'দৈব': পার্থিব কবিতার শিরায় জড়িয়ে থাকা মহাজাগতিক আখ্যান
Joy Goswami Book Review: রবীন্দ্রনাথ জয়ের শিরায় শিরায় আছেন, তা এই গ্রন্থের কবিতাগুলির মধ্যে আরও বেশি স্পষ্ট।
একজন জার্মান দার্শনিক, সাধারণত কবিতাপাঠকদের কাছে অপঠিত এক ব্যক্তিত্ব, একবার বলেছিলেন, কবিতা মানুষের অনিশ্চিত মুহূর্তগুলির বিচ্ছিন্ন অনুভূতিমালা। কোনও একটি সূত্র দিয়ে তাকে গাঁথতে যাওয়াই হলো কবিতা পড়ার সবচেয়ে অন্তরায় একটি কাজ। এই দার্শনিকের কথা যদি এখনকার অতিশিক্ষিত পাঠকরা নাই বা শুনতে চায়, তাহলেও, এ কথা অনস্বীকার্য, কোনও একটি প্রতিষ্ঠিত ছাঁচের ভিতর কবি বা কবিতা যদি থেকে যান দীর্ঘ দীর্ঘকাল, তাহলে তা মৃত্যুরই সমান। অর্থাৎ, একটি বিশেষ ‘সিগনেচার’ ভাষার জন্ম দিয়ে সেই ভাষাতেই কথা বলার মতো করণিক কবিতা তিনিই লিখে যেতে পারেন, যিনি মৃত। সেই সব কবিতায় রক্তচাপ বদলায় না, রক্তে শর্করাও পালটায় না, সে আর বিশুপাগলের মতো চঞ্চল অথচ ভিতরে স্থির থাকে না। সে হয়ে পড়ে একটি পাথরের মতো গুরুঠাকুর। বাণী দিতে হবেই তাকে, নাহলে, সমাজ পরিবর্তন তিনি করবেন কীভাবে। কিন্তু মুশকিল হলো, তিনি যদি প্রকৃতই কবি হয়ে থাকেন, তাহলে তাঁকে আর নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। কারণ তাঁর অন্তরে তিনি প্রথম কবিতা লেখার আগের সেই কিশোর বা কিশোরী সত্তাকেই নিয়ে আছেন, যাঁর জীবন সম্পর্কে অভিজ্ঞতাগুলি সমৃদ্ধ হয়েছে। অল্প। কারণ আমরা যতই জানি, আমাদের এটাও জানতে হবে, আমাদের না-জানাগুলিও ততই বেড়ে যায়।
স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও শেষ বয়সে এসে স্বীকার করে নিয়েছেন প্রথম দিনের মতো, উত্তর পাওয়া যায় না কিছুই। হয়তো প্রশ্নের ধরন বদলায়। এ হেন আবহে, বলুন ‘দৈব’ কাকে বলব? অলৌকিক কিছু ঘটনাকে? না কি জীবনেরই নানা অপ্রত্যাশিত মুহূর্তকে? না কি জীবনের নানা অপ্রত্যাশিত মুহূর্তকে, যেগুলি প্রকৃতির রহস্যময়তা। সবই তো প্রকৃতি। প্রকৃতির এক বিরাট অজানা জায়গায় আমরাও প্রকৃতিই হয়ে আছি। একজন মানুষ, যাকে আমি ভালোবাসি, তিনিও প্রকৃতি। আবার, যিনি হয়তো আমায় হত্যা করবেন, তিনিও প্রকৃতি। জীবনের এক আকস্মিক ট্রাম যেমন ধেয়ে আসবে জীবনানন্দের দিকে, সেও প্রকৃতি। সুতরাং সমস্ত অপ্রত্যাশিত মুহূর্তই হল দৈব, অন্তত আমি সেই শব্দটি দিয়ে এই জয় গোস্বামীর ‘দৈব’ কাব্যগ্রন্থটির দিকে তাকাতে চাই। একজন কবি যখন একটি শব্দ খুঁজে পান, তিনি কি সেই শব্দটা পাওয়ার জন্য পারমুটেট কম্বিনেট করতে থাকেন? না কি তিনি ভাবেন? আবার ভাবেনও না। শব্দটা তাঁর মননে, ভাবনায় হাজির হয়। তিনি তাকে নিয়ে সংসার করেন। সহবাস করেন। তার পর তাকে পরম আদরে রূপ দেন। এই রূপ দেওয়া ও না দেওয়ার মধ্যবর্তী সময়টুকু হলো কবিতা। আর রূপ দেওয়া হলো সেই কবিতার একটি অংশকে প্রকাশ করা। কবিতা হলো সমস্ত কবিতার ‘টিপ অব অ্যান আইসবার্গ’। তার চূড়াটুকু আমরা দেখতে পাই। তার অন্তরালে, গভীরে যে দীর্ঘ ব্যাপ্তি, তাকে আমরা দেখতেই পাই না। সে ডুবে থাকে গহিন ভিতরে। গভীরতার মধ্যে আমরা যখন ডুব দিই, পাঠক হয়ে যাই সেই কবিতার।
জয় গোস্বামীর ‘দৈব’ সে রকমই এক অভিযাত্রা। অনেকগুলি মুহূর্তকে তিনি পেয়েছেন একজন কবি হিসেবে, একজন প্রেমিক হিসেবে। এই কবিতাগুলি কোন কবিতাসমগ্রের মধ্যে লুকিয়ে ছিল, কীভাবে সেই কবিতাগুলিকে নিয়ে আসা হলো এই কাব্যপুস্তিকায়, কীভাবে সেই সব কবিতার সঙ্গে অগ্রন্থিত অনেক কবিতাই সযত্নে জুড়লেন কবি, এ সমস্তই লেখা আছে এই কাব্যগ্রন্থের ভূমিকায় অভিরূপ মুখোপাধ্যায় কর্তৃক। এই কাব্যগ্রন্থ পড়তে গিয়ে অভিরূপের ভূমিকা পাঠকের সত্যিই কাজে লাগবে। কিন্তু তার পর পাঠককে ডুব দিতে হবে একটা অজানা সমুদ্রে। তার কারণ একজন গাইড অভিযাত্রীদের নিয়ে আসেন আসল যাত্রার দোরগোড়ায়। সবকিছুই জানিয়ে দেন। ইতিহাস, ভূগোল। কিন্তু তার পর সে রাস্তাটি কেমন, তা প্রতিটি অভিযাত্রীর কাছে ভিন্ন ভিন্ন। জয় গোস্বামী লিখে গেছেন বলেই, কবিতাগুলির পাঠ একমাত্র জয় গোস্বামীর অনুভূতির মতো হতে হবে, তার কোনও অর্থ নেই। বরং ধরে নিতে পারি, আমরা পাঠক হিসেবে যখন এই কবিতাগুলি পড়ব, তখন ব্যক্তি জয় গোস্বামীকে আমরা ভুলে গেছি। ধরে নিন পাঠক, আপনি আজ থেকে দুশো বছর পরের পাঠক। কোনও এক লাইব্রেরির ধ্বংসস্তূপে আচমকা কবিতা লেখার মতোই আপনি খুঁজে পেয়েছেন এই কৃশ বইটি। বাংলায় লেখা। বাংলা ভাষাটি তখনও জীবিত। আপনি একটার পর একটা পাতা খুলছেন বইটির। আর কী পড়ছেন? এবিসি, সিবিএ ডিডি মিলবিন্যাসে লেখা এক একটি আট পদের কবিতা। দু'টি শব্দের এক একটি শিরোনাম। কিন্তু তা ছাড়াও কী আছে? দলবৃত্ত ছন্দ? আচ্ছা হলো। তারপর?
দৈব আমার ময়ূর, তার গা ধুয়ে দেয় জল
সত্য উচ্চারণের আগে প্রত্যেকবার থামি
এমন স্রোত কোথায় পাব যা থাকে বিশ্রামে
নাহ আপনি তো ঠিক এই ভাষা পড়েননি সংবাদপত্রে। পড়েননি বাংলা ভাষায় লেখা বিবৃতিপ্রধান কবিতায়। এই ভাষা তো সহজ ন্যারেটিভ নয়। তাহলে এই কাব্যভাষা কোথা থেকে এল? দৈব? ইনি কি তবে কবিতায় যা বলা হচ্ছে, তার চেয়ে অনেক অন্য অর্থে কথাগুলি বলছেন? কিন্তু আপনি আবার বুঝতেও পারছেন এই লেখা। মনের মধ্যে নানা দৃশ্য আচম্বিতে ঘুরছে। মনের মধ্যে ডুব দিচ্ছে কত না অনুভূতিমালা। এমন স্রোত কোথায় পাব যা থাকে বিশ্রামে? কে থাকে? সঙ্গীত? মৃত্যু? সময়? এই দেখুন কবিতাটি আপনাকে স্পর্শ করে নিল। এবার তো আপনি আর থামতে পারবেন না। ‘ময়ূর কেমন নাচে কেবল তাই দেখে গেলাম/ আমার দ্বিধা ধুইয়ে দিলেন সকালবেলার নাম’।
আরও পড়ুন- মরা আলোর সিম্ফনি: একটি অকিঞ্চিৎকর পাঠ
যাঁরা এই লেখা পড়বেন, তাঁদের কাছে আমি জয়ের এই কবিতাগুলি পড়ার কথা বলব না। বা, বলব না কবিতাগুলির ভাবসম্প্রসারণ কীভাবে করতে হয়। কিন্তু আমার বিস্ময়টুকু বলব। কারণ জগতের প্রথম কাল থেকে বিস্ময়ই মানুষের জ্ঞানের সারাৎসার। আমি সেই বিস্ময়কেই দৈব বলি। আমার জীবনের অন্যতম আনন্দের দিক এই বিস্ময়। দেখুন, ময়ূর কেমন নাচল, তাই দেখে গেলাম, এই কথাটির মধ্যে আমার আপনার সকলের জীবনের সারাংশ লুকিয়ে আছে। আমরা ঠিক কী করি, ঠিক কীভাবে করি জীবনযাপন? আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য কী? এই বিস্ময়যাপন। সৌন্দর্যবোধ। সুন্দর এবং সৌন্দর্যবোধ বলা যেতে পারে যে কোনও আধ্যাত্মিকতার মূল সুর। কিন্তু দৃশ্যমান সুন্দর এবং অন্তর্জগতের সুন্দর এক নয়। দৃশ্যমান সুন্দরের ভিতরে থাকে রূপের ক্ষণস্থায়িত্ব। কিন্তু অন্তরের সুন্দরের ভিতরে থাকে এক দীর্ঘকালীন দুঃখ ও আনন্দের ছন্দ।
জয়, ‘দৈব’ কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতায় এই ভিন্ন নন্দনতত্ত্বকেই ধরতে চেষ্টা করেছেন। ‘চিত্রী’ কবিতায় ‘আমার নামের ফুল ফুটে যায় পথের বাঁকে বাঁকে’ সেই সৌন্দর্যকে ধরে রাখার আকুতি। আমি নিজেকেই আসলে দেখতে পাচ্ছি এই জগতের মধ্যে। নিজেরই প্রতিফলনে এই জগতের সুন্দর আরও সুন্দর হয়ে উঠছে। এই জন্যই প্রতিটি কবিতায় তিনি সেই সৌন্দর্যস্তবটুকুই রচনা করছেন। এ যেন এক ভিন্ন ফর্মে লেখা ওড, যা আসলে, শাশ্বতের প্রতি তার প্রণয়চিহ্নকে অক্ষরে অক্ষরে লিখে রাখছে। তবে কি এই সব কবিতাগুলি এক একটি গান? সঙ্গীত রয়েছে এই সব কবিতাগুলির মাঝেমাঝে? সেই সুর, কীটসের ভাষায় ‘হার্ড মেলোডিজ আর সুইট বাট দোজ আনহার্ড আর সুইটার’। এই যে আমি কীটসের কথা বললাম, বা রবীন্দ্রনাথও আমার মনের মধ্যে বারেবার উঁকি দিয়ে যাচ্ছেন, তাহলে কি আমি আধুনিক কবিতার থেকে অনেকটাই দূরে সরে গেলাম? এ কথা বলতে না বলতেই কেউ এসে আমায় জানিয়ে দিয়ে গেল, আরে বাবা কবিতাগুলি তো সেই স্বরবৃত্ত ছন্দে লেখা। তবে কি এই কবিতাগুলি রোমান্টিক কবিতা?
আবার প্রশ্ন এল, তাহলে একজন ওয়ার্ডসওয়র্থ বা শেলি বা কীটস বা রবীন্দ্রনাথের প্রথম পর্যায়ের চেয়ে এই কবিতাগুলি আলাদা কীভাবে? কেনই বা এই দু' হাজার তেইশে এসে কবিতাগুলির কাছে আসব আমরা? কারণ, কিছু কিছু অনুভূতি, রূপ-নিরপেক্ষ। যে চোখ নিয়ে একজন কীটস চেয়েছিলেন হেমন্তের বিকেলে উড়ে যাওয়া পাখিদের দিকে, সেই চোখ নিয়েই আজকের লাতিন আমেরিকার কেউ তাকিয়ে থাকেন আর আক্রান্ত হন এক বিপন্নতায়। এই বিপন্নতার কোনও সময়-স্থান-পাত্রের বিভাজন নেই। এই বিপন্নতার ভাষাও আলাদা নয়। এই আনন্দের প্রকাশও আলাদা নয়। আমি বিশ্বাস করি সত্য এক। সত্য অনেকরকম। জয় গোস্বামীর এই ‘দৈব’ কাব্যগ্রন্থেও সেই সব খণ্ড খণ্ড সত্যকেও আবিষ্কার করার নানা জায়গা রয়েছে। মনে হয়, কবি এখানে এক অপূর্ব দ্বৈত-অদ্বৈত খেলায় মেতেছেন। তাই ‘ফুল’ নামক কবিতায় লিখছেন- “ফুলের রঙে দেখি স্বয়ং অপ্রত্যাশিতকে”। এই যে আশ্চর্য একটি পংক্তি কবি লিখলেন, তা এই কবিতাটিকেই মন্ত্রের জায়গায় নিয়ে গেল। দেখুন পাঠক, ঠিক এভাবেই, একটি কবিতা তার সমসময়কে অতিক্রম করে চিরকালীনতার দিকে ছুটে যায়। কবিতা এক অপ্রত্যাশিতর শিল্প। মহাজীবন নামক গ্রন্থের প্রতিটি অক্ষরে, স্পেসে রয়েছে সেই অপ্রত্যাশিত। আমরা নিজেরাও কোনও একটি মুহূর্তের আগে বুঝি না সেই মুহূর্তটি ঠিক কেমনভাবে প্রকাশিত হতে চলেছে।
আরও পড়ুন : “থিও ভ্যান গঘ: ১৮৫৭-১৮৯১” – অচেনা বই, অচিন এক জীবনের খোঁজ
এই প্রসঙ্গে একটি কথা বলতে ইচ্ছে করে। আর তা হলো, জগৎ আসলে আমার সঙ্গে সঙ্গেই বিকশিত হচ্ছে। সে আমার আগে কোথাও বিকশিত হয়ে নেই। এই যে মুহূর্তে একটি ফুল ফুটল, এই মহাবিশ্বও কয়েক কদম প্রসারিত করল নিজেকে। মহাজগতের নিজেকে প্রসারণ করার একটি অংশ হিসেবে এই ফুলের জন্মও রইল। একটি ফুলও তবে মহাজগতের অপ্রকাশ থেকে প্রকাশে আসার যে ঘটনা, তার একটি অংশ। আর সেই ফুলের ঝরে পড়া? তাও কি একটি মহাজগতের ধ্বংসের একটি অংশ? হয়তো, একটি ফুলের মৃত্যুও সেই মহাজগতের ধ্বংসের একটি ম্যাক্রোকজম। কারণ সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে এই মহাজগতেরও মৃত্যু হয়ে চলেছে। সেই মৃত্যু নামক বৃহত্তম ঘটনার সাক্ষী হয়ে রইলাম আমরা একটি ফুলের মৃত্যুর ভিতর। ফুলের যে রঙ, তা তো সেই অপ্রত্যাশিত অপ্রকাশ থেকে প্রকাশ্যে আসার রঙ। শিল্প তাই অপ্রত্যাশিত। একটি কবিতার একটি লাইন অপ্রত্যাশিত ভাবেই চলে আসে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তা ছিল কোথায়? কোথাওই ছিল না। প্রকৃতিই এসব কথা বলতে চাইছিল। কিন্তু সেই অপ্রত্যাশিত শিল্পটিকে উচ্চারণের পর আমি তো তার গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছি না। অর্থাৎ আমি সেই বৃহত্তম লীলাকে ধারণ করে রাখার উপযুক্ত আধারখানি নই। আমি তার সঙ্গে কিছুক্ষণ যেতে পারি মাত্র। ঠিক সেইটাই হয় বলে, সেই কবিতার বাকি লাইনগুলি হয় ধারণের এক প্রবাহ। ‘কাঁটা’ নামক কবিতায় সেভাবেই জয় লিখে ফেলেন একটি অব্যর্থ লাইন— "কী বিষমধু কী মধুবিষ নিয়ে আমার হাঁটা”।
“খাতার লেখা পুড়ছে? তবু আগুন থেকে বেঁচে/ খাতাই বলে : লেখায় আবার বাজ পড়ুক, বাজ!” এইবার দেখুন পাঠক, আধুনিক কবিতার নন্দনতত্ত্বও জয় লিখছেন এই কবিতাগুলির ভিতরেই। যে কথাটি সামান্য লিখিয়ে হিসেবে আমি বোঝার চেষ্টা করি, তা হলো আমার এই বিন্দুসম অস্তিত্বে আমি কি কোনও নির্দিষ্ট কাব্যভাষার দাস না কি আমার কাব্যভাষাকে আমি একটি মাধ্যম হিসেবেই ব্যবহার করে পৌঁছে যেতে পারছি সেই নন্দনতত্ত্বে, যেখানে এক কবি ক্রমাগতই নিজেকে বিপন্ন করে চলেন। তাঁর নিজেকে বিপন্ন করার অস্ত্র কী, একমাত্র ভাষা। সে ভাষা, তাঁর ভাবনার কিয়দংশই হয়তো কবিতায় পরিণত করতে পারে, কিন্তু এই ভাষার মাধ্যমেই কবি নিজের অস্তিত্বকে ফালাফালা করতে করতে চলেন। পথে নিজের ঘটকে পিছনে ফেলে ভেঙে, তবেই এগিয়ে যাওয়া একজন বাউলের কাজ। একজন কবি, সেই বাউলই, যিনি বারবার নিজের ভিতরে খুঁড়ে প্রশ্ন করতে করতে যান। কমলকুমার যেমন বলেছিলেন, ভাষাকে যে আক্রমণ করে, সেই ভাষাকে বাঁচায়। তার থেকে কিছুটা অন্য সুরেই অথচ প্রায় একই কথা বলছেন জয়। এখানে অবশ্য, ভাষা সামগ্রিক অস্তিত্ব নিয়েই হাজির হয়েছে তাঁর সামনে। কবিতাটির নাম ‘লুঠ’।
সান্ধ্যভাষা সেই কবে থেকেই বাংলার কবিতার ভাষার এক অলংকার হয়ে উঠেছে। কিন্তু জয় এই কাব্যপুস্তিকায় একপ্রকার সান্ধ্যভাষাকেই ব্যবহার করেছেন বারবার। ফলে, একই শব্দের, জীবনানন্দীয় মন্তব্য অনুসারে, বলতে পারি, দূরের এবং কাছের অর্থ যে আছে তা যেমন দেখতে পাই, তেমনই, সেই অর্থের যে শব্দ ছাপিয়ে অর্থের এক মানচিত্র তৈরি হতে পারে, তাও দেখতে পাই। এ কথা বলা যেতেই পারে ‘সূর্য পোড়া ছাই’ থেকে শুরু করেই জয় এই বাচ্যার্থকে অতিক্রম করা ভাষায় কবিতা লিখছেন। জয়ের এক নিজস্ব বাংলা ভাষার ভোকাবুলারি তৈরি হয়েছে। সেই ভোকাবুলারি বাংলা ভাষার মধ্যে সম্পূর্ণভাবে ছিল না তা নয়, কিন্তু তার নতুন নতুন ব্যবহারে এই ভোকাবুলারি হয়ে উঠেছে বাংলা ভাষার সম্পদ। জয়ের কবিতা একটু অন্যরকম ভাবে ভাবলে বাংলা ভাষাকে নতুন করে আবিষ্কার করারও কবিতা। একটা সময় জীবনানন্দ যেমন কবিতার শব্দের প্রয়োগের এক সম্পূর্ণ নতুন ইতিহাস রচনা করেছিলেন, উৎপলকুমার বসু, রমেন্দ্রকুমার আচার্য চৌধুরী এবং অনন্য রায়ের পরে জয় একটু অন্যরকম ভাবে নিজস্ব বাংলা ভাষাপ্রয়োগে কবিতা লিখছেন। আর সেগুলি খুব প্রকট পরিবর্তন না হওয়ায় খুব প্রচ্ছন্নভাবে একটু একটু করে বাংলা ভাষার সঙ্গে মিশে গেছে। ‘দৈব’ কাব্যগ্রন্থের সরল কাঠামোর অন্তরালে রয়েছে এই ক্ষুদ্র মীড়গুলির কাজ, যা জয়ের কবিতাকে আরও অনেক বেশি গভীরের প্রতিধ্বনি করে তুলেছে। যেমন, বৃক্ষ নামক কবিতায় তিনি বলছেন-
পুণ্য রাখি জলে যখন স্থলে ঝোলাই পাপ
জল লাফিয়ে ধুইয়ে দিল যা কিছু অন্যায়
স্নেহগাছের ফুল ফোটালাম আমার অন্তঃপুরে
রবীন্দ্রনাথ জয়ের শিরায় শিরায় আছেন, তা এই গ্রন্থের কবিতাগুলির মধ্যে আরও বেশি স্পষ্ট। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের বাইরের দিকটিকে জয় গ্রহণ করেননি। তাঁর ভিতরের দিককেই জয় গ্রহণ করেছেন। এই গ্রহণ করাটা এত বেশি অন্তরের, যে জয়ের সঙ্গে মিশে গেছেন রবীন্দ্রনাথ। জয়ের মনোজগতে রবীন্দ্রনাথ রয়েছে মহাবিশ্বপ্রকৃতির মতোই। এই যে কবিতাগুলি, একে জয় নিজেই বলছেন ‘সন্ধ্যাব্রতকথা’। কী আশ্চর্য, যেন আমাদের কাছে নিখুঁতভাবে ফুটে উঠল এক প্রাচীন বাংলার রূপ। সেখানে ধীর শান্ত মন্থর একটা গতি আছে। সেই গতি মানুষকে ক্লান্ত করে না, নিবিড় করে। আধুনিক কবিতার এই অনাধুনিক আবহই বাংলা কবিতার প্রাণকেন্দ্র। তিনি যেন এক প্রবাহের অংশ হয়েই ফুটে রইলেন বাগানে। সে ফুল নিজেকে ঘোষণা করে না, কিন্তু নিজের সৌন্দর্যে চারদিক মোহিত করে রাখে। এই ফুলের চারপাশে মধুমক্ষিকারা ঘোরে না, এই ফুল মাংসাশী নয়, এর কোনও প্রতিহিংসা নেই। রয়েছে অপেক্ষা। কীসের অপেক্ষা। কান পেতে থাকার অপেক্ষা। মাঝে মাঝে যে তার বারতা আমার ভাষায় কথা পাবে, তার জন্য নিজেকেও করে রাখতে হবে প্রস্তুত। এ হলো সেই উদাসীন প্রস্তুতি। এলে, তার সঙ্গে দু' একটি কথা বলব। জল বিনিময় হবে। না এলে, প্রতীক্ষা করব।
যে ভাষা সম্পর্কে জয় বলছেন, “আমার কাছেই থাক না তোমার সন্ধ্যাগানের ভাষা” (ভাষা), তিনিই বলছেন তারপরে আরও নির্দিষ্টভাবে, “স্বাধীন ভাষার জন্যই এই সান্ধ্যকথাব্রতে/ উড়ে বেড়ায় লেখা আমার সমুদ্রে পর্বতে," (ব্রত)। এক বুক ভর্তি শ্বাস নেওয়া এই কাব্যগ্রন্থে কবির প্রবল শ্বাসকষ্টও টের পাওয়া যাচ্ছে। কেন এই শ্বাসকষ্ট? শ্বাসকষ্ট, তার কারণ হল শিল্পের ক্যানভাস অনেক সময় শিল্পের মুখ বন্ধ করে রাখে। কাঠামোর কী এক সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যা কিছুতেই মনকে, শরীরকে, কাব্যকে, তার কাঠামো থেকে মুক্ত করতে পারে না। তাই অনুভূতি মনের মধ্যেই পাক খায়। ভাবনা মনের মধ্যেই থেকে যায়। তাকে কাঠামো ছেড়ে বেরিয়ে পড়তেই হবে। আর তাই, যখন তিনি সেই বেরিয়ে পড়ার স্বাদ পাচ্ছেন, তিনি নিরালায় শুধু নিজের মধ্যে বসে ভাবছেন, এক বিন্দু নির্জনতায় মুক্তির আনন্দের কথা। আদৌ কি সে তার ঈপ্সিত মুক্তি পেল? পেল না। কারণ আমাদের এক নির্জন নিয়তি আছে। আর তা হলো, সামগ্রিকভাবেই আমরা একটা স্তর পর্যন্ত ভাবতে পারি, তার পর পারি না। তার চেয়েও বেশি যন্ত্রণার জায়গাটি হল, যা ভাবতে পারি, তারও একটা স্তর পর্যন্ত প্রকাশ করতে পারি। তাহলে কীভাবে আমার ভাষাকে আরও বেশি মুক্ত এক প্রকাশমাধ্যম করে তুলতে পারি? ভাষা তো এক কিশোরীর মতো। তাকে বন্দি করে রাখলে সে শুকিয়ে যায়। মুক্ত করে রাখলে তবেই সে আনন্দ পায়। কিন্তু তার জন্য দরকার আড়ালের। বর্মের। ছদ্মবেশ দরকার। ছদ্মবেশ তাই আমাদের আপাত অর্থ দেয়। আর ভিতরের আমি নিজের আনন্দে মুক্ত থাকে। কিন্তু তাও কি তাকে পাওয়া যায়? “চেঁচামেচির ভিড় সরিয়ে গেছি দাওয়ার কাছে/ সত্য উঠে গেছেন কখন, আসন পড়ে আছে।" (ঘর)
আরও পড়ুন- ক্ষমতা আর যৌন শোষণের আখ্যান; মহাভারতকে নতুন করে জানতে কেন পড়তেই হবে ‘পাঞ্চালী’
এইখানে, আসুন একটু থামা যাক। আসুন বইটিকে আবার প্রথম থেকে পড়া যাক। বইটি পড়তে পড়তে পৌঁছে যাওয়া যাক রবীন্দ্রনাথে। ছিন্নপত্রের চিঠিগুলোতে। পৌঁছে যাওয়া যাক জীবনানন্দ দাশের ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’তে। আসুন এসে আরেকবার তুলে নেওয়া যাক বিনয় মজুমদারের 'ফিরে এসো চাকা'। তার মাঝে কি অল্প ঘুরে আসা যায় না নেরুদায়? কিংবা দান্তের ‘ডিভাইনা কম্মেদিয়ায়’। কেন যাব বলুন তো এসব জায়গায়? আমি তো পড়ছি জয়। জয় গোস্বামীর একটি ক্ষুদ্র কাব্যপুস্তিকা। সেটা পড়তে পড়তে কেন যাব আমি এসব জায়গায়? আমি যদি শুধু হাছন রাজায় থাকি, যদি থাকি রামপ্রসাদে, লালনে, বৈষ্ণব পদাবলীতে? পাব না কি, এই প্রেম, এই অন্তরাল, এই সান্ধ্য পৃথিবীর বিড়বিড়ানি? পাস্তেরনাকের কবিতা পড়েছ তুমি? আচ্ছা, ড জিভাগোর কবিতাগুলি? কিংবা হিমেনেথ, বা রুমি? কোথায় সেই আধ্যাত্মিকতা? আধ্যাত্মিকতা কোথায় থাকে? আধ্যাত্মিকতার আধার তো সেই, যে বুকের মধ্যে নিয়ে থাকে এক লক্ষ বছরের আকুতি। আবহমান কালের এক প্রশ্ন বুকে নিয়েই সে লেখে। সেই লেখাই কখনও প্রেম, কখনও আধ্যাত্মিকতা হয়ে সমগ্র মহাবিশ্বজগতেই প্রতিধ্বনিত হয়। বুকের ভিতর এই যে অনিশ্চয়তার দরজা খুলে যায় মাঝেমাঝে, সে তো তারই জন্য। সেই তো সেই ‘তুমি’ যাকে সম্বোধন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, যার জন্য জীবনানন্দ লিখে গেছেন অপেক্ষার কথা। “কী তিথি কার চাঁদ নামাল সাঁকোর তলার জলে?” (জুয়া) এই প্রশ্ন থেকে কবি তো মুক্ত হন না। বরং এই প্রশ্নকেই খুঁড়তে থাকেন।
ভাবার মতো বিষয় যেটি, এই কাব্যগ্রন্থটির কবিতাগুলি কিন্তু জয়ের একটা পর্যায়ের কবিতা। যে পর্যায়ের পরের কবিতাগুলি সম্বন্ধে আমরা জানি। তার পর আরও অনেক কবিতা আসবে। অর্থাৎ অনিশ্চিত যাত্রাপথের একটা ফিরে দেখা অংশ নিয়ে আমাদের এই পাঠে, এই কবিতাগুলি নতুন ভাবে আবার লিখিত হলো। ব্যক্তিগতভাবে এর আগে আমি জয় গোস্বামীর ‘প্রণাম’ এবং ‘ঔরস’ পাঠ করেছি। তারপরে আমি ‘দৈব’ পড়ছি আবার। অনেক নতুন অগ্রন্থিত কবিতা এই কবিতাগুলির সঙ্গে যুক্ত হয়ে তৈরি করছি এক নতুন হারমোনি। কিন্তু এই কবিতাগুলি শাশ্বত কিছু ভাবনা নিয়ে রয়েছে এমনভাবেই, যে, মনে হচ্ছে না, কবিতাগুলি এখুনিই লিখিত হল না। একটা স্পাইরাল গতি, সময়ের মতোই, জয়ের কবিতা ও জীবনপ্রবাহে হাজির। সেই স্পাইরাল গতিতে কোনও কিছুই সরলরৈখিক নয়। ভাষাও নয়, ভাবনাও নয়, অস্থিরতাও নয়, শান্তিও নয়। কবিতার জীবনের আরও এক নিয়তি হলো এই যে একটা সময়ের পর তার আর কোনও সময় থাকে না।
ধরুন, আপনি এই দু'হাজার তেইশে বসেই কারমিনা বুরানা শুনতে পারেন। বা, খুলে বসতে পারেন বোদল্যের-এর কবিতা। কিংবা রিলকের ডুইনো এলিজিতে ঝাঁপ দিতে পারেন। যখন পড়বেন, পড়ার সময়টুকু সেই কবিতার ইতিহাস, সময় কিছুই আপনার মনে থাকবে না। কারণ আপনার সময় দিয়েই আপনার মন কবিতাটিকে আবার লিখে ফেলবে। সেখানে কবি কোথাও নেই। মহৎ কবিতার এটি সবচেয়ে বড় গুণ, যে, এটি স্থানিক সময়কে ভেঙে দিয়ে এক ধরনের জায়মান সময় তৈরি করে। অনেকটা রিলেটিভিটির মতো। আমি পড়ছি যখন, তখন আমার সময় ও কবিতাটির ভাবনা রূপ অরূপ মিলেমিশে তৈরি করছে একপ্রকার যুগ্ম অস্তিত্ব। যেখানে এই যুগ্ম অস্তিত্ব তৈরি হয় না, সেখানে কবিতাটি প্রত্নের মতো পড়ে থকে। সম্পর্ক স্থাপনে অক্ষম বৃদ্ধ শুধু নিজের সময়ের প্রতিনিধি হয়ে থাকে। তার জীবন যে ব্যর্থ হলো, তা নয়। কারণ ফসিল জীবিত না হলেও ইতিহাসকে জীবন্ত করে। কিন্তু নবজীবন সে লাভ করে না। কবিতা তার কবির চেয়ে অনেক বেশি জীবন নিয়ে থাকে। আর সে ক্ষমতা সব কবিতার মধ্যে থাকে না। কিছু কিছু কবিতার মধ্যেই থাকে। সেই সব কবিতার সংখ্যা আমাদের এই মানবসভ্যতায় খুবই কম। একটি সার্থক ও মহৎ গ্রন্থের ভিতরেও হয়তো তার সংখ্যা দুই কি তিন।
কিন্তু্ বলার কথা এই, সেই দু'টি কি তিনটি চিরজীবিত কবিতার জন্য বেশ কয়েকশো ফসিল কবিতাও লিখে ফেলতে হয়। কারণ প্রতিটি ব্যর্থ কবিতার মধ্যেই থাকে চিরজীবিত কবিতা হয়ে ওঠার সম্ভাবনা। আমরা কেউই জানি না, কোন কবিতা আবার নবজীবন লাভ করবে। ভাবুন, কতটা অপ্রত্যাশিত একটা শিল্প নিয়ে কথা বলে গেলাম এতটা। জয় গোস্বামীর ‘দৈব’ কবিতার এই অপ্রত্যাশিত’ জায়গাটিই তুলে ধরছে আমাদের কাছে। কিন্তু, জয় গোস্বামীকে বাদ দিয়েও যদি এই কাব্যগ্রন্থটি পড়া যায়, কবিতাগুলি আমাদের কাছে উঠে আসে, এক চিরকালীন বন্ধু হিসেবে। “কোথায় আমায় ডুবিয়ে নিল কাঁটাবিহীন ঘড়ি” (ঘড়ি) এই কথাগুলি প্রতিধ্বনিত হয় যখন আমরা পড়ি খণ্ডে খণ্ডে এমন এক অখণ্ডভাবনাকে, যা পার্থিব অথচ মহাজাগতিক।