মান্দাসের হাত ধরে উপন্যাসে ফিরছেন রসায়নের রাজা প্রফুল্লচন্দ্র
Prafulla Rasayani, Mandas Publication: এই বইয়ের বিষয় শুধুই বিজ্ঞান নয়, বাংলার এক প্রায় বিস্মৃত বিজ্ঞানী, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। সময় যাঁকে প্রায় ভুলেই গিয়েছে।
বয়সের সঙ্গে সঙ্গে শিকড় আলগা হয়। কলেজবেলার বন্ধুরা হারিয়ে যায়। জীবন অভ্যস্ত হয়ে পড়ে অন্যরকম দায়দায়িত্বে। পেশা, সংসারের ঘূর্ণিপাকে হারিয়ে যায় সেইসব কিশোরবেলার বন্ধুরা। একদিন যাঁদের একত্রে বেঁধেছিল একটি বিশেষ বিষয়ের প্রতি ভালোবাসা, সেই বিষয়টিকে গভীর থেকে জানার ইচ্ছে। তারপর কোনও এক ডিসেম্বরের সন্ধ্যায় বড়দিনের ঠিক আগে আগে সেই বিষয়ের টানেই আবার জড়ো হয় মাথাগুলো। আলাপী সংলাপে ভরে ওঠে ঘর, আর সেসব স্নেহচোখে দেখে একটি বই। যার নাম 'প্রফুল্ল রসায়নী'। যার জন্ম হয়েছে সদ্য, যে বইয়ের প্রকাশ ঘিরেই এত আয়োজন।
'মান্দাস' থেকে সদ্য প্রকাশ পেয়েছে উপন্যাস 'প্রফুল্ল রসায়নী'। না, শুধু উপন্যাস বললে তাকে কম বলা হবে। কারণ আস্ত একটি সময়ের দলিল এই বই। লেখক ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের জৈব রসায়নের কৃতি ছাত্রী। যে বিজ্ঞানের ডানায় ভর করে একদিন ওড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন ইন্দিরা, সেই বিজ্ঞানকেই কিছু ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা তাঁর এই বই। নাম শুনে বুঝতে অসুবিধা হয় না, এই বইয়ের বিষয় শুধুই বিজ্ঞান নয়, বাংলার এক প্রায় বিস্মৃত বিজ্ঞানী, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। সময় যাঁকে প্রায় ভুলেই গিয়েছে। শুধু ছোটবেলায় সাধারণ জ্ঞানের বইতে থেকে গিয়েছে নামটুকু। সেই প্রফুল্লচন্দ্রকে নিয়ে আস্ত একটি জীবনোপন্যাস লিখলেন ইন্দিরা। 'প্রফুল্ল রসায়নী' তাঁর ১২তম উপন্যাস। তাছাড়াও প্রবন্ধ, ছোটগল্পের মতো সাহিত্যের নানা শাখায় পারদর্শী ইন্দিরা।
আরও পড়ুন: রক্ত-মাংস-কফ-শ্লেষ্মায় গড়া ফাঁপা সময়ের গল্প: যাহা বলিব সত্য বলিব
প্রকাশক প্রাথমিক ভাবে চেয়েছিলেন, রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের কোনও একটি প্রেক্ষাগৃহে প্রকাশিত হোক এই বই। তবে শেষপর্যন্ত লেখক ঠিক করেন, তাঁর বৈঠকখানাতেই হবে বইপ্রকাশ। অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন তাঁরা, যাঁদের সঙ্গে একদিন ভালোবাসতে শিখেছিলেন রসায়নের মতো কঠিন বিষয়কে। সেই মতোই সোমবার পণ্ডিতিয়া রোডে লেখিকার বাড়িতে হয়ে গেল বইপ্রকাশের অনুষ্ঠান। যেখানে হাজির ছিলেন লেখক সপরিবার ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়। ছিলেন মান্দাস প্রকাশনার কর্ণধার সুকল্প চট্টোপাধ্যায়, প্রখ্যাত লেখক অনির্বাণ বসু। আর ছিলেন ইন্দিরার কলেজবেলার বন্ধুরা। তাঁদের কেউ আজ কলেজের অধ্যক্ষ, তো কেউ সরকারি আমলা। কেউ বা অধ্যাপক, কেউ পড়ান স্কুলে। স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত প্রত্যেকেই। তবে দীর্ঘদিন পরে এমন পুনর্মিলন উৎসব বোধহয় বিহ্বল করল প্রত্যেককেই। কেউ আবেগতাড়িত হলেন, কেউ বা দিলেন স্মৃতির সমুদ্রে ডুব। কথায়, গল্পে ধরা পড়ল একটুকরো কলেজবেলা।
রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ থেকে সপ্তাহে একদিন করে প্রেসিডেন্সি কলেজে ক্লাস করতে আসা থেকে শুরু করে আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠান, কথায় কথায় এসে পড়ল সবই। স্পনসর জোগাড় করতে ছুটেছিলেন কেসি দাসের বংশধরদের কাছে। প্রফুল্ল রায়ের জন্মশতবার্ষিকী জেনে সানন্দে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা। খুঁড়িতে করে এসেছিল কেশর রসমালাই। এই সবই স্মৃতির স্রোত ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখা। কিন্তু এই সমস্ত কথাবার্তার কেন্দ্রে ছিলেন সেই মানুষটি, যাঁকে নিয়ে আজকের এই আয়োজন। দেড়শো বছর পেরিয়ে আসা সেই রসায়নপাগল বিজ্ঞানী, যিনি না থাকলে হয়তো অনেক কিছুই হত না এই দেশের, এই শহরের। প্রফুল্ল কি শুধুই বিজ্ঞানী ছিলেন, ছিলেন রসায়নপাগল একজন মানুষ? বোধহয় না। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে একজন উদ্যোগপতির ভূমিকায় নেমে এসেছিলেন প্রফুল্লচন্দ্র রায়। তৈরি করেছিলেন বেঙ্গল কেমিক্যাল। যে রাজ্যে আজও ঠিকমতো শিল্প আসে না। প্রতিনিয়ত বুদ্ধিদীপ্ত মেধাবী মস্তিষ্কগুলো দেশ ছেড়ে প্রবাসী হতে বাধ্য হয়, সে দেশে কি আরও একটু আলোচনার দরকার ছিল না প্রফুল্লচন্দ্র রায়কে নিয়ে? রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, সুভাষ বসু থেকে রামমোহন রায়— বাকিরা যতটা আলোচিত, তার সিকিভাগ আলো কি গিয়ে পড়ল এই বিজ্ঞানীর উপর। যিনি নেপথ্যে থেকেও প্রতিনিয়ত সক্রিয় যোগদান করে গিয়েছেন ভারতের স্বাধীনতার আন্দোলনে। সদা নতুনকে খুঁজে পাওয়ার যে নিরন্তর সাধনা, সেখানে নিয়োজিত করেছিলেন গোটা জীবন। নোবেলের মতো স্বীকৃতি তো দূরের, কেন আমবাঙালি ভুলল সেই মানুষটিকে? কেন পড়াশোনার ক্ষেত্রেও সবচেয়ে কম আলোচিত প্রফুল্লচন্দ্র রায়? তার উত্তরই খুঁজেছেন এই বই জুড়ে লেখক ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়।
সোমবার অনুষ্ঠানের শুরুটা হয়েছিল ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্সের অধ্যাপক ড. পার্থসারথি দস্তিদারের গান দিয়ে। অনুষ্ঠানের সূত্র বেঁধেছিলেন অল ইন্ডিয়া রেডিওর কথক ও বাচিকশিল্পী শ্রীতমা মুখোপাধ্যায়। বেথুন কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষা ও লেখিকা ড. কৃষ্ণা রায়, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অধীনস্থ মৎস্য দফতরের স্পেশাল কমিশনার অতনু রায়, মিলি আল আমিন কলেজের অধ্যক্ষা ড. সুনন্দা হালদার এবং মান্দাসের কর্ণধার সুকল্প চট্টোপাধ্যায়ের হাতে প্রকাশ পেল নতুন বই 'প্রফুল্ল রসায়নী'। অবশ্য সত্যি কথা বলতে, সেই মুহূর্তে সকলেই কর্মক্ষেত্রের স্ব স্ব পরিচয় ছেড়ে ফিরে গিয়েছিলেন বছর চল্লিশ আগে। একটাই পরিচয় তখন ওদেঁর, ওঁরা সকলেই ইন্দিরার সহপাঠী। ঘরোয়া আড্ডায় উঠে এল তাঁদের ছটফটে সেই কলেজবেলার কথা। উঠে এল প্রফুল্ল রায়ের অবদানের কথা। শারীরিক অসুস্থতা, সামাজিক প্রতিবন্ধকতা সমস্ত কিছুকে দূরে ঠেলে বড় হয়ে উঠেছিল তাঁর বিজ্ঞানের সাধনা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে কথোপকথন থেকে শুরু করে প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের অজস্র চিঠি, তাঁর জীবনের প্রতিটা লড়াইয়ের এক জীবন্ত দলিল হয়ে উঠেছে এই বই।
ইন্দিরা ও তাঁর বই 'প্রফুল্ল রসায়নী'-কে নিয়ে কথা বলতে গিয়ে মান্দাসের কর্ণধার সুকল্প জানালেন, এই বইটি রূপায়ণের ভাবনার নেপথ্যে ছিল একটি ফেসবুক পোস্ট। সেখান থেকেই তিনি জানতে পারেন পাণ্ডুলিপিটির কথা। তখন থেকেই সেই পাণ্ডুলিপিকে পেপারব্যাকের মলাটে সাজিয়ে দেওয়ার ভাবনা শুরু হয়েছিল সুকল্পের মাথায়। সেখান থেকে শুরু করে 'প্রফুল্ল রসায়নী'-র হয়ে ওঠা একটা যাত্রা। আর সেই যাত্রাপথকে খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন মান্দাস কর্ণধার। এর আগেও 'একান্নবর্তী' নামে লেখকের একটি বই প্রকাশ পেয়েছে 'মান্দাস' থেকে। পাঠকমহলে আদৃতও হয়েছে সেই বই। যেভাবে সত্যকে উপন্যাসের মোড়কে তুলে ধরেছেন এই বইতে ইন্দিরা, বিজ্ঞানের যে রাজনীতির কথা ফুটে উঠেছে বইটির ছত্রে ছত্রে, তা পাঠককে টানবে বলেই আশাবাদী সুকল্প।
আরও পড়ুন: ৫১বর্তী – বাঙালির হারানো ৫১ পদ : স্বাদের শিকড় সন্ধানে এক সফর
এর আগে বিজ্ঞানী প্রফুল্লকে নিয়ে কোনও উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে অন্তত লেখা হয়নি। সেই হিসেবে ইন্দিরাই প্রথম। বিজ্ঞানের ছাত্রী হিসেবে বিজ্ঞানাচার্যের প্রতি এই বই, তাঁর এই অর্ঘ্য কি নতুন এক পথ খুলে দিতে চলেছে বাংলা সাহিত্যের আঙিনায়? মান্দাস প্রকাশিত এই বই কি আজকের ছেলেমেয়েদের কাছে হয়ে উঠবে অনুপ্রেরণা? নগরজীবন কি বুঝতে শিখবে বিজ্ঞানপাগল এই উদ্যোগপতির মর্ম? তাঁর উত্তর খুঁজবে সময়। শীতের এই সন্ধ্যা জুড়ে এই সশ্রদ্ধ স্মৃতিচারণটুকুই বোধহয় সেই আশাবাদের জন্ম দিয়ে গেল অনেকটা।