দশ বছরে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রীকে কটাক্ষ RSS-এর! ভাঙনের ইঙ্গিত সঙ্ঘ পরিবারে?

RSS VS BJP: আরএসএস-এর প্রধান নেতা মোহন ভগবত নির্দিষ্ট কারও নাম না করেই সম্প্রতি বলেছিলেন, প্রধানকে নম্র হতে হবে। নাম না করলেও ওই বার্তা যে দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উদ্দেশ্যেই, তা নিয়ে ওয়াকিবহাল মহলের সংশয় নে...

লোকসভা ভোটের ফলাফল বেরিয়ে গিয়েছে। তৃতীয়বারের জন্য সরকার গড়েছে বিজেপি। কিন্তু একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি বিজেপি। এ বারের ভোটে দেখা গিয়েছে, গত দু'দফার তুলনায় রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ এবং ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট-র আসন সংখ্যা অনেকটাই কমেছে। এক দশকে বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জেতায় আরএসএস-কে মুখ বুজে সব সহ্য করতে হয়েছিল। বিজেপির '৪০০ পারে'র দাবি বিফলে যাওয়া, লোকসভা ভোটে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতাও না হওয়ায় আরএসএ-এর নেতৃত্ব এবার মুখ খুলেছেন। লোকসভা ভোটের ফল নিয়ে মোদি-অমিত শাহদের তীব্র সমালোচনা করেছেন আরএসএস নেতৃত্ব। ভোটের ফল প্রকাশের পর থেকেই বিজেপিকে নিশানা করেন মোহন ভগবত, ইন্দ্রেশ কুমাররা। ইন্দ্রেশ কুমার বলেছিলেন, 'রামকে ভক্তি করার পরও যে দল(বিজেপি) অহংকারী হয়ে উঠেছিল, তাদের (বিজেপি) ২৪১-এই আটকে যেতে হয়েছে।' এই দ্বন্দ্ব কি সঙ্ঘ পরিবার ভাঙনের ইঙ্গিত?

লোকসভার ফলপ্রকাশের কিছু দিন আগে বিজেপির সভাপতি জগৎপ্রকাশ নাড্ডা এক সাক্ষাৎকারে আরএসএস-কে গুরুত্ব না দেওয়ার বিষয়টি কার্যত মেনেই নিয়েছিলেন। নাড্ডা দাবি করেছিলেন, বিজেপি এখন একাই একশো, বিজেপির আর আরএসএস-কে প্রয়োজন নেই। তারপর ফলপ্রকাশ হওয়া থেকেই লাগাতার আরএসএস নেতারাও ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আরএসএস তো আর এমনি এমনিই কোনো মন্তব্য করে না। মন্তব্য করার আগে শিবিরে তা নিয়ে আলোচনা হয়। তাই আরএসএসেরর বক্তব্য নেহাতই উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয় মোটেও।

আরও পড়ুন: মোদির তৃতীয় দফায় কি বিকল্প মিডিয়ার মুখ বন্ধ করা হবে?

আরএসএস-এর প্রধান নেতা মোহন ভগবত নির্দিষ্ট কারও নাম না করেই সম্প্রতি বলেছিলেন, প্রধানকে নম্র হতে হবে। নাম নির্দিষ্ট না করলেও ওই বার্তা যে দেশের তৃতীয়বারের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উদ্দেশ্যেই, তা নিয়ে ওয়াকিবহাল মহলের কোনো সংশয় নেই। দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের নিয়ে এনডিএ জোট গড়ার নিন্দাও করেছে আরএসএস। নাগপুরে সঙ্ঘের শিক্ষানবিশদের সভায় সরসঙ্ঘচালক মোহন ভগবত বলেছিলেন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে 'বিরোধী' নয় 'প্রতিদ্বন্দ্বী' হিসেবে দেখতে হবে। যা একেবারেই মোদি-বিরোধী কথা তা বোঝা যায়। পুরো ভোট প্রচার জুড়ে মোদি যেভাবে বিরোধীদের তোপ দেগেছেন তাতে শিশুও এই বিবৃতির ইঙ্গিত বুঝতে পারবেন। মোহন ভগবত প্রশ্ন তুলেছেন, মণিপুর রাজ্যটি বিজেপি শাসিত হওয়ার পরেও শান্তি ফেরেনি কেন? তাঁর দাবি, মণিপুরে শান্তি ফেরানোর দিকে নজর দেওয়া উচিত ছিল বিজেপির। এ বার ভোট প্রচারে বিজেপি বিরোধীদের কটাক্ষ করতে গিয়ে সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে বলেও দাবি মোহনের। বিজেপি নেতাদের ঔদ্ধত্যের অভিযোগ তুলেছেন আরএসএস নেতা ইন্দ্রেশ কুমার। কংগ্রেস ভাবধারার নেতা অজিত পাওয়ারকে এনডিএ তে যুক্ত করা হয়েছে বলে দলের নেতা কর্মীরা মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছেন বলেও দাবি করা হয়।

কেরলের পালাক্কাড়ে সঙ্ঘ পরিবারের সবচেয়ে বেশি শাখা থাকলেও, এই প্রথম সে রাজ্যে একটি লোকসভা আসনে জিতেছে বিজেপি। ২০২৪-র নির্বাচনে সঙ্ঘ চেয়েছিল, মোদির জনপ্রিয়তার পাশাপশি যেন বিভিন্ন জনমুখী প্রকল্পকে মূল হাতিয়ার করা হয়। বিজেপির 'মোদি গ্যারান্টি'-কে সামনে রেখে '৪০০ পার'- এর লক্ষ্য মোটেই মেনে নিতে পারেননি সঙ্ঘ নেতারা। ফলে প্রচারেও দুই শিবিরের মধ্যে দূরত্ব ছিলই। বিজেপি কর্মীদের দাপটে সঙ্ঘ নেতারা ক্রমশ কোণঠাসাও হচ্ছিলেন। সঙ্ঘের অধিকাংশ নেতারা টিকিট পাননি। ফলত ফল প্রকাশের পরই বিজেপির ব্যর্থতা নিয়ে সরব হয়েছে সঙ্ঘ। চলতি মাসেই বিজেপির বর্তমান সভাপতি জেপি নাড্ডার মেয়াদ শেষ হবে। এই সময় পরিস্থিতি সামাল দিতে সঙ্ঘ-ঘনিষ্ঠ কাউকে সর্ব ভারতীয় সভাপতি পদ দেওয়ার দাবি উঠছে দলের অন্দরেই।

আজকের দিনেও আরএসএস-এর সমর্থন ছাড়া বিজেপির পক্ষে ভোট প্রক্রিয়া চালানো মুশকিল। মোহন ভগবত বলেছেন, 'আরএসএস কিন্তু নিজের কাজ করে যাবে।' অর্থাৎ, বিজেপি থাকুক বা না থাকুক আরএসএস নিজের অবস্থানে অটল থাকবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এটি বিজেপির জন্য বড়সড় সতর্কবার্তা। গণনা কেন্দ্রে বিজেপির কাউন্টিং এজেন্টদের প্রশিক্ষণও আরএসএস কর্মীরাই দিয়েছেন। আরএসএস বিজেপির হাত শক্ত করতে দিনের পর দিন মাঠে ময়দানে নেমে কাজ করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, যেসব রাজ্যে বিজেপি ঢুকতে পারে না, তাদের জন্য ভূমিস্তরে নেমে কাজ করে ভিত তৈরি করে আরএসএস। এতে বোঝাই যাচ্ছে আরএসএসের বিজেপিকে যত না প্রয়োজন, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রয়োজন বিজেপির আরএসএসকে।

Powerful Hindu Group That Spawned Modi Party Slams His Campaign

অটলবিহারী বাজপেয়ীর ঘনিষ্ঠ ছিলেন সুধীন্দ্র কুলকার্নি। তিনি 'দ্য ওয়্যার' সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, আরএসএস-এর সদস্যদের ক্ষুব্ধ হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কুলকার্নি তাঁর বিবৃতিতে মনে করিয়ে দিয়েছেন, 'বিজেপির ১০ বছরের শাসনে এই প্রথম আরএসএস প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা করেছে।' তাঁর মতে, ৩৭০ ধারা বাতিল ও রামমন্দির মতো ইস্যুগুলি নিয়ে কাজ করে বিজেপি আরএসএসকে এত দিন খুশি রেখেছিল।' তিনি উল্লেখ করেন, কিন্তু এসবের মধ্যে আরএসএস-এর প্রতি বিজেপির সম্মান ছিল না। কুলকার্নির দাবি, অমেঠির মতো আসনে 'আরএসএস বিজেপি প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রচার করেছে।' আরএসএস সর্বদা সকলের মতামত অনুযায়ী কাজ করে এসেছে বলেও তাঁর দাবি। উদাহরণ, গোড়া থেকেই মোদি সরকারের কৃষি বিলের বিরোধিতা করেছে আরএসএস। কুলকার্নি জানান, তিনি নিজে দেখেছেন অটলবিহারী বাজপেয়ী এবং লালকৃষ্ণ আডবাণীর সঙ্গে একাধিক মত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তাঁরা দু'জনেই সঙ্ঘ পরিবারের সদস্যের সম্মান করতেন। এক প্রবীণ সাংবাদিক ওই সংবাদমাধ্যমকেই বলেছেন, 'গান্ধীর মৃত্যুর পর আরএসএস-এর উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার একমাত্র প্রতিশ্রুতি ছিল যে এটি একটি 'সাংস্কৃতিক' সংগঠন। কিন্তু গত ১০ বছরে রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্লজ্জভাবে কাজ করেছে তারা। এখন বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় আরএসএস আবার নিজেদের 'সাংস্কৃতিক' পরিচয় পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালাচ্ছে।' তাঁর দাবি, মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকে মহারাষ্ট্রের ব্রাহ্মণ লবি দুর্বল হয়ে পড়েছে।

ভোট ফলাফল বেরোনোর অনেকটাই আগে ভোট চলাকালীন প্রিন্ট গ্রাউন্ড রিপোর্ট করে ‘Heart has soured’— why UP’s RSS workers are lying low in BJP campaign— শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, বিজেপি কেন্দ্রে দশ বছর এবং উত্তরপ্রদেশে সাত বছর ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও আরএসএস কোনও দিক থেকেই লাভবান হয়নি। 'ডবল ইঞ্জিন ' সরকার আরএসএসের কোনও কাজেই আসেনি। মনে করা হচ্ছে, এটাই হয়তো উত্তরপ্রদেশে বিজেপির ভোটে দুর্বল ফলাফলের নেপথ্যে অন্যতম কারণ। আরএসএসের সদস্যরা সহজে দল বদল করেন না। সেখানে অজিত পাওয়ারের সাথে জোট করাটা কখনই মেনে নিতে পারেনি সঙ্ঘ।

আরও পড়ুন: নিজের কেন্দ্র বারাণসীতেই অপমান! মোদির দিকে চটি ছোড়ার অভিযোগ কি সত্য?

মোদির বিরুদ্ধে ঔদ্ধত্যের অভিযোগ তোলার কিছু দিনের মধ্যেই আবার ড্যামেজ কন্ট্রোলে নেমে ছিলেন ইন্দ্রেশ কুমার। বিবৃতি শুধরে দিয়ে তিনি বলেন, 'আমি বলতে চেয়েছিলাম, যারা রামের বিরোধিতা করেছিলেন, তারাই ক্ষমতার বাইরে।' আরএসএস এবং বিজেপির এই সম্পর্ক নতুন নয়। অতীতের তথ্য বলছে, তাদের সম্পর্কে এখন দূরত্ব বাড়লেও, সম্পর্ক ভাঙার কোনও সম্ভবনা নেই। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দু'পক্ষই সুবিধে পেতে চায়। তাই এটি একটি রাজনীতির প্যাঁচ ছাড়া কিছুই নয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, গত দশ বছরে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রীকে কটাক্ষ করেছে আরএসএস। আরএসএসের নেতৃত্বের একের পর এক বার্তায় আন্দাজ করা যায়, বিজেপির পরবর্তী সকল কর্মসূচিতের উপরেই আরএসএসের তীক্ষ্ণ নজর থাকবে। সরকার গঠনের গোড়াতেই এর ইঙ্গিত করে দিয়েছে আরএসএসের শীর্ষ নেতৃত্ব। প্রশ্ন উঠছে, প্রধানমন্ত্রীকে কটাক্ষ করার জন্য কি ফল ভুগতে হবে আরএসএসকে? নাকি বিজেপিকে এবার নিয়ন্ত্রণ করবে আরএসএস? এই সকল সতর্কবাণীকে আদৌ কতটা গুরুত্ব দেবে বিজেপি, সেই প্রশ্নও ফেলে দেওয়া যাচ্ছে না।

More Articles