মুখ্যমন্ত্রীর ডাকে মিলল না সাড়া! মাথা উঁচু করে আন্দোলনেই অনড় জুনিয়র ডাক্তারেরা

Junior Doctor's Protest: দাবি না মানা হলে আন্দোলনের পথ থেকে সরে আসছেন না চিকিৎসকেরা, তা সাফ জানিয়ে দিলেন আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তারেরা।

আরজি করের তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় অবস্থানে অনড় জুনিয়র চিকিৎসকেরা। গত ন অগস্ট আরজি কর হাসপাতালের বক্ষ বিভাগের সেমিনার রুম থেকে উদ্ধার হয় এক তরুণী চিকিৎসকের ক্ষতবিক্ষত দেহ। সেই ঘটনার পর থেকেই কর্মবিরতির ডাক দিয়েছেন জুনিয়র চিকিৎসকেরা। তার পরে আরজি কর কাণ্ডের জল গড়িয়েছে অনেক দূর। সিবিআই তদন্ত থেকে শুরু করে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সুপ্রিম কোর্টের মামলা নেওয়া। তবে কাজে ফেরেননি জুনিয়র চিকিৎসকেরা। মধ্যিখানে কলকাতা পুলিশের কমিশনার বিনীত গোয়েলের ইস্তফা চেয়ে লালবাজারে ধর্না দেন চিকিৎসকেরা। তাঁদের কর্মবিরতি এখনও চলছে। দাবি না মানা হলে আন্দোলনের পথ থেকে সরে আসছেন না চিকিৎসকেরা, তা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন তাঁরা।

সোমবার আরজি কর মামলার শুনানিতে জুনিয়র চিকিৎসকদের কড়া বার্তা দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। কার্যত সময় বেঁধে দিয়ে কাজে ফেরার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল আন্দোলনরত জুনিয়র চিকিৎসকদের। মঙ্গলবার বিকেল পাঁচটার মধ্যে কাজে ফেরার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও নবান্নে প্রশাসনিক বৈঠক থেকে আন্দোলনরত চিকিৎসকদের কাজে ফেরার পরামর্শ দেন। তবে মঙ্গলবার তেমন কিছুই ঘটেনি। বরং চিকিৎসকেদের তরফে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়, তাঁদের দাবিদাওয়া না মানা হলে কাজে ফেরার প্রশ্নই নেই। সোমবার মুখ্যমন্ত্রীর উৎসবে ফেরার মন্তব্যকে অসংবেদনশীল বলে অভিহিত করেছেন এদিন চিকিৎসকেরা। সুপ্রিম কোর্টের এই নির্দেশের উল্টে আরেক ধাপ চড়েছে চিকিৎসকদের দাবিদাওয়া। এতদিন পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েলের পদত্যাগ চাইছিলেন চিকিৎসকেরা। এবার সেই লিস্টে যোগ হয়েছে আরও বেশ কিছু নামও। সেই তালিকায় রয়েছে রাজ্যের স্বাস্থ্যসচিব, স্বাস্থ্য অধিকর্তা (ডিএইচএস) এবং স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা (ডিএমই)-র নামও।

আরও পড়ুন: আরজি কর: ধৃত সন্দীপদের হেফাজতে নিতে চাইছে সিবিআই! নেপথ্যে কোন কারণ?

সোমবার বিকেলেই আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তারেরা তাঁদের নতুন কর্মসূচির কথা ঘোষণা করে দেন। এই দাবিপূরণের জন্য, মঙ্গলবার করুণাময়ী থেকে স্বাস্থ্য ভবন পর্যন্ত অভিযানের ডাক দেন তাঁরা। সেই মতোই প্রতীকী মস্তিষ্ক হাতে নিয়ে এদিন মিছিলে হাঁটেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। তাঁদের বক্তব্য, রাজ্যের স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে একের পর এক দুর্নীতি হয়ে গেলেও স্বাস্থ্য ভবনের তরফে এত দিন কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি। চিকিৎসকদের অভিযোগ, তাঁদের আন্দোলনকে দমাতে নানা পদক্ষেপ করা হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য ভবনের কর্তাদের ‘মস্তিষ্ক উপহার’ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। এক জুনিয়র চিকিৎসকের কথায়, “এ বার অন্তত মাথা খাটিয়ে কাজ করুক স্বাস্থ্য ভবন।”

জুনিয়র ডাক্তারেরা এদিন স্বাস্থ্য ভবনে ‘সাফাই অভিযান’ কর্মসূচীতেও যোগ দেন। ঝাঁটা হাতে স্বাস্থ্য ভবনে ‘ঘুঘুর বাসা’ ভাঙার দাবিও তোলেন তাঁরা। এদিকে এদিন স্বাস্থ্যভবন অভিযান করলেও তাঁদের ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। রাস্তাতেই বসে বিক্ষোভ দেখান তাঁরা। এমনকী বিকেল৫টা অবধি সময়ও বেঁধে দিয়েছিলেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। তার পরেও তাঁদের কয়েক জনকে স্বাস্থ্য ভবনে গিয়ে দাবিদাওয়া জানানোর সুযোগ না দেওয়া হলে অনির্দিষ্টকালের জন্য অবস্থান চালানো হবে বলেও জানান তাঁরা। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মানার ধার না মাড়িয়ে কার্যত এদিন লাগাতার বিক্ষোভ চালিয়ে যাওয়ার কথাই জানিয়েছেন বিক্ষোভরত চিকিৎসকেরা। স্বাস্থ্য ভবনের একটি সূত্র মারফত জানা গিয়েছিল, চিকিৎসকদের একটি প্রতিনিধি দল ভিতরে এসে কথা বলতে চাইলে তাঁদের স্বাগত জানানো হবে। এই বিষয়ে জুনিয়র ডাক্তারদের বক্তব্য, তাঁরা ডেপুটেশন দিতে আসেননি। তাঁদের দাবি স্পষ্ট। সেগুলি মানা না হলে লাগাতার অবস্থান চলবে।

কী কী দাবি রয়েছে চিকিৎসকদের? পাঁচ দফা দাবির মধ্যে রয়েছে—

  • আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত সমস্ত দোষীদের দ্রুত চিহ্নিত করা, অপরাধের উদ্দেশ্য সামনে আনা এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ।
  • তথ্যপ্রমাণ লোপাটের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে জড়িতদের চিহ্নিত করে বিচার।
  • সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণে ‘ব্যর্থ প্রমাণিত’ কলকাতা পুলিশের কমিশনার বিনীত গোয়েলের ইস্তফা।
  • রাজ্যের সব মেডিক্যাল কলেজ, হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা।
  • রাজ্যের সব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভয়মুক্ত পরিবেশ গড়া এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ সুনিশ্চিত করা।

এদিকে এদিন জুনিয়র চিকিৎসকদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চেয়েছিলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। নবান্নে অপেক্ষা করেন তিনি। নবান্নের তরফে এ নিয়ে জুনিয়র চিকিৎসকদের কাছে মেলও করা হয়। তবে সেই ডাকে সাড়া দেয়নি বিক্ষোভকারীরা। চিকিৎসকেদের অভিযোগ, সেই মেলে কোথাও লেখা ছিল না মুখ্য়মন্ত্রী কথা বলতে চান।৬ লাইনের মেল। লেখা ছিল সিনিয়র গভর্নমেন্ট প্রতিনিধিরা কথা বলতে চান। আন্দোলনকারীরা সাফ জানান, "জুনিয়র চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, 'এই মেলকে সদর্থক হিসাবে দেখছি না। আলোচনার পথ খোলা রাখতে চাই। হেল্থ সচিবের কাছ থেকে ইমেল আসা কষ্টকর। নট মোর দ্যান ১০জন, এটাকে অসম্মানজনক বলে মনে করছি। যেভাবে মেল এসেছে এরপর দাঁড়িয়ে এই মেলে সাড়া দেওয়ার জায়গায় আমরা নেই। এরপরেও রাজ্য সরকার যদি ৫টা দাবির ব্যাপারে সদর্থক বার্তা পাই সেক্ষেত্রে কোথাও যাব কি না সেটা ভেবে দেখতে পারি। নবান্ন থেকে মেল আমরা পাইনি। স্বাস্থ্যসচিবের মেল থেকে একটা মেল পেয়েছি। অনেক নমনীয়ভাবে বলতে পারতেন। আমি জানি না নবান্নতে বসে কী হচ্ছে। আলোচনার পথ খোলা। আন্দোলনের ৩২দিন পরে যেভাবে অপমানজনক ভাবে ডাকা হল এই মেলে সাড়া দিতে পারছি না। আমরা যেভাবে অবস্থান বিক্ষোভে বসে রয়েছি সেভাবেই থাকব। আমরা চাই ১০-১২জনের টিম যেতে পারে না।"

আরও পড়ুন: আরজি কর: ফরেন্সিক নমুনা সংগ্রহে গাফিলতি? কতটা ক্ষতি করতে পারে তদন্তের?

মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য অবশ্য জানিয়েছেন, মুখ্য়মন্ত্রী নবান্নে আলোচনার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। জুনিয়র চিকিৎসকদের সঙ্গে তিনি আলোচনায় বসতে চান। তাঁদের তরফে সাড়া না পেয়ে সাড়ে সাতটায় তিনি বেরিয়ে যান নবান্ন থেকে। শোনা গিয়েছে, মুখ্য়মন্ত্রীর সঙ্গে মুখ্যসচিব মনোজ কুমার পন্থ ও স্বাস্থ্যসচিব নারায়ণস্বরূপ নিগমও ছিলেন। তবে সে পথে হাঁটলেন না জুনিয়র চিকিৎসকেরা। কার্যত রাতভর তাঁদের আন্দোলন চলবে বলেই জানিয়ে দিলেন পরিষ্কার করে। জুনিয়র চিকিৎসকদের কর্মবিরতির ফলে রাজ্যের স্বাস্থ্যপরিষেবা অসুবিধায় পড়েছে ভালো মতোই। যদিও মানুষের পাশে দাঁড়াতে বিনামূল্যে অভয়া ক্লিনিক খোলার ডাকও দিয়েছেন তাঁরা। তবে সহ-চিকিৎসকের ধর্ষণ-খুনের সুবিচার না-পাওয়া আন্দোলন থেকে সরে আসার প্রশ্ন নেই, তা আরও একবার বুঝিয়ে দিলেন এদিন জুনিয়র ডাক্তারেরা।

More Articles