মাতৃদুগ্ধেও প্লাস্টিকের কণা! কতটা নিরাপদ আপনার শিশু
Plastic in Breast Milk: মাতৃদুগ্ধ, যাকে অমৃতের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে এই যাবৎ, সেই মাতৃদুগ্ধেও প্লাস্টিকের সন্ধান পেলেন বিজ্ঞানীরা।
২০২০ সালের ঘটনা। তখন প্রথমবার প্লাস্টিকের সন্ধান মেলে মানুষের প্লাসেন্টাতে। গত বছর, অর্থাৎ ২০২১ সালে শিশুদের মলে প্রথমবার মাইক্রোপ্লাস্টিকের সন্ধান পাওয়া যায়। এই বছর মার্চ মাসে প্রকাশিত একটি গবেষণা জানান দিল, মানুষের রক্তও বাদ যায়নি। প্লাস্টিকের সন্ধান মিলেছে সেখানেও।
ছোট থেকে বড়- বিভিন্ন প্রাণীর শরীরে প্লাস্টিক আজ আকছার মেলে। এভারেস্টের শৃঙ্গ থেকে মহাসাগরের অতল অবধি আমরা প্লাস্টিকে ভরিয়ে ফেলেছি বহুদিন আগেই। কিন্তু আমাদেরই কৃতকর্ম বুমেরাং হয়ে আমাদেরই যে ক্ষতি করতে পারে, আমাদেরই কৃতকর্ম যে পরিবেশ-প্রকৃতির সমূহ ক্ষতিসাধন করে সবশেষে আমাদেরই খাদের ধারে এনে দাঁড় করাতে পারে, এই নিয়ে আমরা আদৌ বিশেষ মাথা ঘামিয়েছি?
মাতৃদুগ্ধ, যাকে অমৃতের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে এই যাবৎ, সেই মাতৃদুগ্ধেও প্লাস্টিকের সন্ধান পেলেন বিজ্ঞানীরা। Phthalate-এর মতো প্লাস্টিক এর আগে মাতৃদুগ্ধে পাওয়া গেলেও, পলি-ইথিলিন, পলিভিনাইল ক্লোরাইড, এবং পলিপ্রোপিলিনের মতো প্লাস্টিকের সন্ধান বিজ্ঞানীরা এই প্রথম মাতৃদুগ্ধে পেলেন। তাঁদের গবেষণা সাম্প্রতিককালে 'পলিমার' নামের এক বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
আরও পড়ুন: সমুদ্রের জলে হু হু করে বাড়ছে অ্যাসিডের মাত্রা! কোন বিপদ অপেক্ষায়
গবেষকরা রোমের ৩৪ জন মহিলার ওপর একটি পরীক্ষা করেন। সন্তান জন্ম দেওয়ার এক সপ্তাহের মাথায় সেই মায়েদের বুকের দুধ নমুনা হিসেবে সংগ্রহ করা হয়। সেই নমুনাগুলিকে রামন স্পেক্ট্রোস্কোপির (Raman Spectroscopy) সাহায্যে বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, পরীক্ষায় অংশ নেওয়া মায়েদের মধ্যে ৭৫ শতাংশ মায়ের বুকের দুধে মাইক্রোপ্লাস্টিক রয়েছে।
তার পাশাপাশি সেই মায়েরা কী খাবার খান, কী পান করেন; সেই খাবার ও পানীয় প্লাস্টিকের পাত্রে সংগ্রহ করা হয় কি-না, তাঁদের খাবার প্লাস্টিকে মোড়া হয় কি-না সবই রেকর্ড করা হয়। তাছাড়াও, সেই মায়েরা দৈনন্দিন জীবনে প্লাস্টিকের ব্যবহার কতটা করেন, এবং তাঁদের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মধ্যে প্লাস্টিকের উপস্থিতি কতটা, কিংবা তাঁরা সামুদ্রিক মাছ ও সামুদ্রিক প্রাণী (কারণ প্লাস্টিক এই প্রাণীদেরকেও নিস্তার দেয়নি) খান কি-না তা-ও রেকর্ডে রাখেন গবেষকরা।
এই তথ্যগুলি সংগ্রহ করার কারণ, দৈনন্দিন জীবনের আপাত-সাধারণ কাজকর্ম বা অভ্যাস হয়তো তুলে ধরবে, সেই মায়েদের শরীরে প্লাস্টিক কীভাবে প্রবেশ করছে। কীভাবেই বা তা তাঁদের বুকের দুধে গিয়ে মিশছে।
অবশ্য তাঁদের নিত্যব্যবহৃত প্লাস্টিক দ্রব্যের সঙ্গে, সেই মায়েদের বুকের দুধে প্লাস্টিকের উপস্থিতির আপাত কোনও সম্পর্ক বা কো-রিলেশন গবেষকরা এই গবেষণায় পাননি। আর সেখান থেকেই গবেষকরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন, এই মহিলাদের প্লাস্টিক ব্যবহার করা বা না-করার ওপর, তাঁদের শরীরে প্লাস্টিকের অনুপ্রবেশ ঘটা বা তাঁদের বুকের দুধে প্লাস্টিকের উপস্থিতি নির্ভর করে না। প্লাস্টিক সর্বত্র পাওয়া যায়, এমনকী, বাতাসে বা ধুলো-বালির সঙ্গেও মাইক্রোপ্লাস্টিক মিশছে ক্রমাগত। তাই প্লাস্টিকের ব্যবহার না করলেও বা প্লাস্টিকে মোড়া খাবার না খেলেও, শরীরে প্লাস্টিকের অনুপ্রবেশ থেকে আমাদের নিষ্কৃতি নেই। তাছাড়া প্রতি বছর আমরা অন্তত পঞ্চাশহাজার প্লাস্টিকের কণা খাবারের সঙ্গেই খেয়ে থাকি।
এই গবেষণায় দুই মাইক্রনের থেকে ছোট আকারের মাইক্রোপ্লাস্টিককে গবেষকরা আলাদা করে বিশ্লেষণ করে উঠতে পারেননি, কণাগুলির অত্যন্ত ক্ষুদ্র আকৃতির কারণে। তবে তাঁরা জানাচ্ছেন, খুব সম্ভবত এর থেকেও ছোট মাইক্রোপ্লাস্টিকের কণা মায়েদের দুধে রয়েছে।
ইতালির 'The Università Politecnica delle Marche'-এর গবেষক ড.।ভ্যালেন্তিনা নটারস্টেফ্যানো 'দ্য গার্ডিয়ান'-কে জানিয়েছেন, "শিশুরা বুকের দুধের ওপর নির্ভরশীল যতদিন, ততদিন অবধি অন্তত মায়েদের শরীরে প্লাস্টিকের প্রবেশ কীভাবে কমানো যেতে পারে, তা আমাদের ভাবতে হবে।"
“কিন্তু এত কিছুর পরেও, জোর দিয়ে জানাচ্ছি, বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানোর মতো ভালো কিছু হয় না। আমাদের এই ধরনের গবেষণার উদ্দেশ্য সাধারণ মানুষকে ভয় দেখানো নয় বা শিশুদের বুকের দুধ খাওয়াতে নিরুৎসাহ করা নয়। বরং মানুষকে প্লাস্টিকের কুপ্রভাব বিষয়ে সচেতন করা", জানাচ্ছেন ড. ভ্যালেন্তিনা।
সদ্য মা বা সন্তানসম্ভবাদের নিত্যব্যবহৃত প্লাস্টিক দ্রব্যের সঙ্গে সেই মায়েদের বুকের দুধে প্লাস্টিকের উপস্থিতির আপাত কোনও সম্পর্ক না থাকলেও ড. ভ্যালেন্তিনার উপদেশ, সন্তান গর্ভে থাকাকালীন তাঁরা যেন প্লাস্টিকে মোড়া বা সংরক্ষণ করা খাবার না খান।
প্রতি বছর দশ মিলিয়ন মেট্রিক টন মাইক্রোপ্লাস্টিক বায়ুমণ্ডলে গিয়ে মিশছে। এক মেট্রিক টন মানে এক হাজার কিলোগ্রাম, আর দশ মিলিয়ন মানে এক কোটি। তার মানে ভাবতে পারছেন, দূষিত গ্যাস বাদ দিলেও, আমাদের প্লাস্টিক-নির্ভরশীলতা আমাদের বাতাসকে কতটা বিষিয়ে তুলেছে? আর সেই প্লাস্টিক ভরা বিষাক্ত বাতাস যে প্রতি মূহূর্তে নিঃশ্বাসের সঙ্গে শরীরে ঢুকবে, এ আর নতুন কী!
২০২২ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণা থেকে জানা গেছে, ময়নাতদন্তের পর ৬৫ শতাংশ মানুষের ফুসফুসে মাইক্রোপ্লাস্টিকের সন্ধান পাওয়া গেছে। ফুসফুস থেকে রক্ত, আর সেই রক্তের সঙ্গে সারা শরীরে মাইক্রোপ্লাস্টিক ছড়িয়ে পড়তে খুব বেশি সময় লাগে না। তাই রক্তপ্রবাহ বা প্লাসেন্টাতে মাইক্রোপ্লাস্টিক পেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আদতে তা তো আমাদের কৃতকর্মেরই ফল।
গবেষক ড. ভ্যালেন্তিনা নটারস্টেফ্যানো 'দ্য গার্ডিয়ান'-কে জানিয়েছেন, "মাতৃদুগ্ধে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি শিশুদের জন্যে উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে তুলল।" আমরা নবজাতকের জন্য এই পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে তুলে যেতে অপারগ শুধু নই, আমরা তাদের পৃথিবীকে আরেকটু বিষিয়ে দিয়েছি বইকি।