখানে নানা দেব-দেবীর সম্পর্কে ছড়ার পাঁচমিশালি সমাবেশ ঘটে।


গো-পালন বিষয়ক গীতিকা

গো-পালন গীতিগুলিতে কপিলার মর্তে অবতীর্ণ হতে প্রথমে অনিচ্ছা প্রকাশ ও পরবর্তিতে মনুষ্যজাতির সেবার জন্য দেবগণের সনির্বন্ধ মিনতি এখানে গীত হয়।


পটুয়া শিল্পীরা হিন্দু দেব-দেবীর ছবি এঁকে তাঁদের মহিমা কীর্তন করলেও তাঁরা বেশিরভাগই হিন্দু নন। যদিও তাঁরা হিন্দুদের সংস্কৃতির সঙ্গে অনেকেই সম্পৃক্ত। পটুয়া পরিবারের মেয়েরা অনেকেই হিন্দুদের সামাজিক রীতিনীতি মেনে চলেন। পটুয়াদের হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে কিছু সীমারেখা বরাবরই ছিল। তাঁদের মধ্যেকার বৈবাহিক সম্পর্ক নিজ ধর্মের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। আজ তাঁরা অনেকটাই মুক্ত। 


পটের গান লিখে রাখার কোনও রীতি পটুয়াদের মধ্যে প্রচলিত নয়। তাঁরা ঐতিহ্যগতভাবে এই গান স্মৃতিতে ধরে রাখেন। যিনি পট আঁকেন, তিনি ঐতিহ্যগতভাবে পটের গানকে স্মরণ করেই আঁকেন। কখনও কখনও কেউ কেউ নতুন দৃশ্যের অবতারণা করতে পারেন। যিনি গান গেয়ে পট দেখান, তিনি নতুন গানের কলি যুক্ত করে নেন। এই ব্যাপারে পটুয়াদের স্বাভাবিক দক্ষতা রয়েছ বহুকাল ধরে। তাই শিল্পের দাবি নিয়ে ইতিহাসে পাতায় থেকে যাবে পট ও পটের গান।

More Articles