মস্তানের বাইকে মুখ্যমন্ত্রীর বউ! বাঘাযতীনের মস্তান কানা অজিত আজও কিংবদন্তি

Political Goons of South Kolkata: বড়শির কাঁটা চোখে গেঁথেছে বুঝে কাঁটা ছাড়াতে উল্টোদিকে ফিরতি টান মারলেন অজিত। পরিণতিতে চোখ উপড়ে চলে এল।

দক্ষিণ কলকাতার মস্তানদের গতিবিধি বুঝতে গেলে রাজনৈতিক পরিবেশটা একটু বুঝে নেওয়া উচিত। দক্ষিণ কলকাতা শহরতলি জুড়ে উদ্বাস্তু মানুষের ঢল নেমেছিল তখন। ক্রমে এই শহরতলি জুড়ে বাম রাজনীতি জোরালো হয়ে ওঠে। এইসব অঞ্চল বাম রাজনীতির প্রাবল্যের এলাকার চেয়েও হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির গড় হতে পারত, যদি না শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় প্রয়াত হতেন অকালে।

ক্রমে এই শহরতলি জুড়ে বাম রাজনীতিই মূল স্রোত হয়ে দাঁড়াল। ষাটের দশকে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার তৈরি হল ১৯৬৭ সালে। এই শহরতলি জুড়ে আরএসপি, সিপিআই এবং সিপিআইএমের বড় বড় নেতা কর্মীরা ছিলেন। এই পরিস্থিতিতে খড়িবাড়ি, নকশালবাড়ি, ফাঁসিদেওয়ায় কৃষক বিদ্রোহ দমনে পুলিশের গুলি চালনায় ন'জনের হত্যার ঘটনা ঘটল। এই ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হল সিপিআইএমের অন্দরে। পুলিশমন্ত্রী জ্যোতি বসুর ভূমিকার তীব্র সমালোচনা শুরু হল। সিপিআইএম পার্টি নয় চাই 'প্রকৃত বিপ্লবী' দল— এই আওয়াজ জোরদার হল দিকে দিকে। শেষে ১৯৬৯ সালে জন্ম নিল নতুন দল সিপিআইএমএল।

সারা রাজ্যের মতোই দক্ষিণ শহরতলির বামমনস্ক পরিবারগুলির ছাত্র-যুবরা রাতারাতি হয়ে উঠলেন নকশালপন্থী। কসবা, ঢাকুরিয়া, যাদবপুর, হালতু, বিজয়গড়, বাঘাযতীন, টালিগঞ্জ পূর্ব ও পশ্চিম পুঁটিয়ারি, কুঁদঘাট, ব্রহ্মপুর, গড়িয়া এইসব অঞ্চল ক্রমে যেন নকশালপন্থীদের গড় হয়ে উঠল। এইসব অঞ্চলে নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের মধ্যে এই ছাত্র-যুবদের প্রতি ছিল অসীম শ্রদ্ধা। মেধাবী ছাত্র প্রবীর রায়চৌধুরী বা স্কোয়াড কমান্ডার ননী আইচরা যেমন ছিলেন, ছিল স্থানীয় অসংখ্য নাম। তবে দক্ষিণ শহরতলির অবিসংবাদী নকশাল নেতা ছিলেন আশু মজুমদার। এই রাজনীতি গোটা অঞ্চলে ছেয়ে গিয়েছিল।

আরও পড়ুন- ‘চাকরি দিলাম, মা-কে খাওয়াবি’! জ্যোতি বসুকেও থামিয়ে দিতেন মস্তান-মন্ত্রী রাম চ্যাটার্জি

সে এক রক্তাক্ত সময়। নকশালপন্থীদের হাতে অস্ত্র। পুলিশের পাইপগান ছিনিয়ে নিচ্ছে তারা। ডাক গাড়ি এলাকায় ঢুকলে পাহারাদারের বন্দুক ছিনিয়ে নিচ্ছে। অন্যদিকে সিপিআইএমও সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। তাদের সমর্থক পরিবারগুলি থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে নকশাল হচ্ছে। জমি হারাচ্ছে সিপিআইএম। প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। এই পরিস্থিতিতে দক্ষিণের কংগ্রেসের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগাযোগে থাকা মস্তানরা কী করছেন এলাকায় এলাকায়? এটা বিশদে বুঝতেই রাজনৈতিক পরিস্থিতির ছবিটা তুলে ধরলাম।

এই সময় কোথাও কংগ্রেসপন্থী মস্তানরা সিপিএম এবং নকশাল উভয়কেই এলাকা ছাড়া করছে। কোথাও আবার সিপিএম সিআরপিএফ-কে দিয়ে নকশাল যুবক ধরিয়ে দিচ্ছে। কোথাও আবার কোণঠাসা নকশাল যুবক কংগ্রেস মস্তানের আশ্রয় নিচ্ছে বা কংগ্রেসের যুবক মস্তান নকশালিদের সঙ্গে ভিড়ে যাচ্ছে। এদেরকেই সিপিএম কংশাল বলতো, অন্তত ঢাকুরিয়া-টালিগঞ্জে এই শব্দবন্ধ জনপ্রিয় ছিল।

সব দল সশস্ত্র। সবাই সবার ত্রাস। অদ্ভুত সে এক সময়! কংগ্রেসের চোখে ত্রাস ঢাকুরিয়ার কার্ল মার্ক্স বাদল গুহ। আবার যাদবপুর-টালিগঞ্জে কংগ্রেস সমালোচনা করে সিপিএমের তিন নেতার। ওরা বলত, "টালিগঞ্জের তিন অসুর / শচিন-মনোজ-প্রশান্ত শুর"। পরবর্তীকালে এরা সবাই জন প্রতিনিধি হয়েছিলেন। আবার নেতাজি নগরের সিপিএম সমর্থকদের কাছে ত্রাসের এবং ঘৃণার অপর নাম ছিল বিজয়গড়ের নিখিল বসু রায়। সিপিএম বলত নিখিল গুন্ডা। ছিল আজাদগড়ের সজল ও কাজল নামের দুই ভাই, যারা রাস্তায় বের হলে নাকি এলাকায় কার্ফিউ লেগে যেত! চাকু-ভোজালির হাত বাজিতে সিদ্ধহস্ত। আজাদগড়, বিজয়গড়ের পাশ দিয়ে গলফ ক্লাবের মাঠ। বাতাসে ভেসে আসত কত গল্প। ওই মাঠে নিয়ে গিয়েই নাকি কত সিপিএমের ছেলের গলা কেটেছে কংগ্রেসের মস্তানরা। এসব কথা বাতাসে ভেসে থেকেছে বছরের পর বছর।

তেমনই নিখিল মস্তানকে নিয়ে কত যে গল্প ঘুরেছে মানুষের মুখে মুখে! বিজয়গড়ের এই কংগ্রেসি বাহুবলীকে ঘিরেই বিজয়গড়ের কংগ্রেস আবর্তিত হতো সেই সময়। বিজয়গড়ে কংগ্রেসের অস্তিত্ব জোরালো ছিল। এই অঞ্চলে সন্তোষ দত্তর মতো স্বাধীনতা সংগ্রামী কংগ্রেস নেতা ছিলেন। নিখিল বসু রায়রা ছিলেন সন্তোষ দত্তরই শিষ্য। যাদবপুর থানার এক অফিসার ছিলেন মোহন্তি। এই মোহন্তি কংগ্রেস আশ্রিত বাহুবলীদের সঙ্গে মিলে এলাকার সিপিএম-নকশাল দমনে সক্রিয় ভূমিকা নিতেন। বিজয়গড়ে কংগ্রেস সংস্কৃতি ছিল। বড় বড় কালীপুজো হতো। নিখিল মস্তানও ছিলেন স্বমহিমায়।

পাশে নেতাজি নগর ছিল সিপিএমের গড়। গাছতলা থেকে বিবাদী বাগের বাস ছাড়ত এই রাস্তায়। স্বাভাবিকভাবেই নেতাজি নগরের লোকজন সেই বাসে থাকতেন। এই বাসগুলিকে টার্গেট করত নিখিল বাহিনী। বাস রাণীকুঠি পেরলেই নিখিল বাহিনী দাঁড়িয়ে পড়ত রাস্তায়। বাস দাঁড় করিয়ে চলত সার্চ। "কয়ডা সিপিএম আছস নাইম্যা আয়"— এমন ঘটনা ঘটত দিনের পর দিন। বিজয়গড় বনাম নেতাজি নগরের মধ্যে চলা রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে অফিস যাত্রা রীতিমতো ত্রাসের হয়ে উঠেছিল সেই সময়। এই দ্বন্দ্ব বহুমাত্রিক। পাড়ায় পাড়ায় অসন্তোষ। প্রতি পাড়ায় দু'জন করে মস্তান। কথায় কথায় মারপিট, হাতাহাতি, বোমা। এপাড়া ওপাড়া টেনশন। অতি অস্থির এক অধ্যায়। তবে নিখিল বসু রায় সম্পর্কে বাইরের লোক যাই ভাবুন না কেন, বিজয়গড়ের বহু মানুষ তাঁকে সমীহ করতেন। সত্তরের উত্তাল সময়ে তিনি পাড়ার বহু সিপিএম সমর্থকদেরও নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন। গলফ ক্লাবের মাঠে কাউকে মারতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, এমন শুনে ছুটে গিয়ে জীবন বাঁচিয়েছেন নিখিল, এমন ঘটনাও বহু ঘটেছে।

আরও পড়ুন- ভবানীপুরের ডন, কুঁদঘাটের বোম! দক্ষিণ কলকাতা কাঁপাতেন যে মস্তানরা

নিখিল বসু রায় একজন রাজনৈতিক চরিত্র। সিপিএমের চোখে তিনি ছিলেন ত্রাস তবে বহু মানুষের কাছেই নিখিল ছিলেন ত্রাতা। একটা গল্প বলি। শ্রীকলোনির নকশাল স্কোয়াড কমান্ডার পণ্ডিত দাস এখনও বেঁচে আছেন বহু স্মৃতি আর গল্প বুকে আগলে রেখে। এ গল্প তাঁরই। পণ্ডিত দাস বলছেন,

"নিখিলদা ছিলেন সূর্যের মতো। তাঁকে ঘিরেই যাদবপুর-বিজয়গড়ের কংগ্রেস। আমাদের এখানে, মানে চাষিপাড়ায় পাঁচজনকে খুন করে সিপিএম। নেতাজি নগরের এক প্রভাবশালী নেতার নাম জড়িয়েছিল এই খুনে। এই খুনের পর আমি পার্টি নেতা আশু মজুমদারের কাছে যাই। বলি, ওদের কাছে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র আছে, আমাদের এই পাইপ গান দিয়ে কীভাবে লড়াই করব? আশুদা বললেন, পাঁচজন চলে গেছে। তোরা ওখান থেকে আশেপাশে কোথাও শেল্টার নে। সেই সময় আমি আমাদের সম্পূর্ণ বিপরীত রাজনীতিতে থাকা, পাশের এলাকার বাসিন্দা হিসেবে পরিচিত নিখিল বসু রায়ের সঙ্গে কথা বলে বিজয়গড়ে শেল্টার নিই। কংগ্রেসের সঙ্গে আমরা দূরত্ব বজায় রাখতাম। কংগ্রেসের হাতে খুনের ঘটনা ঘটলে আমরা সিপিআইএমএল-এর নামেই পোস্টার দিতাম, ঘটনার বিরোধিতা করে। স্থানীয় সিপিএম সমর্থকরা চাইত আমি ওদের বাড়ি দুপুরের খাবারটা খাই। সাধারণ মানুষ পছন্দ করত। যাইহোক, বিজয়গড়ে আত্মগোপন করতে পেরেছিলাম নিখিলদার আশ্রয়েই। ওঁকে গুন্ডা-মস্তান যাই বলা হোক না কেন, আমি কিন্তু বলব খুব বড় হৃদয়ের মানুষ। খুব বড় মন ছিল। সেই সময় পার্টির ভেতরে সাধারণ পুলিশকর্মী খুন করার ঘটনাকে আমি সমালোচনা করছিলাম। বলছিলাম, সাধারণ পুলিশ কর্মীরা আমাদের শ্রেণিশত্রু নয়। এই খতম লাইন নিয়ে প্রশ্ন তোলায় পার্টির ভেতরেই অনেকে আমার শত্রু হয়ে উঠেছিল। আমাদের এলাকায় পাঁচ কর্মী খুনের পর আমাকে পার্টির তরফেও অনেক জায়গায় যেতে বলেছিল কিন্তু সেই সময় পার্টি লাইনের বিরোধিতা করায় পার্টির ভেতরে কারও আশ্রয়ে গেলে কী পরিণতি  হবে ভেবে পাশের এলাকাতেই আত্মগোপন করি। আত্মগোপনের ব্যাপারে ভিন্ন মতাদর্শের হলেও কংগ্রেসের ওই নিখিলদা সাহায্য করেছিলেন।"

বিজয়গড়ে র নিখিল বসু রায় ছাড়া ওই তল্লাটে আরেক ত্রাসের নাম ছিল কানা অজিত। আসল নাম অজিত দত্ত। বাঘাযতীনে বিদ্যাসাগর বলে একটা এলাকা আছে। সেই অঞ্চলেরই বাসিন্দা কানা অজিত। কানা অজিতকে নিয়ে গল্পের শেষ নেই। এই ২০২৪-এও তাঁর গল্প কোনও কোনও বৃদ্ধের মুখে ফেরে।

নকশাল নেতা পণ্ডিত দাস

কানা অজিতের ছিল মাছ ধরার নেশা। বিদ্যাসাগরে একটা বিরাট জলাশয় আছে। ওই পুকুরেই মাছ ধরতেন অজিত। একদিন বিপুল নেশা করে মাছ ধরতে বসেছেন। ছিপ ফেলেছেন জলে। হঠাৎ অজিতের মনে হল মাছ টোপ গিলেছে। দিলেন এক টান। বড়শির কাঁটা গিয়ে গেঁথে গেল নিজেরই চোখে। বড়শির কাঁটা চোখে গেঁথেছে বুঝে কাঁটা ছাড়াতে উল্টোদিকে ফিরতি টান মারলেন অজিত। পরিণতিতে চোখ উপড়ে চলে এল। এক চোখ হারিয়ে এভাবেই অজিত দত্ত হলেন কানা অজিত। আর এলাকার সিপিএমের কাছে হয়ে উঠলেন ত্রাস। আসলে যুক্তফ্রন্ট আমলে এলাকাছাড়া হতে হয়েছিল কানা অজিতকে। ৭২ সালে কংগ্রেস ক্ষমতায় ফিরতেই এলাকায় ফিরলেন কানা অজিত। বিদ্যাসাগরের পুকুর পাড়ে যেখানে নিজগুণে চোখ হারিয়েছিলেন সেখানেই সিপিএম কর্মীদের ভরদুপুরে গুলি করে হত্যা করেন অজিত। ভয়ভীতির পরিবেশ ছিলই, এবার অজিতের কল্যাণে তীব্র আতঙ্ক দেখা দেয় বাঘাযতীন, চাষিপাড়া, বিদ্যাসাগর অঞ্চলে।

তখন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায়। তাঁর মন্ত্রিসভায় স্থান পেয়েছেন ছাত্র পরিষদের তরুণ তুর্কি সুব্রত মুখার্জি। অনেকেই বলছেন, বাহাত্তরে কংগ্রেস ক্ষমতায় পৌঁছেছে ছাত্র পরিষদের লাগাতার আন্দোলনের জেরে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পাশাপাশি প্রিয় দাশমুন্সির এলাকাভিত্তিক যুবক সমিতি মডেল। সামনে যুবকসমিতি ও কালীপুজো, পেছনে নকশাল দমনে সশস্ত্র বাহিনী। ফলে সিদ্ধার্থ শংকরের জমানায় এই মস্তানদের বাড়বাড়ন্ত দেখা দিল বিভিন্ন এলাকায়। কানা অজিতও এই তালিকায় এক উজ্জ্বল সংযোজন। শোনা যায়, কানা অজিতকে ব্যক্তিগতভাবেও চিনতেন সিদ্ধার্থ শংকর। কানা অজিতকে কোনও অনুষ্ঠানে দেখলে মঞ্চ থেকেই বলতেন, "দত্ত বাবুকে বসান।" মুখ্যমন্ত্রী চেনেন এমন মস্তান এলাকা দাপাবে এটাই তো স্বাভাবিক! এই সময়েই ঘটে গেল সেই ঘটনা যা অজিতকে এলাকায় গল্পের নায়ক করে দিল।

১৯৭২-৭৩ সাল নাগাদ বাঘাযতীন অঞ্চলে এক অনুষ্ঠানে আসার কথা মুখ্যমন্ত্রী-জায়া মায়া রায়ের। দক্ষিণ শহরতলির রাস্তাঘাট, পরিকাঠামো তখনও তেমন উন্নত নয়। মায়া রায়ের গাড়ি এসে থামল যেখানে, সেখান থেকে অনুষ্ঠান মঞ্চ খানিক দূরে। সরু রাস্তা, গাড়ি ঢুকবে না। মুশকিল আসান হয়ে সামনে দাঁড়ালেন কানা অজিত। বাইক নিয়ে এসেছেন। মায়া রায়কে অনুষ্ঠান মঞ্চ পর্যন্ত পৌঁছে দেবেন। মুখ্যমন্ত্রী-জায়া উঠে বসলেন কানা অজিতের বাইকে। মস্তানের বাইকে মুখ্যমন্ত্রীর বউ! দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল সেই গল্প। সেই গল্প অমর হয়ে গেল সময়ের সীমা পেরিয়ে আজও! এত বছর পরেও কোনও পঁচাত্তরের বৃদ্ধ ঠোঁটের কোণায় হাসি নিয়ে বলেন, "কানা অজিত? মায়া রায়রে বাইকে চাপাইয়া ঘুরাইসিল!"

আরও পড়ুন- মস্তানদের গুরুত্বপূর্ণ অ্যাসাইনমেন্ট দিতেন কংগ্রেসের বদুবাবুই

তবে সার্বিকভাবে দক্ষিণ কলকাতার মস্তানতন্ত্রের শিকড় লুকিয়েছিল আরও গভীরে। দক্ষিণ কলকাতার প্রবাদপ্রতিম মস্তান ছিলেন ননী দত্ত। কুঁদঘাট অঞ্চলে কোনও বাচ্চা রাতে খাওয়া নিয়ে জেদ করলে মা বলতেন, 'বাবা খেয়ে নে, নাহলে ননী দত্ত চলে আসবে!' এহেন ননী দত্ত কসবা, বালিগঞ্জের ওয়াগন ব্রেকারদের সিন্ডিকেট চালাতেন। তার মাথায় হাত ছিল কলকাতার প্রথম সারির মস্তান ইনু মিত্তিরের। এটাই বড় ব্যাপার কারণ ইনু মিত্তির ভানু বোস নেটওয়ার্কের অন্যতম এক নাম। রাজ্য জুড়ে তার দুষ্কর্মের জাল বিছানো।এই নেটওয়ার্কেরই অংশ ননী দত্ত। এই জায়গাতেই কুঁদঘাটের মস্তান হলেও ননী দত্ত এলাকার মস্তান নন, রীতিমতো ডন! এই ননী দত্তরই হাতে তৈরি কুঁদঘাটের বোম। ননীর ছেলে বাপি দত্ত-ও ছিলেন এক বাহুবলী।

যাইহোক, এই ইনু মিত্তিরকে আমরা সক্রিয় দেখছি দক্ষিণে। সরাসরি না সামনে এলেও বহু বাহুবলীর অনুপ্রেরণা তিনি। যেমন, টালিগঞ্জের ফ্যাতন গোস্বামী। কাজকর্ম তেমন কিছুই করেন না অথচ দিব্যি চলছে রংবাজি করে। অনেকের ধারণা, ভানু বোসের ডাকাতি নেটওয়ার্কে ইনু মিত্তিরের হাত ধরে যোগ ছিল ফ্যাতন এবং ননীর। ফ্যাতন যে অঞ্চলে দাদাগিরি করতেন সেই অঞ্চলে বহু মুসলিম পরিবারের বাস ছিল। ফ্যাতনের কাজকর্মে কিছু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার অভিযোগ রয়েছে। এর একটা বড় কারণ হতে পারে, এইসব অঞ্চলে মুসলিম পরিবারগুলিকে হটিয়ে দিয়ে হিন্দু বসতি স্থাপিত হয়েছিল দেশভাগের পর। এই একই ঘটনা সেলিমপুর, ইব্রাহিমপুর রোড জুড়েও হয়েছিল। এ ধরনের ঘটনায় ফ্যাতনের যোগাযোগ থাকতে পারে।

সেই সময়ের আখ্যানে কসবা অঞ্চলের এক শ্যুটারের নাম পাওয়া যাচ্ছে। হরিহর ব্যানার্জি। তিনিও ইনু মিত্তির নেটওয়ার্কের। ইনু মিত্তিরের আরেক খাস লোক ছিল শ্রীকলোনি অঞ্চলের কার্তিক দাস। যারা তাকে চিনতেন তাদের মতে, কার্তিক স্বল্প বুদ্ধিসম্পন্ন হওয়ায় ইনু মিত্তির তাকে দিয়ে যাবতীয় দুষ্কর্ম করাত। ইনু মিত্তির নিজে এক সময় শ্রীকলোনি অঞ্চলে থেকেছেন। তার মানে মধ্য কলকাতার মস্তানদের নিয়ন্ত্রণ ইনুর মাধ্যমে দক্ষিণেও কমবেশি ছিল। কসবা অঞ্চলে দেবা নামে এক প্রসিদ্ধ মস্তান ছিলেন, যিনি প্রয়াত সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের লোক বলে পরিচিত ছিলেন। দেবার গল্প একটা স্বতন্ত্র আখ্যান! তবে উত্তাল সত্তরে দক্ষিণের মস্তানরাও রাজনীতির ওঠা পড়ায় সক্রিয়ভাবেই জড়িয়ে ছিলেন।

More Articles