জুয়ার স্বর্গ এখানেই! ভোট এলেই জমে ওঠে ফালোদির 'সট্টা' বাজার

Phalodi satta market: ভোট এলেই বাজারে ভিড় জমতে থাকে ক্রমে। ভোট যত গড়ায়, তত বড় বড় টাকার বাজি ওঠে ফালোদি বাজারে। জমে ওঠে জুয়ার মার্কেট।

ভোট এলেই পাড়ার রক, চায়ের দোকানে জমে ওঠে আলোচনা, চায়ের কাপে ওঠে তুফান। 'ক' দলের জয় বাধা। 'খ' দলের সুযোগ বেশি এই ভোটে। হার কপালে নাচছে 'গ' দলের। এক কথায় বলে ওপিনিয়ন পোল। চার-পাঁচ মাথা এক হলেই জমে ওঠে বিতর্ক। চায়ের আড্ডায়, পাড়ার রকে যে কখনও সখনও এসব নিয়ে বাজি ধরাধরি হয় না, তেমন নয়। তবে সেসব যাকে বলে নির্ভেজাল বাজি। তার টাকার হিসেবও গুলিয়ে যায়, গুলোয় জয়ের হিসেবও। কিন্তু এই বাজি ধরার বাজার মোটেও তেমন জলবৎতরল নয় যেখানে, সেটা রাজস্থানের যোধপুরের কাছে ফালোদি গ্রাম। ভোট এলেই বাজারে ভিড় জমতে থাকে ক্রমে। ভোট যত গড়ায়, তত বড় বড় টাকার বাজি ওঠে ফালোদি বাজারে। জমে ওঠে জুয়ার মার্কেট।

স্থানীয় ভাবে গ্রামের এ বাজার পরিচিত 'সট্টা' বাজার নামেই। আজ থেকে নয়, দীর্ঘদিন ধরেই ফালোদি সট্টা বাজারের বেশ সুনাম। বেটিং আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। তাতে কী? যেখানে বজ্রআঁটুনি, সেখানেই তো ফস্কা গেরো। তাই চোখের আড়ালে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে এই সট্টা খেলার উল্লাস। মফসসলের ছোট্ট বাজার, বাজারের মধ্যে কয়েকটি ছোট ছোট কিয়স্ক। ভোটের বাজারে সেখানে জমে ওঠে ভিড়। গণতন্ত্রের এই লড়াইয়ে সট্টা বাজারের নির্ভুলতা অবাক করবে বাঘা বাঘা ভোটকুশলীকেও।

আরও পড়ুন: প্রকাশ্যে জুয়া খেলেন মহিলারাও, বাংলার বিচিত্র এই মেলার সঙ্গে জুড়ে আছেন বেহুলা-লখিন্দর!

শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে ভোটকে কেন্দ্র করে এই ট্র্যাডিশন চলে আসছে ফালোদিতে। তবে শুধু ভোট বলে নয়। বাজি ধরার এই প্রবণতা ঢুকে গিয়েছে আসলে ফালোদির রক্তে। রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে দুটো ষাঁড় লড়াই করলেও তা নিয়ে বাজি ধরে বসে ফালোদি। শোনা যায়, উনিশ শতকের শেষের দিকে ফালোদিতে এই সট্টা মার্কেট সংগঠিত রূপ ধারণ করে। আজকাল অবশ্য এই ফালোদির সট্টা বাজারের প্রধান বাজি ধরার সময় এবং বিষয় এই ভোট। কিন্তু প্রাথমিক ভাবে কিন্তু বৃষ্টির সম্ভাবনা নিয়েই শুরু হয়েছিল এই বেটিংয়ের ইতিহাস। রাজস্থান মরুভূমি এলাকা। বৃষ্টির জন্য চাতক-চাওয়া চাইতে চাইতে কবে যে সেই বৃষ্টি নিয়েই বাজি ধরা শুরু করেছিল ফালোদি। সেই ঐতিহ্য এখনও চলছে। এখনও বৃষ্টি নিয়ে বাজি ধরা চলে ফালোদিতে। তবে শুধু বৃষ্টি হবে কি হবে না, তা নিয়ে নয়! কবে হবে? হলে কতটা হবে? টানা কতদিন হবে? পুকুর উপচে পড়বে কিনা বা টিনের ছাদে বৃষ্টির শব্দ শোনা যাবে কিনা, সেগুলোও হয়ে ওঠে বাজি ধরার বিষয়।

আইপিএলকে কেন্দ্র করে ফুলেফেঁপে উঠেছিল ফালোদির সট্টা বাজার। তাছাড়া গণতান্ত্রিক দেশে গণতন্ত্রের উৎসব তো লেগেই রয়েছে। লোকসভা ভোট, বিধানসভা ভোট, পঞ্চায়েত ভোট কিংবা পৌরসভার ভোটকে কেন্দ্র করেই ভিড় জমতে থাকে ফালোদির বাজারে। কোন দল কত ভোটে জিতবে। কে হতে চলেছে রাজ্যের বা দেশের পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী, এ সব নিয়ে মাথাব্যথার কমতি নেই সেখানে। সট্টা বাজারে দুটি শব্দের চল, তার একটি 'খানা', অন্যটি 'লাগানা'। যেখানে জেতার সুযোগ কম, সেটা 'খানা', যেখানে সম্ভাবনা বেশি, সেখানে 'লগানা'র সুযোগও ভালো। স্থানীয়দের ক্ষেত্রে অবশ্য আগেভাগে টাকা জমা দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। কারণ বুকিরা প্রত্যেকেই তাদের ভালো মতোই চেনেন। বাইরে থেকে যারা বেটিং করতে যান, তাদের ক্ষেত্রে নগদ জমা করতে হয়। ডিজিটাল ইন্ডিয়ায় প্রায় সমস্ত লেনদেনই এখন হয় ডিজিটালি। বিশেষত বাইরের লোকেদের সঙ্গে তো বটেই। ফালোদির এই বাজার আন্ডারগ্রাউন্ড হলে কী হবে, সট্টা বাজারের লোকজন ছড়িয়ে রয়েছে বিহার, উত্তরপ্রদেশে থেকে শুরু করে সর্বোত্র, এমনকী কলকাতাতেও। তাঁরা বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে। কোথায় কোন সমীকরণে ঘুরছে ভোটের হাওয়া, কোথায় কোন রাজনীতি কাজ করছে, সব নখদর্পণে তাঁদের।

আরও পড়ুন: জুয়াড়ির স্বর্গ-নরক

প্রতিদিন সকাল দশটা নাগাদ খুলে যায় ফলোদির সট্টা বাজার। স্থির হয়ে যায় নির্ধারিত রেট। তারপর সারাদিন ধরে চলে নানাবিধ বেটিং। বিকেল পাঁচটার পরে ঝাঁপ পড়ে সেই বাজারে। ততক্ষণে অবশ্য কোটি টাকার লেনদেন হয়ে গিয়েছে সট্টা খেলাকে ঘিরে। দূরদূরান্ত থেকে লোকজন ফোন করে পর্যন্ত বাজি ধরে। জিতলে তাদের অ্যাকাউন্টে জমে টাকা। হারলে জলের মতো হারায় লক্ষ্মী। কোনও সুনিশ্চিত বাজার সমীক্ষা নয়, বিশ্লেষণ নয়। তার পরেও মিডিয়া ও স্থানীয় মানুষের কথাবার্তা শুনে তার থেকে একটা ধারণা তৈরি করেই চলে নির্ভুল বেটিং। যার কাছে মুখ থুবড়ে পড়তে পারে তাবড় ভোটসমীক্ষা সংস্থা থেকে শুরু করে ভোট কুশলীরাও। সমাজে বেটিং নিষিদ্ধ এবং আইনবিরুদ্ধ। তবে সেই আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েই এই অন্য নেশায় মেতে রয়েছে রাজস্থানের এই ছোট্ট গ্রাম। চলতি লোকসভা ভোটের ফলাফল সামনে আসতে আসতে আগামী ৪ জুন। ফালোদি কিন্তু এখন থেকেই জেনে গিয়েছে সেদিনের ফলাফল। সেই ফলাফলকে মাথায় রেখে কোটি টাকা উঠছে, পড়ছে। এক আশ্চর্য জুয়াখেলা বছরের পর বছর ধরে চলছে রাজস্থানের একরত্তি গ্রামে।

More Articles