মাত্র কয়েক ঘণ্টায় 'পথের পাঁচালি'-র সুর সৃষ্টি করেছিলেন রবিশঙ্কর!

Pather Panchali: দুর্গার সঙ্গে যে আহির ভৈরবকে অবলীলায় মিলিয়ে দেওয়া যায়, তা তো ‘পথের পাঁচালি’ই শিখিয়েছে আমাদের।

রবিশঙ্করের তখন বেশ নামডাক। স্রোতাদের অনুরোধে এক অনুষ্ঠানে ‘পথের পাঁচালি’র সেই বিখ্যাত সুর বাজাতে আরম্ভ করলেন তিনি। গোড়াতেই সুরু করলেন মেঠো বাঁশির আলাপ দিয়ে। তারপর ক্রমে স্বর বিস্তার। মেঠো সুরে নিয়ে এলেন দুর্গার স্বাদ। এমনই মজা ভারতীয় সংগীতের। কী অবলীলায় সেখানে সুরের অরণ্যে পাড়ি দেওয়া যায়। আশেপাশে বাঁধা নেই, বিপত্তি নেই, শুধু আছে মিড়, শ্রুতি আর তারাবাতির মতো কিছু মুড়কি। মঞ্চে বসে সেতারের  তারে আঙুল বোলাতে বোলাতে সে সময় কী ভাবছিলেন রবিশঙ্কর? সান্ধ্যকালীন রাগের মধ্যে দিয়েই কি তিনি দুর্গার চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন? এ সুরের ইতিহাসখানাও বেশ মজার। সত্যজিৎ রায়ের অনুরোধে মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রবিশঙ্কর।

তখন ৩৫ বছর বয়স রবিশঙ্করের। শিল্পী হিসেবে তখনই এমন তাঁর খ্যাতি যে সারা বিশ্বে ছুটে বেড়াতে হয়। এক জায়গায় বেশিদিন থাকবার জো নেই। হয়তো আজ দিল্লির কোনও এক প্রেক্ষাগৃহে তিনি কেদার বাজাচ্ছেন, পরশুই আবার তাঁকে দেখা যাবে সান-ফ্রান্সিসকোর কোনও এক মঞ্চে তিলক-কামোদ বাজাতে। ইতিপূর্বে খুব বেশি ছবিতে তিনি সুর দেননি। গণনাট্য সঙ্ঘের সঙ্গে যোগসূত্র থাকবার ফলে খ্বাজা আহমেদ আব্বাসের ‘ধরতি কে লাল’ এবং চেতন আনন্দের ‘নীচা নগর’ ছবিতে তাঁকে সংগীত পরিচালক হিসেবে দেখা গিয়েছে।

সে সময় রবিশঙ্করের নিয়মিত যাতায়াত ছিল জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের ডিক্সন লেনের বাড়িতে। সে বাড়ি তখন ছিল ভারতের তামাম গাইয়ে-বাজিয়েদের স্বর্গরাজ্য। উস্তাদ হাফিজ আলি খান থেকে উস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খান। কার পায়ের ধুলো পড়ে না জ্ঞানবাবুর গরিবখানায়? এ বাড়ির এক মজলিশে বসেই তো বড়ে গোলাম আলি তাঁর সেই বিখ্যাত ছায়ানটখানা গেয়েছিলেন। পরবর্তীতে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত যা নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন, "অমনটা আর কখনও শুনিনি।"

আরও পড়ুন-জগন্নাথ মন্দিরে ৪০টিরও বেশি চুলা ভেঙে ফেলা হল, অপরাধী কি মন্দিরের ভেতরেই?

রবিশঙ্কর জ্ঞানবাবুর বাড়িতে যান, সংগীত নিয়ে দুজনের আলাপ আলোচনা চলে। এমনই এক দিন সেখানে তাঁর সঙ্গে দেখা হল সত্যজিৎ রায়ের। সেদিন বিশেষ কোনও কাজে তিনি গিয়েছিলেন সেখানে। সত্যজিৎকে চিনতেন রবিশঙ্কর। দু'জনের পারিবারিক বন্ধুত্ব ছিল বহু পুরনো। সেদিন কথায় কথায় তিনি জানতে পারলেন, বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালি’ উপন্যাস নিয়ে সত্যিজিৎবাবু ছবি বানাচ্ছেন। এবং শুধু তাই নয়, রবিশঙ্করকেই তিনি প্রস্তাব দিলেন তাঁর ছবিতে সুর দেওয়ার। ‘পথের পাঁচালি’র সঙ্গে রবিশঙ্করের পরিচয় ঘটেছিল আগেই। বাড়ির গুরুজনদের কাছ থেকে এ উপন্যাসের কথা তিনি শোনেন, তারপর তা পড়ে মুগ্ধ হন। সম্ভবত সেই কারণেই এক কথাতেই তিনি রাজি হয়ে যান।

শুরু হল তোড়জোড়। সত্যজিৎ রায় চটজলদি দক্ষিণ কলকাতার ভবানী সিনেমায় রবিশঙ্করকে ছবির ‘রাশ’ দেখানোর ব্যাবস্থা করলেন। সেদিন ছবি দেখতে দেখতেই রবিশঙ্করের মনের মধ্যে সুর ঘুরপাক খেতে লাগল। তারপর রেকর্ডিংয়ের দিন ঠিক করা হল। কিন্তু বিপত্তি একটাই, মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা সময় দিতে পারবেন রবিশঙ্কর। তার মধ্যেই গোটা ছবির রেকর্ডিং সেরে ফেলতে হবে।

আসলে সে সময় রবিশঙ্কর ছিলেন বেজায় ব্যস্ত, ফলত একদিনের বেশি সময় দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। নির্দিষ্ট দিনে স্টুডিওতে পৌঁছে গেলেন কলা-কুশলীরা। বাঁশি হাতে প্রস্তুত হলেন অলোক নাথ দে। সুরের মূল চলনগুলো রবিশঙ্কর আগে থেকেই ভেবে রেখেছিলেন। এবার হাতে হাতে তৈরি করতে লাগলেন তার স্বরলিপি। সন্ধে গড়িয়ে রাত নামল, কিন্তু রেকর্ডিং চলতে লাগল পুরোদমে। শোনা যায় ‘সুবর্ণরেখা’ ছবির শ্যুটিংয়ের আগে শুধু বিজন ভট্টাচার্যের চরিত্রকে নিয়ে নানান ধরনের ভাবনা চিন্তা করেছিলেন ঋত্বিক। তাঁকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেছিলেন, "বিশ্বের শ্রেষ্ঠ অভিনেতাকে  সিনেমায় প্রোজেক্ট করতে হবেন না?" সত্যিজিতের ছবি নিয়েও সম্ভবত রবিশঙ্কর এমনই কিছু ভেবেছিলেন। নইলে মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তাঁর মাথা থেকে অমন সুর বের হয় কী করে?

আরও পড়ুন- ‘ভাবা প্র্যাকটিস’ নয়, আজ ঋত্বিককে ভুলতে পারলেই কেন সুবিধা বাঙালির?

অবশেষে রেকর্ডিং শেষ হল। কিন্তু কয়েকটা ফাঁক থেকে গেল। যেমন ধরা যাক, সর্বজয়ার কান্নার দৃশ্যে রবিশঙ্কর নিজে সুর বসিয়ে উঠতে পারেননি। সে কাজ সম্পন্ন করতে হয়েছিল সত্যজিৎকেই। দুর্গার মৃত্যুর বিষাদ পটদীপ রাগে প্রকাশিত হবে, সত্যজিৎকে এমন নির্দেশই দিয়েছিলেন তিনি। দক্ষিণামোহনের তারসানাইয়ে ফুটে উঠেছিল সর্বজয়ার বিলাপ।

এ ছাড়াও ছিল মিঠাইওয়ালার সেই বিখ্যাত দৃশ্য। তাতেও সময়ের অভাবে সুর বসাতে পারেননি রবিশঙ্কর। এবার মাঠে নামলেন স্বয়ং সুব্রত মিত্র। অনেকেই জানেন না, চমৎকার ক্যামেরাম্যান হওয়ার পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন দুর্দান্ত সেতার বাদক। নানান ভাবনা চিন্তা করে তিনি সেই দৃশ্যে সুর বসালেন। কিন্তু এর ফলে মুশকিলে পড়লেন রবিশঙ্কর। তিনি যেখানেই ‘পথের পাঁচালি’র সুর বাজান, সেখানেই স্রোতারা মিঠাইওয়ালার ধুন শুনতে চান। এ সুর তো আদৌ তাঁর দেওয়া নয়!

‘পথের পাঁচালি’র পর ‘অপরাজিত’ এবং ‘অপুর সংসার’ ছবিতেও সত্যজিতের সঙ্গে কাজ করেছিলেন রবিশঙ্কর। ‘অপুর সংসার’ ছবিতে রাগেশ্রী রাগের এক অদ্ভুত চলন তৈরি করেছিলেন বেহালায়। ঠিক যেমন নিনো রোতা কে বাদ দিয়ে ‘এইট অ্যান্ড হাফ’ বা ‘লা দলচে ভিতা’র কথা ভাবা যায় না, তেমনই রবিশঙ্কর ছাড়াও সত্যজিৎ অসম্পূর্ণ। এ প্রসঙ্গে মাও সে তুঙের সেই বিখ্যাত উক্তি থেকে খানিক ধার করেই বলা চলে, রবিশঙ্কর জুড়ে আছেন ‘পথের পাঁচালি’র অর্ধেক আকাশ। দুর্গার সঙ্গে যে আহির ভৈরবকে অবলীলায় মিলিয়ে দেওয়া যায়, তা তো ‘পথের পাঁচালি’ই শিখিয়েছে আমাদের।

তথ্যঋণ-

Ravi and Ray- Telegraph

More Articles