সুভাষ না রাসবিহারী, বাঙালির প্রাণের নায়ক সব্যসাচী আসলে কে!

ঝড় জলের রাতে সব্যসাচী বৃষ্টির আস্তরণ পেরিয়ে হারিয়ে যাচ্ছেন দূরে। তাঁর দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ভারতী। সুমিত্রার চোখের কোলে জমছে কান্না। এতদিন বর্মা মুলুকে যৌথ প্রচেষ্টায় যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তার শেষ কি এখানেই? নাকি, আরও কোনও একলব্য আছেন যিনি মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে অবলীলায় হানা দেবেন সূর্যতোরণে ? আশা নিরাশার এই দোলাচলেই ফুরোয় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'পথের দাবী'। তার কুশীলব সব্যসাচী মল্লিক বাঙালির আদর্শ সুপারহিরো। কঠিন শপথ তাঁর, যে কোনও মূল্যে ভারতবর্ষের শরীর থেকে মুছে ফেলতে হবে পরাধীনতার গ্লানি। দুই হাতে পোক্ত তীরন্দাজের তেজ নিয়ে তিনি যাত্রা করেন অন্ধকার থেকে আলোর উদ্দেশ্যে। ইংরেজ শাসনে সব্যসাচীর মধ্যে দিয়ে যেন একজন যথার্থ বিপ্লবীকে  ফুটিয়ে তুলেছিলেন শরৎচন্দ্র। তাঁর চিন্তাধারায় প্রকাশ পেয়েছিল অগ্নিযুগের হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধার স্পৃহা। প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়, সে চরিত্রের বাস্তব অনুপ্রেরণা কে? কার আদলে সব্যসাচীর মতো অমন একজন প্রখর বুদ্ধি সম্পন্ন চরিত্র এঁকেছিলেন তিনি? একদল মনে করেন সুভাষচন্দ্র বসু। কিন্তু তথ্য প্রমানের রায় এ ধারণার বিপরীতে।  সব্যসাচীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যর সঙ্গে আসলে যাঁর মিল খুঁজে পাওয়া যায় তাঁর নাম রাসবিহারী বসু। যাঁর কিস্সা কাহিনি শ্রোতাকে যুগ যুগ ধরে রোমাঞ্চিত করে এসেছে। 

দিনটা ছিল খ্রিস্টমাসের, সাল ১৯১২। তৎকালীন বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জের সিদ্ধান্তে ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে স্থানান্তরিত হয়েছে দিল্লিতে। তারই উদ্বোধনে সারা শহরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে জৌলুষময় 'State entry' । বিরাট শোভাযাত্রার মধ্যে দিয়ে নতুন রাজধানীর মানুষজন বরণ করে নিচ্ছেন হার্ডিঞ্জকে।।তিনি বসে আছেন জমকালো সাজের এক পেল্লায় হাতির উপর। হঠাৎ করে তাঁর উপর এসে পড়ল দুটো বোমা। ক্ষয় ক্ষতি বিশেষ হল না ঠিকই, কিন্তু মাহুতের মৃত্যু ঘটল তৎক্ষণাৎ। আশেপাশে হুলুস্থুল পড়ে গেল। কার এত বড় আস্পর্ধা যে স্বয়ং বড়লাটকে লক্ষ্য় করে বোমা ছোঁড়ে? সাক্ষীও পাওয়া গেল অল্প সময়ের মধ্যেই। তিনি জানালেন যে এক বাড়ির ছাদ থেকে স্পষ্ট দেখেছেন দুজন মুসলমান জেনানাকে বোমা ছুঁড়তে। আসলে কেউই জানতেন না, মহিলার ছদ্মবেশের আড়ালে লুকিয়ে ছিলেন খোদ বাংলার দুই দামাল বিপ্লবী। তাঁদের নাম বসন্ত বিশ্বাস এবং মন্মথনাথ বিশ্বাস। গুপ্ত সমিতির নায়ক রাসবিহারীর নির্দেশেই তাঁরা চাঁদনি চৌকের একটা বাড়ির ছাদে পজিশন নিয়েছিলেন। সযত্নে তাঁদের ছদ্মবেশে মুড়ে দিয়েছিলেন খোদ রাসবিহারী। ইংরেজ সরকারের কাছে তাঁর মাথার দাম তখন অনেক। ফেরারি জীবনের সূত্রপাত অবশ্য হয়েছিল এ ঘটনার আগেই। এককালে ফরেস্ট অফিসের নিরীহ কেরানির ছদ্মবেশে চালাতেন বিপ্লবের কাজ। কিন্তু আত্মগোপন করে থাকা বেশিদিন সম্ভব হল না তাঁর পক্ষে। পালাতে হল কাশীতে।

ইতিহাসের চেয়েও প্রাচীন শহর বারাণসী। সেখানেই বাড়ি ভাড়া নিয়ে রাসবিহারী থাকেন। জোর কদমে চলে গুপ্ত সমিতির সদস্যদের তালিম। এমনই একদিন দলের ছেলেদের বোমা বাঁধা শেখাতে গিয়ে কোনোভাবে বাড়ির ভেতরেই ঘরে গেল বিস্ফোরণ। এলাকা কেঁপে উঠল তার শব্দে। বাড়িওয়ালা ছুটে এলেন তড়িঘড়ি, ছেলে ছোকরারা করে কী। এসে তো তিনি হতবাক। সমবেতভাবে তাঁর কাছে সাফাই গাওয়া হল, 'ইয়ে, মানে, এসিড ভরতি একটা বোতল ফেটে শব্দ হল আর কী।' এরপর আর সে বাড়িতে থাকা চলেনা রাসবিহারীর। উপরন্তু, বোমা ফেটে খানিক আহতও হয়েছিলেন তিনি। তাঁকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হল ডাক্তার কালীপ্রসন্ন সন্যালের বাড়ি। হঠাৎ একদিন তাঁর এক সহকর্মী এসে জানালেন, কাশীর দেওয়ালে দেওয়ালে তাঁর ছবি আটকানো পোস্টার ঘুরছে। ব্রিটিশ সরকার ঘোষণা করেছে, যে ধরিয়ে দিতে পারবে রাসবিহারীকে, তাকে দেওয়া হবে মোটা টাকা পুরস্কার। রাসবিহারী বুঝলেন এমন অনেকেই আছে যারা কটা টাকার জন্য তাঁকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে পেছপা হবে না। কী করা যায়?

এসব ভাবতে ভাবতেই  মাথায় একটা ফন্দি এল। সহকর্মীদের বললেন একটা খাটিয়া জোগাড় করতে। তারপর খেলার শুরুওয়াত। রাসবিহারীকে গ্রেপ্তার করতে দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়ে আছেন পুলিশ, তাঁদের চোখের সামনে দিয়েই খাটিয়া করে চাদর চাপা মৃতদেহ নিয়ে বেরিয়ে গেলেন একদল। শবের ছদ্মবেশে  ঠায় শুয়ে রইলেন রাসবিহারী বসু। এভাবেই পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে সেখান থেকে পালালেন তিনি। এমন  ঘটনার সন্ধান রাসবিহারীর জীবনে যে কত পাওয়া যাবে তার ইয়ত্তা নেই।  তাঁর ছদ্মবেশে জাপান পালানোর গল্প আজকের দিনেও শিহরণ জাগায়। 

দিল্লীর বিস্ফোরণের ঠিক তিন বছর পরেই রাসবিহারী বুঝলেন ভারতে থেকে আর কাজ করা সম্ভব নয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের স্বার্থে জাপান যাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু সেখানে যাবেনই বা কী করে? পাসপোর্ট কোথায়? এমন সময় তাঁর কানে এলো কয়েকদিনের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথের সে দেশে যাওয়ার কথা। এসে পড়ল সুযোগ। মাথায় সাদা রেশমের পাগড়ি এবং বুকে অভিজাত কোর্ট চাপিয়ে তিনি একটা ব্রুহাম চেপে রওনা হলেন পাসপোর্ট অফিসের দিকে। সেখানে গিয়ে চোস্ত ইংরেজিতে জিগেস করলেন, 'আমি কি একবার পাসপোর্ট অফিসারের সঙ্গে দেখা করতে পারি?' অমন সম্ভ্রান্ত পোশাক দেখে পাসপোর্ট অফিসার এমনিতেই হকচকিয়ে গেছিলেন। এবার রাসবিহারী তাঁকে জানালেন যে তিনি রবীন্দ্রনাথের আত্মীয়, রাজা পি. এন. টেগোর।  তারপর তাঁর প্রয়োজন খোলসা করলেন। পাসপোর্ট অফিসার নিশ্চই শুনেই থাকবেন যে রবীন্দ্রনাথ জাপানের উদ্দেশ্যে রওনা দিচ্ছেন। তিনি যাচ্ছেন রবিবাবুর সহকারী হিসেবে। রবীন্দ্রনাথের জাপান পৌঁছনোর আগেই তাঁকে পৌঁছে যাবতীয় বন্দ্যবস্ত সেরে রাখতে হবে। সেসব মাথায় রেখে তাঁকে যদি চটজলদি একটা পাসপোর্টের ব্যবস্থা করে দেওয়া যায় তাহলে খুবই সুবিধা হয়। ঠাকুরবাড়ির একজন সদস্য এসে পাসপোর্ট চাইছেন আর অফিসারসাহেব তাঁকে মানা করে দেবেন তা কি হয়? অল্প সময়ের মধ্যেই রাসবিহারীর হাতে এসে গেল পাসপোর্ট। 

আরও পড়ুন-রবীন্দ্রনাথ আঁতকে ওঠার ভান করলেন মোহরের কথা শুনে…

এভাবেই ছদ্মবেশকে কাজে লাগিয়ে ভয়ঙ্কর সমস্ত অ্যাডভেঞ্চারে জড়িয়ে পড়েছেন রাসবিহারী বসু। তাঁর এই ছদ্মবেশের কারিগরী সব্যসাচী মল্লিকের মধ্যেও প্রবলভাবে লক্ষ করা যায়। পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিতে কখনও ঢিলে পায়জামা আর রাওলপিন্ডির নাগরা পরে তিনি কাবুলিওয়ালা সাজেন। আবার কোনও সময় তিনি চট্টগ্রামের মাঝির বেশ ধরে যাত্রীদের নদী পারাপার করান। রাসবিহারীর মতোই তিনি বহু ভাষায় কথা বলতে পারেন। তাঁর চারিত্রিক গুণাবলী সুভাষের আদলে গড়ে ওঠা সম্ভব ছিল না প্রধানত দুটো কারণে। প্রথমত শরৎচন্দ্র সাক্ষাৎকরে নিজেই জানিয়েছেন যে সব্যসাচীর ক্ষেত্রে তিনি অনুপ্রেরণা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন রাসবিহারীকে। দ্বিতীয়ত, সুভাষবাবু কলকাতা ছেড়ে আফগানিস্তানের উদ্দেশ্যে পালয়েছিলেন ১৯৪১ সালে। অথচ, এর ১৫ বছর আগেই প্রকাশিত হচ্ছে 'পথের দাবী'। 

বিতর্ক চলবে নিজের পথে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম দুই নায়ককে কেন্দ্র করে সাধারন মানুষের গল্পকথার অন্ত নেই। চে গেভারা মনে করতেন,  'A revolutionary is guided by feelings of love'। ঔপনিবেশিক শাসনের কবল থেকে জন্মভূমিকে মুক্ত করতে এই রোম্যান্টিকতার টানেই তো দেশ ছেড়েছিলেন রাসবিহারী। পরবর্তীতে তাঁর পথ অনুসরণ করেছিলেন সুভাষ। ২৩ জানুয়ারি সুভাষের জন্মদিন। তার ঠিক দুদিন পর, অর্থাৎ ২৫ এ জানুয়ারি জাপানে সম্পন্ন হয়েছিল রাসবিহারীর শেষকৃত্য। একে কাকতলীয়  ছাড়া আর কীই বা বলা যেতে পারে? শুধু আদর্শ নয়, জন্ম মৃত্যুর তারিখের মধ্যে দিয়েও বাঙালির দুই শ্রেষ্ঠ নেতা যেন চলে এসেছেন পরস্পরের বড্ড কাছাকাছি।

 

More Articles