নীরবতা আর লুকনো চোখের জল, ডিসেম্বরের ফ্রান্স দিতে পারে এইটুকুই

Christmas 2023 in Palestine : দেশ থেকে আসা ছাত্রছাত্রীরা মাথা নিচু করে লুকিয়ে রাখছে চোখের জল। ছুটিতে বাড়ি ফেরা হবে না। আর কোনওদিনই কি ফেরা হবে বাড়ি?

অ্যাডভেন্টের দ্বিতীয় সপ্তাহ। শহর গঞ্জ সেজে উঠেছে। ক্রিসমাস প্রায় দোরগোড়ায়। আলো, বাজনা, উপহার হাতছানি, তবু বাৎসরিক আয়োজনে এ বছর যেন মন খারাপের বাঁশি। যুদ্ধের দামামা। বড়দিনের উপহার কেনার ফাঁকে মানুষ পা মেলাচ্ছে মিছিলে, গলা তুলছে মিটিংয়ে। পাড়ায় পাড়ায় চলছে ইজরায়েল-হামসা যুদ্ধের বিরোধিতা। যুদ্ধবিরতির দাবিতে গলা মেলাচ্ছেন সব ধর্মের সব রঙের মানুষ।

ওয়াশিংটনে ফ্রিডম প্লাজা, লন্ডনের পার্লামেন্ট স্কোয়ার থেকে প্যারিসের প্লাস দে লা রেপুবলিক, সেই অক্টোবর মাস থেকে ছবিটা পৃথিবীর সব শহরেই সমান। দলে দলে মানুষ পথে নেমেছেন। ১০ অক্টোবর, ২০২৩, যুদ্ধ বিধ্বস্ত ইজরায়েলের প্রতি সমবেদনায় আইফেল টাওয়ারে সারা সন্ধে-রাত জ্বলেছে নীল আলো। হপ্তাখানেক পরে এই শহরের বুকেই দেখা যাবে প্যালেস্তাইনের প্রতি সমবেদনায় সরগরম প্যারিসের অলিগলি। যুদ্ধে পক্ষ নির্বাচনে দ্বিধাবিভক্ত ফ্রান্স। একদিকে প্রো-প্যালেস্তাইন মিছিল, অন্যদিকে ইহুদিদের প্রতি ক্রমবর্ধমান হিংসার বিরোধিতায় সরব আরেক দল প্যারিসবাসী। রাজধানীতে দিনে দিনে গোপনে বেড়েছে চাপান উতোর। সন্ত্রাসবাদী হামলা শুরু হয়েছে নাগরিক জীবনে। সাধারণ মানুষ, পর্যটকদের উপর আক্রমণের সংখ্যা বাড়ছে। ইওরোপের অন্যান্য দেশের মতোই ফ্রান্সের বড় শহরগুলিতে বাড়ছে বিপদের আশঙ্কা।

কিছুদিন আগে আইফেল টাওয়ারের নীচে এক আতঙ্কবাদীর হামলায় প্রাণ হারান জনৈক পর্যটক, আহত আরও দুই। হামলাকারীর বয়ান জানাচ্ছে, বিশ্বজুড়ে ইসলাম ধর্মের মানুষের মত্যুতে, মূলত এই মুহূর্তে, প্যালেস্তাইন যুদ্ধে নিহত হাজার হাজার মুসলমানের মৃত্যুর বদলা নিতেই সে অস্ত্র তুলে নিয়েছে। ইজরায়েল যে নির্যাতন চালাচ্ছে গাজায়, সেই অন্যায়ের সমান ভাগিদার ফরাসি রাষ্ট্র। মানসিক অসুস্থতার শিকার এই ব্যক্তির অপ্রত্যাশিত আচরণে ফ্রান্স জুড়ে আলোড়ন। উৎসবের মরসুমে, খুব দ্রুতই মেরুকরণ ঘটছে ফরাসি সমাজে! ইজরায়েল না প্যালেস্তাইন? সমর্থন কার দিকে?

আরও পড়ুন- কেন এত বিখ্যাত প্যালেস্তাইনের সাদা-কালো স্কার্ফ! কেফিয়াহর বিশেষ প্রতীকের অর্থ অবাক করবে

ফ্রান্সে অতএব, এ বছর শীতের আবহাওয়া অনিশ্চিত। ডিসেম্বরের শিরশিরে হাওয়ায় হাতে হাত গলিয়ে গরম গ্ল্যুওয়াইনে চুমুক দিয়ে হালকা মনে ঘুরে বেড়ানোর শীতের ছুটি এবছর নয়। সপ্তাহ শেষে সব পাড়ায় মিছিল বেরিয়েছে প্যালেস্তাইনের পক্ষে। রাষ্ট্র সে সব মিছিল একবাক্যে মেনে নিতে চাইছে না। অক্টোবরের শেষ শনিবার প্যালেস্তাইনে যুদ্ধবিরতির দাবিতে প্যারিসে মিছিল বের করার প্রস্তাব শহর কর্তৃপক্ষ নাকচ করে দেয়। তাদের আশঙ্কা, এই মিছিলের কারণে স্বাভাবিক জনজীবন ব্যাহত হতে পারে। ইতিমধ্যেই ফ্রান্সের বিভিন্ন জায়গায় অ্যান্টি-সেমিটিক আচরণ বাড়ছে। প্যারিসের বিভিন্ন পাড়ায় ইহুদিদের বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, দরজা-জানলা ভাঙচুর চলছে। মিছিলের মাঝে দু'পক্ষে গণ্ডগোল বাঁধলে সামলানো মুশকিল।

যদিও এসব কোনও যুক্তির তোয়াক্কা না করেই প্যারিসবাসী শনিবার ঠিক সময়মতো রাস্তায় নেমেছে। এক থিয়েটারকর্মীকে বলতে শোনা যায়, "মানবাধিকারের দেশে মানবাধিকারের দাবিতে হাঁটা যাবে না, এমন অবিচার আমরা মানছি না!" এই মিছিলে হেঁটেছেন সরকারি কর্মচারি, আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, অভিনেতা, লেখক, ছাত্র, অভিভাবক। গায়ে জড়ানো প্যালেস্তাইনের পতাকা, গলায় স্লোগান, হাতে সাইনবোর্ডে গোটা অক্ষরে লেখা

"Where has our humanity gone?"

মার্সেই শহরে প্যারিসের মতোই মিটিং মিছিল বন্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছিল মিউনিসিপালিটি। গত সপ্তাহে কলেক্টিফ উর্জন্স প্যালেস্তাইন নামক সংস্থা এক মিছিলের ডাক দিয়ে একটি ভিডিও প্রকাশ করে যেখানে সরাসরি বলা হয়, "la première Intifada" -র কথা এবং হামাস বাহিনীর ব্যাবহৃত স্লোগান তোলা হয় "Vive la résistance"। শহরবাসীর এমন আবেগপ্রবণ উত্তেজনা দেখে কর্তৃপক্ষ মনে করে, এ মিছিলের অভিপ্রায় হয়তো শান্তিপূর্ণ নয়, বরং শহরে নতুন করে হিংসার বাতাবরণ তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। মার্সেই এমনই শহর যেখানে দিশি মদের দাম ১০সেন্ট বাড়লে রাস্তা অবরোধ করা হয়। অতএব, এবার উৎসবের বাতাবরণে জল ঢেলে প্রতিবাদ না করতে দেওয়ার বিরুদ্ধে দু'দিন প্রতিবাদ চালায় মার্সেইবাসী। ফলাফল, মিউনিসিপালিটির থেকে মিছিলের অনুমোদনপত্র আদায় করে নির্দিষ্ট দিনে মিছিল শুরু হয় পোর দ'এইক্স-এর রাজপথে। স্লোগানে লেখা হয়

"Du fleuve à la mer, la Palestine sera libre" (From the river to the sea, Palestine will be free).

আরও পড়ুন- স্নান-খাওয়ার জলটুকুও নেই! দূষিত সমুদ্রের জলেই বাঁচছে গাজার শরণার্থী শিশুরা

বন্দরে তখন জ্বলে উঠছে ক্রিসমাসের আলো। উৎসবের নিয়মে একে অপরের জন্য উপহার পাঠাচ্ছে মানুষ। ধর্মে ধর্মে বিরোধ, ধর্মে ধর্মে যুদ্ধ। কিন্তু সাধারণ মানুষ তার আদিম ধর্ম মেনে অন্য দেশের সম্পূর্ণ অচেনা নাগরিকের জন্য পাঠাচ্ছে সহমর্মিতা। দাবি করছে ন্যায়বিচার। সমর্থনের পাল্লা প্যালেস্তাইনের দিকে খানিক ভারী হলেও, সকলেই চাইছেন যুদ্ধ বন্ধ হোক। বন্ধ হোক নিরীহ মানুষের প্রাণহানি। সাধারণ মানুষকে এই ভয়াবহ অত্যাচার থেকে মুক্তি দেওয়ার ব্যবস্থা হোক। গত শীতে যত গলি থেকে রাজপথ ইউক্রেন যুদ্ধের বিরোধিতায় ব্যস্ত ছিল, এ বছর সেই সব প্লাজা বা স্কোয়ারে অন্য যুদ্ধের বিরোধিতা। দেশ বদলায়, মানুষ বদলায়, দাবি একটাই: শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের।

উৎসবের কোলাহল থেকে এবছর একটু দূরে দাঁড়িয়ে ফ্রান্সের মানুষ ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন যুদ্ধে নিহতদের উদ্দেশ্যে দু'দণ্ড নীরবতায় কাটাচ্ছেন। ও দেশ থেকে আসা ছাত্রছাত্রীরা মাথা নিচু করে লুকিয়ে রাখছে চোখের জল। ছুটিতে বাড়ি ফেরা হবে না। আর কোনওদিনই কি ফেরা হবে বাড়ি? দিন শেষে কোনওমতে পরিবারের থেকে একটা খবর পেলে নিশ্চিন্ত, না হলে হা-হুতাশ, এইভাবেই পরদেশে দিন কাটাচ্ছেন যুদ্ধাঞ্চলের এক্সপ্যাটরা। পরিবারে সবার জন্য সারা বছর ধরে জড়ো করা উপহার রঙিন কাগজে মোড়া হবে না এবছর। বিষণ্ণ এই ডিসেম্বরে উপহার পাঠানোর ঠিকানা ধুলোয় মিশেছে। মানুষে-মানুষে চলছে দূর থেকে সংহতি বিনিময়, এক হাতে অপর হাত ধরে রাখার প্রতিশ্রুতি। আবার কোনওদিন ঘরে ফেরার আশা, গোটা পরিবার পরিজনকে আরেকবার দেখতে পাওয়ার স্বপ্ন। এ বছর ক্রিসমাসে এগুলিই সবচেয়ে দামী উপহার।

More Articles