ইদ সবার উৎসব হোক, কেন চান না রাজনীতিবিদরাই?
Eid 2023: অনেক মুসলমান ধর্মাবলম্বী মানুষ রমজান মাসে শুধু ইফতারের পরের খাওয়াদাওয়া নিয়ে অ-মুসলমানদের আগ্রহ নিয়ে আপত্তি তুলছেন।
আজ ইদ। গত ৩০ দিন ধরে রমজান মাসে মুসলমান ধর্মাবলম্বী মানুষরা রোজা রেখেছেন। সারা দিনের উপোস। সন্ধেবেলায় নামাজের পর উপোস ভেঙেছেন। এর মাঝেই দেশের এবং এই রাজ্যেরও বিভিন্ন জায়গায় হিন্দুদের রামনবমী উৎসবের সময় হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক হিংসা হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় রামনবমীর মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছেন বিজেপির ছোট-বড় নেতারা। মসজিদের সামনে দিয়ে রামনবমীর মিছিল গেছে। তা নিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়েছে। ইঁট-পাটকেল ছোঁড়া হয়েছে। আগুন জ্বালানো হয়েছে। শাসকদলের প্রশাসনিক অব্যবস্থা চোখের সামনে এসেছে। তা নিয়ে রাজনৈতিক তরজাও চলেছে। আপাতত সেই হিংসার খবর হেডলাইন থেকে সরে গেছে। কিন্তু ক্ষত রয়ে গেছে। রয়ে যায়। মানুষের মনে।
রেড রোডে ইদের নামাজের শেষে প্রতি বছরের মতো এবারও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের বক্তব্য রেখেছেন। ইদের শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি তিনি বেশি সময় ব্যয় করেছেন রাজনৈতিক কথায়। বিজেপিকে রুখতে মুসলমান সমাজকে এক হতে বলেছেন। ভোট যাতে ভাগ না হয়ে যায়, সেই আবেদন করেছেন। ভরসা দিয়েছেন তিনি ওঁদের সঙ্গে রয়েছেন। ধর্মীয় আচার পালন হোক বা উৎসবের দিন- রাজনীতিকে বাইরে রাখা যায়নি।
রাজনীতিকরা নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য যে ধর্মকে ব্যবহার করেন তা ঐতিহাসিক সত্য। পৃথিবীর ইতিহাস ঘাঁটলে রাশি রাশি উদাহরণ পাওয়া যাবে। আবার ধর্মও যে রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে তার প্রমাণও হাতে গরম মেলে। পশ্চিমি দুনিয়ায় চার্চ ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক যে একে অন্যের পরিপূরক ছিল তাও আমরা দেখেছি। ইসলামিক রাষ্ট্র তো আজও আছে।
আরও পড়ুন- সাগরদিঘি উপনির্বাচনের ফলাফলের বার্তা: সংখ্যালঘুরা শুধু ভোটব্যাঙ্ক নন
এ কথা ঠিক যে সমাজকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে রাখতে গেলে রাজনীতি ছাড়াও আরও কিছু লাগে যা রাজনীতি বহির্ভূত। নাগরিক সমাজকে একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত রাখতে গেলে, একটি কাঠামোর মধ্যে ধরে রাখতে গেলে শুধু রাজনীতির কথায় তা হয় না। ধর্ম এমনই একটি রাজনীতি-বহির্ভূত বিষয় যা সামাজিক ও কখনও কখনও রাজনৈতিক নৈতিকতার মানদণ্ড ঠিক করে দেয়। আর ভারতীয় সমাজে তো ধর্ম একটি অপরিহার্য বিষয়। রাজনীতিকরা কখনই সেটি এড়িয়ে যেতে পারেননি। গান্ধিজি থেকে মোদিজি- নিজের নিজের মতো করে রাজনীতিতে ধর্মকে ব্য়বহার করেছেন। আর ভারত তো ধর্মের ভিত্তিতেই দ্বিখণ্ডিত হয়েছে স্বাধীনতার সময়েই। ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলির মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে। তার লালন-পালন হয়েছে রাজনীতিকদের হাত ধরেই।
কিন্তু এই ধর্ম ও রাজনীতির সমীকরণটি অত জটিল হয় না যখন সমাজ একমাত্রিক হয়। একটি ধর্মের উপর ভিত্তি করে যখন রাষ্ট্র পরিচালনা করা হয়, তখন সমস্যা কম। কিন্তু ভারতের মতো বহু ধর্ম, ভাষা, জাতির দেশে এই সমীকরণ সোজা নয়। তার উপর যেখানে ধর্মকে রাষ্ট্রের থেকে আলাদা রাখা ও নিজের নিজের ধর্ম পালনকে সাংবিধানিক অধিকার দেওয়া হয়েছে।
একই সঙ্গে এ দেশে রাজনীতিকরা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে নিজেদের ভোট ব্যাঙ্ক হিসেবে দেখতে শুরু করেছেন অনেকদিন ধরেই। ধর্মীয় নেতারাও ক্ষমতার কাছে থাকার জন্য তাতে ইন্ধন জুগিয়ে চলেছেন। এছাড়াও 'আমার ধর্মই শ্রেষ্ঠ' এই বিশ্বাস তো প্রায় সব ধর্মের ধর্মগুরুর মধ্যেই রয়েছে। সেই আবেগ বাহিত হয়েছে ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেও। আর রাজনীতি ও ধর্মকে আলাদা করা রাজনীতিকদের পক্ষেই সম্ভব হয়নি।
এই জটিল সমীকরণে সাধারণ মানুষ একটি জাঁতাকলে আটকে গেছেন। তাঁরা রাজনীতিবিদ বা রাজনীতির চশমা দিয়েই ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলিকে চিনছেন। কারও কারও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থাকতে পারে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই পরের মুখের কথা নিয়ে চলতে ভালবাসেন। নিজের ধর্ম কারও কাছে শ্রেষ্ঠ হয়ে যায়। কারও কাছে অন্যের ধর্ম ঘৃণার বস্তু হয়ে যায়। অবিশ্বাসের মনোভাব তৈরি হয়। রাজনীতিকরা তার ফায়দা তোলেন।
এই জাঁতাকল থেকে বাঁচার একটিই উপায়। যেহেতু ধর্মকে এড়িয়ে রাস্তা চলা কঠিন, তাই একটি ধর্মের সঙ্গে অন্য ধর্মের সরাসরি আদানপ্রদান বেশি করে হওয়া উচিত। রাজনীতিকদের হাত ধরে নয়। নিজের ধর্মের প্রচার ও ধর্মান্তকরণের উদ্দেশ্যে নয়। শুধু জানা বোঝার জন্য সরাসরি যোগাযোগ।
বিলেতে এই রমজান মাসেই কোনও কোনও মসজিদে অ-মুসলিম নাগরিকদের ডাকা হয়। অ-মুসলিমদের যা অজানা, যা কৌতূহল তা কথাবার্তার মাধ্যমে মেটানোর চেষ্টা হয়। শুধু রমজান মাসেই নয়। বছরের কোনও সপ্তাহান্তে মসজিদের দরজা খুলে দেওয়া হয় সবার জন্য। সেখানে মুসলমানদের নানা আচার-অনুষ্ঠানের ব্যাপারে অ-মুসলমানদের কৌতূহল মেটানোর ব্যবস্থা থাকে। সেখানে নিজেদের ধর্মের প্রচারের থেকেও বেশি গুরুত্ব পায় অন্যদের সঙ্গে সেতু তৈরির কাজটি। সেখানে কেউ ঠিক ঝগড়া করতে যান না। যুক্তি তর্ক চলে। কিন্তু অনেকটাই খোলা মনে।
বিলেতে এই কাজটির প্রয়োজনীয়তা হয়তো অন্য জায়গায়। পশ্চিমি দুনিয়ায় অ-মুসলমানদের মুসলমান-ভীতি দূর করার তাগিদ থেকেই এমন আয়োজন হয়। কিন্তু তার মাধ্যমে অন্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে যোগাযোগ তো বাড়ে। ভ্রান্তি দূর হয়। অবশ্যই এতে দু'পক্ষের উদার মানসিকতা একটি আবশ্যিক শর্ত।
এদেশেও এই যোগাযোগ বাড়ুক। তবেই স্বার্থান্বেষী মহলের অভিসন্ধিকে পরাজিত করা যাবে। দু'টি যুযুধান পক্ষ তৈরি করার ষড়যন্ত্রকে পরাজিত করা যাবে। যুক্তিবাদী মানুষের সংখ্যা বাড়বে। মধ্যপন্থী মানুষের সংখ্যা বাড়বে। যাঁদের সংখ্যা এখন কমে গেছে। তাই রামনবমীর সময় দাঙ্গা চলতে থাকে। মধ্যস্থতা করার কেউ থাকে না। হয় তুমি এপক্ষ বা তুমি অন্য পক্ষ। প্রশাসনও রাজনীতির দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়।
আরও পড়ুন- মানুষের সমর্থন ছাড়া দুর্নীতি হয় না, রাজ্যকে ভাগাড় করেছে জনতাই?
অনেক মুসলমান ধর্মাবলম্বী মানুষ রমজান মাসে শুধু ইফতারের পরের খাওয়াদাওয়া নিয়ে অ-মুসলমানদের আগ্রহ নিয়ে আপত্তি তুলছেন। কলকাতার জাকারিয়া স্ট্রিটে খাদ্যরসিকদের ভিড় দেখে অস্বস্তি বোধ করছেন। তাঁদের বক্তব্য রোজা, ইফতার, জাকাত, তারাবির নামাজের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা কম, খাওয়াদাওয়া নিয়ে আলোচনা বেশি হচ্ছে। হয়তো ঠিক।
কিন্তু এর মাধ্যমেই যদি দু'টি সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে আদানপ্রদানের রাস্তা তৈরি হয়, যদি ইদ পালন ধর্মীয় আচারের থেকে সর্বসাধারণের উৎসবে পরিণত হয় তাহলে ক্ষতি কী!
অনেকটা এভাবেই তো দুর্গাপুজো দুর্গোৎসবে পরিণত হয়েছে। আচারের থেকেও উৎসব বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। এতেই কিছু রাজনীতির কারবারিদের সমস্যা হয়েছে। তাই তো তাঁরা ধর্মীয় প্রতীক, আচারে গুরুত্ব বাড়াতে চেষ্টা করছেন। তাতে অন্য ধর্মের বা ধর্ম থেকে দূরে থাকা নাগরিকদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করা যায়। একই কায়দায় রামনবমীকে রাজনীতির কাদায় ফেলা হচ্ছে। সেই পাঁকে আটকে যাচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
আজ একসঙ্গে ইদ ও অক্ষয় তৃতীয়া। অনেকেই মুসলমান ও হিন্দু ধর্মের দু'টি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি খুঁজে পাচ্ছেন। ভালো। মাঝে মাঝেই আমরা এরকম দু'চারটে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উদাহরণ পেয়ে যাই সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে। যা আসলে ব্যতিক্রমী বলেই গণ্য হয়। এই সম্প্রীতি মূলধারার হোক। রাজনীতিকদের এড়িয়ে হোক। মধ্যপন্থী ও যুক্তিবাদী মানুষের মাধ্যমে এই প্রচেষ্টা সফল হোক।