২০২৪ লোকসভা ভোট: নতুন এক 'দেবতার জন্ম' দেখছে মোদির ভারত

Narandra Modi: অনেকেই বিশ্বাস করেন, যে আজকের প্রধানমন্ত্রী, লজিক্যাল, অর্থাৎ যুক্তিবাদী। কিন্তু তিনি নিজে বলেছেন, তিনি লজিক্যাল তো ননই, এমনকী তিনি বায়োলজিক্যালও নন।

ভোটের আগে বছরভর নানাবিধ হিন্দুত্ববাদী কাজকর্মে মেতেছিলেন তিনি। ভক্তিভরে রীতিমতো সন্ন্যাসীর যাপনের মধ্যে দিয়ে গিয়ে রামলালার স্থাপনা করেছেন অযোধ্যার রামমন্দিরে। সেই প্রধানমন্ত্রীই ভোটের মরসুমে খোদ নিজেকেই ভগবান বলছেন। এখন প্রশ্ন উঠছে, নরেন্দ্র মোদি কি সত্যিই অবিনশ্বর? নরেন্দ্র মোদি কি ঈশ্বরের প্রেরিত দূত? তিনি কি এসেছেন ভারতবর্ষকে মুক্তির দিশা দেখাতে? তিনিই কি বিষ্ণুর অবতার? নাকি স্বয়ং রাম জন্মেছেন নরেন্দ্র মোদি হয়ে? পুরীর জগন্নাথদেবও কি তাঁর ভক্ত? আর এই সব প্রশ্নই আজকাল ভারতীয় রাজনীতিতে ঘোরাফেরা করছে। ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে যখন নরেন্দ্র মোদি সিদ্ধান্ত নেন, তিনি গুজরাটের একটি আসনের পাশাপাশি, উত্তর প্রদেশের বেনারস কেন্দ্র থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। সে সময় তিনি বলেছিলেন, ‘মা গঙ্গা’ স্বয়ং তাঁকে ডেকেছেন, সেই ডাকে সাড়া দিয়েই তিনি বেনারসে এসেছেন। তাঁর এই বেনারসে আসা, কোনও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য নয়, ‘মা গঙ্গা’র ইচ্ছেপূরণের জন্যেই। আসলে তিনি জানেন, ভারতবর্ষের বেশিরভাগ মানুষই গ্রামে থাকেন এবং তাঁদের বৃহদাংশই ধর্মভীরু। তাঁদের কাছে যদি বলা যায় যে মোদি ‘মা গঙ্গা’-র আহ্বানে সাড়া দিয়ে বেনারসে এসেছেন, তাহলে অনেক প্রশ্নই ওঠে না।

এবারের নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী ভাষণ খেয়াল করলে দেখা যাবে, তিনি এবারের নির্বাচনকে মোটামুটি ধর্মীয় দিক দিয়েই দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যখন কংগ্রেস তাঁদের নির্বাচনী ইস্তেহারে বিভিন্ন সামাজিক ন্যায়ের কথা বলার চেষ্টা করেছে, তখন প্রধানমন্ত্রী সেই সামাজিক ন্যায়ের ধারপাশ দিয়েও হাঁটেননি। বরং তিনি সচেতনভাবেই সরাসরি বলেছেন, কংগ্রেসের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি এবং ন্যায়পত্রের সঙ্গে নাকি মুসলিম লিগের প্রতিশ্রুতির সাদৃশ্য আছে। প্রধানমন্ত্রী খুব ভালো করে জানেন, তিনি তথ্য দিয়ে কংগ্রেসের ন্যায়পত্রকে খন্ডন করতে পারবেন না। তাই সরাসরি তিনি ঢুকে গিয়েছেন তাঁর পছন্দের রাস্তায়, হিন্দু- মুসলমানের মেরুকরণের রাজনীতিতে। সেই মেরুকরণ এতটাই প্রবল যে তিনি সরাসরি বলেছেন, কংগ্রেস বা বিরোধী 'ইন্ডিয়া' জোট ক্ষমতায় এলে হিন্দু মহিলাদের মঙ্গলসূত্র পর্যন্ত ছিনিয়ে নেওয়া হবে এবং তা ‘ঘুসপেটিয়া’ এবং যাঁদের বেশী সন্তান, তাঁদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হবে। তাঁর যে স্পষ্ট ইঙ্গিত, মুসলমানদের দিকে ছিল, তা সকলে বুঝলেও 'নিরপেক্ষ' নির্বাচন কমিশন অবশ্য বুঝতে পারেনি।

আরও পড়ুন: ‘খান মার্কেট গ্যাং’! ‘ঘুসপেটিয়া’র পর দেশের মুসলিমদের নতুন তকমা মোদির

আমরা জানি, আমাদের প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলন করতে স্বছন্দ নন। বিরোধীদের এ নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই। তবে তাতেও বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর কিছু যায় আসে বলে মনে হয় না। গত ৩ জানুয়ারি দিল্লির বিশিষ্ট সাংবাদিক পঙ্কজ পচৌরি তাঁর এক্স হ্যান্ডেলে লেখেন, ২০১৪ সালের ৩রা জানুয়ারি দিনটি একটি ঐতিহাসিক দিন, যেদিন ভারতের এক প্রধানমন্ত্রী শেষ সাংবাদিক সম্মেলন করেছিলেন এবং তিনি ছিলেন ডঃ মনমোহন সিং। পঙ্কজ পচৌরি আরও লেখেন, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী তাঁর সময়ে ১১৭টি সাংবাদিক সম্মেলন করেছিলেন। পাশাপাশি তাঁর প্রশ্ন ছিল, যে প্রধানমন্ত্রী সারাক্ষণ বলে বেড়ান, তিনি একজন সাহসী ব্যক্তি। তাঁর জন্যেই বিশ্বজুড়ে ভারতকে আজ শক্তিধর দেশ হিসেবে গণ্য করা হয়। সেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কেন সাংবাদিক সম্মেলন করতে এত ভয়? কেন নিউ ইয়র্ক টাইমসের মতো সংবাদপত্রে পর্যন্ত তাঁর এই সাংবাদিক সম্মেলনকে এড়ানো নিয়ে সমালোচনামূলক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়? তবে একটা কথা বলতেই হয়, আমাদের প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলন না করলেও, তাঁর সাক্ষাৎকার কিন্তু দেখা যায়। সেই সব সাক্ষাৎকার, দেশের সেরা সেরা গণমাধ্যমে সম্প্রচারিত হয়, বড় বড় সংবাদপত্রেও প্রকাশিত হয়। বহু মানুষ তা দেখেন এবং হয়তো বিশ্বাসও করেন। কিন্তু সবচেয়ে অবাক করা ঘটনা দেখা গেল এবারের লোকসভা নির্বাচনের মাঝামাঝি। এই রকমই একটি সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময়ে প্রধানমন্ত্রী সরাসরি বলেন, তিনি সমাজ জীবনে নাকি কোনোদিনই ‘হিন্দু-মুসলমান’ মেরুকরণের কথা বলেননি।

এই সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়েছিল গঙ্গা বক্ষে দাঁড়িয়ে, সেখানেই তিনি জোরের সঙ্গে বলেন, তিনি যদি জীবনে কখনো যদি ওই মেরুকরণ করে থাকেন, তাহলে তিনি সকলের মধ্যে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন। তাঁর এই সাক্ষাৎকারটির অবশ্য আরও একটি দিক ছিল, যা নিয়ে বেশী আলোচনার প্রয়োজন। অনেকেই বিশ্বাস করেন, যে আজকের প্রধানমন্ত্রী, লজিক্যাল, অর্থাৎ যুক্তিবাদী। কিন্তু তিনি নিজে বলেছেন, তিনি লজিক্যাল তো ননই, এমনকী তিনি বায়োলজিক্যালও নন। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, তাঁর জন্ম বায়োলজিকালি হয়নি, অর্থাৎ কোনও শুক্রানু বা ডিম্বানুর মিলনে তিনি জন্মাননি। তিনি ঈশ্বর প্রেরিত দূত, তাঁকে ঈশ্বর পাঠিয়েছেন দেশের মানুষের সেবা করতে। তিনি বলেছেন, তাঁর মা হয়তো তাঁকে জন্ম দেননি। এমনিতে আমরা আগে দেখেছি, প্রধানমন্ত্রী বিগত নির্বাচনগুলিতে তাঁর মায়ের সঙ্গে ক্যামেরা নিয়ে সাক্ষাৎ করেছেন, সেই ছবি মূহুর্তে ভাইরাল হয়েছে এবং তাঁর মায়ের প্রতি সম্মান, শ্রদ্ধা দেখে দেশের মানুষ মনে করেছে, এই তো এক সুপুত্রের কাজ। নিজের হাজার কাজ থাকা সত্ত্বেও তিনি তাঁর সময় বের করে তাঁর মায়ের খোঁজ নিতে যেতেন। সেই মোদিই বলে ওঠেন, যে তিনি বায়োলজিকালি জন্মাননি, এবং নিজেকে ঈশ্বরের অবতার বলে দেখানোর চেষ্টা করেন। অথচ সেই সাংবাদিক যিনি সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, তিনিও উল্টে প্রশ্ন করেন না, ‘তাহলে আপনি জন্মালেন কী করে?’ আসলে এটাই ফারাক, সাংবাদিক সম্মেলন এবং তৈরি করা সাক্ষাৎকারের।

এবার আসা যাক, কেন প্রধানমন্ত্রী নিজেকে ঈশ্বরের প্রেরিত দূত হিসেবে দেখাতে চাইছেন? আসলে তিনি জানেন, ভারতবর্ষের মানুষ ধর্মভীরু। তাঁদের কাছে যদি এই বার্তা পৌঁছে দেওয়া যায়, একজন ঈশ্বর এসেছেন তাঁদের সেবা করতে, তাহলে এই নির্বাচনে জয় যেন একপ্রকার নিশ্চিত হয়ে যায়। কিংবা পরাজিত হলেও বোধহয় আর গদিচ্যুত করা যায় না ঈশ্বরকে। একজন মানুষকে না হয় তাঁর দোষ, গুণ, ত্রুটি বিচ্যুতি দিয়ে মাপা যায়, কিন্তু ঈশ্বরের এই অবতারকে তো জাগতিক মাপকাঠি দিয়ে মাপা যায় না। আমরা যতদিন বাঁচি, ততদিন শিখি, তবে এই শেখাটা বাকি ছিল। আমরা চলচ্চিত্রে দেখেছি, ‘হীরকের রাজা ভগবান’। আসলে ধর্ম, ক্ষমতা এবং রাষ্ট্র মিলে মিশে গেলে, এই ধরনের অবতারের সৃষ্টি হয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজে সেটা জানেন। ইতিহাসে কি আগে এই ধরনের উদাহরণ দেখা গেছে? জার্মানির অ্যাডলফ হিটলারের দ্রূত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাকে তাঁর প্রচার সচিব গোয়েবেলস ঈশ্বরপ্রদত্ত গুণাবলি বলে প্রচার করতেন। না, এসব কথা অবশ্য তিনি নিজে বলতেন না। তাঁর আশেপাশের চ্যালা-চামুন্ডারা এই সমস্ত প্রচার করতেন। শোনা যায়, সেসময় একটি বড় কনক্লেভ হয়েছিল তা নিয়ে। সেখানে, লেখক, গায়ক, বুদ্ধিজীবিরা এ সমস্ত কথা প্রচার করেছিলেন আর হিটলার তা উপভোগ করেছিলেন, কিন্তু তা-ও তিনি নিজে নিজেকে অবতার বলে ঘোষণা করেননি।

আরও পড়ুন: নারী-পুরুষের মিলনে জন্মাননি! খোদ ঈশ্বর প্রেরিত দূত মোদি! প্রধানমন্ত্রীর কথা বিশ্বাস করেন?

একটি গণতান্ত্রিক কাঠামো সম্পন্ন দেশ, যাঁকে তিনি ‘মাদার অফ ডেমোক্র্যাসি’ বলে থাকেন, তাঁর ফাদার নিজে বলে বসেন, তিনি ঈশ্বরের অবতার এবং তাঁর জন্ম বায়োলজিকালি হয়নি, তখন বোধহয় লজিক অর্থাৎ যুক্তিবুদ্ধির শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। যখন কোভিড এসেছে দেশে, তখন যেভাবে থালা বাটি বাজিয়ে ভাইরাস তাড়ানোর নিদান দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী, সেদিনই বোধহয় বোঝা হয়ে গিয়েছিল ভবিষ্যতে এই যুক্তি বুদ্ধির উপরে আক্রমণ নেমে আসতে চলেছে। আজকে সেই বৃত্তই যেন সম্পূর্ণ হয়েছে। যাঁরা সেদিন বিরোধিতা করেননি, তাঁদের অনেকেই হয়তো জীবন দিয়ে বুঝেছেন যে যুক্তি বুদ্ধি বিসর্জন দিলেই আসে ভক্তি, আর সেই ভক্তি থেকেই সৃষ্টি হয় দেবতার… কখন যেন সাধারণ প্রস্তরখন্ড দেবতা হয়ে যায়, ‘দেবতার জন্ম’ হয়।

More Articles