১১ বছরের খুদের আবিষ্কারে মজেছিল গোটা বিশ্ব, যেভাবে এসেছিল কাঠি আইসক্রিম
১৯০৫ সালে বানানো একটি ১১ বছরের খুদের এই আবিষ্কার এক যুগান্তকারী সৃষ্টি হয়ে রইল। তাই যখনই এরপর পপসিকল মুখে পুরে তার স্বাদ নেবেন, তখন এপারসনের নামটা মনে পড়বেই।
আইসক্রিম খেতে কে না ভালবাসে! ছেলে, মেয়ে, বাচ্চা, বুড়ো সকলেরই আইসক্রিম দেখলে প্রাণের ভেতরটা কেমন ঠান্ডা হয়ে যায়। ছোটবেলায় আইসক্রিম মানেই ছিল পেপসি, একটি প্লাস্টিকের ভেতর সরু বরফ ভরা থাকত আর তার ছিল রংবেরঙের ফ্লেভার, যেমন– ম্যাঙ্গো, ব্ল্যাক কারেন্ট, অরেঞ্জ ইত্যাদি। এরপর আসে কাঠি আইসক্রিম বা পপসিকল, পেপসির মতোই নানা ফ্লেভারে আসত এই কাঠি আইসক্রিম। আর ছিল একটি কাঠির ওপর বরফকুচি দিয়ে তার ওপর নানা রঙের ফ্লেভার দিয়ে দেওয়া, যাকে আজকে আমরা 'গোলা' বলে থাকি। এই ছিল ছোটবেলার আইসক্রিম, আর তা খাওয়ার জন্য স্কুল ছুটি হতে না হতেই দৌড়ে চলে যেত ছেলেমেয়েরা আইসক্রিমের গাড়ির সামনে। টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে কিনে নিতাম একটুকরো সুখ। কাঠি আইসক্রিম, পেপসি- এগুলি খেতে দারুণ লাগত, কিন্তু বাজারে রটনা ছিল যে, এগুলি নাকি ড্রেনের জল বা নর্দমার জল দিয়ে বানানো হয়। সেই কারণে মা-বাবার সামনে এই আইসক্রিম খাওয়া ছিল নৈব নৈব চ। লুকিয়ে লুকিয়ে এই ঠান্ডা সরবতের স্বাদ অনুভব করতে হতো। কিন্তু এই কাঠি আইসক্রিম এল কীভাবে?
এক খুদে বাচ্চার তৈরি জমাট বাঁধা বরফের গোলা সকলের প্রিয় কাঠি আইসক্রিম হয়ে উঠবে, কেইই বা তা ভাবতে পেরেছিল! আর তা এমনই যুগান্তকারী সৃষ্টি হলো যে, বাচ্চা থেকে বুড়ো সকলেই প্রাণভরে তার আস্বাদ গ্রহণ করল। আজ থেকে প্রায় ১১৭ বছর আগের কথা। সালটা ছিল ১৯০৫। বাংলায় তখন বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন চলছে, শহিদ হচ্ছে মানুষ। তখন অন্যদিকে আমেরিকার সানফ্রান্সিস্কোর বে এলাকায় বেড়ে উঠছে ফ্রান্সিস উইলিয়াম এপারসন। কাছের মানুষজন তাকে 'ফ্র্যাঙ্ক' বলে ডাকে। তখন তার বয়স ১১। এই ১১ বছরের খুদেই আবিষ্কার করেছিল কাঠি আইসক্রিম, যার স্বাদ আমরা এখনও পেয়ে থাকি।
ছোট থেকেই ফ্র্যাঙ্কের ভালবাসা ছিল সরবৎ। ছোট্ট খুদের বায়না মেটাতে মাঝে মাঝে বাধ্য হয়ে তাঁর হাতে গ্লাস ধরিয়ে দিত পরিবারের লোকজন। ফ্রান্সিসের এই বায়না শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা কোনওকালেই কোনও বাধা মানত না। এরকমই এক শীতের দুপুরে নিজের বাড়ির বারান্দায় বসে সরবতে চুমুক দিচ্ছিল ছোট্ট ফ্রান্সিস। গ্লাসের ভেতর ছিল চিনিমেশানো সোডা-জল আর একটি কাঠি। এই কাঠি দিয়েই সে গ্লাসের জল অনবরত নাড়াচাড়া করছিল। এর মধ্যে বাড়ির ভেতর থেকে তাকে ডাকাডাকি করা হলে গ্লাস বাইরে রেখেই সে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ে। রাত হলেও গ্লাসের কথা তার আর মনে থাকে না। রাতে ঘুমিয়ে পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে বাইরে বারান্দায় এসে দেখে, এক অদ্ভুত দৃশ্য। গ্লাসের ভেতরের সরবত জমে বরফ হয়ে গেছে, আর তার মাঝখানে কাঠিটা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কি মনে হতেই ফ্রান্সিস কাঠি ধরে টানলে গ্লাস থেকে বরফ কাঠিসমেত তার হাতে চলে আসে। সেই বরফ খেয়ে দেখে ফ্রান্সিস বুঝতে পারে, এই বরফে সরবতের স্বাদই রয়েছে। এইভাবেই তৈরি হলো প্রথম কাঠি আইসক্রিম।
আরও পড়ুন: নাম শুনলেই জিভে জল, কী ভাবে এল আইসক্রিম…
তাঁর এই উদ্ভাবনের কথা সবার প্রথম বন্ধুদের কাছে বলেন ফ্রান্সিস। আর এও বলেন যে, কীভাবে এই কাঠি চেপে ধরে চেটে চেটে এই বরফ খাওয়া যায়। বন্ধুরা উৎসাহিত হলে ফ্রান্সিস তাঁদেরকেও বানিয়ে এনে খাওয়ান। খেয়ে তাঁরাও ওই একই স্বাদ পেয়েছিলেন। প্রশংসাও করেছিলেন তার আবিষ্কারের। এরপরই নিজের পাড়ায় এই কাঠি আইসক্রিম বিক্রি করতে শুরু করেন ফ্রান্সিস। প্রথমে এই বরফ গোলার নাম ছিল– ‘এপসিকল’। তাঁর নিজের পদবির সঙ্গে ‘আইসিকল’ মিশিয়ে তৈরি করেছিলেন তাঁর আইসক্রিমের নাম। বাড়ির আশপাশে এই ‘এপসিকল’ বিক্রি করে কিছু পয়সা রোজগার করেছিলেন তিনি।
এর ঠিক ১৮ বছর পর, ১৯২৩ সালে নিজের এলাকার বাইরে এই আইসক্রিম বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। আর এই আইসক্রিম বিক্রি করার জন্য চূড়ান্ত স্থানও নির্বাচন করেছিলেন– ক্যালিফোর্নিয়ার নেপচুন বিচ নামে একটি বিনোদন পার্ক। ওই পার্কে আসা কচিকাঁচাদের কাছে বিক্রি করেন এই ‘এপসিকল’, তাদের হাত ধরে সুপারহিট হয় এই আইসক্রিম। এই এপসিকলের এত জনপ্রিয়তা দেখে পেটেন্টের জন্য আবেদন করেন ফ্রান্সিস।
১৯২৪ সাল তখন। ততদিনে বিয়ে করেছেন ফ্রান্সিস। তার বাচ্চারা এই ‘এপসিকল'-এর নাম বদলে করল ‘পপ’স সিকল’ যা পরবর্তীকালে ‘পপসিকল’ নামে পরিচিত হয়। সেই নামেই কাঠি আইসক্রিমের পেটেন্ট করিয়েছিলেন ফ্রান্সিস। পপসিকলের প্রথম বিজ্ঞাপনে ফ্রান্সিস লিখেছিলেন,
Frozen confection of attractive appearance, which can be conveniently consumed without contamination by contact with the hand and without the need for a plate, spoon, fork or other implement.
বিজ্ঞাপনে তিনি আরও জানিয়েছিলেন যে, তার আইসক্রিমের কাঠি তৈরি হয় বার্চ বা পপলার গাছের কাঠ দিয়ে।
কিন্তু ফ্রান্সিস এই জনপ্রিয়তার সুখ বেশিদিন নিতে পারেননি। ১৯২০ সালে জো লো কোম্পানির কাছে তিনি এই ‘পপসিকল’-এর সব স্বত্ত্ব বিক্রি করে দেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার কাছে কোনও পুঁজি না থাকায় আমাকে আমার সব সম্পত্তির মালিকানা দিয়ে দিতে হলো।" পপসিকলের মালিকানা দিয়ে দেওয়ার পর তিনি আর আগের মতো ছিলেন না। জো লো সংস্থাই এপারসনের আবিষ্কারকে আরও জনপ্রিয় করে তুলেছিল। ১৯২৯-'৩৯ সালে দেশে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিলে মাত্র পাঁচ সেন্টে তারা একটি প্যাকেটে জোড়া কাঠি যুক্ত দু'টি করে পপসিকল বিক্রি করা শুরু করে। যাতে একই পরিবারের দু'টি বাচ্চার জন্য অত্যন্ত কম মূল্যে পপসিকলের একটি প্যাকেট কেনা যায়।
ইতিমধ্যে বাজারে পপসিকলের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে প্রকট হয়েছিল গুড হিউমার নামে একটি সংস্থা। তারা চকোলেট সাঁটা কাঠি আইসক্রিম বাজারে বিক্রি শুরু করে। এরপর গুড হিউমার সংস্থার বিরুদ্ধে কপিরাইট আইন ভাঙার মামলা ঠুকে দেয় জো লো কোম্পানি। আদালতে রায় বের হয় যে, গুড হিউমার চকোলেট সাঁটা কাঠি আইসক্রিম করবে আর জো লো জমাট বাঁধা বরফের আইসক্রিম বিক্রি করবে। কিন্তু এই রায়ের পরেও তাদের যুদ্ধ থামেনি। মিল্ক পপসিকল বাজারে জনপ্রিয় হতে থাকলে সেই নিয়েও তাদের মধ্যে আরেক যুদ্ধের সূচনা হয়।
১৯৮৯ সালে মধ্যস্থতা করানোর জন্য এগিয়ে আসে ইউনিলিভার কোম্পানি। তারা গুড হিউমারকে কিনে নিলে যুদ্ধের অবসান ঘটে। পপসিকল ব্র্যান্ডের মালিকানাও তারা কিনে নেয়। ফলে দুই পক্ষই একই ছাদের তলায় এসে পড়ে। কিন্তু ততদিনে প্রয়াত হয়েছেন ‘পপসিকল’-এর আবিষ্কারক ফ্রান্সিস এপারসন। ১৯৮৩ সালে এপারসনের মরদেহ ওকল্যান্ডের মাউন্টেন ভিউ কবরখানায় সমাধিস্থ করা হয়। যদিও সেই সময়ে পপসিকলের সঙ্গে নিজেকে পাকাপোক্ত করে ফেলেছেন এপারসন।
ছয়ের দশক থেকে আমাদের দেশে পপসিকল পাওয়া যায়। বিভিন্ন রঙ বা ফ্লেভার দেওয়া চিনি জল বা দুধ জমিয়ে বাঁশের চ্যাপটা কাঠি দেওয়া আইসক্রিম সকলের প্রিয় ছিল। পরে এতে আরও নানা ফ্লেভার যুক্ত হয়। তবুও আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এত প্রতিযোগিতার মাঝেও কাঠি আইসক্রিমের জনপ্রিয়তা এতটুকু কমেনি। ১৯০৫ সালে বানানো একটি ১১ বছরের খুদের এই আবিষ্কার এক যুগান্তকারী সৃষ্টি হয়ে রইল। তাই যখনই এরপর পপসিকল মুখে পুরে তার স্বাদ নেবেন, তখন এপারসনের নামটা মনে পড়বেই। এই দ্রব্যমূল্যের বাজারে আজও পপসিকল কম দামে বিক্রি হয়। আবার বিভিন্ন ব্র্যান্ডের আলাদা ফ্লেভারের পপসিকলও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। অনুমান করা হয়, আজকের দিনে দাঁড়িয়ে প্রতি বছরে ২০০ কোটি পপসিকল বিক্রি হয়। তবে কাঠি আইসক্রিমের আবিষ্কারের কোনও প্রামাণ্য তথ্য না পাওয়া গেলেও এপারসনই যে তার জনক তা বলাই বাহুল্য।