উগ্র হিন্দুত্বর বিরুদ্ধে জেহাদ! দলিত জাগরণের নেপথ্যের নায়ক পেরিয়ার
Periyar Erode Venkatappa Ramasamy: ১৯৪৭ সালের ১৫ অগাস্ট ব্রিটিশ শাসকরা ক্ষমতা থেকে সরলে তিনি ঘটনাটিকে ‘উচ্চবর্ণীয় হিন্দুত্ববাদীদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর’ বলে ‘মৌনদিবস’ পালন করেছিলেন।
একটি বৈষম্যযুক্ত আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় ‘Consciousness of Oppressed’ হল এমন এক অশান্ত চেতনাস্রোত যা থেকে থেকে জ্বলে ওঠে। অতীত থেকেই এই ভূখণ্ডে সামাজিক সম্পর্কগুলি শৃঙ্খলিত হয়ে আছে হায়রার্কিক্যাল অনুশাসন গ্রন্থ মনুসংহিতাকে ভিত্তি করে। ফলস্বরূপ এমন এক সমাজব্যবস্থা নির্মিত হয়েছে যার ভিত্তি যেমন অর্থনৈতিক বৈষম্য তেমনই সামাজিক বৈষম্য। অর্থাৎ ধর্মীয় অনুশাসনের মাধ্যমে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ নিপীড়িত অংশকে জন্মগতভাবেই শূদ্র বা নীচুজাত বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবহেলিত, শোষিত, বঞ্চিত, অসম্মানিত মানুষকে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মুক্ত করতে দক্ষিণ ভারতে যিনি এক নতুন জাগরণের সূচনা করেছিলেন তিনি ‘পেরিয়ার’ ই ভি রামাসামী (Erode Venkatappa Ramasamy)।
আজ ই ভি রামাসামীর ১৪৪তম জন্মদিবস। ১৮৭৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর তামিলনাডুর এরোড শহরে জন্ম হয় তাঁর। মাত্র ১২ বছর বয়সে স্কুলের পড়াশোনা ছেড়ে পারিবারিক ব্যবসায় নেমে পড়েন তিনি। ১৯১৯ সালে কংগ্রেসে যুক্ত হন এবং ১৯২৪ সালে কেরলের ভাইকম মন্দির সংলগ্ন রাস্তায় এঝাবা অতিশূদ্র সম্প্রদায়ের প্রবেশাধিকার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ১৯২৫ সালে কংগ্রেস পরিচালিত শেরমাদেবী গুরুকুলম বিদ্যালয়ে ব্রাহ্মণ ছাত্রদের জন্য পৃথক আহারের ব্যবস্থা হলে ছাত্ররা প্রতিবাদ জানায়। এই ঘটনা সম্পর্কে অবহিত হলে পেরিয়ারের কংগ্রেস সম্পর্কে মোহভঙ্গ হয়। ১৯২৫-এর নভেম্বরে কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে সংরক্ষণ নিয়ে বিতর্ক হলে তিনি কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে আসেন।
১৯২৫-এর ২ মে ই ভি রামাসামী প্রকাশ করেন সাপ্তাহিক ‘কুদি-আরাসু’ বা ‘জনগণের রাজ’ পত্রিকা। যৌক্তিকতাবাদী দৃষ্টিতে সমাজ সংস্কারের উদ্দেশ্যে এই বছরই ই ভি রামাসামী শুরু করেন ‘আত্মমর্যাদা আন্দোলন’ (The Self Respect Movement)। এই লীগ পরিচালিত হতো একটি যৌক্তিক-নিরীশ্বরবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে। তাঁদের বক্তব্য ছিল, জাতপাত বিভাজন ব্যবস্থার বিনাশ করতে হলে ব্রাহ্মণ্য-হিন্দুধর্মের শৃঙ্খল ভেঙে বেরোতে হবে কারণ হিন্দুত্ববাদের মূল ধারণা প্রোথিত আছে বর্ণাশ্রম অর্থাৎ জাত-বিভাজনের ধারণার মধ্যে। সামাজিক ন্যায় এবং সাম্য অর্জনের পথে ধর্ম এক বিরাট বাধা। রামাসামীর নেতৃত্বে আত্মমর্যাদা আন্দোলন প্রায় সারা তামিলনাডুতেই এক ব্যাপক সংগঠিত আন্দোলনের রূপ নিয়েছিল। বলা যায়, এদেশের বুকে তিনিই সর্বপ্রথম ‘হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদ’কে একটি বৈষম্যবাদী সর্বগ্রাসী রক্ষণশীলতা এবং প্রগতির পথে প্রধান অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন।
আরও পড়ুন- বিজেপির গান্ধী-মুক্ত ভারতের কৌশল না কি মোদি আমলেই যোগ্য সম্মান পাচ্ছেন নেতাজি!
তামিল সমাজের নিজস্ব সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয় রয়েছে, একথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রাচীন তামিল সাহিত্যের উদাহরণ সামনে এনে পেরিয়ার বলেছিলেন, সেখানে কোনওরূপ বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থার ইঙ্গিত নেই, ব্রাহ্মণরাই দক্ষিণ ভারতে জাতপাতের বৈষম্যের জন্ম দিয়েছে। এভাবে দক্ষিণ ভারতে মনুসংহিতা দহন, রামের ছবি পোড়ানো, গণেশের মূর্তি ভাঙা, মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রবেশ, দেবদাসী প্রথা নির্মূলীকরণ, সংরক্ষণের দাবিতে আন্দোলন, কৃষকদের জমির আন্দোলন এবং সিপিআইয়ের সঙ্গে যৌথভাবে রেলওয়ে শ্রমিকদের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। বিজ্ঞান এবং যৌক্তিকতাবাদী আন্দোলনের বিস্তারেও তাঁর ভূমিকা স্মরণযোগ্য। দক্ষিণ ভারতের নারী আন্দোলনের চিন্তাচেতনা নির্মাণে পেরিয়ারের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। তখনকার নারীমুক্তির প্রশ্নে কমিউনিস্ট পার্টির চিন্তাভাবনাও এত প্রগতিশীল ছিল না। মন্দিরের দেবদাসীরাও তাঁর ভাবনায় আকৃষ্ট হয়ে নারী আত্মমর্যাদা আন্দোলনের নেতৃত্বে উঠে এসেছিলেন। ১৯৩৮ সালে দক্ষিণ ভারতের নারী আন্দোলনের নেত্রীরা একটি সম্মেলনে তাঁকে ‘পেরিয়ার’ বা ‘মহামানব’ বলে সম্বর্ধনা দিয়েছিলেন। তখন থেকেই শব্দটি তাঁর নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়।
১৯৩২ সালে সোভিয়েত রাশিয়া ভ্রমণে যান রামাসামী এবং সেখানকার সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা তাঁকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করে। দেশে ফিরে তিনি একটি সমাজবাদী রাজনৈতিক দল ‘সমধর্ম-সমাজবাদী পার্টি’ গড়ে তুলে এক মারমুখী শ্রমিক আন্দোলনে সামিল হন এবং গ্রেফতার হন। এদেশের সামাজিক-অর্থনৈতিক সমস্যা থেকে মুক্ত হতে হলে রাশিয়ার মতো একটি সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে- এই ছিল তাঁর অভিমত। পরবর্তীকালে হিন্দিভাষা আগ্রাসন বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন তিনি। এই সময় থেকেই পৃথক ‘দ্রাবিড়নাডু’ গঠনের বিষয়ে তামিলদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হয়। ১৯৪৪-এ তিনি গড়ে তোলেন ‘দ্রাবিড় কাঝাগম’।
১৯৪৭ সালের ১৫ অগাস্ট ব্রিটিশ শাসকরা ক্ষমতা থেকে সরলে তিনি ঘটনাটিকে ‘উচ্চবর্ণীয় হিন্দুত্ববাদীদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর’ বলে ‘মৌনদিবস’ পালন করেছিলেন। ব্রিটিশ শাসনে বহুবার কারাবরণ করা এই মানুষটি স্বাধীন ভারতেও ছিলেন প্রথম রাজনৈতিক বন্দি। দিল্লির শাসনকে বিদেশীদের শাসন বলতেন তিনি। ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনেও তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য। কোন সমাজ ভারতরাষ্ট্রকে জাতপাত, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, সাম্প্রদায়িকতা, পরস্পর ঘৃণা মুক্ত করতে পারে এই প্রশ্নের উত্তর তিনি খুঁজেছিলেন তাঁর ‘নতুন বিশ্ব’ রচনায়। সেখানে তিনি এক সাম্যবাদী সমাজের রেখাচিত্র হাজির করেছিলেন।
আরও পড়ুন- হাথরাস থেকে লখিমপুর- আইনের জটে কেন আজও আটকে দলিত ধর্ষণের মামলা?
এই রাষ্ট্রে উগ্র হিন্দুত্ববাদী শক্তি ক্ষমতায় আরোহণের পর সবচেয়ে বেশি যার স্ট্যাচুর উপর আক্রমণ হয়েছে তিনি হলেন পেরিয়ার। কারণ তিনি সারা জীবন হিন্দু-ঐতিহ্যবাদী চিন্তা প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রাম চালিয়েছিলেন। ভারত ভূখণ্ড অসংখ্য নিপীড়িত শ্রেণি, জাত ও জাতিসত্তার কারাগার। এখনও একজন দলিত নাবালক ছাত্রকে শিক্ষকের জলের কলসি ছোঁয়ার অপরাধে প্রাণ দিতে হচ্ছে। বর্তমানে কর্পোরেট পুঁজির সঙ্গে হিন্দুত্ববাদী চিন্তাধারার যোগফলই এই কারাগারকে টিকিয়ে রাখার অন্যতম হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। এই উগ্র জাতীয়তাবাদী আগ্রাসী আক্রমণের সময়ে পেরিয়ার রামাসামীর মতো এশিয়ার অন্যতম চিন্তাশীল সমাজ-সংস্কারক ও মানবতাবাদী ব্যক্তিত্বকে নিয়ে চর্চা ভীষণ ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।
১৯৭৩ সালের ২০ ডিসেম্বর একটি মিটিং চলাকালে অসুস্থ হয়ে পড়েন আজীবন সংগ্রামী এই চিন্তাবিদ এবং ২৪ ডিসেম্বর ভেলোর হাসপাতালে জীবনাবসান হয় তাঁর। সমাজজীবন ও মানবজীবনে ধর্মের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে এই মানুষটিই চিরকাল বলে গিয়েছিলেন, “Religion spoils our brain, it spoils our knowledge of nature, it endangers our prosperity, it stands as obstacle in the path of progress.”