তোমার গন্ধ আমার কণ্ঠে
Philosophy of Smell: গন্ধ মানুষের সবচেয়ে পুরাতন, সবচেয়ে ব্যক্তিগত দীর্ঘপথ পরিক্রমার রেলগাড়ি। যখন তখন বিনা টিকিটে পরিক্রমা করা যায়। আমাদের শরীর-মন, যাবতীয় সামাজিক বোঝাপড়া, শ্রেণির বোধ গন্ধে বাঁধা পড়েছে।
যখন যেখানে থাকি, শরীর একটা হলেও, মন থাকে দুটো। একটা মন বাস্তবের সঙ্গে পাল্লা দেয়, তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। অন্য মনটা যখন যেখানে থাকি না, যে জায়গা, যে স্মৃতি ফেলে এসেছি সহসা তাকে এনে হাজির করে। রংদার রোজের মন আর সেপিয়া স্মৃতিধর মন নিজেদের মধ্যে এক অলিখিত বোঝাপড়ায় শরীরটাকে দাঁড় করিয়ে রাখে। আমি যেখানে নেই, আমি যার কাছে নেই, সেই জায়গা, সেই মানুষের স্মৃতি বিস্মরণের দরজা ঠেলে কী ভাবে উঠে আসে? সহসা চোখে উদ্ভাসিত হয় দৃশ্য। নগ্ননির্জন রাতে কানে ভেসে আসে ফেলে আসা কোনো চেনাজনের রিনরিনে গলা। অথবা স্মৃতির জানালায় অকস্মাৎ ধাক্কা মারে গন্ধ।
সবুজের চিহ্নমাত্র নেই, এমন পাড়া দিয়ে যাচ্ছি হঠাৎ করে নাকে ভেসে এল বকুল ফুলের গন্ধ। সেই গন্ধ ভাসিয়ে নিয়ে গেল ফেলে আসা জন্মে। দূর থেকে ভেসে আসছে প্রেশারকুকারে তৈরি মাংসের গন্ধ। এই গন্ধ নিয়ে ফেলল কোনো ফেলে আসা রবিবারে দুপুরে। গন্ধ মানুষের সবচেয়ে পুরাতন, সবচেয়ে ব্যক্তিগত দীর্ঘপথ পরিক্রমার রেলগাড়ি। যখন তখন বিনা টিকিটে পরিক্রমা করা যায়। আমাদের শরীর-মন, যাবতীয় সামাজিক বোঝাপড়া, শ্রেণির বোধ গন্ধে বাঁধা পড়েছে। গন্ধের শক্তি অসীম। সুখস্মৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত গন্ধ যেমন মনকে সুনীল সাগরের শ্যামল কিনারে নিয়ে ফেলবে, তেমনই হঠাৎ ভেসে আসা কোনো চেনা গন্ধ থেকে প্রত্যেকবার পালাতে চাওয়ার সাক্ষী কত কে। অর্থাৎ গন্ধ এক ধরনের নিয়ন্ত্রকও বটে। মা, শিশু, প্রেমিকা— সব প্রিয়কে আমরা থাকা না থাকায় ফিরে ফিরে পাই গন্ধের হঠাৎ অনুপ্রবেশে, সাবানের মোড়কে, বিকেলের ভেসে আসা গন্ধে। অথচ রঙের যেমন নাম আছে, গন্ধের তেমন কোনো নাম নেই। প্রতিটি গন্ধই আলাদা। কিন্তু হলুদ, সাদা, নীল এমন কোনো ট্যাগ জোটেনি তার। সে বড়জোর অমুক ফুলের গন্ধ, তমুক মশলার ঘ্রাণ। সে স্বাদের সম্পূরক (যেমন- টক গন্ধ), প্রতিতুলনাধন্য। তার কোনো নামফলক নেই, রেকর্ড রাখা যায় না, সে বাঁচে স্মৃতিতে।
গন্ধকে কখনো তার প্রাপ্য মর্যাদা দিতে পারেনি ইওরোপ। কেন পারেনি? আসলে রেনেসাঁস বা জ্ঞানদীপ্তি চক্ষুষ্মানতার। আখোঁ দেখা হালের কথা বলে। সেখানে গন্ধের স্মৃতির কোনো দাম নেই। সে দিক থেকে ভাবলে আধুনিকতা গন্ধের মাহাত্ম্যকে গলা টিপে খুন করেছে । ডারউইন থেকে শুরু করে ফ্রয়েড, কেউ গন্ধকে ব্যাধি-বেদনার সঙ্গে জড়িয়েছেন কেউ আবার গন্ধের মধ্যে বন্যতা খুঁজে পেয়েছেন। ডারউইনের মতে মানবতার সঙ্গে গন্ধের কোনো সম্পর্কই নেই। উনিশ শতক থেকে গন্ধের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে রোগ-ব্যাধির ধারণা। উনিশ শতকের মহামারীগুলি নগরজীবনকে পূতিগন্ধময় করে তুলেছিল। তখন থেকেই একটি গন্ধহীন শুচিবায়ুগ্রস্থ সমাজকল্পের জন্ম। এবং গন্ধের সঙ্গে ভদ্রলোকি-ছোটলোকিকে জুড়ে দেওয়া। দার্শনিকরা একে ডায়ালেক্টিক অফ ডিঅডরাইজেশন বলছেন। এই ধারণার প্রবক্তারা বলেন, আধুনিকতার শর্ত গন্ধহীনতা, যে যত বেশি গন্ধের, সে ততই গন্ধহীন হতে চায়। নিজস্ব স্বাভাবিক গন্ধকে সে দাগিয়ে দেয়, পরিত্যাগ করে। পরিবর্তে বেছে নেয় কৃত্রিম গন্ধকে। সুগন্ধী, সাবান, ওডিকোলনের জন্ম এই ভদ্রলোকি সংস্কৃতিকে পুঁজি করেই। অন্যদিকে প্রলেতারিয়েতকে চিহ্নিত করা তার ঘেমো গন্ধে।
অথচ উনিশ শতকের আগে ইওরোপ গন্ধের ছদ্মবেশ ধারণ না করে প্রকৃত শরীরী গন্ধকেই গুরুত্ব দিত, তাকে প্রকট করার নানা তুক আবিষ্কার করেছিল। মনে হয় অমরত্বের ধারণার সঙ্গে সুগন্ধী ব্যবহারের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। আমার এই দেহঘড়ি চিরকাল টিকটিক বাজবে না। জল আর বাতাসের সংস্পর্শে প্রতিদিন পচে যাবে। দুর্গন্ধ হয়ে যাবে। আমাদের অন্তরে যে পশুটা রয়েছে তাকে লুকোতে, মৃত্যুহীনতার ধারণার প্রতি বিশ্বস্ততায় মানুষ সুগন্ধের কাছে যায়।
ইওরোপীয় দার্শনিকরা গন্ধ নিয়ে কী ভাবছেন? ১৭৫৭ সালে এডওয়ার্ড ব্রুক বলছেন, কোনো গন্ধ বা স্বাদ কোনো তীব্র অনুভূতির জন্ম দিতে পারে না। শুধুমাত্র তেতো স্বাদ আর পচা গন্ধ ব্যতিক্রম। ১৭৯৮ সালে কান্ট বলছেন, গন্ধ- least rewarding অর্থাৎ সবচেয়ে কম ফলদায়ী। Most easily dispensable অর্থাৎ যে কোনো মুহূর্তে বর্জনযোগ্য। এর নব্বই বছর পরে টেবিলটা উল্টে দিলেন ফ্রেডরিক নিটশে। বললেন, All my genius is in my nostril. নাসারন্ধ্রই আমার সমস্ত প্রতিভার উৎস। দর্শনশাস্ত্রকেই বরং তিনি ঘ্রাণের শক্তি বোঝার অপারগতার জন্যে গালমন্দ করলেন। জিনিওলজি অফ মরালস গ্রন্থে নিটশে দেখাবেন, প্রতিটি প্রাণই শক্তির প্রশ্নে নিজেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে অনুভব করতে চায়। আর স্বাভাবিক ভাবে ঘৃণা করে। শক্তির পথে যা কিছু বাঁধা, সহজাত ভাবেই সে তা শুঁকে দেখে। নিটশের ভাবনায় নাক শব্দটি শরীরের প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়েছে। নাক যেন প্রতিরোধের দেওয়াল, বর্ম। আর ঘ্রাণ নেওয়াকে তিনি ভাবছেন এক চূড়ান্ত সম্ভাবনা হিসেবে। তাঁর লেখাতেই পাই, স্রেফ নাক নয় যে চোখ কান দিয়েও শুঁকতে পারে তাকে যেতে হবে উন্মাদাশ্রমে, হাসপাতালে। অর্থাৎ ঘ্রাণ-ক্ষমতাকে তিনি ইওরোপীয় রেনেসাঁর উল্টোদিকে, সর্বোচ্চ ক্ষমতার পর্যায়ে রেখেছেন।
ফরাসি কবি শার্ল বোদলেয়ারের গন্ধপ্রীতি সর্বজনবিদিত। তাঁর জনপ্রিয়তম কাব্যগ্রন্থ লা ফ্লর দ্যু মাল-এ পাই,
অন্যদের মন ভাসে সুরে, প্রিয়তমা, আমার সন্তরণ তোমার সুগন্ধে
ভার্জিনিয়া উলফের স্বল্পপরিচিত তুলনামূলক কম পঠিত গ্রন্থ- ফ্লাশ: এ বায়োগ্রাফি। সেখানে দেখা যায় ফ্লাশ, একটি ককার স্প্যানিয়েল কুকুরটি বুঝতে পারে, ভালোবাসা স্রেফ একটা গন্ধ।
রবীন্দ্রনাথের লেখায় গন্ধের ব্যঞ্জনা এসেছে কী নিবিড়তায়। দৃশ্য-শ্রাব্যের মতোই তাঁর কাছে গুরুতর গন্ধ। ধরা যাক এই গানটির কথা-
আঁধার কুঁড়ির বাঁধন টুটে চাঁদের ফুল উঠেছে ফুটে॥
তার গন্ধ কোথায়, গন্ধ কোথায় রে।
গন্ধ আমার গভীর ব্যথায় হৃদয়-মাঝে লুটে॥
চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত ফুলের গন্ধ, তার তো কোনো নাম নেই, তাকে তো সংরক্ষণের কোনো উপায় নেই। তবু সে আছে। গভীর ব্যথার উপলব্ধির সঙ্গে অন্তর্লীন, আছে। লুটিয়ে আছে, বিদীর্ণ করে, আছে। গন্ধ রবীন্দ্রনাথের কাছে একটা সম্ভাবনা, যা অপেক্ষমান একজন প্রকৃত অনুভবীর জন্যে। অন্যথায় তার গন্ধমদির অস্তিত্ব বৃথা। উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থে পড়তে পাই-
কুঁড়ি-র ভিতর কাঁদিছে গন্ধ অন্ধ হয়ে–
কাঁদিছে আপন মনে,
কুসুমের দলে বন্ধ হয়ে
করুণ কাতর স্বনে।
কহিছে সে, "হায় হায়,
বেলা যায় বেলা যায় গো
ফাগুনের বেলা যায়।"
উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থটি লেখা ১৯১৪ সালে। ঠিক তার পরের বছর লেখা একটি বহুশ্রুত গানে গন্ধ শব্দটির আশ্চর্য প্রয়োগ রয়েছে। গানটির নাম-আকাশ আমায় ভরল আলোয়। গানের শেষাংশটি মনে করুন-
ওরে শিরীষ, ওরে শিরীষ,
মৃদু হাসির অন্তরালে গন্ধজালে শূন্য ঘিরিস--
তোমার গন্ধ আমার কণ্ঠে আমার হৃদয় টেনে আনে॥
গন্ধ একটা জাল! দার্শনিকদের এত হাহাকার, গন্ধের কোনো নাম নেই, গন্ধের কোনো অবয়ব নেই, সত্য গন্ধের কোনো সংরক্ষণ আধার নেই। তার চরিত্র ব্যাখ্যায় জাল শব্দটি আনলেন রবীন্দ্রনাথ। মাকড়সার জাল আমরা দেখতে পাই না। অতি গোপনে সে জাল-বিস্তার করে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করে। শিরীষ গন্ধও তেমন। ক্রমে যেন ছেয়ে যাচ্ছে গোপনে। এই গোপন অন্তর্ঘাতের আবহ তৈরি করতেই হয়তো এ গানের শুরুতে রবীন্দ্রনাথ ক্রিয়াপদ হিসেবে 'হানা' শব্দটি নিয়ে আসেন। নাচের আবীর হাওয়ায় 'হানে'।
গন্ধ আর হৃদয় রবীন্দ্রনাথের এই লিখনভাবনায় পারস্পরিক পরিণয় বন্ধনে আবদ্ধ। হৃদয়কে তো দেখা যায় না, সে নানা অভিব্যক্তিতে প্রকাশিত হয়। কবি চান তার চরণে হৃদয় খুলে রাখতে, কিন্তু পারেন কি? হৃদয়ের প্রকাশপথ শেষমেশ গান, হাসি, আনন্দ, ক্রোধ। আর এই হৃদয়কে প্রকাশকে স্থিরনিশ্চিত করছে গন্ধ। গন্ধে আবিল মন কণ্ঠে প্রকাশিত হচ্ছে, সুরের আবীরে আকাশ ভরে যাচ্ছে। যাত্রাপথের আনন্দগানে রবীন্দ্রনাথ ভেসে আসা গন্ধকে চিরকাল জড়িয়ে ধরতে চেয়েছেন।
জীবনানন্দের গন্ধের দর্শন সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাঁর গন্ধের বোধ অতিপ্রাকৃতিক, অপ্রত্যাশিত, গা ছমছমে, সর্বগ্রাসী কখনওসখনও। ঘোড়া কবিতাটি মনে পড়ে, সুতীব্র অনুভূতিসমূহের তালিকা এই কবিতা। যেমন দৃশ্য তেমন ঘ্রাণ, একই শক্তি নিয়ে প্রকট এই কবিতায়।
কবিতার প্রথম লাইন যেমন-
আমরা যাইনি ম’রে আজো— তবু কেবলি দৃশ্যের জন্ম হয়:
তেমনই এই কবিতার পঞ্চম লাইনে পাব-
আস্তাবলের ঘ্রাণ ভেসে আসে এক ভিড় রাত্রির হাওয়ায়;
ঘোড়া পাঁচ হাজার বছরের বেশি সময় মানুষের সঙ্গী। আস্তাবলের ঘ্রাণ শব্দবন্ধটি পাঁচ হাজার বছরকে গিলে নিল এক লহমায়।
আবার দেখুন, হাজার বছর শুধু খেলা করে কবিতাটি।
হাজার বছর শুধু খেলা করে অন্ধকারে জোনাকির মতো:
চারিদিকে পিরামিড— কাফনের ঘ্রাণ;
বালির উপরে জ্যোৎস্না— খেজুর-ছায়ারা ইতস্তত
বিচূর্ণ থামের মতো: এশিরিয়— দাঁড়ায়ে রয়েছে মৃত, ম্লান।
শরীরে মমির ঘ্রাণ আমাদের— ঘুচে গেছে জীবনের সব লেনদেন;
‘মনে আছে?’ সুধালো সে— সুধালাম আমি শুধু, ‘বনলতা সেন।’
ইতিহাসের সুদীর্ঘ পথরেখা বোঝাচ্ছে কবরে শায়িত দেহের গায়ে জড়ানো কাপড়ের ঘ্রাণ। পৃথিবীর ইতিহাস আসলে তো হত্যার, মৃত্যুর, নিষ্ঠুরতার, আদিম বর্বরতার। সেই ইতিহাসপথে তাই জেগে আছে কাফনের ঘ্রাণ। সমস্ত সংলাপ শেষে পড়ে রয়েছে- মমির ঘ্রাণ।
জীবনানন্দের কবিতার সঙ্গে বসবাস করলে মনে পড়ে পারফিউম সিনেমার নায়ককে। যার জন্ম একটি বীভৎস দুর্গন্ধময় বাজারে, যে গন্ধের নানাকিসিমকে মিশিয়ে ফেলে। জীবনানন্দ গন্ধের প্রাগাধুনিক চিহ্নক এবং ইওরোপীয় আধুনিক কোডগুলিকে মিশিয়ে দেন ঘাতকের ছলনায়। ধানের গন্ধ, কলমি গন্ধের সঙ্গেই কবিতায় ঠাঁই পায় মৃত্যুর ঘ্রাণ। তাঁর ভাবনা ইর্যাটিক, তাঁর তালিকায় যে গন্ধ ঠাঁই পেয়েছে, স্বাভাবিক বলে পরিগণিত ইন্দ্রিয়লোকে সে গন্ধ রেজিস্টারই হয় না কখনও। পাঠক মনে করুন-
আকাশে জ্যোৎস্না- বনের পথে চিতা বাঘের গায়ের ঘ্রাণ;
হৃদয় আমার হরিণ যেন:
যোগ্যতমের উদবর্তন যে ভুবনের সর্বোচ্চ সত্য, সেখানে মানুষ বিপদ মাথায় নিয়ে, শত্রুর সঙ্গে যুঝেবুঝে, চিতাবাঘের গায়ের ঘ্রাণে বেঁচে আছে হরিণ হৃদয় নিয়ে। থাকা না থাকার মাঝে, তবু সুতীব্র বাঁচার অভিলাষে, ভয়ে ভয়ে। পড়েছি কম। জেনেছি, কম। কিন্তু গন্ধের এমন সংরাগ, এমন প্রয়োগ কখনও কোথাও দেখেনি। জীবনানন্দ, মার্জিন অফ দ্য মার্জিন, প্রান্তিকতম, কেন্দ্র থেকে অনেক দূরে, বিচ্ছিন্ন প্রান্তে স্থিত অকল্পনীয় অনুভবে লীন।