জমিদার রবীন্দ্রনাথ || হিন্দু আর মুসলমান প্রজাদের সেদিন এক আসনে বসিয়েছিলেন কবিগুরু
রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যেন কোনও বিভাজন না থাকে তাঁর জমিদারিতে।
১৮৮৯ সালের গ্রীষ্মকালে সোলাপুরের উদ্দেশে রওনা দিলেন জ্ঞানদানন্দিনী দেবী। গ্রীষ্মের ছুটিতে ছেলেমেয়ের স্কুল বন্ধ, অতএব সেখানে গিয়ে স্বামী সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে কিছুদিন থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। তাঁর যাত্রাপথের সঙ্গী হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন নেহাতই কম। সোলাপুর থেকে ফেরার পথে তাঁরা মহারাষ্ট্রের পুণা শহরে এলেন। সেখানে কয়েকটা দিন নিশ্চিন্তে কেটে গেল রবীন্দ্রনাথের। এই পুণাতেই তিনি বিদূষী রমাবাঈকে নারীর অধিকার নিয়ে এক চমৎকার বক্তৃতা দিতে শুনলেন। বর্ষার মাঝামাঝি কলকাতা ফিরলেন রবীন্দ্রনাথ। জোড়াসাঁকো ফিরে তিনি শুনলেন, তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছেন দেবেন্দ্রনাথ।
দেবেন্দ্রনাথ তখন বার্ধক্যে পৌঁছেছেন। তাঁর অবর্তমানে ঠাকুর বংশের বিরাট জমিদারির দায়িত্ব কে নেবে, তা নিয়ে বেজায় চিন্তিত ছিলেন তিনি। সত্যেন্দ্রনাথ চাকরির সূত্রে বাংলাদেশের বাইরে থাকেন। ফলত, তাঁকে সে দায়িত্ব দেওয়া চলে না। দ্বিজেন্দ্রনাথ সারাদিন দর্শনচর্চা নিয়েই থাকেন, তিনিও এ দায়িত্ব নিতে পারবেন না। অতএব, রবীন্দ্রনাথের হাতেই জমিদারির দায়িত্ব অল্প অল্প করে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন দেবেন্দ্রনাথ। ইতিপূর্বে রবীন্দ্রনাথের দিন কাটছিল জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর নব্য-প্রতিষ্ঠিত ‘বালক’ পত্রিকায় লেখা দিয়ে আর অক্ষয় চৌধুরীর সঙ্গে সাহিত্যচর্চা করে। এবার তাঁর জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরু হল।
নীলমণি ঠাকুরের পুত্র রামলোচন ঠাকুরের বিষয়বুদ্ধি ছিল প্রখর। পূর্ববঙ্গের বিরাহিমপুর পরগণায় তিনি জমিদারি কেনেন। তাঁর বিরাহিমপুরের জমিদারির কাছারি ছিল শিলাইদহে। তাঁর দত্তকপুত্র দ্বারকানাথ ঠাকুর ১৮৩০ সালে কালীগ্রাম পরগণায় জমিদারি কেনেন। এছাড়াও ঠাকুরদের জমিদারি ছিল পাণ্ডুয়া ও উড়িষ্যায়। দ্বারকানাথের আমলেই সাজাদপুরে রানি ভবানীর জমিদারী নিলামে ওঠে। তিনি ১৩ টাকা ১৩ আনা দিয়ে সেই জমিদারি কিনে নেন। জমিদারি ছাড়াও কলকাতার সোনাগাছি অঞ্চলের যৌনপল্লি থেকে দ্বারকানাথের আয় হত ভালোই। সেখানকার প্রায় ৪৩টা বেশ্যালয়ের মালিক ছিলেন তিনি।
আরও পড়ুন: রাবীন্দ্রিক ডায়েট || স্ত্রী ছাড়া কারও হাতের জিলিপি খেতেন না রবীন্দ্রনাথ
বাবামশায়ের কাছ থেকে জমিদারির দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার পর প্রাথমিকভাবে কলকাতার সেরেস্তায় বসতেন রবীন্দ্রনাথ। এই সেরেস্তা থেকেই তিনি অল্প অল্প করে জমিদারির কাজ শেখা আরম্ভ করলেন। তারপর তাঁকে পূর্ববঙ্গের তালুকের দেখাশোনা করতে শিলাইদহ চলে যেতে হল। শিলাইদহ গিয়ে প্রথমে কোনও পাকা বাড়িতে ওঠেননি রবীন্দ্রনাথ। পদ্মার পারে বোটের ভেতরেই তিনি দিন কাটাতেন। এমতাবস্থায় ভ্রাতুষ্পুত্র সুরেন্দ্রনাথ কে উৎসর্গ করে তিনি লিখে ফেললেন ‘বিসর্জন’ নাটক।
সর্বদা জমিদারিতে থাকতেন না রবীন্দ্রনাথ। শিলাইদহের আবহাওয়ায় কখনও দমবন্ধ লাগলে চলে যেতেন শান্তিনিকেতনে। শান্তিনিকেতন তখন আজকের মতো জনবসতিপূর্ণ ছিল না। ধু ধু প্রান্তরজুড়ে কেবল দু'-চারটে চালাঘর দেখা যেত। এছাড়াও ছিল দেবেন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠিত আশ্রম ও মন্দির। শান্তিনিকেতনে কয়েকটা দিন কাটিয়ে ফের জমিদারির কাজে ফিরতে হত তাঁকে। কাজে মন বসাতে পারতেন না রবীন্দ্রনাথ। একদিকে তাঁর দায়িত্বের বোঝা, অন্যদিকে অবসরের আহ্বান। কাজের মাঝে তাঁর মন পড়ে থাকত গ্যেটের ‘ফাউস্ট’ বা বিদ্যাপতির পদাবলিতে। তিনি লিখছেন, “উপবাস করে আকাশের দিকে তাকিয়ে অনিদ্র থেকে, সর্বদা মনে মনে বিতর্ক করে, পৃথিবীকে এবং মনুষ্যহৃদয়কে কথায় কথায় বঞ্চিত করে, স্বেচ্ছাচারিত দুর্ভিক্ষে এই দুর্লভ জীবন ত্যাগ করতে চাই নে। ...দেবতার মতো হাওয়া হয়ে যাওয়ার চেষ্টা আমার কাজ না।”
তবে, জমিদারি সামলানোর ফলে রবীন্দ্রনাথের লাভও কিছু হয়েছিল। বেশ কয়েকবছর জমিদারিতে ঘোরার ফলে তিনি পল্লিগ্রামের মানুষজনের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন। পরবর্তীতে এর প্রতিফলন ঘটেছিল তাঁর ছোটগল্পে। জমিদার হিসেবে রবীন্দ্রনাথ কেমন ছিলেন, তার কিছু পরিচয় মেলে রবীন্দ্র-গবেষকদের দ্বারা উল্লেখিত এক ঘটনায়।
শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে সেদিন পুণ্যাহ উপলক্ষে বিশেষ আয়োজন করা হয়েছে। বেলা বাড়লে সাধ্যমতো খাজনা নিয়ে একে একে প্রজারা আসবেন সেখানে। রবীন্দ্রনাথ কুঠিবাড়িতে পৌঁছে দেখলেন সকলেই ব্যস্ত হয়ে ছোটাছুটি করছেন। নায়েব, গোমস্তা, কারও দম ফেলার সময়টুকুও নেই। এমতাবস্থায় তাঁর চোখ গেল বসার আয়োজনের দিকে। তিনি দেখলেন ঘরের ভেতর পরপর বেশ কিছু চেয়ার সাজানো। মাটিতে পাতা রয়েছে শতরঞ্চি। তার খানিকটা অংশ সাদা চাদরে ঢাকা, বাকিটা ফাঁকা। নায়েব গোমস্তাদের জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, ওই চেয়ারগুলো পাতা হয়েছে বড়লোক প্রজা এবং জমিদারির আমলাদের জন্য। আর শতরঞ্চির চাদরে ঢাকা অংশে হিন্দু প্রজারা বসবেন, বাকি অংশে বসবেন মুসলমান প্রজারা। রবীন্দ্রনাথ এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে তাঁরা জানান, এমন নিয়মই চলে আসছে দ্বারকানাথের আমল থেকে। রবীন্দ্রনাথ সেদিন তাঁর নায়েব-গোমস্তাদের ঘরের ভেতর থেকে সমস্ত চেয়ার সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন, হয় সকল প্রজার জন্যেই শতরঞ্চির ওপর চাদর পাতা হোক, নয় চাদর একেবারে সরিয়ে নেওয়া হোক। পুণ্যাহের মতো একটা শুভ দিনে এমন বিভাজনমূলক ব্যবস্থা চোখের সামনে দেখে নীরব থাকা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না।
নানা দ্বিধা-দ্বন্দের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের জমিদারি জীবন কেটেছে। তবে মোটের ওপর তাঁকে প্রজাদরদী জমিদারই বলা চলে। জমিদারি জীবনকে রবীন্দ্রনাথ স্বেচ্ছায় নির্বাচন করেননি। কতকটা পরিস্থিতির চাপে পড়েই তাঁকে সেই পেশা বেছে নিতে হয়েছিল। ‘রবীন্দ্রজীবনকথা’-য় মহাল পরিদর্শনের কালে রবীন্দ্রনাথের লেখনীর এক বিশেষ অংশ উদ্ধৃত করছেন প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়। জমিদারি জীবনের প্রতি খানিক হতাশ হয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, “ভাববার, অনুভব করার, কল্পনা করবার, মনের ভাব প্রকাশ করবার অবসর এবং উত্তেজনা অল্পে অল্পে চলে যায়...ভিতর ভিতর দিন-রাত্রির একটা অবিশ্রাম খুঁৎখুঁৎ চলতে থাকে।”
পরবর্তীকালে প্রগতি সাহিত্য সমালোচকদের একাংশ রবীন্দ্রনাথের এই সত্তাকে ধরে তাঁর সাহিত্যকর্মের সমালোচনা করার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর ‘উর্বশী’ কবিতাকে তাঁরা নিজেদের রচনায় আক্রমণ করেছিলেন। অথচ এই ‘উর্বশী’-তেই সামন্ততান্ত্রিক রক্ষণশীল কাঠামোর এক বিরুদ্ধ ভাষ্যের সন্ধান মেলে। নবারুণ ভট্টাচার্যকে ঠিক প্রগতি ঘরানার সাহিত্যিক বলা চলে না। তবে উত্তরাধিকার-সূত্রে সেই ঘরানার সঙ্গে তাঁর খানিক যোগাযোগ অবশ্যই ছিল। তিনি অবশ্য পরিচালক কিউয়ের এক তথ্যচিত্রে তাঁর অগ্রজদের সঙ্গে খানিকটা দ্বিমত পোষণ করছেন। আহমদ আলি বা ভবানী সেনের মতো প্রগতি সাহিত্য সমালোচকেরা রবীন্দ্রনাথের প্রতি সুবিচার করেননি। রবীন্দ্রনাথ জমিদার ছিলেন ঠিকই, কিন্তু সেই সত্তাকেই তাঁর সাহিত্যবিচারের একমাত্র শর্ত হিসেবে দেখা চলে না।