যে কবিতায় অন্ধকার নামে সহসা

Poems written by Aritra Som: এই কাব্যগ্রন্থ, ধরে রেখেছে ব্যক্তির এবং সমষ্টির অন্ধকারের গান। বিষাদের পথে ক্রমাগত হেঁটে যাওয়া। একা একা একা। যতদূর গেলে আর ফেরা নেই।

একজন কবি৷ তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ মাত্র একটি। তারপর টুপ করে ঝরে যাওয়া। মৃত্যুর অব্যবহিত পরে দেখা গেল, তিনি অজস্র কবিতা লিখেছেন। কবিতায় ছয়লাপ করে দিয়েছেন নিজের সঙ্গোপন৷ প্রকাশের ইচ্ছে যাঁকে এমন সবুজলতার মতো জড়িয়ে ছিল, তিনি কেন বিরতির আগেই মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে যাবেন? কেন একটু ধরে খেলবেন না? এইসব অভিমানের বারুদের উপর বসে কেটেছে অনেক দিন। এখন একটু থিতু যেন। গভীর রাতে বাড়ি ফিরে, ছুটির দুপুরের আলগা অবসরে তাঁর কবিতার দাওয়ায় বসে আছি। কেমন লাগছে? ভালো? অনবদ্য? আশ্চর্য? এসব ক্লিশে বিশেষণের পথ না ধরে বরং দু'একটা কবিতাই এখানে পেশ করি। মৃত্যুর পরে কবির বন্ধুদের প্রচেষ্টায় প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ থেকে। কাব্যগ্রন্থটির কোনো নাম নেই। কবির নামই সর্বনাম হয়েছে এখানে। এখানেই সংকলিত প্রথম দিকের একটি কবিতার চলন এমন-

তোমার ভেজা জবার গন্ধ আমায় ছিঁড়ে ফেলুক, রাই
এই রাত্রি আমি চাই না আর
যেন সর্বক্ষণ ঝড় ওঠে...
আমার ঘেন্না হয়, খুব ঘেন্না হয়
সন্তর্পণে এড়িয়ে চলি সুলভ আস্তানা
এই ঘাম, এই শীৎকার... আহ্ রাই! তুমি চাবুকে নেভাও
কান্নার শহরে ক্ষান্ত করো ভালোবাসা ভালোবাসা...

এখানে ভালোবাসায় কেউ শীতকাল রেখে চলে গেছে

                                                                          (যে দেহে রাইয়ের গন্ধ)


প্রবল যৌনতাড়না থেকে এই কবিতার জন্ম, মনে হয়। মনে হয়, ভেজা জবার গন্ধ রূপকের আড়ালে স্ত্রী যৌনাঙ্গের একটা বনগন্ধময় আবিল করা ঘ্রাণ। এই ঘ্রাণ আছে, কারণ অনুভূতিরা সজাগ। কিন্তু যাকে কেন্দ্র করে এই তীব্র আশ্লেষ, সে নেই, স্রেফ আছে যেন অভ্যাস বশে রমণের অভীপ্সা৷ এবং তারপর অবশ্যম্ভাবী ক্লান্তি। ফিরে ফিরে আসছে তাই, আমার ঘেন্না হয়, খুব ঘেন্না হয়। তুমি চলে গেছ, তবু তোমার গন্ধ আমি উপেক্ষা করতে পারছি না, কিছুতেই। শেষতক চাইছি যেন তাড়না, আদিম রিপুর প্রাবল্য আমায় ছিঁড়ে ফেলে৷ ছিঁড়ে গেলেই মুক্তি৷ একটু দাঁড়াই। ভাবি, কবির চিন্তায় মানুষ কি কোনও বাজনা? তার ছিঁড়ে গেলে যে থেমে যাবে! এক সুতীব্র বেদনা থেকে কেউ মুক্তি চাইছে ছিঁড়ে গিয়ে। পড়লেই মনে হবে, যাওয়ার আগে সে হয়তো বাজছিল, তারপর ছিঁড়ে গেল। চাবুকে। আঘাতে। সে আর চায় না কোনো ভালবাসার ঝোঁক। কারণ সে জানে-

এখানে, ভালবাসায় কেউ শীতকাল রেখে চলে গেছে।

চমকে যেতে হয় এখানে শব্দটির জোরে। কমাটি এমন প্রত্যয়ে পড়েছে যেন মনে হচ্ছে কারো দাঁড়িয়ে থাকা ধরা আছে লাইনটির বাঁদিকের অংশে। পরের অংশে শূন্যতা, বিষাদ, অপ্রাপ্তির বোধ বোঝাতে শীতকাল শব্দটি এল। একটি শব্দ, সে মানে বদলে অনেকটা বড় হয়ে নানা অনুভবকে ধারণ করল। মাথায় বিদ্যুৎচমকের মতো খেলে যায় শেক্সপিয়ার, সনেট নম্বর ৯৭, প্রথম পঙক্তি-


How like a winter hath my absence been
From thee, the pleasure of the fleeting year!
What freezings have I felt, what dark days seen!
What old December’s bareness every where!

অক্ষমের তর্জমায়-

আমার তোমার অদর্শন কেমন যেন
শীতকাল হয়ে গেছে, ক্ষণস্থায়ী বছরের আনন্দ!
কী ঠাণ্ডা যে আমি অনুভব করেছি! কী অন্ধকার দিন দেখেছি!
পুরনো ডিসেম্বরের নগ্নতা চারধারে!

অদর্শনের বিষাদ, শীতের মতো নয়, শীত হয়ে গেছে। ডিসেম্বর হয়ে ঘিরছে চারধার। চারধার মানে কতটুকু, ওই যে নবীন, অকালপ্র‍য়াত কবির শেষলাইন, এখানে, ভালবাসায় কেউ শীতকাল রেখে চলে গেছে। ওই দাঁড়াবার জায়গাটুকুই। শীতকাল এখন সেখানে।

অন্য কবিতায় যাই।

আমরা যারা প্রতিটা ধানক্ষেত ভেঙে আষাঢ়ের গল্প লিখি
তারা জানি-- কেমন করে
সারাটা দিন, একটা কাকতাড়ুয়া
                              স্বপ্ন আগলে রাখে

তারপর ঝড় হয়।
কাকতাড়ুয়া হারিয়ে যায়।

কাঠামোটা, আগামী বছরের আশ্বাস নিয়ে
                               উড়তে থাকে

                                                       (কাকতাড়ুয়া)

প্রথম লাইনটির দিকে তাকিয়ে আছি। আমরা যারা প্রতিটা ধানক্ষেত ভেঙে আষাঢ়ের গল্প লিখি। বর্ণচোরা লিখনভঙ্গিমা। গল্পটা আষাঢ়ে হতে পারত, তার খুব কাছ ঘেঁষে হলো- আষাঢ়ের। ধানক্ষেত ভাঙা আষাঢ়। শুনলেই মনে পড়বে, রবীন্দ্রনাথের গান,

মেঘের 'পরে মেঘ জমেছে, আঁধার করে আসে।

যে লেখে সে জানে কী ভাবে ধানক্ষেতে আষাঢ় আসে। সব লন্ডভন্ড হয়। দিনের বেলা এই ক্ষেত আগলে দাঁড়িয়ে ছিল পাখি তাড়ানো কাকতাড়ুয়া। প্রবল ঝড়ে তার শরীর গেছে উড়ে। স্রেফ আছে কাঠামোটা। কত রকম ভাবে এই কবিতার কাছে আসা যায়। আমরা শব্দের প্রয়োগে কবি একটি বর্গ তৈরি করছেন। আমরা কারা? যারা মাঠমজুর, বেগার, ফালতু, যখন তখন যার কাজ যাবে। ঝড় এলেই যার অস্তিত্ব বিপন্ন, তার কাঠামোটা স্রেফ টিকে আছে আশ্বাসে। কবিতাটা প্রেমেরও নয় কি? যে স্বপ্ন বেলা অবেলায় আঁকড়ে বেঁচে আছে এক সাধারণ যুবা, সে স্বপ্ন ভেঙে যাবে, যাবার বেলায় সমস্তটা নিয়ে যাবে। সে তবু থাকবে। একটা নড়বড়ে হাড্ডিসার অস্তিত্বের মতো! এমন আশ্চর্য সাধারণ অথচ বেদনার গানের মতো কবিতা বড় কম পড়েছি। সমস্ত ফালতুদের জন্য এই কবিতাটা সওয়াল করে যাবে, নিরুচ্চারে।

আরেকটি ছোট কবিতা পাঠকের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই।

কোনো কথা নেই
কোনো অভিমান নেই
শুধু একে অন্যের পায়ের দিকে নীরব চেয়ে থাকা...

বাকিটুকু স্পর্শের কম্পনমাত্র

                                                    (নির্বাক ৬)

কথা নেই। অভিমান নেই। চেয়ে থাকা নেই। অর্থাৎ যা থাকলে দু'টি মানুষ এক সুতোয় বাঁধা থাকে, সেই গ্রন্থি খুলে গেছে। মানুষ দু'টি এখন একে অন্যের পায়ের দিকে চেয়ে আছে। অর্থাৎ পাশাপাশি বসে আছে। কোথায়? কোর্টে? বলা নেই। হাসপাতালে,শিশু অসুস্থ? বলা নেই। শুধু বলা আছে হঠাৎ যে এই দুজনের একজন কেঁপে উঠল, স্মৃতিতে নয়, বেদনায় নয়। কেবল ছোঁয়াচে। বুঝে নিতে ইচ্ছে করে, এরা প্রাক্তন। অথবা যেন আজ শেষ কথা বলতে এসেছে। একে অন্যের পায়ের দিকে চেয়ে বসে আছে। এরপর দু'জন চলে যাবে দু'দিকে। এর মধ্যে যদি ছুঁয়ে যায় শরীর, বিস্ফোরণ সম্ভাবনা নেই, কেবল স্পর্শে কেঁপে উঠবে শরীর। এই কেঁপে ওঠাই তো বলে দেয়, এই ছোঁয়াচ আজ অচেনা! সম্পর্কের শেষ ঋতুর এমন মিনিমাল উপস্থাপনা, কী বিস্ময়, কী বিস্ময়!

আজ শেষ করব দু'শোর বেশি কবিতায় ঠাসা এই কাব্যগ্রন্থের আর একটি কবিতাকুহকের কথা বলে। কবিতাটি এইরকম-

জানলার দিকে, সোজা চোখে
তাকিয়ে আছে
ইডিয়ট চেয়ারটা
দেখছে ঝুপড়ির ওঠানামা
দেখছে, সেসব গিলে নিলে কী করে
আরও পয়মন্ত রূপ পায় কিশোরী...

শিরদাঁড়া জমে যায় ঘামে
ক্রমড আসবাব হয়ে ওঠার আগে
আমি শেষবার তাকাতে চাই নীহারিকা!

চেয়ারটার মাথা থেকে খসে গেল মেঘ।
দেওয়াল নেই
টিভি নেই-- ভেতরে
ঝুপড়ির মেয়েটা ঘষে ঘষে
বুকের ময়লা তুলে রাখছে

ছেঁড়া মাংসের উপর ডলে দিচ্ছে সিগারেট

                                                                ( সিঁড়ির আড়ালে-৫)

কবিতার প্রধান চরিত্র হিসেবে চেয়ারকে দেখেছি শেষ কবে? পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলালের কবিতায়-

টেবিল, দূরের সন্ধ্যা

ঘনিয়ে আসছে। ফল, মৃতদেহ
অফিসফাইল, জোড়া-খোয়া দুল
নেগেটিভ প্রিন্ট, অ্যালবাম, প্যাড

কী রাখব তোমার উপর?

চেয়ার, রাখতে হবে সামান্য সরিয়ে!

                                                          (টেবিল)

সেই চেয়ারই এই কবিতায় দ্রষ্টা যেন। অথবা চেয়ারে যে স্থানু, সে, যেন ক্রমশ আসবাব হয়ে যাচ্ছে, তার আগে দেখে নিতে চাইছে দৃশ্য। এক পয়মন্ত মেয়েকে। যে ঘষে ঘষে বুকের ময়লা তুলছে। এর পর রয়েছে একটি স্পেস। স্বপ্নের মরণের জন্য যেটুকু জায়গা লাগে।

তারপর লেখা- 'ছেঁড়া মাংসের উপর ডলে দিচ্ছে সিগারেট'। কে ডলে দিচ্ছে? বলা নেই। বলা আছে, বুকের ময়লা তোলা নীহারিকাদের মাংস হয়ে যাওয়া। নরম মাংসে সিগারেটের ছ্যাঁকা খাওয়ার গল্প। এই গল্প তো রাতের। দিনে নীহারিকা, পয়মন্ত কবিমানসী সাবান ঘষছিল শরীরে। তারপর আসবে ছ্যাঁকা খাওয়ার রাত। দিন আর রাত আলাদা করতেই একটা স্পেস রেখে যান কবি। আলো থেকে অন্ধকারে যাওয়ার অনিবার্য সেতু এই স্পেস।

মাত্র কয়েকটি কবিতা তুলে ধরলাম। যে কথাটা বুঝতে ও বোঝাতে চাইলাম, এই কাব্যগ্রন্থ, ধরে রেখেছে ব্যক্তির এবং সমষ্টির অন্ধকারের গান। বিষাদের পথে ক্রমাগত হেঁটে যাওয়া। একা একা একা। যতদূর গেলে আর ফেরা নেই।

আমার থেকে বয়সে অনেক ছোট এই যে কবির কবিতা পড়লাম, তাঁর নাম অরিত্র সোম। বইয়ের নাম তাঁর নামেই। বেলঘরিয়ার বাসিন্দা ছিলেন অরিত্র। আমার সহকর্মী ছিলেন। এ বছর, ১৪ এপ্রিল, পয়লা বৈশাখের দিনে তিনি আত্মহননের পথ বেছে নেন। দেশের বাইরে উচ্ছ্বাসের মধ্যমণি হয়ে বসে আছি, সে অবস্থায় এই খবর পাই। মনের সমস্ত আলো নিভে যায় মুহূর্তে। সেই মৃত্যুর অভিঘাত পেরিয়ে কিছুতেই তাঁর কবিতার কাছে যেতে পারি না। চেষ্টা করি। আপনারা পারলে তাঁর কবিতার পাশে দু'দণ্ড বসবেন।

More Articles