কোথাও ভ্যাটিকান সিটি, কোথাও বাংলার ঐতিহ্য, যেভাবে সেজে উঠছে কলকাতার দুর্গাপুজো
রথের চাকা গড়াল। সেই সঙ্গে বঙ্গে শুরু হয়ে গেল উমার আবাহন। রথের দিন ধুমধাম করে বড় বড় উদ্যোক্তারা সেরে নিলেন খুঁটিপুজো। কোথাও কোথাও বিচ্ছুরিত হলো রাজনৈতিক গ্ল্যামারের ছটা।
কথায় বলে, আষাঢ়ে রথ যেদিন, আশ্বিনে পুজো সেদিন। অর্থাৎ, আর মাত্র ৩ মাস। রথের চাকা গড়াল। সেই সঙ্গে বঙ্গে শুরু হয়ে গেল উমার আবাহন। রথের দিন ধুমধাম করে বড় বড় উদ্যোক্তারা সেরে নিলেন খুঁটিপুজো। কোথাও কোথাও বিচ্ছুরিত হলো রাজনৈতিক গ্ল্যামারের ছটা।
শ্রীভূমি স্পোর্টিং ক্লাব
গত বছর শ্রীভূমির লেজার লাইট শো আর বুর্জ খলিফা তাক লাগিয়েছিল শহরবাসীকে। ষষ্ঠী থেকেই ভিড় সামলাতে নাভিশ্বাস ওঠে কর্মকর্তাদের। তবে বুর্জ খলিফা নিয়ে শ্রীভূমি স্পোর্টিং জেরবার হয়েছিল। বিতর্ক তাদের নাজেহাল করে তুলেছিল। প্রথমে লেজার লাইটিং বন্ধ পরে দর্শনার্থীদের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয় বুর্জ খলিফাও। তবে গতবারের বিতর্ক শ্রীভূমি স্পোর্টিংকে দমিয়ে দিতে পারেনি। এবার তাদের চমক ভ্যাটিকান সিটি। সুজিত বসু কীভাবে তাক লাগান, তার অপেক্ষায় কলকাতাবাসী।
এটা শ্রীভূমির সুবর্ণজয়ন্তী বর্ষ। প্রতি বছরের মতো এবছরও রথের দিন ঘটা করে খুঁটিপুজো করল শ্রীভূমি। রথ মানেই দুর্গাপুজোর প্রস্তুতি শুরু। এদিন থেকেই শুরু হয়ে যায় বনেদিবাড়ির কাঠামো পুজো। বিভিন্ন পুজোকমিটিগুলো রথের দিনই খুঁটিপুজো করে। এদিন নিয়মনীতি মেনেই সাড়ম্বরে খুঁটিপুজো পালন করল শ্রীভূমি স্পোর্টিং ক্লাব। খুঁটিপুজোর অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ক্লাব-কর্তা ও মন্ত্রী সুজিত বসু।
আরও পড়ুন: বাঙালির দুর্গাপুজো শুরু হলো কীভাবে, কত খরচ হয়েছিল সেকালের পুজোয়?
গত ২ বছর নমো নমো করে সারতে হয়েছিল খুঁটিপুজো। তবে এবার জাঁকজমক করে তা পালন করা হয়। ক্লাবের অন্যান্যদের সঙ্গে খুঁটিপুজোর অনুষ্ঠানে সামিল হন সুজিত বসু। পুজো দেন, আরতি করেন। পুরোহিতের মন্ত্রোচ্চারণ আর ঢাকের বাদ্যি জানান দেয়, মা আসছে।
কলকাতার বড় পুজোগুলোর মধ্যে অন্যতম লেকটাউনের শ্রীভূমি স্পোর্টিং ক্লাব। প্রত্যেকবারেই তাদের পুজোয় কোনও না কোনও চমক থাকে। গতবার যেমন বুর্জ খলিফার আদলে মণ্ডপ করা হয়েছিল। এবার সুবর্ণজয়ন্তী। তাই চমকও ভিন্ন ধরনের। অভিনবত্ব যে থাকবে, তা বলাই বাহুল্য। কী বললেন শ্রীভূমি স্পোর্টিংয়ের সভাপতি সুজিত বসু?
"প্রত্যেক বছরই আমরা কিছু অভিনব করি। এবছর সুবর্ণজয়ন্তী। গত বছর আমরা বুর্জ খলিফা বানিয়েছিলাম। মানুষ ভালবেসেছিলেন। এবার ভ্যাটিকান সিটি করব। ৫০ লক্ষ ভক্ত ভ্যাটিকান সিটিতে যান। এবার তাঁরা এখানে আসবেন।‘’
গত বছর বুর্জ খলিফা বানিয়ে হিমশিম খেয়েছিল শ্রীভূমি। তাদের বুর্জ খলিফা দেখতে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ ভিড় করেন। প্রথমে বিমানচালকদের আপত্তির জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয় লেজার লাইটিং। তারপর বন্ধ করে দেওয়া হয় বুর্জ খলিফার আলো। এরপর দমকলমন্ত্রী সুজিত বসুর সঙ্গে কথা বলে সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয় বুর্জ খলিফা। ভিড় এড়াতে এই সিদ্ধান্ত বলে জানানো হয়। তবে এবারও যে শহর কলকাতা শ্রীভূমিমুখী হবে, তা ভালোই জানেন আয়োজকরা।
নাকতলা উদয়ন সংঘ
মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের পুজো হিসেবে পরিচিত নাকতলা উদয়ন সংঘ। প্রতিবারই তাদের পুজোয় চমক থাকে, এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না বলে জানালেন কর্মকর্তারা। নাকতলা উদয়ন সংঘর দুর্গাপুজো এবার ৩৮ বছরে পা দিল। রীতি মেনে রথের দিন পালিত হলো খুঁটিপুজো। বাংলার কৃষ্টি-সংস্কৃতি নিয়ে এবারের পুজোর থিম। পরিষ্কার করে কী হতে চলেছে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের পুজোর থিম, তা নিয়ে কলকাতাবাসীর আগ্রহের অন্ত নেই। উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, কিছুদিনের মধ্যে তা খোলসা করা হবে। এখন চমকের অপেক্ষা।
খুশবন্ত সিংয়ের 'ট্রেন টু পাকিস্তান’ বহু আলোচিত এবং আলোড়িত এক উপন্যাস। দেশভাগের যন্ত্রণা এর প্রতিটি লাইনে ব্যক্ত হয়েছে। আর সেই বইয়ের আলোকেই গতবারে নাকতলা উদয়ন সংঘ থিম করেছিল`চালচিত্র’। নাকতলা দেশভাগের ভয়াবহতাকে তুলে ধরেছিল তাদের মণ্ডপ ও প্রতিমার মধ্য দিয়ে। তাদের উদ্যোক্তারা এবার জানালেন, বাংলার কৃষ্টি ও সংস্কৃতি প্রাচীন ঐতিহ্য বহন করে। সেকথা মাথায় রেখে সমাজকে চমক নয়, বার্তা দেবে নাকতলা। কলকাতার অন্যতম বড় পুজো এই নাকতলা উদয়ন সংঘ, এবার তাদের মণ্ডপসজ্জার দায়িত্বে শিল্পী প্রদীপ দাস।
গড়িয়াহাট হিন্দুস্থান ক্লাবের পুজো
গড়িয়াহাট হিন্দুস্থান ক্লাবের পুজো এবার ৬০ বছরে পা দিল। ক্লাবের সভানেত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। রথের দিন সাড়ম্বরে খুঁটিপুজো হল। পুজোর ঢাকে কাঠি। এদিন সব আচার মেনেই মায়ের আবাহন হলো। গামছা দিয়ে তৈরি করা হয় প্রতীকী রথ। উদ্যোক্তারা জানালেন, এবারের পুজোর থিম- দ্বেষ নয়, মনে দেশ। গত ৮ বছর ধরে এই পুজোর দায়িত্বে রয়েছেন পাড়ার মহিলারা। এবারও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। মহিলা নেত্রীকে সামনে রেখে যে দুর্গোৎসবের আয়োজন, তাতে মা-র আবাহন যে মহিলারা করবেন, তা বলাই বাহুল্য। মহিলারা প্রধান ভূমিকায় থাকলেও অনির্বাণ দাস সাজিয়ে তুলবেন এই ক্লাবের পুজো।
সুরুচি ও বাদামতলার আষাঢ় সংঘ
দক্ষিণ কলকাতার জনপ্রিয় বারোয়ারি পুজোগুলোর মধ্যে অন্যতম নিউ আলিপুরের সুরুচি সংঘ। অরূপ বিশ্বাসের পুজো বলে এই পুজোর নামডাক। তবে অক্ষয় তৃতীয়ার দিনই এই পুজোকমিটি খুঁটিপুজো সেরে নেয়। প্রতিবারের মতো এবারও তাদের পুজোর থিমে থাকছে চমক। অক্ষয় তৃতীয়ার দিন খুঁটিপুজো সারেন এই পুজোর আয়োজকরা। এই পুজো অরূপ বিশ্বাসের পুজো বলে খ্যাত। পুজো কমিটির সদস্যদের পাশাপাশি খুঁটিপুজোতে উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস।
সুরুচির পাশাপাশি অক্ষয় তৃতীয়ার দিন খুঁটিপুজো হয় বাদামতলা আষাঢ় সংঘে। খুঁটিপুজোয় উপস্থিত ছিলেন রাসবিহারীর বিধায়ক দেবাশিস কুমার, দক্ষিণ কলকাতার সাংসদ মালা রায়।
মূলত রথের দিন খুঁটিপুজোর যে এত ধুম, এর কারণ কী?
শাস্ত্রে উল্লেখ রয়েছে, 'রথস্থ বাম নং দৃষ্টা পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে’। অর্থাৎ, রথের ওপর অধিষ্ঠিত জগন্নাথকে দর্শন করলে পুনর্জন্ম হয় না। তাই রথের রশি টানাকেও পুণ্য কাজ বলে মনে করেন ধর্মপ্রাণা হিন্দুরা। রথ নিয়ে রয়েছে নানা রহস্য ও পৌরাণিক কাহিনি। রথের দিন বিশেষ শুভ দিন বলে গ্রাহ্য হয়, তাই এই দিনে বাঙালির শারদোৎসবের সূচনা হয়। খুঁটিপুজো করেই শুরু দুর্গাপুজোর। এভাবেই রথের সঙ্গে জুড়ে গেছে উমার আবাহন।