বুড়ো হাড়ে ভেলকি রোনাল্ডোর, শেষ ইউরোয় অমরত্বের হাতছানি
Cristiano Ronaldo: অনেক বিশেষজ্ঞ বলেছিলেন, তাঁকে বেঞ্চে রাখাটাই এখন ভালো কিন্তু কোচ সবসময়ই রোনাল্ডোর পাশে ছিলেন।
ফুটবল দুনিয়ায় একের পর এক রেকর্ড গড়ার পরেও সমর্থকদের একাংশের চোখে তিনি ছিলেন স্বার্থপর। পেনাল্টি নেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি বেশি আগ্রহ প্রকাশ করলেই যেন সমর্থকদের চক্ষুশূল হয়ে উঠতেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো। ফুটবল দুনিয়ায় সমালোচকের সংখ্যা তাঁর কম নয়। অনেক সময় বিশেষজ্ঞরাও তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন, মাঠে শুধুমাত্র তিনি শুধু নিজের গোলের কথাই ভাবেন। সতীর্থদের নাম গোল তালিকায় এল কিনা, তা নিয়ে রোনাল্ডোর মাথাব্যথা নেই। শুধু নিজের রেকর্ড করলেই হলো। কিন্তু, তুরস্কের বিরুদ্ধে সেই নিন্দুকদেরই মুখ বন্ধ করে দিলেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো।
ডিফেন্স চেরা দৌড় নিয়ে গোলরক্ষককে একা পেয়ে গিয়েছিলেন তিনি। সোজা শট মিললেই গোল হওয়ার সম্ভাবনা ৯৯% কিন্তু তিনি শট নিলেন না, বরং বলটা বাড়িয়ে দিলেন পাশেই থাকা ব্রুনো ফার্নান্দেজের দিকে। খালি গোলপোস্টে বল জালে জড়াতে ভুল করলেন না ব্রুনো। আর এই গোলের মধ্যে দিয়েই তুরস্কের বিরুদ্ধে নতুন রেকর্ড গড়ে ফেললেন রোনাল্ডো নিজেই। এখনও পর্যন্ত, রেকর্ড অনুযায়ী ইউরো টুর্নামেন্টে সবথেকে বেশি সব মিলিয়ে আটটি অ্যাসিস্ট করেছেন তিনি। এর থেকে বেশি অ্যাসিস্ট কোনও খেলোয়াড়ের এই মুহূর্তে নেই। একটা সময় তাঁর নামের পাশে ইউরো কাপের সব থেকে বেশি গোল করার রেকর্ড ছিল। তবে এবার, তার মুকুটে জুড়ল আরও এক নতুন পালক।
আরও পড়ুন- একটানা ঘুমান না রোনাল্ডো, তবুও থাকেন টগবগে মেজাজে, যে রহস্য লুকিয়ে তাঁর দৈনন্দিন জীবনে
এতদিন পর্যন্ত সর্বোচ্চ গোলদাতার কীর্তি ছিল এই পর্তুগিজ তারকার। ষষ্ঠবারের জন্য ইউরো কাপ খেলতে নামার আগে ১৪টি গোল করেছিলেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো। রেকর্ড অনুযায়ী, বর্তমানে ইউরোতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা মিশেল প্লাতিনি। ফরাসি এই কিংবদন্তির গোল সংখ্যা বর্তমানে ৯টি। ফলে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর সঙ্গে তাঁর ব্যবধান বিরাট। আর এই ব্যবধান ভেঙে ফেলা খুব একটা সহজ কাজ হবে না বড় বড় ফুটবলারদের পক্ষেও।
তবে, তুরস্কের বিরুদ্ধে খেলার দিন নিজের নামের পাশে ১৭ গোলের রেকর্ড রাখতে পারতেন তিনি। তা না করে বরং এই 'স্বার্থপর' খেলোয়াড় নিজের সতীর্থকে এগিয়ে দিলেন বল। ভক্ত তো বটেই, এই ম্যাচের শেষে রোনাল্ডোর এই কীর্তির প্রশংসা করলেন খোদ পর্তুগিজ কোচ রবার্তো মার্টিনেজ। সাংবাদিক সম্মেলনে কোচ বললেন,
"আজ রোনাল্ডো যেটা করে দেখাল, সেটা সবার কাছেই শিক্ষণীয়। নিজে গোল করার সুবর্ণ সুযোগ ছিল। পুরো বলটা কাটিয়ে নিয়ে এসেছিল রোনাল্ডো কিন্তু শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত বদল। গোলের সামনে দাঁড়িয়েও ব্রুনোকে পাশ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল রোনাল্ডো। শুধুমাত্র পর্তুগাল কেন, সারা বিশ্বের উঠতি ফুটবলারদেরও এই জিনিসটা শেখা উচিত।"
পর্তুগালের বিরুদ্ধে এই ম্যাচে তুরস্ক প্রথম থেকেই কিছুটা আন্ডারডগ ছিল। একাধিক সুযোগ পেয়েও কাজে লাগাতে পারেনি তুরস্ক। পর্তুগাল প্রথমার্ধেই দু'টি গোল করে নিয়েছিল। তার মধ্যে একটি ছিল তুরস্কের আত্মঘাতী গোল। তবে, এই ম্যাচে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ কিন্তু আগে পেয়েছিল তুরস্ক। হাইভোল্টেজ ম্যাচের ঠিক ছয় মিনিটের মাথায় তুরস্কের কাছে এসেছিল বিরাট সুযোগ। আকতুরকোগলু সামনে থেকে বল পেয়েও কাজে লাগাতে পারেননি সেই সুযোগ। মাত্র দুই গজ দূর থেকে গোলপোস্ট লক্ষ্য করে শট করতে পারলেন না তিনি। এটাকে স্রেফ ব্যর্থতা বললেও হয়তো ভুল বলা হবে। আর এই ব্যর্থতার পরেই, ম্যাচের চাপ বাড়াতে শুরু করে পর্তুগাল। ফলে সহজেই তুরস্কের হাত থেকে ম্যাচ বেরিয়ে যায়।
প্রথমদিকে কিন্তু পর্তুগাল গোল পায়নি। ২২ মিনিটের মাথায় বার্নার্ডো পর্তুগালের হয়ে প্রথম গোলটি করেন। সুযোগ ছিল রোনাল্ডোর কাছে, তবে তিনি শেষ মুহূর্তে বল পায়ে লাগাতে পারেননি, সেই কারণে পাশে থাকা বার্নার্ডোর কাছে পৌঁছে যায় লিয়াওয়ের দুরন্ত ক্রস। ২৮ মিনিটের মাথায় তুরস্ক একটা ক্ষমাহীন ভুল করে। নিজের গোলেই বল ঢুকিয়ে ফেলেন আকায়দিন। নিজের গোলকিপারকে ব্যাক পাস দিতে গিয়ে এই ভুলটি করে ফেলেন তিনি। তিনি পাস দেবার সময় দেখতেই পাননি তাঁর গোলকিপার ঠিক কোন জায়গায় রয়েছেন। ফলে অঘটন ঘটে যায় খুব সহজেই।
দ্বিতীয়ার্ধে ২-০ গোলে এগিয়ে থেকে আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলতে শুরু করে পর্তুগাল। রোনাল্ডো নিজেই বেশ কয়েকটি শট নেন। তবে গোলের মুখ খুলতে পারেননি তিনি। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে কিছুটা খেলায় ফেরে তুরস্ক। দ্বিতীয়ার্ধে তুরস্কের কাছে আসে বেশ কয়েকটি সুযোগ কিন্তু একটি সুযোগেও পর্তুগালের গোলপোস্টে বল জড়াতে পারেননি তুরস্কের খেলোয়াড়রা। উল্টে ম্যাচের ৫৬ মিনিটের মাথায় তৃতীয় গোলটি করে ফেলে পর্তুগাল। আর এটাই ছিল সেই গোল, যার কারণে ইউরোর আরও একটি নতুন রেকর্ড নিজের নামে করে নেন রোনাল্ডো। শেষ আধঘণ্টায় কোনও গোল না হলেও, সহজ জয় দিয়ে শেষ ষোলোর রাস্তা পরিষ্কার করেছে পর্তুগাল। ৮টি অ্যাসিস্ট করে চেক প্রজাতন্ত্রের পোবোরস্কিকে ছাপিয়ে এই মুহূর্তে অ্যাসিস্ট তালিকায় এক নম্বরে উঠে এসেছেন রোনাল্ডো।
আরও পড়ুন- বিশ্বকাপ ফাইনালের তখন কয়েক ঘণ্টা বাকি, অজ্ঞান হয়ে গেলেন রোনাল্ডো!
ইউরোর মূল পর্বে সব থেকে বেশি ম্যাচ খেলার কৃতিত্বও এই মুহূর্তে তাঁরই ঝুলিতে রয়েছে। এখনও পর্যন্ত ২৭ টি ম্যাচে মাঠে নেমেছেন তিনি দেশের জার্সি গায়ে। তবুও একইসঙ্গে গোল আর অ্যাসিস্ট বিভাগে সর্বেসর্বা হয়ে ওঠা নিঃসন্দেহে বিশাল ব্যাপার। আর এটাই প্রমাণ করে ফুটবলের জগতে রোনাল্ডোর জায়গা এখনোও কতটা উপরে। অথচ ইউরো ২০২৪ শুরু হওয়ার আগে দলের নিয়মিত একাদশে এই স্ট্রাইকারকে রাখা হবে কিনা, সেই নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন অনেক।
অনেক বিশেষজ্ঞ বলেছিলেন, তাঁকে বেঞ্চে রাখাটাই এখন ভালো কিন্তু কোচ সবসময়ই রোনাল্ডোর পাশে ছিলেন। রোনাল্ডোকে আশ্বাস দিয়ে তিনি বলেছিলেন, আর কেউ পাশে না থাকুক তিনি থাকবেন। সব সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিয়ে দলের সবচেয়ে অভিজ্ঞ খেলোয়াড়ের উপরে ভরসা রেখেছিলেন কোচ মার্তিনেজ। চলতি ইউরোতে এখনও পর্যন্ত তাঁর পা থেকে একটিও গোল আসেনি। গোলের খরা যেন কাটতেই চাইছে না রোনাল্ডোর। আপাতত রোনাল্ডোর পা থেকে গোল আসুক এটাই চাইছে গোটা বিশ্ব। কোচ এখনও এই আশায় রয়েছেন, কবে আবার নিজের পুরনো ফর্ম ফিরবেন রোনাল্ডো! কবে আবার দেখা যাবে সেই বিখ্যাত সেলিব্রেশন! আপাতত গোটা ফুটবল বিশ্ব তাকিয়ে রয়েছে রোনাল্ডোর দিকে। নক আউট পর্বের আগে তিনি যদি নিজের সেরা ফর্মে ফেরেন, তাহলে আরও একবার ইউরো জেতার স্বাদ পেতে পারে পর্তুগাল। এখন এটাই দেখার, কোচ আর সমর্থকদের ভরসার প্রতিদান কতটা দিতে পারেন ৫ বারের ব্যালন ডি'অর জয়ী এই তারকা।