মণিপুর ২০২৩: জয় গোস্বামী
Manipur: জাতিহিংসার আগুনে দাউদাউ করে জ্বলছে মণিপুর, দিনের আলোয় ধর্ষিতা মেয়েরা। ইনস্ক্রিপ্টে কলম ধরলেন জয় গোস্বামী।
১
মণিপুরে যদি থাকত আমার মেয়ে?
চাকরিসূত্রে থাকত আমার মেয়ে?
তাহলে কী করতাম !
এখন কী করছি?
এই বুড়ো হাড়ে আর কিছুই না পারি
ওদের সামনে গিয়ে
গায়ে কেরোসিন তেল ঢেলে দিয়ে মরতে তো পারতাম !
আমি কোনও কাজ করিনি সৎসাহসে
মণিপুর আজ জ্বলছে আমার-ই দোষে !
২
সারা গা থেকেই পোশাক ছাড়িয়ে নিয়ে
উলঙ্গ করে ঘোরালো
মেয়ের বয়সি মেয়ে সব !
কবি হয়ে বসে আছিস শহরে, ঘরে—
এই ঘটনার পরে
যা পান করিস তা কি জল? বিষ না?
কবিতা এখনো লিখিস কী করে?
কলমের নিব ঢুকিয়ে
কেন এক্ষুনি, এক্ষুনি তোর দুচোখ
অন্ধ করিস না?
৩
তুমি দায়ী। দায়ী তুমি
আজীবন শুধু ছাপার জন্য কবিতা লিখে গেলে—
কোনও কাজে নামলে না
মেয়েদের প্রেমে ছন্দ বেঁধেছো মধ্যযৌবনেও—
সেই মেয়ে একদিন
সন্তান হয়ে এল।
মণিপুর বুঝি সন্তান নয় তোমার?
তুমি কবি ! কবি তুমি !
মণিপুরে এসে তোমার যা কিছু লেখা
পোড়া কালো মরুভূমি !
৪
নেকেড প্যারেড, নেকেড প্যারেড !
প্যারেডে মেয়েরা, মেয়েরা
এ-ভিডিও আজ ভাইরাল
ঘরে বসে শুধু কবিতা লিখেছি
ভেবেও দেখিনি কে এরা !
কবি নামধারী জীব
এইবার তুই খাতাপত্তর তুলে
মণিপুরে গিয়ে নিজেই নিজের চিতা জ্বাল্ !
৫
কবিতা বানাই ছন্দে
আর সে-কবিতা ছাপি
আজ যে-ভারতবর্ষে
মণিপুর ঘটে চলে
সে-মাটিতে তোর ছন্দের লেখা পাপ
নিজ কবিতার পাপের সঙ্গে নিজে পুড়ে মর্, পাপী !
৬
আমার কবিতা কোনো অন্যায়
আটকাতে পারবে না
কাছে দূরে, মণিপুরে
আটকাতে পারবে না
তবু যে-মেয়েরা প্রকাশ্য দিবালোকে
লজ্জাবস্ত্র বাঁচাতে পারেনি
বুকে হাত দিয়ে স্বীকার করছি
আমার এসব লেখা
আরও একবার কেবলই তাদের সম্ভ্রম ছিঁড়ে কেনা !
৭
মেয়ে হয়ে জন্মালি
এটাই তোদের দোষ
জন্মালি মণিপুরে—
তোদের এত সাহস !
তোদের নগ্ন করে ঘোরাচ্ছে কারা?
ছুঁচ সুতো দিয়ে সেলাই করেছি ঠোঁট—
ভুলে গেছি সব লজ্জা ও সব ঘেন্না
ভাগ্য ভালো যে রবীন্দ্রনাথ চাক্ষুষ করলেন না
ঘরে ঘরে, ঘরে ঘরে
ধর্ষিতা হয় মণিপুর-কন্যারা !
৮
শান্তি নেই, শান্তি নেই
আছে কেবল স্বেচ্ছাচার
মেয়ে হলেই লজ্জা তার
কেড়ে নেওয়ার এ-অধিকার
পেয়েছি, পাই, পুরুষলোক
ও গো মাটি, মৃত্তিকা
ও বজ্র
জ্বালো এবার অভিশাপের চাবুক-চোখ
এই পুরুষ অধিকারের
বিনাশ হোক বিনাশ হোক
৯
কত মাস ধরে ইন্টারনেট বন্ধ !
মণিপুর ফেটে ছিটকে বেরোনো
অগ্ন্যুৎপাত-কথা
বাইরের পৃথিবীকে
জানতে দেবে না ওরা
আমার কলমে সে-কবিতা নেই
যে-কবিতা দিকে দিকে
দেখাতে পারবে দাউ দাউ মেয়েদল
ঘোড়া ছোটাচ্ছে, মেঘে জ্বলন্ত ঘোড়া !
১০
ভোর নেই, কোনো ভোর নেই, মণিপুরে
রাত নেই, কোনো রাত নেই
শুধু সূর্যের চক্ষু
পুড়িয়ে দিচ্ছে, পুড়িয়ে—
মাঠ বন নদী বৃক্ষকে, লজ্জায়
জোর করে সব ঘরের মেয়েকে উলঙ্গ করে পথে
হাঁটতে বাধ্য করে আজ যারা, তাদের
দলের পতাকা উড়িয়ে—
তারা পুড়ে খাক হয়ে যাবে, হয়ে যায় !
এ-ভুল প্রচার ধুয়ে মুছে যাবে
কলিযুগে আজ আগুনের কোনো হাত নেই !
১১
কোনখানে ওরা গুলি করেছিল মনোরমাকে?
নারী শরীরের ঠিক সেই অঙ্গে
যে-অঙ্গ থেকে শিশুর জন্ম হয়
মনোরমাকেও ওই জায়গায় গুলি করবার আগে
ধর্ষণ করে নিতে
ভোলেনি তারাও।
ভুলে গেছে শুধু ‘মনোরমা’ নামটির
শেষ অক্ষর ‘মা’ কে !
কে বলে এ-কথা মনোরমা আজ মৃতা?
ভুল ভুল ভুল, সারা মণিপুর এখনো এখনো তার
দ্বিগুণ দ্বিগুণ জ্বল্ জ্বল্ করা চিতা !
১২
শ্বাপদ-শাসন। বহুদিন, বহুদিন।
আজও মণিপুর অগ্নিগিরির লাভা
আমার শরীরে পড়ে থাকা হাড় ক-খানা
সে-লাভায় মিশে যাক
গলিয়ে পুড়িয়ে থকথকে আর অকর্মণ্য করে দিক
এ-বুড়ো কবির যত কন্যারা আছে এই দেশ ভরে
সকলের দিকে বাড়ানো
ক্ষমতার এই থাবা !
১৩
পথে যে বিবস্ত্র মহিলারা
তারা কেউ নয় আমার। কাউকেই চিনি না।
নির্বিশেষে নবীনা প্রবীণা
বস্ত্রহীনা, লজ্জাবস্ত্রাহীনা !
অর্ক, আমি মণিপুর নিয়ে
একটি শব্দ লিখবারও যোগ্যতা রাখি না
জানি শুধু এইটুকুই, ওদের কাছেই
চলে গিয়ে একসারিতে দাঁড়াতে পারছি না
মণিপুর নৃপদুহিতার
হ্যাঁ, ঠিক বলছেন, সেই চিত্রাঙ্গদার
হাতে পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়ে নেব কিনা
আজও তা জানি না
জানি এ-মুহূর্তে মণিপুরে
পিতৃস্নেহ পুড়ে পুড়ে পুড়ে
এ-শহরে আসে ভস্মরাশি
আমি সেই ভস্ম জড়ো করে
অর্ক, আপনাকে দিয়ে আসি
‘উঠিতে পারিত যদি সহসা প্রকাশি
সেইসব ভস্মপ্রাণ জননীর মতোন আত্মায়’
দূরতম সে-আশায় এই ব্যর্থকবি দোয়া চায়
আকাশের কাছে, জানে মণিপুরে মেয়েরাই বীর
জয়যুক্ত হবে তারা, এই লগ্ন যেন দেখে যায়
ঝাপসা চোখ— এ ব্যর্থ কবির !
১৪
আমি কি জানি না কী দারুণ ঘৃণা
মণিপুর-কথা বলছে?
যে-পার্বত্য নদীগুলি বয়ে যায়
সমস্ত নদী জ্বলছে !
জ্বলমানস্রোতে মণিপুরবাসিনীরা
ঝাঁপাবে না ঝাঁপাবে না
কখনো জহরব্রতে
সব সংগ্রামকারিনী
একটি কন্যামুখে আজ ধরা দেয়
বুকুন, আমার মেয়ে সে
জন্মে গিয়েছে এ দেশে
বুকুনরা বলে— বলবে— বলছে— বলুক
নগ্ন-ই করো ধর্ষণ-ই করো
কোনও মেয়েকেই পরাজিত করা যায় না
ও শাসক, এই তোমার সামনে তুলে ধরলাম আয়না
বিষ ধরে আছি— ঢালিনি—
ঢালব যখন বিশ্ব দেখবে আকাশে দাঁড়িয়ে উঠেছে
সেই নৃমুণ্ডমালিনী !
১৫
থাকো তো সমতলে নিজ দলে
প্রজেক্ট সরকারি মাতামাতি
আমরা খেটে খাই জনজাতি
তোমরা পদলেহী মিডিয়াছল
আমরা পাহাড়ের বাতাস, জল ...
১৬
চু কিত-কিত খেলো চু কিত-কিত
পাহাড় ভগবান, পাহাড়-ই রক্ষক
আমরা কুকি।
আমরা দু-বেলাই নিয়েছি ঝুঁকি
তোমরা আমাদের ঠেলেছ কোণে
রণাঙ্গন থেকে রণাঙ্গনে
পাহাড়ে বাস করি আমরা তাই
নিজে পাহাড়
মুঠোয় ধরে আছি দধীচি-হাড় !
১৭
মণিপুর কোনো অঞ্চল নয়
লাল-রঙা এক বই।
বালিশের নীচে সেই রেডবুক নিয়ে
ঘুমোতে গেলেই মধ্যরাত্রে আকাশে জ্বলবে সূর্য
আবার বলছি মণিপুর নয় প্রদেশ বা অঞ্চল
এখানে মেয়েরা বলে না : জলকে চল্
মণিপুর লালবই
সেই বই নিয়ে পথে নেমে সব মেয়ে
ঘুরে দাঁড়িয়েছে, বলছে :
ঘনিয়ে আসছে সমাপ্তিদিন
আমরা কিন্তু তোমাদের হারাবই !
১৮
এই অবস্থায় পুনরাবৃত্তিই কবি করুক
পাহাড়ে সূর্যের ওই
উদয় আর অস্ত-ই
মেয়েরা পাঠ করে যাক
সে-পাঠে রক্তের ঝলক
সূর্য মূল রেডবুক
সেদিকে তাকিয়েই মেয়েরা বলে
এ মণিপুরে
আমরা সকলেই সূর্য হই
পাহাড়ে তোমাদের আটকাবোই
১৯
অথর্ব এই কবি তুলবে নিশান?
সামর্থ্য নেই তার।
মণিপুরের মেয়েরা
অস্ত্রে দিলে কী শান !
তাহলে তরবার
গরম করো, তোমরা পাহাড়-চিতা
জয় করে আয়, কন্যারা আমার—
তোদের দিকে তাকিয়ে আছে ব্যর্থকবিপিতা !
২০
ঘরের মেয়েকে পথে টেনে নাও
পথের মেয়েকে পথেই পোড়াও
উলঙ্গ করে যাদের ঘোরাও
তারা কার দিদি? কার বোন?
বলো এইসব কদিন দেখতে পারবো?
সকলের হাতে দলের পতাকা
থানা পুলিশকে কিনে নেয় টাকা
কবির চোখের গর্তেরা ফাঁকা
চোখ নেই, কোনো চোখ নেই
সে বাধা দেয় নি, সে বাধা দেয়নি
বাধা না-দেবার শাস্তির শেষে
জ্যান্ত ঢোকাবে তাকে ফার্নেসে
কবি খুঁজে মরে তেমন কাউকে
লোক নেই, কোনও লোক নেই
২১
অপমান শুধু তাড়া করে আসে অপমানে।
না, না। অপমান আমার না, আমি মানীলোক !
মেয়েদের যত অপমান হয়, মেয়ে জানে
হাতে কত লোম, এগিয়ে পিছিয়ে, সজ্ঞানে
কর্তামুষ্টি লজ্জাবস্ত্র ছিঁড়ে আনে
বাইরে তাদের হাঁটতে চলতে বাধ্য করে
আমি কবি, সব টিভিতেই দেখি একলা ঘরে
লিখেই চলেছি পঙক্তির পর পঙক্তি
মেয়েরা হাঁটছে নেকেড প্যারেডে— জানি না
ওদের মধ্যে আমার কন্যা কোনটি?
২২
আর নয়। এই শেষবয়সের শেষে
যা কিছুই লিখি, সে-লেখায় উঠে এসে
মেয়েরা বলছে : কী এগোয়? দ্যাখো, থাবা না?
দাঁড়িয়ে দেখছ? ঘরে বসে আছ?
তুমি কি কারওর পুত্র ছিলে না কোনওদিন?
এখনো, এখনো তুমি বুকুনের বাবা না?
২৩
শর্মিলা আর ফিরতে চান না মণিপুরে
শর্মিলা চানু ফিরতে চান না মণিপুরে
যে-আগুন তাঁকে এতদিন খেলো কুরে-কুরে
এখনো খাচ্ছে— লেখা সে আগুনে ঘুরে-ঘুরে
পাচ্ছে না আশ্রয় !
শর্মিলা চানু, আপনাকে এই বৃদ্ধ
লেখক বলছে : আমাদের এই দেশে
একটাই নীতি— বাবার বন্ধু, কাকার বন্ধু হোক
মা মাসি শাসান : বাইরে বলবি না—
নয়, কোনও কথা নয় !
ছোটোবেলা থেকে সব নারীকেই নারীত্ব লাঞ্ছনা
সহ্য করতে হয়।
দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করতে হয়।
২৪
ছারখার। ছারখার।
নদীতে নদীতে বইছে তীব্র ক্ষার।
আমার লেখা কি আর খুব দরকারি?
কবি হয়েছি তো, তাই
বাগানে বানাবো বাড়ি।
যে-বাগানে ঢুকি, যে-গাছের কাছে যাই
দেখি গাছ নেই— গাছেদের জায়গায়
দাঁড়িয়ে রয়েছে মণিপুরে ধর্ষিতা
একজন করে নারী !