‘মোদি জমানায় ২৫ কোটি দেশবাসী দারিদ্রমুক্ত’! তবে রেশন কাকে দিচ্ছে বিজেপি সরকার?
Poverty in India: কিন্তু সত্যিই যদি প্রতিদিন ৭৫ হাজার করে মানুষকে গরিবির আওতা থেকে বের করে এনে থাকে মোদি সরকার, তাহলে ঘটা করে বিনামূল্যে রেশনের ঘোষণা আসলে কাদের জন্য?
ভোটের দামামা বাজতে না বাজতেই গত বছর নভেম্বর মাসেই বিনামূল্যে রেশন দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। গরিবদের জন্য সেই ঘোষণা লোকসভা ভোটের আগে বিজেপি সরকারের বড়সড় পদক্ষেপ ছিল বলেই মনে করেছিলেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞেরা। বিরোধীরা বলতে শুরু করেন, মোদির এই ঘোষণাই দেশের দারিদ্রের সবচেয়ে বড় প্রমাণ। অথচ ভোট যখন একেবারে দরজায় কড়া নাড়ছে, যে কোনও মুহূর্তে ঘোষণা হয়ে যেতে পারে ভোটের দিনক্ষণ, ঠিক সেসময় মোদি সর্গবে জানালেন, তার জমানাতেই দেশের ২৫ কোটি মানুষ দারিদ্রসীমার উপরে উঠে এসেছেন। দেশে দারিদ্র কমছে।
লোকসভা ভোটের আগে প্রথম থেকেই আত্মবিশ্বাস দেখিয়ে এসেছে বিজেপি সরকার। ফেব্রুয়ারির শুরুতে অন্তর্বর্তী বাজেটে কার্যত আকর্ষণীয় কোনও ঘোষণাই করেনি বিজেপি সরকার। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন জানিয়েছিলেন, সরকার গড়ার পরেই সম্পূর্ণ বাজেটের ঘোষণা করবে বিজেপি সরকার। এই লোকসভা ভোটে জয় নিয়ে যে কতটা আত্মবিশ্বাসী নরেন্দ্র মোদি সরকার, তা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল সেখানেই। আর সেই আত্মবিশ্বাসকেই দ্বিগুণ করেছে নীতি আয়োগের সাম্প্রতিকতম রিপোর্ট। নীতি আয়োগের সিইও বিভিআর সুব্রমনিয়াম জানিয়েছেন, নরেন্দ্র মোদি সরকারের আমলে ভারতের অন্তত ২৫ কোটি মানুষ দারিদ্র থেকে মুক্তি পেয়েছেন। আর তারপরেই একটি সংবাদমাধ্যমের অনুষ্ঠানে সেই খতিয়ানই তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। গর্বের সঙ্গে জানান, গত দশ বছরে দেশের ২৫ কোটি মানুষ দারিদ্রসীমার উপরে উঠে এসেছেন।
একদিন আগেই সামনে এসেছে নীতি আয়োগের সেই রিপোর্ট। হাউসহোল্ড কনসাম্পশন এক্সপেনডিচার সার্ভের (গৃহস্থালির খরচের সমীক্ষা) রিপোর্ট তুলে ধরে নীতি আয়োগের সিইও বিভিআর সুব্রমণিয়ম জানান, মোদী জমানায় উন্নতি ও বিকাশের নয়া দিগন্ত খুলে গিয়েছে ভারতের কাছে। ভারতে দারিদ্রের হার বর্তমানে কমে পাঁচ শতাংশের নীচে নেমে গিয়েছে। ২০২২ সালের অগস্ট মাস থেকে ২০২৩ সালের জুলাই, গোটা এক বছর ধরে চালানো হয়েছে এই সমীক্ষা। দেশে বর্তমানে গৃহস্থালির খরচের উপরে বিশ্লেষণ করা হয় এই সমীক্ষার মাধ্যমে, যার মাধ্যমে দেশের বর্তমান দারিদ্রের হার কোন জানান, দারিদ্র দূরীকরণে কতটা সাফল্য এল, তা নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে একটি প্রধান মেট্রিক হল গৃহস্থালির খরচের হিসেব। হাউসহোল্ড কনসাম্পশন এক্সপেনডিচার সার্ভের রিপোর্টে দেখা গিয়েছে, শহুরে ও গ্রামীণ উভয় জায়গাতেই গৃহস্থালির খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। উভয় ক্ষেত্রেই প্রায় আড়াই গুণ বেড়েছে গৃহস্থালির খরচ। ২০১১-১২ সালে মাথাপিছু মাসিক গড় খরচ যা ছিল, তা গত এক দশকে লাফ দিয়ে অনেকটাই বেড়েছে।
আরও পড়ুন: জলের গভীরে ‘ঐশ্বরিক’ অভিজ্ঞতা! ভোটের আগে দ্বারকায় কেন ডুব মোদির?
সাম্প্রতিক সেই রিপোর্ট অনুযায়ী দেখা গিয়েছে, মাসিক মাথাপিছু গড় খরচ সাড়ে ৩৩ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৩ হাজার ৫১০ টাকা। উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে গ্রামীণ এলাকায় মাথাপিছু গড় মাসিক খরচ। সেখানে ৪০ শতাংশেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়ে মাথাপিছু গড় মাসিক খরচ হয়েছে ২ হাজার টাকার কিছু বেশি। পাশাপাশি দেশে বর্তমানে দারিদ্রের হার ৫ শতাংশ বা তার কম হতে পারে বলেও বেশ কয়েকটি রিপোর্ট উল্লেখ করে জানান নীতিআয়োগ কর্তা। নীতি আয়োগের রিপোর্ট অনুসারে, নরেন্দ্র মোদী জমানায় সবচেয়ে বেশি মানুষ দারিদ্রমুক্ত হয়েছেন উত্তরপ্রদেশে। এই সংখ্যা ৫.৯৪ কোটি। এরপর রয়েছে বিহারের স্থান। সেখানে দারিদ্র থেকে মুক্তি পেয়েছেন ৩.৭৭ কোটি মানুষ। এছাড়া মধ্যপ্রদেশে ২.৩০ এবং রাজস্থানে ১.৮৭ কোটি মানুষ দারিদ্র মুক্ত হয়েছেন।
সংবাদমাধ্যমের সেই অনুষ্ঠানে নীতি আয়োগের সেই রিপোর্টকেই কার্যত অস্ত্র করতে দেখা গেল প্রধানমন্ত্রীকে। জানালেন, , “ভারতে গরিবি সিঙ্গল ডিজিটে পৌছে গিয়েছে। বিগত এক দশকে কনজামশন দেড় গুণ বেড়েছে অর্থাৎ মানুষের বিভিন্ন পণ্য ও পরিষেবা গ্রহণের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে। গ্রামের মানুষের আর্থিক সামর্থ্য বাড়ছে। ২০১৪ সালের পর থেকে আমাদের সরকার গ্রামকে নজরে রেখে পরিকাঠামো তৈরি করেছে। গ্রাম ও শহরের মধ্যে সংযোগ তৈরি করা হয়েছে। মহিলাদের আয় বাড়ানো হয়েছে। ভারতে প্রথমবার খাবারের উপরে খরচ ৫০ শতাংশের কম হয়েছে। অর্থাৎ আয়ের ৫০ শতাংশই শুধু পরিবারের মুখে অন্ন জোগাতে খরচ হচ্ছে না, তারা অন্য ক্ষেত্রেও খরচ করতে পারছেন।” তিনি আরও বলেন, “এতদিন আমরা শুধু গরিবি হটাও স্লোগান শুনেছিলাম, বিগত ১০ বছরে আমরা ২৫ কোটি মানুষকে দারিদ্রসীমা থেকে বের করে এনেছি। আমাদের সরকারই এই কাজ করেছে।”
ভোটের আগে নিজের পাঁচ বছরের কাজের খতিয়ান দিতে কে না চায়। মোদিও এদিন হেঁটেছেন সেই পথেই। জানিয়েছেন, ভারতে প্রতিদিন ২টো করে কলেজ খুলেছে। প্রতি সপ্তাহে একটা নতুন বিশ্ববিদ্যালয় খুলেছে। প্রতিদিন ৫৫ পেটেন্ট, ৬০০ ট্রেডবার রেজিস্টার করা হয়েছে। প্রতিদিন দেড় লক্ষ মুদ্রা লোন দেওয়া হয়েছে, ৩৭টি নতুন স্টার্টআপ শুরু হয়েছে। ভারতে প্রতিদিন ১৪ কিমি রেলওয়ে ট্রাক তৈরি করা হচ্ছে, ৫০ হাজার এলপিজি সংযোগ দেওয়া হয়েছে। প্রতি সেকেন্ডে একটি বাড়িতে জলের লাইনের সংযোগ দেওয়া হয়েছে। প্রতিদিন ৭৫ হাজার মানুষকে গরিবি থেকে বের করে আনা হয়েছে।”
কিন্তু সত্যিই যদি প্রতিদিন ৭৫ হাজার করে মানুষকে গরিবির আওতা থেকে বের করে এনে থাকে মোদি সরকার, তাহলে ঘটা করে বিনামূল্যে রেশনের ঘোষণা আসলে কাদের জন্য? কারা লাইন দিয়ে নিতে আসবেন বিজেপি সরকারের সেই আর্থিক সহায়তা। দেশ থেকে যদি গরিবি দূর হয়েই গিয়ে থাকে। স্বাভাবিক ভাবেই মোদির এই ঘোষণার পরেই দেশ জুড়ে শুরু হয়ে গিয়েছে জোর চর্চা। গত নভেম্বর মাসে ছত্তীসগঢ়ে একটি জনসভায় গিয়ে বিনামূল্যে রেশন দেওয়ার কথা বলেছিলেন মোদি। প্রধানমন্ত্রীরএই ঘোষণার পরেই বিরোধীরা বলতে শুরু করেছিলেন, দেশ যে এখনও দারিদ্রের অন্ধকারে ঢাকা, তার বড় প্রমাণ এই রেশনের ঘোষণাই। কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ সেসময় মোদীকে নিশানা করে বলেছিলন, 'প্রধানমন্ত্রীর বিনামূল্যে রেশন ঘোষণাই দেশের আর্থিক দুর্দশার প্রমাণ। দেশের মানুষের মধ্যে আর্থিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে বিপদসীমায় পৌঁছে গিয়েছে। মানুষের আয় বাড়ছে না, কিন্তু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম এখন আকাশছোঁয়া। দেশের মানুষের মধ্য়ে আর্থিক ভারমাস্য নষ্ট হয়ে গিয়ে বিপদসীমায় পৌঁছে গিয়েছে। মানুষের আয় বাড়ছে না কিন্তু নিত্য প্রয়োজনায় জিনিসের দাম আকাশছোঁয়া।'
আরও পড়ুন:বেছে বেছে টুইট সরাতে বলছে মোদি সরকার! বিস্ফোরক অভিযোগ মাস্কের
২০২০ সালে কোভিড অতিমারির সময় মোদী সরকার চালু করেছিল প্রধানমন্ত্রীর গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনা। এর অধীনেই মাথা পিছু পাঁচ কেজি খাদ্যশস্য দেওয়া হয়েছিল। সেই প্রকল্পকে আগামী পাঁচ বছর চালু করার কথা ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সে সময় বিরোধীদের তোপের মুখে প্রধানমন্ত্রী দাবি করেছিলেন, ব্যক্তিগত জীবনেও চরম গরিবি দেখেছেন মোদি নিজেও। তিনিও বড় হয়েছেন দারিদ্রের মধ্যেই। ফলে তাঁকে বই পড়ে জানতে হয়নি গরিবি আসলে কী জিনিস। তিনি গরিবেপ কষ্ট বুঝতে পারেন বলেও দাবি করেছিলেন সে সময়। তা যে তিনি অক্ষরে অক্ষরে বুঝেছেন, তা বোধহয় আলাদা করে বলে দিতে হয় না। নাহলে মাস খানেকের মধ্যেই পাল্টে গেল ভারতের পরিস্থিতি? একধাক্কায় ২৫ কোটি দরিদ্র দেশবাসী গরিবির অন্ধকার ছেড়ে বেরিয়ে এলেন! রাতারাতি এমন ঘটনাকে 'ম্যাজিক' বলেই তোপ দেগেছেন বিরোধীরা।