রামায়ণ, মহাভারত থেকে মঙ্গলকাব্য... যেভাবে বদলে গেল বাঙালির পিঠেপুলির স্বাদ
Pithe puli in Indian Epics: পৌষপার্বণের প্রধান কিন্তু সরা পিঠে। যাকে কেউ বলে ভাপা পিঠে, কেউ আবার বলে চিতই পিঠে। এপার বাংলায় বাউনি বাঁধার আগে মাটির সরায় পিঠে ভাজতে হয়।
“...নলেন গুড়ের সৌরভে আজ
মশগুল যে ভিটে;
পিঠে পিঠে পিঠে।
ক্ষীর-নারিকেল লাগবে আরো?
নিয়ে যা হাতচিঠে;
পিঠে পিঠে পিঠে।"
পৌষ সংক্রান্তির সঙ্গে বাঙালির এতটাই নিবিড় সম্পর্ক যে, বাংলার কাব্য-সাহিত্য, মহাকাব্যিক আখ্যান থেকে লোকায়ত সাহিত্য সুবাসিত হয়েছে পিঠে পুলির আঘ্রাণে। ঠাকুরমার ঝুলির সঙ্গে পরিচয় নেই, এমন শৈশব খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ‘ঠাকুরমার ঝুলি’-তে কাঁকনমালা আর কাঞ্চনমালার গল্পে কে রানি আর কে দাসী, তার মীমাংসা হয়েছিল পিঠে বানানোর ক্ষেত্রে দু’জনের মুনশিয়ানা দেখে। দাসী বানিয়েছিল আস্কে পিঠে, ঘাস্কে পিঠে, আর রানি সরুচাকলি, চন্দ্রপুলি, আরও কত কী! পৌষ পার্বণ মানেই বাংলায় যে হরেক পিঠের সমাহার, সেই রীতি উঠে এসেছিল বাংলার একান্ত নিজস্ব ছেলেভুলানো গল্পেও। পিঠে কেবল বাঙালিরই একচেটিয়া খাবার, এই নিয়ে আদি অনন্তকাল থেকে গলাবাজি চলছে।
ব্রহ্মপুরাণ অনুযায়ী, দক্ষযজ্ঞের সময় সতীর টুকরো টুকরো দেহ যে সব জায়গায় পড়েছিল সেই ৫১ পীঠই পিঠের উৎসস্থল। এমনকী, মহাভারতেও প্রায় ১০৮ রকমের পিঠের উল্লেখ আছে। তবে পিঠে পার্বণ, থুড়ি, পৌষ পার্বণের কপিরাইট কিন্তু একমাত্র বাঙালিরই। বাংলা ছাড়াও অসম, ওড়িশা, বিহার-সহ সমগ্র পূর্বভারতের মানুষই পিঠেপ্রেমী। পিঠে সাধারণত নিরামিষ হতো। তবে কালের নিয়মে বদলে গিয়েছে পিঠে বানানোর ধরন।
প্রাচীনকালে পিঠে মিষ্টান্নেরই অঙ্গ ছিল। কৃত্তিবাসী রামায়ণে সীতার খাবার পরিবেশনে উল্লেখ পাওয়া যায়, “...দধি পরে পরমান্ন পিষ্টকাদি যত।" মঙ্গলকাব্যেও রয়েছে পুলি-পিঠের রন্ধনপ্রণালী। ক্রমে তা নতুন রূপে পরিচিত হয়েছে বাংলায়। ওপার বাংলায় পিঠের বিস্তার বহুল। ঢাকার রাস্তায় সারা বছরই গরম পিঠে পাওয়া যায়। উত্তরবঙ্গে রানিনগর, জলপাইগুড়ি ও মালদা স্টেশনেও পিঠে বিক্রি হয়। স্টেশন সংলগ্ন গ্রাম্য বধূরা নারকেল কোরা আর চালের গুঁড়োর পিঠে ভাপিয়ে কলাপাতায় মুড়ে বিক্রি করেন।
আরও পড়ুন- মুগপুলি আর গোকুল পিঠে যেন সময়গাড়ি, কে বলে রান্নার ভূগোল নেই!
রামায়ণ ও মহাভারতে পিঠের আখ্যান লক্ষ্য করা যায়। মহাভারতের আদিপর্বে দেখা যায় বক রাক্ষসকে বধের প্রাক্কালে ভীমসেন পায়েস, অন্ন ও পিঠে পেট ভরে ভোজন করেছিলেন। এক পেট পিঠে খেয়েই বক রাক্ষসকে বধ করেছিলেন। রামায়ণে নারকেল পুলি, কলাবড়া, তালবড়া, ছানাবড়া, খাজাগজা, গুড়পিঠে, জিলিপি প্রভৃতি নানান ধরনের সামগ্রীর উল্লেখ আছে।
রামায়ণের উত্তরাকাণ্ডে দেখা যায় শাক ভাজা, ঝাল, অম্বল, পায়েস ও দধির সঙ্গে নানা রকমের পিষ্টকাদি সহযোগে সীতা লক্ষণকে আহার করিয়েছেন। কৃত্তিবাসের এই মহাকাব্যে সেকালের খাদ্যাভ্যাস, বেশভূষা, আচার-অনুষ্ঠান, রীতিনীতি প্রভৃতির পরিচয় পাওয়া যায়। যেমন— গুহকের কুটিরে ভরতকে দই, দুধ, নারকেল, আম, কলা প্রভৃতি দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। এছাড়া এই কাব্যের বিভিন্ন অংশেই নারকেল-পুলি, পায়েস, পিঠে প্রভৃতি বাঙালি-খাবারের যথেষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায়। উত্তরকাণ্ডে সীতা লক্ষ্মণকে নিজের হাতে রান্না করে যা খেতে দিয়েছিলেন, তা বাঙালি খাদ্যাভ্যাসেরই প্রকাশ।
জগন্নাথদেবের ভোগেও পিঠে পড়ে। মাসি গুণ্ডিচাদেবীর বাড়ি থেকে আসেন নিজের বাড়িতে। তাঁদের খাবারের নানান সামগ্রীর অন্যতম হল মাঠপুলি ও পিঠাপুলি। পৌষের শীতে পিঠেপুলি না পাওয়ার জন্য ঈশ্বর গুপ্তের মনস্তাপ স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে তাঁর ‘পৌষ পার্বণ ২’ কবিতায়। তিনি লিখছেন,
"এবারে বছরকার দিন, কপালে ভাই,
জুটলো নাকো পুলিপিঠে।
যে মাগগির বাজার, হাজার হাজার,
মর্তেছে লোকে, কপাল পিটে৷"
চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে কালকেতুর বউ ফুল্লরার কাছে শীতের দিনে তাঁর আদরের পিঠেপুলি কত মধুর ছিল তাঁর অভিলাষেই তা ব্যক্ত-
"মনে করি সাধ খাইতে মিঠা,
খীর নারকেল তিলের পিঠা।"
আবার ‘নক্সী কাঁথার মাঠ' কবিতায় পল্লিকবি জসীমউদ্দীন বাঙালি মেয়েদের দশটি আঙুলের শিল্পকৌশলকে সমুজ্জ্বলভাবে তুলে ধরেছেন—
"তাহার মতন চেতন সেওই।
কে কাটিতে পারে।
নী করা পাকান পিঠায়
সবাই তারে হারে।"
এই সময় বাংলার বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মানুষ বিভিন্ন দেব-দেবীর পুজো করে থাকেন, নানা উৎসবে মেতে ওঠে। পৌষ উৎসব হল সাঁওতালদের শেষ উৎসব। উত্তর-পশ্চিম বাঁকুড়া ও পুরুলিয়ার আদিবাসীরা এই পরবের শেষ দিনগুলিতে মৌফুলের মউ বা সোমরস ও হাঁড়িয়া খেয়ে টুসুর গান ও নৃত্যগীতে সকলে মিলেমিশে একাকার হয়ে ওঠে। হাওড়া, হুগলি, বর্ধমান প্রভৃতি জেলায় সাঁওতালি সমাজে সাড়ম্বরে ‘সাকরাত’ বা পৌষপার্বণ পালন করা হয়ে থাকে। সংক্রান্তির দিন প্রথম পিঠেগুলি তাঁরা তাঁদের সবচেয়ে বড় দেবতা ‘মারাং বুরু’কে ভক্তিভরে নিবেদন করেন। তারপর পূর্বপুরুষদের উদ্দেশে পিঠের নৈবেদ্য সাজিয়ে উৎসর্গ করেন। এরপর পিঠের সুবাষ ও স্বাদে অবগাহন করেন নিজেরা। সাড়ম্বরে পালিত হয় পৌষ পার্বণ।
আরও পড়ুন- শুক্তো থেকে বোয়াল মাছ, বেহুলা-লখিন্দরের বিয়ের মেনু জিভে জল আনতে বাধ্য
পৌষপার্বণের প্রধান কিন্তু সরা পিঠে। যাকে কেউ বলে ভাপা পিঠে, কেউ আবার বলে চিতই পিঠে। এপার বাংলায় বাউনি বাঁধার আগে মাটির সরায় পিঠে ভাজতে হয়। বাউনি অর্থ লক্ষ্মীর বন্ধন। পাকা ধান গোলায় তোলার প্রতীক হিসেবে, কয়েকটি পাকা ধানের শিষ দিয়ে বিনুনি করে, বাড়ির বিভিন্ন জায়গায় সৌভাগ্যের চিহ্ন হিসেবে সেগুলি বেঁধে দেওয়া হয়। ভাবা হয়, এইভাবেই চিরতরে বাঁধা পড়ে থাকবে সৌভাগ্য। পিঠে ভাজা শেষ হলে তা সেই সরার উপর রেখে, তার উপর মাটির তৈরি ঢাকনা চাপা দিয়ে, সেই ঢাকনার ছোট্ট-গোল মাটির হাতলকে বেড় দিয়ে প্রথম বাউনিটি বেঁধে দিতে হয়।
কিন্তু পৌষ মাসেই কেন পিঠে তৈরির ধুম পড়ে বাঙালি ঘরে?
কথায় বলে, পৌষমাস নাকি লক্ষ্মীমাস। কৃষিজীবী বাংলায় এই সময়েই ধান উঠত চাষির গোলায়। ধান মানেই তো ধন, সম্পদ। তাই এই সৌভাগ্যকে উদযাপন করার জন্য পৌষের শেষ দিনে পার্বণের আয়োজন। আজকের দিনে কৃষিজমির মালিকানা আর ক'জনেরই বা আছে! তবু মুছে যায়নি এই লোকউৎসবের ধারা। আর তারই প্রধান পর্ব হিসেবে রয়ে গিয়েছে নতুন ধানের চাল আর নতুন গুড় দিয়ে পিঠে বানানোর রীতি। আর সেই পিঠে দেওয়া-থোওয়া চলে আত্মীয়-পরিজন, পাড়াপড়শিদের মধ্যে, বাদ যান না পরলোকগত পূর্বপুরুষ কিংবা বাস্তুদেবতাও। যেন বুঝিয়ে দেওয়া হয়, ভাগ করে নেওয়ার মধ্যে দিয়েই সম্পদের আসল উদযাপন সম্ভব।
গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে আউশ ধান গোলায় ওঠে। আর সেই নতুন চালেই পিঠে তৈরির প্রস্তুতি নিতে শুরু করে বাঙালি। মা-ঠাকুরমাদের মতো সুনিপুণ না হলেও আজকের প্রজন্মের প্রজন্মের অনেকেই কিন্তু স্বজাতির ঐতিহ্য বজায় রাখতে মরিয়া। পিঠের জুটি হেমন্তের নতুন গুড়। এই পিঠের সঙ্গে বাঙালির প্রেম অনেক দিনের। রামায়ণ-মহাভারতের কাল থেকে এই স্বাদ গন্ধে তাই অবগাহন করে চলেছে বাঙালি।