যত্রতত্র কিউআর কোড স্ক্যান করছেন, কী ভয়াবহ বিপদ লুকিয়ে রয়েছে জানেন?
QR Code Scan: পিৎজা় অর্ডার করতে গিয়ে আপনার আপনার অগোচরেই সরকার জানতে পারবে আপনি তাঁকে ভোট দেবেন কিনা
আপনি কী ধরনের কফি খেতে ভালোবাসেন, আপনার পছন্দের কফিশপের ওয়েবসাইট ইতিমধ্যেই তা জানে। কিংবা আপনি পাস্তা ইন রেড সস বা হোয়াইট সসের মধ্যে কোনটি পছন্দ করেন, পিৎজা় খেলে কী টপিং দিয়ে খেতে ভালোবাসেন, সেসবই জানে আপনার পছন্দের ক্যাফের ওয়েবসাইট। কিউআর কোডের ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খাবার-দাবার চটজলদি অর্ডার করতেও সুবিধে হয়েছে আজকাল। নিজের পছন্দের রেস্তোরাঁ বা ক্যাফেতে যান, টেবিলে রাখা কিউআর কোডটি মোবাইলে স্ক্যান করলেই সঙ্গে সঙ্গে আপনি পৌঁছে যাবেন সেই সংস্থার ওয়েবসাইটে। পেয়ে যাবেন মেনু। সেখানেই অর্ডার করে দাম মিটিয়ে দিতে পারবেন। মেনু কার্ড বা ওয়েটার কারও অপেক্ষায় বসে থাকতে হবে না। বলার অপেক্ষা রাখে না, কিউআর কোডের ব্যবহারের এই অভ্যেস কোভিড প্যান্ডেমিকের সময় থেকে হু হু করে বেড়েছে।
ক্যাফে বা রেস্তোরাঁর কথা বাদই দিলাম, মাঝারি থেকে বড় ব্যবসায়ীরা নিজেদের পসরা আপনার সামনে পেশ করবেন বলে, শরণাপন্ন হয়েছেন সেই কিউআর কোডেরই। চাইলেই সেই ওয়েবপেজের ইউআরএলটিও রাখা যায়। কিন্তু সেই দীর্ঘ ইউআরএল সঠিকভাবে টাইপ করা সময় সাপেক্ষ বিষয়, ধৈর্যও লাগে। তাই অগত্যা কিউআর কোডের ব্যবহার, যার মধ্যেই থাকে ইউআরএলটি। ফোনের ক্যামেরা তাক করলেই স্ক্যানার চিনতে পারে সেই ইউআরএল। কিন্তু আপনি কি জানেন এই সাদা-কালো চৌকো-চৌকো দাগ দিয়ে তৈরি নকশার মধ্যেই কতটা বিপদ লুকিয়ে রয়েছে?
কিউআর কোড অ্যানালগ এবং ডিজিটাল জগতের মেলবন্ধন ঘটায়। আর এই ডিজিটাল যোগাযোগের সময়ই আপনার ব্যক্তিগত তথ্য আদায় করে সেই ওয়েবসাইটি, যেটিতে আপনি কিউআর কোড স্ক্যান করে ঢুকেছেন। ‘দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট’ সূত্রে জানা যাচ্ছে, ফরেস্টার নামে একটি গবেষণা সংস্থা ২০২১ সালে জানিয়েছে, এ যাবৎ যত ব্যক্তি স্মার্টফোনের সাহায্যে কিউআর কোড ব্যবহার করে কোনও ওয়েবপেজে প্রবেশ করেছেন, তাঁদের পঞ্চাশ শতাংশ ব্যক্তি বাধ্য হয়েছেন তাঁদের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করা থেকে ওয়েবপেজগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে।
আরও পড়ুন- ৪জি-র থেকে দশগুণ বেশি স্পিড, ভারতকে কতটা বদলে দেবে ৫জি পরিষেবা
মোজি়লা ফায়ারফক্সের মুখ্য টেকনোলজি অফিসার এরিক রিসকরলা ‘দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট’-কে জানিয়েছেন কিউআর কোড ব্যবহারের ফলে আমাদের গোপনীয়তা নষ্ট হতে পারে। পাশাপাশি এরিক রিসকরলা এও জানিয়েছেন কিউআর কোড নিজে আমাদের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ বা চুরি করে না, এর কারণে আমাদের গোপনীয়তাও নষ্ট হয় না। কিন্তু কিউআর কোড যে ওয়েবসাইটে আমাদের নিয়ে যায়, সেই ওয়েবসাইটটি এই ধরনের কাজ করতেই পারে।
অ্যাডওয়ার্ভের প্রোডাক্ট ডিরেক্টর ব্রেন্ট রামোস ‘দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট’-কে জানিয়েছেন, বিভিন্ন ব্র্যান্ডের পণ্যের উপরে যে কিউআর কোড থাকে, তা আমাদের কোন ওয়েবসাইটে নিয়ে যাবে এবং সেই ওয়েবসাইট আমাদের সম্পর্কে কী কী তথ্য সংগ্রহ করবে তা স্পষ্টভাবে ক্রেতাদের জানানো উচিত। পাশাপাশি, সংগ্রহ করা তথ্য কী কাজে ব্যবহার করা হবে এবং তা তৃতীয় কোনও ব্যক্তি পরবর্তীতে ব্যবহার করবেন কিনা, তাও জানানো প্রয়োজন।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই তথ্যগুলি সংগ্রহ করে কুকিজ়। যাদের কাজ হল ওয়েবসাইট ব্যবহারের সময় আপনার, আমার অভিজ্ঞতা যাতে ভালো হয় তা নিশ্চিত করা। ধরুন, একটি রেস্তোরাঁ থেকে বারবার মার্গারিটা পিৎজা় অর্ডার করেন, সেক্ষেত্রে পরবর্তীকালে যখন আপনি সেই ওয়েবসাইটে যাবেন, তখন সেই ওয়েবসাইট আপনাকে আপনার পছন্দের মার্গারিটা পিৎজা়র কথাই মনে করিয়ে দেবে। বা হয়তো জানাবে, অনেক তো মার্গারিটা পিৎজা় খেলেন, এবার একটু সলামি পিৎজা়ও খেয়ে দেখুন।
এ তো না হয় আমাদের ছোটোখাটো খাদ্যাভাসের তথ্য সংগ্রহ করা। কিন্তু ওয়েবসাইটগুলি তো আমাদের ফোন নম্বর, ঠিকানা, নাম-ধাম, আপনি কাদের সঙ্গে মেলামেশা করেন, কাদের সঙ্গে চলাফেরা করেন, আপনি কোথায় কোথায় যান এবং সেই সব জায়গায় কত সময় কাটান, সব তথ্য হামেশাই আমাদের অজান্তে সংগ্রহ করে। এর আগে এরকম একাধিক সংস্থা তথ্য সংগ্রহ করে, ব্যবহারকারীর অনুমতি ছাড়াই সেই তথ্য বিক্রি করেছে। জনসমক্ষে এনে হাজির করেছে সেই ব্যক্তিগত তথ্য। যাদের মধ্যে কুখ্যাত হল মার্কিন সংস্থা ‘ক্লিয়ারভিউ এআই’। এমনকি আপনার, আমার অবারিত ভার্চুয়াল চারণক্ষেত্র ফেসবুকও বাদ যায়নি তালিকা থেকে। তাতে গোপনীয়তা তো নষ্ট হয়েছে বটেই। জীবন সংশয়ের সম্ভাবনাও এড়ানো যায়নি।
শুধু তাই নয়, আপনি কোন কোন ওয়েবসাইটে ঘুরে বেড়ান, আপনি কোন রাজনৈতিক দলকে ভোট দেন, কোন রাজনৈতিক দলের নিন্দেমন্দ করেন, সেই খবরও রাখে কুকিজ়। স্বাভাবিক ভাবেই পিৎজা় অর্ডার করতে গিয়ে আপনার আপনার অগোচরেই সরকার জানতে পারবে আপনি তাঁকে ভোট দেবেন কিনা। আর যে দেশে গোমাংস খাওয়ার অপরাধে পুড়িয়ে মারা হয়, আমিষ-নিরামিষাশীর মাঝেও ভেদাভেদ তৈরি হয়, সেদেশে জনগণের ব্যক্তিগত খাদ্যাভ্যাসের তথ্য পাচার হলে আমরা কতটা নিরাপদ থাকব, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।
আরও পড়ুন- জন্ম ফ্রান্সে, বাঙালির প্রিয় পিকনিকের ইতিহাস ছড়িয়ে আছে বিশ্বজুড়ে
এখানেই শেষ নয়, এই কিউআর কোডে লুকনো থাকতে পারে ক্ষতিকর ওয়েবসাইটের ইউআরএল। যা আপনার আর্থিক তথ্যও অনায়াসে সংগ্রহ করতে পারে বা হ্যাক করতে পারে আপনার ফোনকে। রোবোকল বা সিম-জ্যাকিংয়ের কথা শুনেছেন? হ্যাঁ, অচেনা কোনও কিউআর কোড স্ক্যান করলে আপনাআপনি ফোন চলে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে আপনি অজানা একজন ব্যক্তিকে নিজের কলার আইডি নম্বর এবং ভৌগোলিক অবস্থানটিও জানিয়ে বসবেন, জানাচ্ছেন ফোর্বস টেকনোলজি কাউন্সিলের সদস্য মোরে হ্যাবার।
মোরে হ্যাবার জানাচ্ছেন, অজানা কিউআর কোড স্ক্যান করলে কখনও কখনও কোনও ইভেন্টও আপনার ফোন ক্যালেন্ডারে যোগ হতে পারে। সেই ইভেন্টগুলো প্রশ্নাতীতভাবেই আপনার জন্য অনাবশ্যক। বর্তমানে অচেনা নম্বর থেকে ইউআরএল লিঙ্ক পাঠিয়ে হামেশাই ব্যাঙ্ক থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে ফেলা হয় বা ফোন হ্যাক করা হয়। এখন মানুষ অনেকটাই সচেতন হয়েছেন, তাই এই ধরনের কাজ করা থেকে বিরত থাকছেন। কিন্তু ধরা যাক আপনাকে অচেনা নম্বর থেকে একটি কিউআর কোড পাঠানো হল, আর আপনিও ঔৎসুক্যের বশে তা স্ক্যান করে বসলেন। আপনাকে সেই একই প্রতারণার ফাঁদে ফেলা হল, শুধু ফাঁদটা অন্যভাবে সাজিয়ে।
বিদেশের রাস্তায় দেখা গেছে ব্যস্ততম জায়গাগুলিতে বিবরণহীন, বেনামী কিউআর কোড। আর তা স্ক্যান করতেই বিপত্তি! কখনও তথ্য চুরি, তো কখনও লাখ লাখ টাকা গায়েব। কিউআর কোড বিষয়টা নিজে ক্ষতিকর নয়। তবে তা যে ওয়েবসাইটে নিয়ে যেতে পারে তা চরম ক্ষতি করতে পারে। তাই কিউআর কোড স্ক্যান করার আগে যাচাই করে নেওয়াই শ্রেয়। এবং বিবরণহীন, নামহীন কিউআর কোড কখনও স্ক্যান করা উচিত নয়।