‘আউনি বাউনি’ ভুলেছে বাঙালি, কর্পোরেট যুগে যেভাবে বদলাল পৌষ আগলানোর রেওয়াজ
Poush Sankranti : বাঙালির ঘরে ঘরে কেমন ছিল সেকালের 'আউনি বাউনি' রীতি?
poush-month-rituals-and-maker-sankranti-bengali-traditionবাঙালির লক্ষী মাস পৌষ। তাই তাকে আগলে রাখাই ছিল সেকালের রেওয়াজ। আধুনিকতার সঙ্গে পাল্লা দিতে দিতে ঠিক কতটা সাবেকিয়ানা খুইয়েছে বাঙালি তার হিসেব কষা মুশকিল। তবে কলকাতা ছাড়িয়ে খানিক পথ ভুলেই যদি মফস্বল অথবা গ্রামবাংলার পথে পা বাড়ানো যায় তবে আজও কানে আসে শঙ্খ ধ্বনি। বাতাস ম ম করে পিঠে পায়েসের গন্ধে। পৌষ মাসের এই শেষবেলাটুকু ঘিরে থাকে উৎসবের মহল।
‘আউনি বাউনি চাউনি/তিন দিন কোথাও না যেও/ ঘরে বসে পিঠে-ভাত খেও।’ তিন দিন অর্থাৎ আজ, কাল, পরশু। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে পৌষ সংক্রান্তির আগের দিন, পৌষ সংক্রান্তির দিন এবং পরের দিন। প্রচলিত এই ছড়ার পিছনেই লুকিয়ে রয়েছে বাঙালির চিরাচরিত উৎসব। পিঠে উৎসব।নতুন চালের গুঁড়ি আর নলেন গুড়ের মিশেল, আর তাকে সঙ্গত করছে খাঁটি দুধ। আহা এ স্বাদ যেন অমৃত। চেখে না দেখলে মাহাত্ম্য বোঝা অসম্ভব। আসকে পিঠে, দুধ পুলি, সরুচাকলি, পাটিসাপটা, সেদ্ধ পিঠে, ভাজা পিঠে সব মিলিয়ে লম্বা তালিকা। এক এক পদের এক এক রকম স্বাদ।
মা ঠাকুমার হাতে তৈরি সেই স্বাদ আধুনিক যুগে মিলছে দোকানে দোকানে। তার সঙ্গে এসেছে নয়া ফিউশন। তবে এই উৎসবের সঙ্গে যেসব আবেগ জড়িয়ে ছিল সেগুলো আজ অস্তাচলে। একটা সময় ছিল আজকের দিনে নলেন গুড় আর চাল গুঁড়ির জোগান দিতে হিমসিম খেতেন দোকানিরা। সকালের রান্নাবান্না কোনও মতে সেরে মা ঠাকুমারা বসে পড়তেন পিঠে গড়ার কাজে। তার পর আঁচ পড়ত উনুনে। মাটির সরায় করে প্রথমেই চাপানো হত আসকে পিঠে। সরা থেকে তুলে সরাসরি পাতে তুলে দিতেন তাঁরা। নলেন গুড়ে ডুবিয়ে পিঠেতে বকামোর দিলেই মুখের মধ্যে ঘটে যেন অন্য বিপ্লব। এই তিনদিন কবে কোন পিঠে রাঁধা হিভ আগে থেকেই ঠিক করে নিতেন তাঁরা। সেই মতো জোগাড় করে লেগে পড়তেন কাজে। সবাই মিলে গোল হয়ে বসে পিঠে তৈরি যেন ছিল একটা উৎসবের মতো। কাজ করতে করতেই চলত খোশ গল্পও ।
আরও পড়ুন - পেটে খেলে পিঠে সয়, পিঠ থেকেই কি এল ‘পেট’ শব্দটি?
কিন্তু পিঠে খাওয়ার এই রেওয়াজ ছাড়াও এই পার্বণ ঘিরে রয়েছে ‘আউনি বাউনি চাউনি’। অবশ্য রয়েছে বলা বুঝি ভুল। বরং হারাচ্ছে বলাই শ্রেয়। কিন্তু কী এই উৎসব? এই যে ছড়াটি, তার ভেতরে লুকিয়ে থাকা অর্থের খোঁজ করতে গিয়ে বিশিষ্ট ভাষাতাত্ত্বিক কামিনীকুমার রায় বলেছেন, ‘আওনি— লক্ষ্মীর আগমন, বাওনি— লক্ষ্মীর বন্ধন বা স্থিতি আর চাওনি— তাঁহার নিকট প্রার্থনা।’ পৌষ মাসকে লক্ষ্মী মাস যে বলা হয় এ কথা আগেই বলা হয়েছে। এই জন্য এই মাসে বাড়ি থেকে কোনও কিছু বের করেন না গেরস্থরা। এমনকী ভাইরা শীত হলেও এই মাসে বাংলা পঞ্জিকায় থাকে না বিয়ের তারিখ। ঘরের মেয়ে, সেও তো লক্ষ্মী তাই তাকে বিদায় দেওয়া সাজে না এই মাসে। এটাই রেওয়াজ। এটাই দস্তুর। শুধু হারিয়ে গিয়েছে এই রেওয়াজের আসল বিশেষত্বটুকু।
নতুন খড় বিনুনির মতো পেঁচিয়ে দরজার শিকলে, কড়ায়, গোলাঘরের আংটায়, ঢেঁকির খুঁটিতে অথবা তোরঙ্গের চাবি-কব্জায় কিংবা সিন্দুকের হাতলে বেঁধে দেওয়াই ছিল রীতি। লক্ষ্মী দেবীকে আগলে রাখার, বেঁধে রাখা চেষ্টা। এখন অবশ্য খড় খুঁজে পাওয়াই রীতিমত ঝক্কি। গ্রাম গঞ্জে মিললেও শহরের বুকে রীতিমত দুষ্কর। তার ওপর আধুনিক সময়ে মানুষ ভীষণ ব্যস্ত। এসব করার সময় কোথায় তার! তাই সবেকিয়ানাও হারাচ্ছে কাকের স্রোতে। একটা ছড়া খুব প্রচলিত ছিল একটা সময় - “এসো পৌষ যেও না জন্ম জন্ম ছেড়ো না,/ আঁধারে-পাঁদারে পৌষ, বড়ো ঘরের কোণে বোস/পৌষ এল গুড়ি গুড়ি, পৌষের মাথায় সোনার ঝুড়ি।” ছড়ার ছত্রে ছত্রেও রয়েছে পৌষকে না যেতে দেওয়ার বার্তা। রয়েছে সোনার ঝুড়ি অর্থাৎ সোনার ফসলের প্রসঙ্গ। নতুন ফসল ওঠে এই সময়। বাজারে নতুন আলু, মুলো, ধান, সর্ষে সহ আরও কর কিছু। এমন সোনার পৌশকে তাই আগলে রাখতেই চাইত বাঙালি।
কেমন ছিল সেই রীতি? অতীতের পাতায় সে সব আজও রয়েছে। আজও বর্ষীয়ান কারোর কাছে গেলে গল্প বলেন তাঁরা। আর আমরা চকলেট ফিউশনের পাটিসাপটা খেতে খেতে সেই গল্পেরস্বদ নিই। পৌষ সাজানোর রেওয়াজ ছিল সেকালে। সরষে ও গাঁদা ফুল দিয়ে সাজিয়ে তৈরি করা পৌষ বুড়ি। বুড়ি অর্থাৎ মাটির উনুন। তাকে মাটি লেপে ফুল, আলপনা দিয়ে সাজিয়ে তোলা হত। এর পর চলত পুজোর জোগাড়। তারপর শুদ্ধ বস্ত্র পরে ঘরের মহিলারা সন্ধ্যার পর থেকে পৌষ আগালাতে মেতে ওঠতেন। ‘পৌষমাস লক্ষ্মীমাস যাইও না ছাড়িয়ে, ছেলেপিলেকে ভাত দেব থালা ভরিয়ে।’ ছড়া কাটতে কাটতে চলত আগলানো। সঙ্গে চলত শঙ্খ এবং উলুধ্বনি। অতঃপর জল ছিটিয়ে শেষ করা হত পৌষ আগলানোর পর্ব। তারপর আবার একটা বছরের অপেক্ষা। তারপর আবার ফিরতি পৌষ। বাংলার এই উৎসবকে মাথায় রেখেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন - “পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে,/ আয় রে চলে, আয় আয় আয়/ ডালা যে তার ভরেছে আজ পাকা ফসলে,/ মরি হায় হায় হায়,…”
আরও পড়ুন - মুগপুলি আর গোকুল পিঠে যেন সময়গাড়ি, কে বলে রান্নার ভূগোল নেই!
পৌষ সংক্রান্তির দিন কোথাও কোথাও ঘুড়ি ওড়ানোর নিয়ম। সেও এক অন্য উন্মাদনা। আজকাল আকাশে আতস কাঁচ নিয়ে ঘুড়ি খুঁজতে হলেও বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে ঘুড়ি জড়িয়ে রয়েছে অনেক গভীরে। ঠিক ওই পিঠে পুলির মতোই। আমরা যত আধুনিক হয়েছি, হারিয়েছে সাবেকিয়ানা। এখন তাই দুধ ফোটানোর গন্ধ আসে না আর। দোকানে চাল গুঁড়ির খোঁজে লাইন নেই। নলেন গুড়ও তাই অন্য রাস্তা খুঁজেছে। নলেন গুড়ের আইসক্রিম অথবা চায়ের ফিউশন অধিক জনপ্রিয়। এতো বেশি যান্ত্রিক হচ্ছে প্রজন্ম যে রান্নাবান্নার পিছনে খাটাখাটনি সময় আর নেই। তাই সব কিছুই কর্পোরেট। পিঠেও কর্পোরেট। বাহারি রঙের প্যাকেটে দোকানে দোকানে বিক্রি হয় পাটিসাপটা, সরুচাকলি। আর নিয়ম রক্ষা করতে বাঙালির ওতেই ভরসা। আর বাউনি বাঁধা সে তো ভুলেই গেছে বাঙালি। তাছাড়া সিন্দুকে মা লক্ষ্মীকে অগলানোর দিনও তো এখন শেষ। ভরসা এখন ব্যাংকের লকারে অথবা মিউচ্যুয়াল ফান্ডে। সেখানে অবশ্য বাউনি বাঁধার প্রয়োজন পড়ে না। তাই বাঙালি এখন পৌষ আগলায় অনলাইনেই।