আরজি কর: রাস্তা জুড়ে আঁকায়-লেখায় প্রতিবাদ, যে ভাবে আন্দোলনের ভাষা হয়ে উঠছে গ্রাফিতি
Kolkata Doctor Rape-Murder Case: স্লোগান, গানের পাশাপাশি এই আন্দোলনের চরিত্র হয়ে উঠেছে রং-তুলিও। আর তার প্রমাণ মিলবে কলেজ স্ট্রিটে গেলেই। সেখানে রাস্তা জুড়ে প্রতিবাদ এঁকে দিয়েছেন শিল্পীরা।
আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সেমিনার রুম থেকে ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় উদ্ধার হয় এক চিকিৎসক তরুণীর মৃতদেহ। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট অনুযায়ী, তাঁর শরীরের অন্তত চব্বিশটি জায়গায় আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। নির্মম ভাবে ধর্ষণ ও খুন করার প্রমাণ মিলেছে সর্বত্র। সেই চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনের প্রতিবাদে উত্তাল গোটা রাজ্য। রাজ্য পেরিয়ে আন্দোলনের ঢেউ ছুঁয়েছে দেশ, এমনকী ঘটনার ভয়াবহতায় কেঁপে উঠেছে গোটা বিশ্ব। নানা স্তর, নানা মহল থেকে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। চিকিৎসকেরা তো বটেই, তারকা থেকে সাংস্কৃতিক মহল, আইটি কর্মী থেকে উকিল, পিছিয়ে নেই কেউ। কোথাও তাঁকে ডাকা হচ্ছে 'তিলোত্তমা' নামে, কেউ বা তাঁকে ডেকেছেন 'অভয়া'। আরজি করের ঘটনায় তদন্তভার রাজ্যপুলিশের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে সিবিআইয়ের হাতে তুলে দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট। ওই ঘটনায় স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে মামলা করেছে সুপ্রিম কোর্টেও। স্লোগান, গানের পাশাপাশি এই আন্দোলনের চরিত্র হয়ে উঠেছে রং-তুলিও। আর তার প্রমাণ মিলবে কলেজ স্ট্রিটে গেলেই। সেখানে রাস্তা জুড়ে প্রতিবাদ এঁকে দিয়েছেন শিল্পীরা। আরজি করের নির্যাতিতার জন্য বিচার চেয়ে আঁচড়ে-রঙে বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে রাজপথ।
আরও পড়ুন: এই উদাসীন আন্দোলনের রঙ্গমঞ্চে ইলা মিত্রকে খুব প্রয়োজন আজ
আরজি কর মামলা নিয়ে গোড়া থেকেই কোণঠাসা রাজ্য সরকার। প্রমাণ লোপাট-সহ দোষীদের আশ্রয় দেওয়ার মতো একাধিক অভিযোগ তোলা হচ্ছে শাসকের বিরুদ্ধে। সেই ব্যাপারটি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টেরও ভর্ৎসনার মুখে পড়েছে রাজ্য সরকার। এখনও পর্যন্ত ওই ঘটনায় এক সিভিক পুলিশকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। সম্প্রতি সামনে এসেছে মৃতার ময়নাতদন্তের রিপোর্ট। নিহতের শরীরে পাওয়া ডিএনএ-র সঙ্গে অভিযুক্তের ডিএনএ মিলিয়ে দেখার চেষ্টা চলছে। বুধবার একাধিক দাবি নিয়ে সিজিও কমপ্লেক্স থেকে স্বাস্থ্যভবন পর্যন্ত মিছিল করেন চিকিৎসকদের দল। সেখানে যেমন ছিলেন জুনিয়র ডাক্তারেরা, তেমনই ছিলেন সিনিয়র চিকিৎসকেরাও। গত ৯ অগস্ট দেহ উদ্ধার হয় ওই চিকিৎসকের। তার পর থেকেই বিক্ষোভের পথে হেঁটেছেন চিকিৎসকেরা। দীর্ঘদিন ধরেই চলছে তাঁদের কর্মবিরতি। এমনকী সুপ্রিমকোর্টের উপরোধেও বিক্ষোভ প্রত্য়াহারের পথে হাঁটেনি চিকিৎসক মহল। কর্মক্ষেত্রে চিকিৎসকদের নিরাপত্তা ও ধর্ষিতার সঙ্গে যা ঘটেছে, তার বিচার না-হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন তাঁরা। যে কারণে গোটা রাজ্য জুড়েই চাপের মুখে পড়েছে চিকিৎসা পরিকাঠামো। এমনকী তার আঁচ ছড়িয়েছে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালেও।
এরই মধ্যে যে যার মতো করে প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে নিয়েছেন। রাস্তায় নেমে প্রায় প্রতিদিনই চলছে আন্দোলন-প্রতিবাদ। কখনও নেমেছেন অভিনেতা-তারকারা, কখনও গায়ক-গায়িকা, কখনও আবার নৃত্যশিল্পী বা বাচিকশিল্পীরা ডাক দিয়েছেন পথে নামার। আইটি কর্মী থেকে শুরু করে আইনজীবী, গাড়িচালক থেকে বিভিন্ন পেশার মানুষ এগিয়ে এসেছেন এই আন্দোলনের শরিক হতে। এর আগে এত বড় আন্দোলন শেষ কবে শহর দেখেছিল, মনে করা কঠিন। বরাবরই কলেজ স্ট্রিটের রাস্তা সরগরম থেকেছে আন্দোলনের জোয়ারে। মিটিং-মিছিলে মোড়া থেকেছে সেই রাজপথ। গোটা শহর যখন আরজি করের ঘটনার প্রতিবাদে মুখর, তখন কলেজ স্ট্রিট যেন আস্ত প্রতিবাদ হয়ে জেগে রইল। আরজি করের নির্যাতিতার জন্য সুবিচার চেয়ে রঙে-স্লোগানে বাঙ্ময় হয়ে উঠল। আজ থেকে নয়, দু-এক দশক ধরেই গ্রাফিতি শিল্প হয়ে উঠেছে এক অন্যতর প্রতিবাদের ভাষা, আন্দোলনের স্বর।
আর সেই স্বরই নতুন করে ফুটে উঠল কলেজস্ট্রিটের রাস্তার আনাচেকানাচে। মঙ্গলবার মধ্যরাতে সেজে উঠল কলেজস্ট্রিটের বিখ্যাত সেই রাস্তা। যার একধারে প্রেসিডেন্সি কলেজ, হেয়ার স্কুল, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আর মেডিক্যাল কলেজ। অন্য ধারে দাঁড়িয়ে রয়েছে হিন্দু স্কুল। একসময় নবজাগরণ ও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের আতুরঘর হয়ে উঠেছিল এই সব রাস্তাই। এখনও কান পাতলে কংক্রিটের বুকে শোনা যায় সেই সব আন্দোলন আর প্রতিবাদের ইতিহাস। আরও একবার সেই জায়গাই ফিরিয়ে আনল কলেজ স্ট্রিটের বুকে একরাশ গ্রাফিতি। রাস্তাতেই ফুটে উঠল প্রতিবাদের ছবি। মঙ্গলবার সেই প্রতিবাদের শিল্পে হাত মেলালেন চিত্রপরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়। প্রেসিডেন্সি কলেজেরই পড়ুয়া ছিলেন এক সময়। দেওয়াল লিখন, প্রতিবাদে মোড়া সেই কলেজ জীবনই যেন মঙ্গলবার ফিরে এল রং-তুলিতে। সাদা টি শার্ট আর বারমুডায় রাস্তায় তুলি হাতে দেখা গেল তাঁকে। শুধু সৃজিতই নন, অনেকেই এই আঁকায় হাত মিলিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন:দাবি মানতে গড়িমসি স্বাস্থ্যভবনের! আরজি কর কাণ্ডে আরও বাড়বে চিকিৎসকদের আন্দোলনের ঝাঁজ?
এই বিশেষ কর্মসূচীর নাম রাখা হয়েছে 'রাতে জাগো দিনে জাগাও'। মঙ্গলবার সৃজিত-সহ অনেককেই কলেজস্ট্রিটে রাস্তায় রংতুলি হাতে দেখা গেলেও এর শুরুটা কিন্তু হয়ে গিয়েছিল ১৯ অগস্ট, সোমবার থেকেই। সারারাত ধরেই চলেছে রাস্তায় আঁকা, লেখা, স্লোগানিং, প্রতিবাদী গান-বাজনা। ঠিক হয়েছে, সারা শহর ও শহরতলিতে রোজ রাতে দল বেঁধে এই কাজ হতে থাকবে। আঁকাঝোঁকা চলবে রাস্তা জুড়ে, লেখা হবে দেওয়াল। আঁকা-গ্রাফিতির মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হবে প্রতিবাদ। যেসব এলাকায় এই কাজ হবে, তার জন্য আগে থেকেই মেইলের মাধ্যমে যোগাযোগ করা হয়েছে সেই সব এলাকার থানায়, জানানো হয়েছে আবেদন। এই উদ্যোগে এগিয়ে এসেছেন অসংখ্য মানুষ। প্রতিবাদের স্বর পৌঁছে দিয়েছেন, রাস্তায় লেখা-আঁকার জন্য জোগান দিয়েছেন লেখা-আঁকার ভাবনা। কোনও রাজনৈতিক দল বা সংগঠন নয়, সাধারণ ছাত্রছাত্রী থেকে শিল্পীরা এগিয়ে এসেছেন এই প্রতিবাদ কর্মসূচীতে। এত এত রাস্তা আঁকার জন্য প্রয়োজনীয় রং-তুলি ও অন্যান্য সামগ্রী কেনার খরচ জোগার করতে ব্যবস্থা করা হয়েছে ক্রাউড ফান্ডিংয়েরও। স্লোগানে, চিৎকারে প্রতিবাদ তো রয়েইছে, তার সঙ্গেই এই অনুচ্চ প্রতিবাদকেও শহরের বুকে ছড়িয়ে দিতেই এই সাধু উদ্যোগ বলেই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।