চিড়িয়াখানার খাঁচায় বন্দি মানুষ! কৃষ্ণাঙ্গ আদিবাসী ওটা বেঙ্গার কাহিনি সভ্যতার লজ্জা
৪ ফুট ১১ ইঞ্চি উচ্চতার পিগমি তরুণ ওটাকে তাঁর বাড়ির সামনে থেকেই অপহরণ করেন স্যামুয়েল। ১৯০৬ সালে তাঁকে নিউইয়র্কের সবচেয়ে বড়ো চিড়িয়াখানায় বানরের খাঁচায় বন্দি করে রাখা হয়। অনেকেই বুঝতে পারতেন না ওটা আসলে মানুষ নাকি বানর?
পিগমি বললে প্রথমেই কী মনে পড়ে? যারা আশি বা নব্বইয়ের দশকে ছোটোবেলা কাটিয়েছেন, তাঁদের বোধহয় গুরানকেই সবচেয়ে আগে মনে পড়বে। পিগমি সর্দার গুরান। খুলিগুহায় অবাধ যাতায়াত ছিল তাঁর। এই পিগমিরাই জানত বেতালের আসল পরিচয়। অথবা সিংহদমন গাটুলা সর্দার। হেমেন্দ্রকুমার রায়ের ‘আবার যকের ধন’-এর সেই দুর্দান্ত যোদ্ধা। তাঁর কথাও মনে পড়তে পারে। কিন্তু যদি বলা হয় ওটা বেঙ্গার কথা? মনে পড়ছে? নাহ, আপনার দোষ নয়, সত্যি বলতে তাঁকে কেউ মনে রাখেনি সেভাবে। তবে ইতিহাস চর্চাকারীদের কাছে এই নামের অসীম গুরুত্ব। আসলে ওটা বেঙ্গা নিছক রক্তমাংসের এক মানুষই নন বরং সভ্যতার বুকে তিনি এক প্রতীক। তিনি মানুষের নির্লজ্জ বৈষম্যের প্রতীক। প্রতীক সাদা চামড়ার অশ্লীল অহংয়ের। ‘সভ্য মানুষ’ তাঁকে চিড়িয়াখানায় রেখেছিল দীর্ঘ দিন। তাঁকে দেখানো হত মেলাতেও। তিনি ইতিহাসের বুকে এমন এক অধ্যায়ের প্রতীক, যা স্মরণ করলে সভ্য মানুষের মাথা নুয়ে পড়তে বাধ্য। তাঁর জীবনের গল্প শুনলে পাথরেরও চোখে জল আসতে বাধ্য।
১৯০৪ সালের মার্চ মাস। কঙ্গো সেই সময় বেলজিয়ামের উপনিবেশ। ওটার বাড়ির এলাকায় আমেরিকার বাসিন্দা স্যামুয়েল ভার্নার ঘুরতে আসেন। ওটার বয়স তখন ২০ বছর। ৪ ফুট ১১ ইঞ্চি উচ্চতার পিগমি তরুণ ওটাকে তাঁর বাড়ির সামনে থেকেই অপহরণ করেন স্যামুয়েল। ১৯০৬ সালে তাঁকে নিউইয়র্কের সবচেয়ে বড়ো চিড়িয়াখানায় বানরের খাঁচায় বন্দি করে রাখা হয়। দর্শনার্থীদের অনেকেই বুঝতে পারতেন না ওটা আসলে মানুষ নাকি বানর? ছোটোখাটো দেখতে, গায়ের রং কালো, দাঁত অত্যন্ত তীক্ষ্ণ। পরণে পোশাক থাকলেও পায়ে কোনও জুতো ছিল না। নিশানা লক্ষ্য করে ধনুক দিয়ে তীর ছুড়ে মারার ব্যাপারে অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন তিনি। নানা রকমের কসরত দেখিয়ে তিনি দর্শকদের আনন্দ দিতেন। বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী দর্শকদের প্রধান আগ্রহ ছিল ওটার ধারালো দাঁত।
চিড়িয়াখানায় ওটা ছিলেন এক ‘আইটেম’। যাঁকে দেখার জন্য ভিড় উপচে পড়ত বানরদের খাঁচার সামনে। হ্যাঁ, ‘সভ্য’ মানুষের খেয়ালে তাঁর জায়গা হয়েছিল সেখানেই। এমনও শোনা যায়, কোনও কোনও দিন ওটা বেঙ্গার খাঁচার সামনে জড়ো হয়ে যেতেন প্রায় পাঁচশো লোক! সেই কারণেই প্রথমে ছোটো খাঁচায় রাখা হলেও পরে তাঁকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় বড়ো খাঁচায়। কেবল তাঁর জন্যই রাতারাতি দর্শক সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যায়। এমন ‘আমোদ’ কি সহজে মেলে? দর্শকরা তাঁর দিকে নানা কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি করতেন। প্রথম প্রথম ততটা না হলেও অচিরেই ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে তাঁর। ক্রমশ হিংস্র হয়ে উঠতে থাকেন ওটা বেঙ্গা।
আরও পড়ুন- মহিলাদের চুলেই ছিল পাচারের রাস্তা! কোথা থেকে এল ‘খোঁপা’ শব্দটি
শেষ পর্যন্ত কী হয়েছিল আফ্রিকার অরণ্য থেকে শহরের বুকে পৌঁছে যাওয়া সেই মানুষটির? সেকথা বলার আগে জানানো দরকার, তিনি কী করে পৌঁছেছিলেন তথাকথিত বুট-হ্যাট পরা সভ্যদের মাঝখানে! ১৮৮৩ সালে মধ্য আফ্রিকার কঙ্গোতে জন্ম ওটা বেঙ্গার। ক্রমে সেই জায়গাটি হয়ে ওঠে রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ডের শাসনাধীন বেলজিয়ামের উপনিবেশ। অরণ্যের নিয়ম মেনে অল্প বয়সেই বিয়ে হয়ে যায় ওটা বেঙ্গার। সন্তানও হয়। কিন্তু কে জানত সামনের দিনগুলোর উপরে নেমে আসতে চলেছে অন্ধকার পর্দা। শিকার করতে গিয়েছিলেন বেঙ্গা। ফিরে এসেই দেখেন গ্রাম হয়ে গিয়েছে শ্মশান! তাঁর পরিবারের সকলেই মারা গিয়েছেন রাজার সেনার অতর্কিত আক্রমণে। সেই ভয়ঙ্কর আঘাত সইতে না সইতেই অচিরে ধরা পড়তে হল ক্রীতদাস ব্যবসায়ীদের হাতে। এদিকে ১৯০৪ সালে আফ্রিকায় এলেন স্যামুয়েল ফিলিপস ভার্নার। লক্ষ্য ‘সেন্ট লুইস ওয়ার্ল্ড ফেয়ার’-এর প্রদর্শনীর জন্য বেশ কয়েকজন পিগমিকে নিয়ে যাওয়া। খাঁচাবন্দি বেঙ্গাকে দেখে পছন্দ হয়ে গেল তাঁর। কয়েক বস্তা নুন আর কয়েক গোছা পিতলের তারের বিনিময়ে সওদা সম্পূর্ণ হল! যদিও শেষ পর্যন্ত ভার্নারকে ছাড়াই বেঙ্গা ও তাঁর মতো কয়েকজন হতভাগ্যকে আমেরিকায় নিয়ে আসা হয় ১৯০৪ সালের জুনে। ভার্নার সেই সময় ম্যালেরিয়া আক্রান্ত। পরে দেশে ফিরে তিনি বুক ফুলিয়ে গল্প বানিয়ে বলে দেন, ওটা বেঙ্গাকে নাকি নরখাদকদের হাত থেকে উদ্ধার করেছেন তিনি।
আমেরিকায় এসেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন ওটা বেঙ্গা। সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল তাঁর ওই তীক্ষ্ণ দাঁত। আসলে জঙ্গলের এক প্রথা মেনে ছোটোবেলাতেই ওইভাবে দাঁতগুলোকে বল্লমের ফলার মতো বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যা দেখে সভ্য মানুষদের গা শিরশির করত। সেই সময়কার এক কাগজে দাবি করা হয়, বেঙ্গা নাকি তাঁর দাঁত দর্শকদের একবার দেখানোর জন্য ৫ সেন্ট দাবি করেন! এমনকি, ছবি তুলতে বা কসরত দেখাতেও পয়সা নেন। বলাই বাহুল্য, এসবই রঙিন গল্প। প্রদর্শনীর শেষে অবশ্য একবার বাড়ি ফেরার সুযোগ হয়েছিল বেঙ্গার। কিন্তু কোথায় যাবেন তিনি? তাঁর গ্রামটাই যে নিশ্চিহ্ন। তাঁর সঙ্গে যাঁদের নিয়ে আসা হয়েছিল, তারা কেউ পিগমি নন, বাটোয়া উপজাতির। শোনা যায়, এই সময় এক বাটোয়া মহিলাকে নাকি বিয়ে করেছিলেন বেঙ্গা। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সেই মহিলা মারা যান সাপের কামড়ে। এরপরই ফের আমেরিকা ফেরার সিদ্ধান্ত। গিয়ে পড়া সেই চিড়িয়াখানায়, যার কথা আগেই বলা হয়েছে।
তবে ওই চিড়িয়াখানায় বেঙ্গার দুর্ভোগ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। সৌজন্যে চার্লস ডারউইন! আসলে ডারউইনের বিবর্তনবাদ খ্রিস্টিয় বিশ্বাসের পুরো উলটো। তাই খ্রিস্টান নেতারা সমালোচনা করে বলতে থাকেন, বেঙ্গাকে যেভাবে মানুষ ও পশুর মিসিং লিঙ্ক বানানো হচ্ছে তা অন্যায়। জনগণের একাংশের ক্ষোভের মুখে পড়ে চিড়িয়াখানা থেকে মুক্তি দেওয়া হয় ওটাকে। চিড়িয়াখানা থেকে বেরিয়েও অবশ্য সম্পূর্ণ মুক্তি হয়নি তাঁর। আফ্রিকান-আমেরিকান রেভারেন্ড জেমস এইচ গর্ডন পরিচালিত নিউ ইয়র্কের ‘হাওয়ার্ড কালারড অরফান’ মানসিক চিকিৎসাকেন্দ্রে জায়গা হয় ওটার।
আরও পড়ুন- ধ্বংস হচ্ছে পৃথিবীর ফুসফুস, সংশয়ে হাজার হাজার আদিবাসীর জীবন! নেপথ্যে কারা?
১৯১০ সালের জানুয়ারিতে ওটাকে ভার্জিনিয়ার লিঞ্চবার্গে ‘লিঞ্চবার্গ থিওলজিক্যাল সেমিনারি অ্যান্ড কলেজ’-এ পাঠিয়ে দেন গর্ডন। এই স্কুলে মূলত কৃষ্ণাঙ্গ ছাত্ররাই পড়াশোনা করতেন। স্কুলে বেশ কয়েক জনের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় ওটার। সেখানে তিনি অন্যদের শেখাতেন, কী ভাবে শিকার করতে হয় এবং মাছ ধরতে হয়। রাতের খোলা আকাশের তলায় আগুন জ্বালিয়ে তার চারপাশে বৃত্তাকারে ঘুরে ঘুরে নাচগান করতেন তিনি। এছাড়াও বাড়িতে থাকার সময় তিনি কী কী করতেন সেই গল্পও বন্ধুদের শোনাতেন ওটা। তবে মনের ভেতর সেই ফেলে আসা কঙ্গো চাগাড় দিতে থাকে বছর তিরিশের যুবক ওটার।
লিঞ্চবার্গে স্থানীয় এক শিক্ষকের কাছে থেকে ওটার ইংরেজি শিক্ষা শুরু হয়। কাজ চালানোর জন্য যথেষ্ট ইংরেজি শেখা হয়েছে ভেবে এক দিন হঠাৎই স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেন তিনি। লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে অর্থ উপার্জনের জন্য লিঞ্চবার্গের একটি তামাক কারখানায় কাজ শুরু করেন ওটা। তখন থেকেই তাঁর বাড়ি ফেরার চেষ্টার শুরু। না, আর ফিরতে পারেননি বেঙ্গা। ততদিনে শুরু হয়ে গিয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। আফ্রিকা যাওয়ার সব জাহাজ বন্ধ। ক্রমে বিষণ্ণতা গ্রাস করে তাঁকে। একদিন লুকিয়ে রাখা একটা বন্দুক দিয়ে আত্মহত্যা করে বসেন অসহায় মানুষটি। ১৯১৬ সালে, কোনও দিন আর বাড়ি ফিরতে পারবেন না বুঝতে পেরে আত্মঘাতী হয়েছিলেন তিনি। বারবার চেষ্টা হয়েছে, ‘ওসব বানানো কথা’ বলে ওটার প্রসঙ্গ উড়িয়ে দেওয়ার। ওটা বেঙ্গার মৃত্যুর পর ১৯১৬ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার এক প্রতিবেদনে তাঁকে প্রদর্শন করার গল্প প্রত্যাখ্যান করা হয়। পত্রিকাটির নিবন্ধে বলা হয়, “তিনি এমন একটা কাজ করতেন যে মনে করা হতো তাঁকে বুঝি প্রদর্শনীর জন্য বানরের খাঁচায় বন্দি করে রাখা হয়েছে।” কিন্তু শেষ পর্যন্ত ২০২০ সালের অগাস্ট মাসে ক্ষমা চায় ব্রঙ্কস চিড়িয়াখানা। কথিত আছে ক্ষমাই পরম ধর্ম, কিন্তু ক্ষমা চাইতে যদি এক শতাব্দীরও বেশি লেগে যায় তাহলে সত্যিই কি ক্ষমা করা যায়?