রামমন্দির ফেলে হঠাৎ নালন্দামুখী মোদি! নয়া স্ট্র্যাটেজি বিজেপি 3.O সরকারের?

Prime Minister Narendra Modi: খ্রিস্টীয় পঞ্চম-ষষ্ঠ শতাব্দীতে গুপ্ত রাজা এবং পরবর্তীতে কনৌজ সম্রাট হর্ষবর্ধনের পৃষ্ঠপোষকতায় বিকশিত হয়েছিল এই নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়। আর এবার সেই সুপ্রাচীন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়েরই নতুন ক্যা...

শুধু দেশেরই নয়, সম্ভবত গোটা বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় নালন্দা। খ্রিস্টীয় পঞ্চম-ষষ্ঠ শতাব্দীতে গুপ্ত রাজা এবং পরবর্তীতে কনৌজ সম্রাট হর্ষবর্ধনের পৃষ্ঠপোষকতায় বিকশিত হয়েছিল এই নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়। আর এবার সেই সুপ্রাচীন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়েরই নতুন ক্যাম্পাসের উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তৃতীয়বার দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অভিষিক্ত হয়েছেন নরেন্দ্র মোদি, দশ দিনও হয়নি। এর মধ্যে জি-৭ বৈঠক উপলক্ষে ইটালি সফর করলেও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর এটাই তাঁর আন্তর্দেশীয় সফর। প্রায় ১৭০০ কোটি টাকা খরচ করছে কেন্দ্রীয় সরকার নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই নয়া ক্যাম্পাসের পিছনে।

লোকসভা ভোটের আগে প্রায় একটা বছর গেরুয়া শিবির ব্য়ায় করেছিল রামমন্দির গড়া ও তার উদ্বোধনের এলাহি আয়োজনে। সে সবটাই যে লোকসভা ভোটের দিকে তাকিয়ে, তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি। তবে রামমন্দির যে বিজেপির জন্য তেমন ফলশ্রয়ী হয়নি, তা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে লোকসভা ভোটের ফলাফলেই। উত্তরপ্রদেশ তো বটেই, খোদ অযোধ্যাতেও জয় পায়নি বিজেপি। চারশো পারের দাবির ধারেকাছে না গেলেও তৃতীয়বারের জন্য সরকার গড়েছেন মোদি। তবে তা যে একার চেষ্টায় সম্ভব হয়নি গেরুয়া শিবিরের, তা অস্বীকার করার জো নেই। কার্যত কিংমেকারের জায়গায় ছিল এনডিএ শিবিরের শরিক বিহারের নীতীশ কুমারের জেডিইউ এবং অন্ধ্রের চন্দ্রবাবুর টিডিপি। ছিল আরও বেশ কয়েকটি ছোটবড় শরিক দল। এই ভোটে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা বিজেপির কাছে না থাকায় প্রায় সব কিছুর জন্যই শরিকদলগুলির উপরে ভরসা রাখতে হয়েছে বিজেপিকে। তার উপর আবার অনেক বছর বাদে প্রধান বিরোধী দলের আসন ফাঁকা থাকছে না লোকসভায়। সব মিলিয়ে ২০২৪ লোকসভা ভোট যে তেমন স্বস্তি দিতে পারেনি গেরুয়া শিবিরকে, তা একরকম স্পষ্ট। তাই কি, কুর্সিতে বসেই নতুন ভাবমূর্তি গড়তে উঠে পড়ে লেগেছেন মোদি।

আরও পড়ুন: ১৯৭৭ আর ২০২৪: ইন্দিরা আর মোদির দুই নির্বাচনে কী কী আশ্চর্য মিল?

গত পাঁচ বছর ভুলের ছায়া যাতে নয়া জমানায় না পড়ে, সেই চেষ্টায় যেন ত্রুটি রাখছে না বিজেপি। আর তার জন্য কি এবার স্ট্র্যাটেজিতেই বদল আনতে চলেছে মোদি সরকার। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, পঞ্জাবের কৃষকদের আন্দোলন মোদির ভোটে বড়সড় প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করছেন অনেকে। সে কারণেই কি ক্ষমতায় বসেই প্রথম কিসান নিধি প্রকল্পে সই করলেন মোদি! বার্তা দিতে চাইলেন, কৃষকদের পাশেই রয়েছে নতুন মোদি সরকার। ঠিক তেমনভাবেই ভোটের মুখে যে নরেন্দ্র মোদিকে শিক্ষা-সংস্কৃতি সবকিছুর উপরে উঠে ধর্ম নিয়ে কথা বলতেই শোনা গিয়েছে বারবার, সেখানে তৃতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে মোদি উদ্বোধন করলেন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়া ক্যাম্পাসের। নালন্দার অনুষ্ঠানে গিয়ে মোদিকে বলতে শোনা গেল, ‘‘তৃতীয় বার প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেওয়ার ১০ দিনের মধ্যে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে পেরেছি বলে আমি খুব খুশি। নালন্দা কোনও নাম নয়, এটা একটা পরিচয়। আগুন বইকে পুড়িয়ে ফেলতে পারে। কিন্তু জ্ঞান ধ্বংস করতে পারে না।’’

গোটা ভোটের মরসুমে মোদি-শাহরা আপ্রাণ চেষ্টা করে গিয়েছেন, যাতে হিন্দুভোটকে যতটা সম্ভব নিজেদের দিকে টানা যায়। তার জন্য মুসলিমদের প্রতি আক্রমণ শানিয়েছেন। কখনও মোঘল আমলের একাধিক স্থাপত্য গুঁড়িয়ে দেওয়ার কথা বলতে শোনা গিয়েছে বিজেপির নেতামন্ত্রীদের। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর এ যেন অন্য মোদি। যে গো-বলয়ের প্রতি সবচেয়ে বেশি আস্থা ছিল গেরুয়া শিবিরের, সেই উত্তরপ্রদেশ-বিহারই কার্যত খালি হাতে ফিরিয়েছে বিজেপিকে। তার উপর বিহারে নীতীশ কুমার, চিরাগ পাসওয়ান, জীতন রাম মাঝির মতো এনডিএ শরিকদের সমর্থনই দেশের সিংহাসনের দিকে এগিয়ে দিয়েছে মোদিকে। ফলে সিংহাসনে বসে সে রাজ্যে যে সফর করতেই হত মোদিকে, তা আর নতুন কথা কী! তবে শুধু সফর নয়, তিনি বিহারে পৌঁছলেন নালন্দার মতো ঐতিহাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়া ক্যাম্পাস উদ্বোধনের কাজ নিয়ে। সেখানে গিয়ে মোদি বললেন, নালন্দা ভারতের সৌভ্রাতৃত্বের মন্ত্র ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’-এর আত্মা। তিনি এ-ও বলেন, ‘‘এই বিশ্ববিদ্যালয় শুধু ভারত নয়, গোটা এশিয়ার ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বছরের পর বছর ধরে এখানে পড়ুয়ারা জ্ঞান অর্জন করতে এসেছেন। বর্তমানে নালন্দায় ২০টির বেশি দেশের ছাত্রছাত্রী রয়েছেন।’’

নালন্দার নতুন ক্যাম্পাস উদ্বোধনের আগে বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ দেখতে গিয়েছিলেন মোদী। ২০১৬ সালে ওই ধ্বংসাবশেষকে ‘হেরিটেজ’ তকমা দিয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জ। নতুন ক্যাম্পাসের উদ্বোধনের সময়ে মোদীর সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন দেশের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর, বিহারের রাজ্যপাল রাজেন্দ্র বিশ্বনাথ আরলেকর, মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার এবং নালন্দার আচার্য অরবিন্দ পনগরিয়া। এ ছাড়াও অস্ট্রেলিয়া, বাংলাদেশ, ভুটান, ব্রুনেই, চিন, ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া-সহ ১৭টি দেশের প্রতিনিধি অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলেন। নালন্দার নতুন ক্যাম্পাসে মোট দু’টি ব্লক রয়েছে। উভয় ক্ষেত্রেই রয়েছে ৪০টি করে শ্রেণিকক্ষ। মোট ১৯০০ ছাত্রছাত্রীর বসার বন্দোবস্ত রয়েছে এই ক্যাম্পাসে। এ ছাড়া, ৩০০টি করে আসন যুক্ত দু’টি অডিটোরিয়ামও রয়েছে। নালন্দার এই ক্যাম্পাসের হস্টেলে থাকতে পারবেন সর্বোচ্চ সাড়ে ৫০০ জন ছাত্রছাত্রী। নতুন ক্যাম্পাস তৈরিতে ১৭০০ কোটি টাকা খরচ করেছে কেন্দ্রীয় সরকার।

আরও পড়ুন:মোদির প্রাণ প্রতিষ্ঠা ব্যর্থ! আবার উদ্বোধন হতে চলেছে রামমন্দিরের?

তবে কি তৃতীয় দফায় এসে স্ট্র্যাটেজিতে বড়সড় বদল আনছে গেরুয়া শিবির। এতদিন মন্দির, ধর্মের পিছনেই সমস্ত সময়, লোকবল ব্যয় করেছে গেরুয়া শিবির। তবে তা বিশেষ সুবিধা এনে দিতে পারেনি ২০২৪ লোকসভা ভোটে। তাই কি এবার শিক্ষা এবং প্রাচীন ইতিহাস রক্ষায় মন দিতে চাইছে বিজেপি সরকার। এমনিতেই নীট কেলেঙ্কারিকে কেন্দ্র করে উত্তাল দেশ। এ সময় নালন্দার মতো ঐতিহাসিক পীঠের সংরক্ষণ কি মোদি সরকারকে সামান্য হলেও ব্রাউনি পয়েন্ট এনে দেবে? দেশের মানুষ কি মোদির তৃতীয় দফায় অন্য রকম সরকার দেখতে চলেছে? উঠেছে প্রশ্ন।

More Articles