সত্তার দ্বৈত রূপে রবীন্দ্রনাথ ও বোর্হেস: ভাবনার যমজ সন্তান
Rabindranath Tagore and Jorge Luis Borges: রবীন্দ্রনাথ ও বোর্হেসের মধ্যে মিলের সম্ভাবনা যে কম, দুই লেখকের স্বভাবের স্বাতন্ত্র্য আর শৈলীর ভিন্নতা দেখেই যে-কোনও পাঠক তা বুঝতে পারবেন।
অক্টাভিও পাজ এক আলাপে, মূলত নিজের কাব্যসত্তার উন্মোচনের সূত্রেই, লেখকদের সত্তার দ্বৈততা নিয়ে যা বলেছিলেন তার গুরুত্ব অনুধাবন করলে আমাদের পক্ষে আলোচনার সূত্রপাত অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে বলে তার উক্তিটি তলব করব। তার আগে বলা দরকার যে, বহুকাল থেকেই, বহু লেখক ‘নিজ’ (Self) ও ‘অপর’ (Other)-এর মধ্যকার বিভাজন ও ভিন্নতা সম্পর্কে সজাগ ছিলেন বটে, তার প্রকাশও ঘটেছে ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে- লেখক থেকে দার্শনিক পর্যন্ত যার বিস্তার- কিন্তু তা কিছুটা অস্বচ্ছতায় ও আড়পথে বাঁধা ছিল সবসময়ই।
‘নিজ’ থেকে ‘অপর’-এ যাতায়াতের জন্য লেখক যখন সর্বনামের আশ্রয় নেন তখন তা নিছক খেয়ালি মনের অর্থহীন প্রস্থান বা যাতায়াত যে নয়, সেটা দার্শনিক এবং কোনও কোনও লেখক আগেই আমাদের নজরে এনেছিলেন। “সর্বনামের এ প্রবণতাকে হামবোল্ড কেবল ভাষায়, অস্তিত্বেরই শিকড়-ছোঁয়া গভীরে নিহিত বলে মনে করেন। তাঁর মতে, মানুষ কখনও প্রাত্যহিক জীবনে ব্যবহারের ভাষা দিয়ে পরিমিত যে ছোট পৃথিবীটা তা নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারে না।” (কবির নাম ও সর্বনাম, রণজিৎ গুহ, ধানসিঁড়ি , সেপ্টেম্বর ২০২০, পৃ- ২৫) আর তাই শিল্পী বা লেখকের ক্ষেত্রে, “এককে অপরত্বে ব্যক্ত করাই তার স্বভাব।” (প্রাগুক্ত,পৃ ৩৫) কারণ “সত্তামাত্রই এভাবে অন্যত্বের প্রতীকী ছদ্মে সংসারনাট্যে মঞ্চস্থ হয়।”( প্রাগুক্ত,পৃ ৩৮)
অক্টাভিও পাজও আমাদেরকে তার স্বভাবসুলভ স্বচ্ছতায় ধরিয়ে দেন লেখকের এই সর্বনামের ব্যবহার বা দ্বৈততার স্বরূপ:
“র্যাঁবো অপর-এর মাধ্যমে নিজ-এর সমালোচনা করেন, তবে যেমনটা আমি আগেই বলেছি, এই অপর হচ্ছে অন্য এক সত্তা, অন্য আমি। সাবজেকটিভির মৌলিক (Radical) এক সমালোচনা আমাদের করা প্রয়োজন। লেভি-স্ত্রাসের লেখার কোনও কোনও অংশে সাবজেকটিভিটির সামগ্রিক এক সমালোচনা আমরা দেখতে পাব; এবং এইখানটাতেই ভিটগেনস্টাইনের মতো দার্শনিকের গুরুত্ব। ভাষার সমালোচনা করতে গিয়ে তিনি নিজের, অহংয়ের সমালোচনা করেছিলেন। তিনি দেখিয়েছিলেন যে ‘আমি’ হচ্ছি শুধুই এক ব্যকরণিক কল্পনা।”
Rimbaud criticizes the self through the other, but as I said, the other is another self, another I. We need to make a radical critique of subjectivity. In parts of Levi-Strauss we find a total criticism of subjectivity; and this is the importance of a philosopher like Wittgenstein. In criticizing language, he criticized the self, the ego. He has shown that `I' is only a grammatical fiction. (Octavio Paz: Homage to the Poet, Kosrof Chantikian, Kosmos, USA, 1980, P-161)
দার্শনিক ভিটগেনস্টাইনের কথা বাদ দিলে, কবিদের মধ্যে ওই ‘অন্য আমি’র এক বাষ্পরূপ দেখা দিয়েছিল গত শতাব্দীর কোনও কোনও কবির মধ্যে এবং তারও আগে কোনও কোনও দার্শনিক ও ভাবুকদের মাঝে। যেমন মার্টিন হাইডেগারের মধ্যে এর এক বিস্তার আমরা লক্ষ্য করব সত্তা নামক অনুসন্ধান ও তা নির্ণয়ের ফলে। মূলত ভাষার স্বভাবচরিত্রকে ধরতে গিয়ে সত্তার এই স্বরূপটিকে আবিষ্কার ছিল দার্শনিক তাৎপর্যে খু্বই গুরুত্বপূর্ণ।
১.
হোর্হে লুইস বোর্হেস তাঁর Book of Imaginary Beings গ্রন্থে ‘The Double’ নামক ভুক্তিটিতে দেখিয়েছিলেন কীভাবে দর্শনে, সাহিত্যে ও বিভিন্ন জাতির উপকথায় দ্বৈত রূপের ধারণা উঁকি দিয়ে গেছে। দর্শনে পিথাগোরাস ও প্লেটোর মধ্যে এই সংক্রান্ত ধারণার আভাস ছিল আগেই। অন্যদিকে, সাহিত্যে রবার্ট লুইস স্টেভেন্সন, রসেট্টি, হথর্ন, দস্তেয়ভস্কি, আলফ্রেড দে মুসেট, হেনরি জেমস, ক্লেইস্ট, চেস্টারটন, লাভকাদিও হের্ন কিংবা পো এবং ওয়াইল্ড-এ তা কীভাবে জায়গা করে নিয়েছে তার এক সংক্ষিপ্ত কিন্তু তথ্যবহুল চিত্র তুলে ধরেছেন তিনি। সন্দেহ নেই যে দ্বৈততার এই ধারণার প্রতি বোর্হেসের ছিল এক প্রবল আকর্ষণ। আর এই আকর্ষণের ফল ছিল তার নিজের সাহিত্যে এর সৃষ্টিশীল রূপান্তর। আমরা দেখতে পাব বোর্হেসের গল্পে, কবিতায়, এমনকী কোনেও কোনও প্রবন্ধেও তিনি সত্তার দ্বৈত রূপকে শৈল্পিক বুননে তুলে ধরেছেন। বোর্হেস-অনুবাদক নরম্যান টমাস ডি জিওভান্নি আমাদেরকে এরকম কিছু উদাহরণের হদিস দিয়েছেন তাঁর The Lesson of the Master গ্রন্থের একটি অধ্যায়ে। বোর্হেসের ‘The South’ গল্পে তো আছেই,আছে The Self and Othre গ্রন্থে ‘Emerson’ ( “I have not lived. I want to be someone else.”) ও ‘Conjectural Poem’ নামক কবিতায় (“I, longed to be someone else,”), In Praise of Darkness কাব্যগ্রন্থের ‘May 20, 1928’ নামক কবিতায় (“He will smooth back his hair, adjust his tie…and try to imagine the other man—the one in the mirror—performs the actions and that he, the double, repeats them..”)। এগুলো ছাড়াও তিনি সত্তার দ্বৈততার আভাস দিয়ে গেছেন নানা সময়ে অন্যান্য লেখাতেও। কখনও তিনি কোনও কোনও লেখককে নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে ওই দ্বৈত রূপের সন্ধান পেয়েছেন তাদের জীবন ও কর্মের অভিন্ন আয়োজনে। ১৯৪৭ সালে ওয়াল্ট হুইটম্যানকে নিয়ে রচিত এক প্রবন্ধে তিনি জানালেন,
“There are two Whitmans: ‘the friendly and eloquent savage’ of Leave of Grass and the poor writer who invented him…The latter chaste, reserved, and somewhat taciturn; the former, outgoing and orgiastic.” ( Borges : A Reader, i Edited by Emir Rodriguez Monegal and Alastair Read, Published by E P Dutton, 1981, P-192)
বাইশ বছর পর তিনি আবারও হুইটম্যান অনুবাদ করতে গিয়ে ভূমিকায় সেই দ্বৈত রূপের আরেক উন্মোচন ঘটালেন: “এই মকলুকাত দ্বৈত প্রকৃতির: তিনি হলেন বিনয়ী সাংবাদিক ওয়াল্টার হুইটম্যান, লং আইল্যান্ডের বাসিন্দা যাকে কোনও কোনও ব্যস্ত বন্ধু ম্যানহাটনের ফুটপাথে পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় শুভেচ্ছা জানাবে এবং তিনিও সেই অন্য একজন যা প্রথমজন হতে চেয়েছিলেন এবং যা তিনি হতে পারেননি; যে-মানুষটি ছিলেন দুঃসাহসিক এবং ভালোবাসার মানুষ, অলস, প্রেমময়, উদাসীন, আমেরিকা ভ্রমণকারী।”
"Esa criatura es de naturaleza birofme; es el modesto periodista Walter Whitman, oriundo de Long Island que algun amigo apresurado saludaria en las aceras Manhattan, y es, asimismo , el otro que el primero queria ser y no fue, un hombre de aventura y de amor, indolente, amoroso, despreocupado, recorredor de America. "( Walt Whitman, Hojas de Hierba, Trducido por Jorge Luis Borges, Editorial Lumen, P-9)
উপরোক্ত এসব লেখায় অনেকটা বিচ্ছিন্নভাবে সত্তার দ্বৈত রূপ চিত্রায়িত হলেও, বোর্হেসের ‘The Other’ নামক গল্পে, ‘Borges and I’ নামক প্যারাবোলে এবং ‘The Watcher’ নামক কবিতায় যতটা তীব্রতা ও প্রত্যক্ষতায় আরও বেশি ঘনীভূত ও পূর্ণাঙ্গ রূপে হাজির হয়েছে, ততটা তার অন্য লেখায় খুব একটা দেখা যাবে না।
২.
সাহিত্যে সত্তা নানা রূপে বিভাজিত হয়ে একে অপরের সঙ্গে কীভাবে এক সুমধুর দ্বন্দ্বে সম্পূরক ভূমিকায় ঘনীভূত আর প্রত্যক্ষ হয়ে উঠছে তা বোর্হেসে যেমন দেখতে পাই,অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথকেও কোনও কোনও কবিতায় সত্তার বিভাজন ও একত্রীকরণের এক লীলায় মেতে উঠতে দেখি জীবনের মধ্য গগনে, এমনকী উপান্তে এসেও। শৈল্পিক আদর্শ আর কালের ব্যবধানের কথা ভাবলে, এই দু'টি নাম যে এক নিঃশ্বাসে উচ্চারিত হবার নয়, তা পরহেজগার পাঠকমাত্রই জানেন। বহুদিক থেকেই অমিলের প্রাচুর্য বহমান এই দুই লেখকের মধ্যে। শৈল্পিক কলাকৌশলে যেমন, তেমনই প্রকাশের রীতিতেও দু'জন প্রায় মেরুদূর ব্যবধানে। কিন্তু তবু দু'জনই ভিন্নতার শিখর থেকে কোনও কোনও ক্ষেত্রে এসে মিলিত হয়েছেন উপলব্ধির উপত্যকায়, যদিও তার প্রকাশরীতিতে রয়েছে স্বভাবজাত স্বাতন্ত্র্য। ১৯১৮ সালে রচিত এক গানে রবীন্দ্রনাথ তাঁর দুই আমিকে তুলে ধরলেন এভাবে:
যে আমি ওই ভেসে চলে কালের ঢেউয়ে আকাশতলে
ওরই পানে দেখছি আমি চেয়ে।
ধুলার সাথে, জলের সাথে, ফুলের সাথে, ফলের সাথে,
সবার সাথে চলছে ও যে ধেয়ে॥
ও যে সদাই বাইরে আছে, দুঃখে সুখে নিত্য নাচে--
ঢেউ দিয়ে যায়, দোলে যে ঢেউ খেয়ে।
একটু ক্ষয়ে ক্ষতি লাগে, একটু ঘায়ে ক্ষত জাগে--
ওরই পানে দেখছি আমি চেয়ে॥
যে আমি যায় কেঁদে হেসে তাল দিতেছে মৃদঙ্গে সে,
অন্য আমি উঠতেছি গান গেয়ে।
ও যে সচল ছবির মতো, আমি নীরব কবির মতো--
ওরই পানে দেখছি আমি চেয়ে।
এই-যে আমি ঐ আমি নই, আপন-মাঝে আপনি যে রই,
যাই নে ভেসে মরণধারা বেয়ে--
মুক্ত আমি তৃপ্ত আমি, শান্ত আমি, দীপ্ত আমি,
ওরই পানে দেখছি আমি চেয়ে॥ (গীতিবিথীকা, ১৯১৮)
অন্য এক কবিতায় দেখতে পাব এই দুই ‘আমি’র এক লীলা:
শুরু হতেই ও আমার সঙ্গ ধরেছে,
ঐ একটা অনেককালের বুড়ো,
আমাতে মিশিয়ে আছে এক হয়ে।
আজ আমি ওকে জানাচ্ছি--
পৃথক হব আমরা। (২২ নং কবিতা, শেষ সপ্তক কাব্যগ্রন্থ, ১৯৩৫)
প্রথম উদ্ধৃত ওই গান আর তারও ১৭ বছর পরে রচিত কবিতার এই উদ্ধৃত অংশটুকুতে আমার দেখতে পাচ্ছি দুই আমির এক সহাবস্থান এবং দ্বিতীয় কবিতায় তাদের আবার পৃথক হবার আকাঙ্খা। রবীন্দ্রনাথের এই দ্বৈততার সঙ্গে বহু বছর পরে রচিত আর্হেন্তিনিয় কবি, প্রাবন্ধিক ও কথাসাহিত্যিক হোর্হে লুইস বোর্হেসের ‘Borges and I’ নামক এক প্যারাবলে আশ্চর্য নৈকট্য আমারা খুঁজে পাব। নৈকট্যের বিষয়টি চিহ্নিত ও বিশ্লেষণ করার আগে আমরা বোর্হেসের এই লেখাটি এক লহমায় পাঠ করে নেব:
“বোর্হেস এবং আমি
যা কিছু ঘটে সে অন্য কেউ, অন্য এক বোর্হেসের জীবনে ঘটে। আমি বুয়েনোস আইরেসের রাস্তা দিয়ে হাঁটি, হয়তো মুহূর্তের জন্য দাঁড়াই কখনও, তাকিয়ে দেখি হলঘরে প্রবেশ পথের খিলানের দিকে আর গ্রিল করা দরজার দিকে : চিঠিপত্রে খবর পাই বোর্হেসের আর তাকে দেখতে পাই অধ্যাপকদের নামের তালিকায় অথবা কোনও কোনও জীবনী-অভিধানে। ভালোবাসি বালি-ঘড়ি, মানচিত্র অষ্টাদশ শতকের মুদ্রণরীতি, কফির স্বাদ আর স্টিভেনসনের গদ্য : অন্যজনও এইসব পছন্দ করে ; কিন্তু তা এতটা চটুলভাবে করে যে নাটুকে বলে মনে হয়। এটা বলা অত্যুক্তি যে, আমাদের পরস্পরের সম্পর্ক দ্বন্দ্বময় : আমি বাঁচি বেঁচে থাকতে হয়, যাতে বোর্হেস সাহিত্য রচনা করতে পারে, আর এই সাহিত্য রচনাই আমার বেঁচে থাবার ইন্ধন। আমার পক্ষে এটা স্বীকার করা এখন কঠিন নয় যে, ইতোমধ্যে সে মূল্যবান কয়েকটি পৃষ্ঠা লিখে ফেলেছে; কিন্তু এই পৃষ্ঠাগুলো আমাকে রক্ষা করতে পারে না, সম্ভবত এই কারণে যে, যা কিছু ভালো তা কারো একার নয়, এমনকী তারও নয়, বরং তা ভাষা এবং ঐতিহ্যের। তাছাড়া বিলুপ্ত হওয়াই আমার নিশ্চিত নিয়তি, আর আমার জীবনের কোনও কোনও মুহূর্ত তার মধ্যে টিকে থাকতে পারে। ধীরে ধীরে, আমি তার কাছে সবকিছু অর্পণ করছি, যদিও তার বানিয়ে এবং বাড়িয়ে বলার বিশ্রী অভ্যেস সম্পর্কে আমি সম্পূর্ণ সজাগ। স্পিনোজা ভাবতেন যে, সমস্ত বস্তুরাশি সর্বাবস্থায় তার সত্তার অনুরূপ হয়ে উঠতে চায়, পাথর চিরকালই পাথর হতে চায়, আর বাঘ চায় বাঘ হতে, আমি বোর্হেসের মধ্যেই থেকে যাব; আমার নিজের মধ্যে নয় (আমি অন্য কেউ-- যদি এটা সত্য হয়); শ্রমসাধ্য কোনও গিটার বাজনা কিংবা, অন্য কিছুর চেয়ে তার বইপত্রে আমি নিজেকে কম খুঁজে পাই। অনেক বছর আগে আমি তার কাছ থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেছিলাম এবং শহরতলির পুরাণ থেকে চলে গিয়েছিলাম সময়, আর অনন্তের খেলার মধ্যে, কিন্তু এইসব খেলা এখন বোর্হেসের জীবনের অংশ আর আমাকে এখন অন্য কিছু ভাবতে হবে। এইভাবে আমার জীবন ফুরিয়ে যাচ্ছে আর আমি সবকিছুই হারিয়ে ফেলি এবং সবকিছুই বিস্তৃতির অতলে হারিয়ে যায় অথবা অন্যের বিষয় হয়ে যায়।
জানি না আমাদের মধ্যে কে এই পাতাটি লিখছে।”
দুই লেখক থেকে উদ্ধৃত লেখাগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার আগে আমরা তাঁদের সাদৃশ্যের স্বরূপ বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করব কিছু কিছু ঘটনা আর তাদের রচনার সূত্রে।
‘বোর্হেস এবং আমি’ নামক প্যারাবল-এর ১৫ বছর পর বোর্হেস আবারও ফিরে আসবেন সত্তার দ্বৈত রূপের লীলায় তার ‘The Other’ নামক এক গল্পে। এই গল্পে পরিণত বোর্হেস মিলিত হচ্ছেন তাঁর কৈশোরের অন্য এক বোর্হেসের সঙ্গে। তাদের উভয়ের সঙ্গে মিল ও অমিলের দ্বন্দ্বকে ফুটিয়ে তুলছেন জানুসের মতো এক দ্বৈত আদলে। কিন্তু স্বপ্ন, বাস্তবতা আর স্মৃতিকাতরতায় এমনভাবে মোড়ানো এটি যা পেন্ডুলামের মতো উভয়দিকে দুলতে থাকে। ‘Borges and I’ এবং ‘The Other’ নামক রচনার মধ্যবর্তী সময়ে ‘The Watcher’ নামক কবিতায় আবার তিনি মথিত হবেন এই দ্বৈততার সুমধুর আবেশে। আমরা এই মুহূর্তে তার এই কবিতায়ও এক নজর চোখ বুলিয়ে নেব যাতে বোর্হেসের দ্বৈত রূপের ভিন্ন এক উদাহরণ আমাদের আলোচনাকে প্রাসঙ্গিক রাখতে সাহায্য করে:
পর্যবেক্ষক
ভেতরে প্রবেশ করে আলো আর আমি জেগে উঠি; ওই তো ওখানে সে।
কথা বলতে শুরু করে তার নাম-পরিচয় দিয়ে, যা আমার (অবশ্যই) নিজেরই সে নাম।
ফিরে আসি গোলামির সে-দিনগুলোয় যা কিনা দশকব্যাপী সাতবার বিদ্যমান ছিল।
চাপিয়ে দিয়েছে তার স্মৃতিগুচ্ছ আমার উপর। প্রতিটি দিনের সব আলিজালি, মানবীয় পরিস্থিতি চাপায় সে আমার উপর।
আমি তার পুরনো সেবক; আমাকে সে বাধ্য করে পা দু'খানি ধুয়ে দিতে তার।
আমার জন্য সে আয়নায়, মেহগনি কাঠে আর দোকানের কাঁচের শোকেসে অপেক্ষায় থাকে।
কোনও কোনও নারী তাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল, আমি তার বেদনার অংশীদার হব নিশ্চয়ই।
এখন এই কবিতাটি লিখিয়ে নিচ্ছে,যা আমার পছন্দ নয়।
আমাকে সে বাধ্য করে নাছোড় এ্যাংলোস্যাক্সনের অস্পষ্ট তালিম গ্রহণে।
আমাকে সে বানিয়েছে মৃত সেনাদের এক অন্ধ পূজারি, যাদের সঙ্গে এতটুকু বাক্য বিনিময় সম্ভব নয়।
সিঁড়ির অন্তিম ধাপে মনে হয় সে আমার পাশেই রয়েছে।
সে আমার প্রতি পদে, আমার কণ্ঠস্বরে আছে।
আমি তার সবকিছু ঘৃণা করি।
জেনে খুব ভালো লাগে দুচোখে সে কিছুই দেখে না।
আমি এক চক্রাকার প্রকোষ্ঠে আর অনন্ত দেয়াল ক্রমে প্রসারিত হয়।
যদিও করে না তারা প্রতারিত একে অন্যকে, কিন্তু মিথ্যাচার দু'জনেই করি।
একে অন্যকে চিনি ঘনিষ্ঠভাবে,অবিচ্ছেদ্য সহোদর আমরা দু'জন।
আমার পাত্র থেকে পান কর জল আর খাচ্ছ তুমি আমার খাবার।
আত্মহননের দ্বার খোলা আছে, কিন্তু ধর্মতাত্ত্বিকেরা বলেন যে
আমার জন্য প্রতীক্ষিত অন্য এক রাজত্বের অতি দূর ছায়ার ভেতরে থাকবো আমি।
(The Gold of the Tiger, 1972)
৩.
রবীন্দ্রনাথ ও বোর্হেসের মধ্যে মিলের সম্ভাবনা যে কম, দুই লেখকের স্বভাবের স্বাতন্ত্র্য আর শৈলীর ভিন্নতা দেখেই যে-কোনও পাঠক তা বুঝতে পারবেন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্য শৈলীর। নান্দনিক বিশ্বাসের ক্ষেত্রেও তাদের পার্থক্য মেরু-দূর নাহলেও, তা ‘মৈত্রীঘনিম’ নয় কোনওভাবেই। রবীন্দ্রনাথের মধ্যে, তা সে কবিতাই হোক আর কথাসাহিত্যই হোক- বিছিয়ে এবং বিস্তারে বলার এক রাজরঙিন ধীরশ্রী প্রবণতা আছে, কিন্তু বোর্হেস এই প্রবণতাকে এতটাই শক্রজ্ঞান করেন যে উপন্যাসের মতো ‘অসংযত’ ও ‘বাগড়ম্বরপূর্ণ’ বিভাগটিকেই তিনি অত্যন্ত স্বাচ্ছন্দ্যে অস্বীকার করেন। গল্পে তিনি এতই নিখুঁত আর শৈল্পিক সংযমের এক অনন্য রূপকার যে তা যেকোনও ভাষার প্রধান শিল্পীর কাছেই এক অবিশ্বাস্য অর্জন বলে মনে হবে। পার্থক্য আছে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রেও। কোনও কোনও লেখককে পছন্দের ক্ষেত্রেও আছে এই ভিন্নতা। ১৯২৪ সালে যখন তাদের সাক্ষাৎ হলো বুয়েনস আইরেসে তখন ইংরেজ লেখক রুডইয়ার্ড কিপলিং নিয়ে বেশ খানিকটা তর্কই হয়েছিল দু'জনের মধ্যে। রবীন্দ্রনাথ তথাকথিত জাতীয়তাবাদী ছিলেন না, ছিলেন না অন্ধ ইংরেজবিরোধীও, তাই বলে ইংরেজতোষণের নীতিও কখনও সমর্থন করেননি। “ভারতে ব্রিটিশ শাসনের এক জোরালো সমালোচনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯৪১ সালে, তাঁর জীবনের শেষ জন্মদিনে একটি বক্তৃতায়) বলেন, ভারত ব্রিটেনের সঙ্গে সম্পর্ক থেকে অনেক কিছু লাভ করেছে, যেমন শেক্সপিয়রের নাটক, বায়রনের কাব্য এবং সবার উপরে উনিশ শতকের ইংরেজ রাজনীতির বিরট হৃদয়-ঔদার্য। তিনি তাঁর এই শেষ বক্তৃতায় (‘দ্য ক্রাইসিস ইন সিভিরাইজেশন’) বলেছেন, ট্রাজেডি এটাই যে তাদের নিজের সভ্যতার যা যথার্থ সর্বোত্তম—মানবিক সম্পর্কের মর্যাদাকে তুলে ধরে, তা এদেশের ব্রিটিশ প্রশাসনে কোনও স্থান পায়নি।” (জগত কুটির, অমর্ত্য সেন, আনন্দ পাবলিশার্স, জুলাই ২০২২, পৃ ১৯০) ভারতে ইংরেজদের বৈষম্যমূলক নীতির প্রয়োগ সত্ত্বেও তাদের সাহিত্যের প্রতি অনুরাগের কোনও ঘাটতি ছিল না। বহু ইংরেজ লেখকই ছিল রবীন্দ্রনাথের প্রিয়, তারপরও কিপলিংয়ের জাতিবিদ্বেষী মনোভাবকে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি মেনে নেননি। অন্যদিকে, কিপলিংয়ের রচনাশৈলী বোর্হেসের এতটাই প্রিয় ছিল যে সেখানে রাজনৈতিক বিবেচনা তাঁর কাছে গৌণ হয়ে গিয়েছিল। এই বৈপরীত্য সত্ত্বেও বোর্হেস ও রবীন্দ্রনাথ-- জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে ছিলেন অভিন্ন অবস্থানে। দু'জনই জাতীয়তাবাদের ঘোরতর সমালোচক। বোর্হেস লেখায় এবং সাক্ষাৎকারে একাধিকবার জাতীয়তাবাদের বিপরীতে তাঁর অবস্থানকে তুলে ধরেছেন স্পষ্টভাবে।রবীন্দ্রনাথের মতো তিনিও বিশ্বাস করেন: “Nationalism is the main affliction of our times.” (Twenty four Conversations with Borges, Roberto Alifano, Lascaux Pubishers, 1984,P-12)। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষ উপযাপন উপলক্ষ্যে যখন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর পক্ষ থেকে লেখার তাগিদ এল, তখন ঘটনাক্রমে ১৯১৭ সালে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদ (Nationalism) নামক গ্রন্থটিকেই তিনি বেছে নিলেন আলোচনার জন্য। সন্দেহ নেই যে আলোচনার জন্য এই বইটি বেছে নেওয়ার পেছনে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বোর্হেসের দৃষ্টিভঙ্গির ঐক্যবোধ। এবং বোর্হেস সেখানে ‘প্রাচ্যীয় বিচ্যুতি’ সত্ত্বেও অকুণ্ঠ সমর্থন জানালেন রবীন্দ্রনাথকে। বোর্হেসের সঙ্গে ওই সাক্ষাতেই কিপলিং নিয়ে বিরোধ হলেও, ফরাসি কবি বোদলেয়ারকে অপছন্দের ক্ষেত্রে ছিলেন অভিন্ন। পৃথিবীর এতসব লেখক সম্পর্কে বোর্হেস লিখলেন, কিন্তু আধুনিকতার প্রতিভূ হিসেবে পরিচিত বোদলেয়ারকে নিয়ে একটি প্রবন্ধও লিখলেন না। রবীন্দ্রনাথও কখনও এই ফরাসি কবিকে নিয়ে লেখেননি কোনও প্রবন্ধ।
আরও একটি মিলের কথাও এই সূত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে, তা হচ্ছে জার্মান ও ফরাসি ভাষা শেখার ব্যাপারে উভয়ের আগ্রহ। রবীন্দ্রনাথ কৈশোরে এই দুটো ভাষাই শেখার চেষ্টা করেছিলেন। পরবর্তীকালে পরিণত বয়সে আরও খানিকটা বিধিবদ্ধভাবে “রবীন্দ্রনাথ একজন মিশনারি মহিলার কাছে জার্মান শিখেছিলেন গাজীপুরে।”( দেবব্রত চক্রবর্তী, দেশ,১৬ ডিসেম্বর ২০২২, পৃ ৪৭) এবং এই ভাষাটি শিখেছিলেন একেবারে নিজের আগ্রহে ও উদ্যোগে।
“I also wanted to know German literature and, by reading Heine in translation, I thought I had caught the glimpse of the beauty there.” (Talks in China, English Writings of Tagore, Volume 2, P-588)
এবং যৌবনের শুরুতেই ফরাসি ও জার্মান ভাষায় বিশেষজ্ঞের সহায়তায় তিনি এই দুই ভাষার একাধিক কবির কবিতা মূল থেকে অনুবাদও করেছিলেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য জার্মান কবি হাইনরিশ হাইনে যাঁর ৯টি কবিতা তিনি অনুবাদ করেছেন। আর ফরাসি ভাষা থেকে অনুবাদ করেছেন ভিক্টর য়ুগোর ৬টি আর জঁ-পিয়ের ফ্লরিয়াঁর ১টি কবিতা। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য এই ভাষা দু'টি আরও বেশি ভালোভাবে রপ্ত করার জন্য সময় দিতে পারেননি। কিন্তু এই দুই ভাষাতেই বোর্হেসের দখল ও পাণ্ডিত্য ছিল বিস্ময়কর এবং রবীন্দ্রনাথের মতোই দুটো ভাষাতেই তাঁর হাতেখড়ি হয়েছিল শৈশবে।
১৯১৪ সালে বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগে আগে বোর্হেসের বাবার চোখের চিকিৎসার জন্য যখন গোটা পরিবার জেনেভা পৌঁছয়, তখন যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় সেখানেই তাঁরা ১৯১৯ সাল পর্যন্ত থেকে যেতে বাধ্য হন এবং বোর্হেসকে ভর্তি করা হয় সেখানকার এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। এই সময় তিনি লাতিন, জার্মান ও ফরাসি ভাষা শেখেন। আর আশ্চর্যের ব্যাপার হলো জার্মান শিখতে গিয়ে তিনি দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট দ্বারা প্রতিহত হওয়ায় হাইনে পড়া শুরু করেন।এছাড়া নিৎশে এবং শোপেনহাওয়ারও তিনি জার্মান ভাষায় পড়েন। কিন্তু কবিদের মধ্যে হাইনেই হয়ে উঠেছিল তার প্রথমদিককার পাঠ। আর ফরাসি শিখতে গিয়ে তিনি য়ুগোকেই পেয়েছিলেন সেই কৈশোরে, যেমনটা ঘটেছে রবীন্দ্রনাথেরও ক্ষেত্রেও। বোর্হেস তাঁর আত্মজৈবনিক রচনায় জার্মান ভাষা শেখার ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথের মতোই হাইনে সম্পর্কে প্রায় অভিন্ন এক অভিজ্ঞতায় পৌঁছেছিলেন: “স্কুলের বাইরে নিজ উদ্যোগে জার্মান শেখায় হাত দিই। … হাইনের প্রথমদিকের কবিতার বই লিরিশ ইন্টের্মেশশো আর একটা জার্মান-ইংলিশ অভিধান জোগাড় করলাম। একটু একটু করে হাইনের সহজ শব্দাবলি আয়ত্ত করার পর দেখলাম, অভিধান ছাড়াই পড়তে পারছি। দ্রুতই আমি ভাষার সৌন্দর্যে নিজের মতো প্রবেশ করতে পারলাম।”
“On my own, outside of school, I took up the study of German….So I got hold of a copy of Heine’s early poems, the Lyrisches Intermezzo, and a German-English dictionary. Little by little, owing to Heine’s simple vocabulary, I found I could do without the dictionary. Soon I had worked my way into the loveliness of the language.” – The Aleph and Other Stories 1933-1969, Jorge Luis Borges, E P Dutton and Co, 1970, P 215-216
অর্থাৎ দুজনই ভাষাটি শিখেছিলেন নিজের ব্যক্তিগত উদ্যোগে এবং হাইনে ছিল তাঁদের উভয়ের জন্য যেমন উত্তম প্রবেশিকা, তেমনই উভয়েই ছিলেন এই কবির ভাষার সৌন্দর্যে আপ্লুত।
বোর্হেস বিশের দশকে জেনেভা থেকে ফিরেই জার্মান ভাষা থেকে অনুবাদও করলেন, কিন্তু হাইনে নয়, বরং জার্মান এক্সপ্রেশনিস্টদের কবিতা, বিশেষ করে জার্মান ভাষা থেকে ভিলহেল্ম ক্লেম (Wilhelm Klemm) থেকে ৫টি, কুয়ার্ট হাইনিক (Kurt Heynicke) থেকে ৪টি, অসগাস্ট স্ট্রাম (Ausgust Stramm) থেকে ২টি, এইচ. ভি.স্টুমেয়ার (H. v. Stummer) থেকে ১টি, অ্যার্নস্ট স্টাডলার (Ernst Stadler) থেকে ১টি, ইয়োহানেস আর. বেখেয়ার (Johaanes R. Becher) থেকে ১টি, ভ্যারনার হান (Werner Hahn) থেকে ১টি, আলফ্রেড ফাগটস্ (Alfred Vagts) থেকে ১টি,লোথার শ্রেয়েয়ার (Lothar Schreyer) থেকে ১টি। আর ফরাসি থেকে সে-সময় তিনি পিয়ের আলবের-বিরো (Pierre Albert-Birot)-এর প্রবন্ধ কেবল অনুবাদ করেছেন, আর ফরাসি ভাষায় দু' একটি নিবন্ধ লিখেছেন। অর্থাৎ, দু'জনই জার্মান ভাষার হাইনে দ্বারা আপ্লুত ছিলেন। হাইনের কথা রবীন্দ্রনাথ যেমন, তেমনই বোর্হেসও তাদের বিভিন্ন লেখায় উল্লেখ করেছেন তাঁদের পাঠ ও প্রীতির নমুনা হিসেবে।
৪.
একথা ঠিক, ইওরোপিয় এই দুই ভাষায় সাহিত্য পাঠ ও অনুবাদের এলোমেলো সাদৃশ্যের কথা যদি গ্রাহ্যে নাও নিই এবং শৈল্পিক বিচারে উভয়ের মনের গড়নে পার্থক্য সত্ত্বেও, অনুভূতির কোনও কোনও মুহূর্তে তারা একই সমতলে এসেছিলেন অনেকটা দৈবক্রমে। তবে দৈবেরও আছে প্রচ্ছন্ন যুক্তি ও বাস্তবতা যা কখনও কখনও এতটাই অচেনা রূপে উদ্ভূত হয় যে আমরা তাকে ব্যতিক্রম বলে অভিহিত করি। কিন্তু আসলে সেটাও স্বভাবের এক অস্ফুট ও অব্যাপ্ত রূপ মাত্র। ঠিক এই অর্থে রবীন্দ্রনাথে যা ছিল অব্যপ্ত ও অস্ফূট তা বোর্হেসের ক্ষেত্রে ছিল স্বতঃস্ফূর্ত আর প্রস্ফুটিত এক প্রবণতা, যার প্রকাশ ঘটেছে কূটাভাস বা বিরোধাভাস নামক অলংকারে। নানান ধরনে রবীন্দ্রনাথে কূটাভাস খুব প্রচুর না হলেও, একেবারে নগণ্যও নয়, কিন্তু বোর্হেসে তা ছিল প্রায় এক মৌল প্রবণতা, ফলে তাই প্রাচুর্যের ভার। উভয়ের মধ্যে নির্দিষ্ট এই আলংকারিক অভিব্যক্তি আমরা দেখতে পাব তাঁদের ভিন্ন ভিন্ন রচনায়। প্রথমে রবীন্দ্রনাথের অল্প কিছু নমুনা আমরা নজরে আনার চেষ্টা করব উভয়ের প্রবণতার মৈত্রীযোগ বোঝার স্বার্থে।
এ চিরজীবন তাই আর কিছু কাজ নাই
রচি শুধু অসীমের সীমা;
(উপহার, মানসী)অসংখ্য বন্ধন-মাঝে মহানন্দময়
লভিব মুক্তির স্বাদ!
..........
মোহ মোর মুক্তি রূপে উঠিবে জ্বলিয়া,
( মুক্তি, নৈবেদ্য)পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি,
(পথের বাঁধন, মহুয়া)তুমি আমার মুক্তি হয়ে এলে বাঁধনরূপে--
(গীতবিতান, পৃ ৫৮৪)
‘অসীমের সীমা,’—এ যেন বৈপরীত্যের সংঘর্ষে জ্বলে ওঠা সোনালি এক শিখা। আর ‘মোহ’ মানে তো একধরনের বন্ধনকেই বোঝানো হচ্ছে এই কবিতায়, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এই মোহকেই মুক্তি রূপে বিবেচনা করছেন। এর পরের উদ্ধৃতিতে ‘মুক্তি’ হয়ে উঠছে বিপরীতার্থের ‘বাঁধনরূপে’। বৈপরীত্যের বন্ধন নিয়ে এরকম কূটাভাস রবীন্দ্রনাথে আরও আছে, আছে তাঁর কোনও কোনও গদ্যের বাক্যাংশে। আমরা সেই অনুসন্ধানের বিস্তারে এ মুহূর্তে যাব না। আমরা শুধু দেখতে চাই- কূটাভাসের প্রতি রবীন্দ্রনাথের মোহ, তা বোর্হেসে এক কেন্দ্রীয় শক্তি হিসেবে নিজের রচনারাজ্যকে কীভাবে শাসন করছে।
কূটাভাসের প্রতি বোর্হেসের অনুরাগ তৈরি হয়েছে সেই সব স্প্যানিশ, ফরাসি ও ইংরেজ লেখকদের মাধ্যমে যারা এই জাদুকরি অলংকারের মাধ্যমে মানবচরিত্র ও বিশ্বজগতের রহস্যকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। বোর্হেস বিষয়ক এক লেখায় আঁদ্রে মারোয়া বলেছিলেন:
“He akin to Kafka, Poe, sometimes to Henry James and Wells, always to Valery by the abrupt projection of his paradoxes…”(Jorge Luis Borges, Labyrinths, Penguin Books, 1987, P-9 )”
এছাড়া বিশ্বজগত ও মানব-অস্তিত্বের গোলকধাঁধাময় স্বভাব সম্পর্কে পাস্কাল, গিয়োর্দানো ব্রুনো, এলেঁ দ্য লিলে, ইলিয়ার জেনো, কেবেদো, কাফকা কিংবা শেক্সপিয়রের কূটাভাসিক উপলব্ধিগুলোকে তিনি নিজের স্বভাবের অংশ করে নেন। কূটাভাস তাঁকে এতটাই আকৃষ্ট করেছে যে তা নিয়ে তিনি একাধিকবার লিখেছেন, যেমন ‘Avatars of the tortoise’,‘The paradox of Apollinaire’, ‘Kafka and his procursors’—এই সব প্রবন্ধে সরাসরি কূটাভাস নিয়ে আলোচনা করেছেন।
এটা সত্যি যে কূটাভাস নিয়ে আলোচনা ছাড়াও,বোর্হেসে কূটাভাস বাচনিক অলংকার হিসেবে যেমন এসেছে, তেমনি তা অভিব্যক্ত হয়েছে তাঁর কোনও কোনও গল্পে একটি সামগ্রিক বক্তব্য হিসেবে। তাঁর কোনও কোনও গল্পে একই চরিত্রের মধ্যে কূটাভাসের মতো আপাত পরস্পরবিরোধী স্বভাববৈশিষ্ট্যকে চিত্রায়নের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। বিভিন্ন সময় সাক্ষাৎকারে যেমন, তেমনি প্রবন্ধে এবং গল্পে তিনি কূটাভাসের প্রতি তাঁর পক্ষপাতকে অব্যাহত রেখেছেন। স্মরণ করা যাক তাঁর সেই বিখ্যাত প্রবন্ধটির কথা, ‘সময়ের নতুন খণ্ডন’ বা ‘New refutation of time’, যেখানে তিনি লিখেছেন:
“Time is the substance I am made of. Time is a river which sweeps me along, but I am the river; it is a tiger which destroys me, but I am the tiger; it is a fire which consumes me, but I am the fire.”
তাঁর গল্পে কূটাভাস এসেছে কখনও কাঠামো রূপে, কখনও বা সম্পূর্ণ গল্পের সারবস্তুর পরস্পরবিরোধী ব্যঞ্জনায়, যেমন ‘Theme of the traitor and Hero’. এই গল্পে তিনি ফারগাস কিলপ্যাট্রিক নামে যে বিপ্লবী চরিত্রটি সৃষ্টি করেছেন সেই বিপ্লবী নিজেই বিপ্লবের বিশ্বাসঘাতক হিসেবে আবির্ভূত হন। বোর্হেসের জাদুকরি আখ্যান ও বর্ণনার মাধ্যমে “দণ্ডিত নেতা নিজেই মৃত্যুদণ্ডে সই দিলেন।” “অদৃষ্ট একই সঙ্গে তাকে দণ্ড ও মুক্তি দিয়েছে।” অর্থাৎ শিকার নিজেই শিকারি। এরকম কূটাভাসিক গড়ন তাঁর অন্য আরও কয়েকটি গল্পে এবং চরিত্রের মধ্যে পাওয়া যাবে।
কূটাভাস থেকে সরে এবার আমরা উভয়ের অন্য একটি বৈশিষ্ট্যের দিকে দৃষ্টি দেব, সেটা হচ্ছে একের মধ্যে বহুর ধারণা কিংবা বহুর মধ্যে এক-এর। বোর্হেস কেবল প্রবন্ধে ও গল্পেই নয়, কবিতায় (‘The Watcher’, The Gold of Tiger) এবং প্যারাবোলেও (‘From Someone to no one’, ‘Everyting and Nothing’ এবং ‘Borges and I’) আমরা এই ধারণার শিল্পিত আয়োজন দেখতে পাব। সত্তার দ্বৈততা বা শূন্যতা কিংবা একই সত্তার বাস্তব ও অবাস্তবের মধ্যে সংযোগ ও বিনিময়—এসব ধারণা সম্ভবত বোর্হেসে এসেছে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের মরবীবাদের হাত ধরে। ভারতের অষ্টম বা নবম শতকের শঙ্করাচার্যের দর্শন (অদ্বৈতবাদ বা মায়াবাদ) এবং বৌদ্ধবাদের এক দূরাগত আভা আমরা তাঁর গল্পে বা কবিতায় নানাভাবে ঘুরেফিরে আসতে দেখব— যেমন ‘From Someone to no one’ এবং ‘The Watcher’-এ। রবীন্দ্রনাথও ঐতিহ্যসূত্রে উভয় ধারায় স্নাত ছিলেন। বিভাজন ও ঐক্যবোধ উভয় লেখকের মধ্যে কীভাবে কাজ করে তার খানিকটা আভাস আমরা শুরুতেই লক্ষ্য করেছি। এখানে আরও কিছু দৃষ্টান্তে আমরা চোখ বুলিয়ে যাব। এবার অন্য আরেকটি উদ্ধৃতি দেব রবীন্দ্রনাথ থেকে :
হৃদয়ের অসংখ্য অদৃশ্য পত্রপুট
গুচ্ছে গুচ্ছে অঞ্জলি মেলে আছে
আমার চার দিকে চিরকাল ধ'রে
আমি-বনস্পতির এরা কিরণপিপাসু পল্লবস্তবক,
এরা মাধুকরী-ব্রতীর দল।
(তেরো, পত্রপুট)
এর এক সমান্তরাল আমরা লক্ষ্য করব বোর্হেসের একটি ছোট্ট লেখায় যাকে প্যারাবল বলা যেতে পারে।
“বহু বছরব্যাপী এক লোক প্রদেশ, রাজ্যসমূহ, পাহাড় পর্বত, উপসাগর, জাহাজ, দ্বীপপুঞ্জ, মাছ, কক্ষসমূহ, যন্ত্রপাতি, নক্ষত্র, ঘোড়া আর মানুষের প্রতিমা দিয়ে ভরে তুলেছে শূন্যস্থান। মৃত্যুর অব্যবহিত আগে, সে আবিষ্কার করে যে ধৈর্য্যশীল রেখাসমূহের গোলকধাঁধা তার নিজেরই মুখশ্রীকে তুলে ধরেছে।”
Through the years, a man peoples a
space with images of provinces, kingdoms,
mountains, bays, ships, islands,
fishes, rooms, tools, stars, horses, and
people. Shortly before his death, he
discovers that the patient labyrinth
of lines traces the image of his own
face.
(A Personal Anthology, Jorge Luis Borges, Jonathan Cape, London, 1967, P 203)
ভিন্ন পথে ভিন্ন উপাদানে গড়ে উঠলেও, দুটো লেখাতেই আছে বহুর মাধ্যমে একক আদলের নির্মাণ ও বিশ্বাসের প্রতিফলন।
বহু বছরব্যাপী যে লোকটি বিভিন্ন বস্তুপুঞ্জ দিয়ে শূন্য জায়গাটি ভরে তুলেছে, মৃত্যুর অব্যবহিত আগে সে আবিষ্কার করছে যে এসব মিলিয়েই আসলে তার নিজেরই এক পূর্ণাঙ্গ আদল। রবীন্দ্রনাথ ওই রকম বৈচিত্রে না গিয়ে একটি বনস্পতিরই ‘অসংখ্য অদৃশ্য পত্রপুট’ আর ‘কিরণপিপাসু পল্লবস্তবক’-এর এক বনস্পতির কল্পনার মাধ্যমে নিজেরই এক পূর্ণাঙ্গ রূপের ধারণাকে তুলে ধরেছেন। দু'জনের প্রকাশভঙ্গি ভিন্ন হলেও মর্মত তাঁরা অভিন্ন আত্মারই সহোদর।
এরকমই নৈকট্যের আরেকটি প্রকাশ আমরা রবীন্দ্রনাথে দেখতে পাব নিচের এই পঙক্তিতে:
আমার জীবনে লভিয়া জীবন
জাগো রে সকল দেশ। (গুরু গোবিন্দ, কথা ও কাহিনী কাব্যগ্রন্থ, ১৯০০)
এই পঙক্তিতে তিনি যে-বৈশ্বিকবোধের মঞ্জুরী ফুটিয়েছেন তা আসলে একের মধ্যে বহুত্বেরই এক প্রকাশ কিংবা বহুর সম্মিলনে ‘এক’-এর পূর্ণাঙ্গ রূপ।
আমরা শুরু করেছিলাম গীতিবিথীকার সেই গানটির সঙ্গে বোর্হেসের ‘পর্যবেক্ষক’ নামক কবিতা এবং ‘বোর্হেস এবং আমি’ শীর্ষক প্যারাবলটির মধ্যে সাযুজ্য নির্ণয়ের মাধ্যমে। ‘নিজ’ ও ‘অপর’-এর বিভাজন ও ঐক্য উভয় লেখকের মধ্যে দেখা গেলেও, রবীন্দ্রনাথে তা কখনই খুব সর্বব্যাপী ছিল না, যেমনটা ছিল বোর্হেসের ক্ষেত্রে।
“বোর্হেস সবসময়ই ছিলেন অন্য এক বোর্হেসের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা ভিন্ন এক বোর্হেস, আর তা ছিল অসীম পর্যন্ত।”
Borges fue siempre el otro Borges desdoblado en otro Borges, hasta el infinito. (El arquero, la fleche y el blanco, Octavio Paz [Borges y Mexico], p-312)
রবীন্দ্রনাথ এই দ্বৈততার ‘অসীম’ অভিযাত্রী ছিলেন না ঠিকই, কিন্তু তার আকস্মিক উপস্থিতি দেখা গেছে মাঝেমধ্যে—কবিতায় আর গানে এবং কখনও কখনও গদ্যে। তারই এক নমুনা রবীন্দ্রনাথের ওই গানটি। রবীন্দ্রনাথের এক ‘আমি’ কালের ঢেউয়ে আকাশতলে ভেসে যাচ্ছে এবং বহু কিছুর সঙ্গে সে ভেসে যাচ্ছে—ধুলো ,জল, ফুল ও ফলের সঙ্গে।
অন্যদিকে, বোর্হেসে কী ঘটছে? রবীন্দ্রনাথ যেমন গানটির প্রথম বাক্যেই কোনওরকম নাটকীয়তা ছাড়াই জানিয়ে দিচ্ছেন অন্য এক আমিকে তিনি দেখছেন, একইভাবে বোর্হেসও তার ‘বোর্হেস এবং আমি’ নামক প্যারাবলের শুরুতেই জানিয়ে দিচ্ছেন যে “যা কিছু ঘটে সে অন্য কেউ, অন্য এক বোর্হেসের জীবনে ঘটে।” কিন্তু এই কথাগুলো কে বলছে এই অন্য বোর্হেস সম্পর্কে? পরের বাক্যেই আমরা দেখতে পাব বক্তা-আমিকে, অন্য আরেক ‘আমি’কে। তাঁর ভাষায়: “আমি বুয়েনস আইরেসের রাস্তা দিয়ে হাঁটি, হয়ত মুহূর্তের জন্য দাঁড়াই কখনও, তাকিয়ে দেখি হলঘরে প্রবেশপথের খিলানের দিকে আর গ্রিল করা দরজার দিকে : চিঠিপত্রে খবর পাই বোর্হেসের আর তাকে দেখতে পাই অধ্যাপকদের নামের তালিকায় অথবা কোনও কোনও জীবনী-অভিধানে।” এর পর এই-‘আমি’ তার নিজের পছন্দের কিছু তালিকা তুলে ধরে, তবে সেই অন্য-‘আমি’ও সেসব পছন্দ করলেও “কিন্তু তা এতটা চটুলভাবে করে যে নাটুকে বলে মনে হয়। এটা বলা অত্যুক্তি যে, আমাদের পরস্পরের সম্পর্ক দ্বন্দ্বময়”। রবীন্দ্রনাথও গানের পরের স্তবকে এক-‘আমি’র কর্মকাণ্ডের তালিকা দেন, যেমন,
ও যে সদাই বাইরে আছে, দুঃখে সুখে নিত্য নাচে--
ঢেউ দিয়ে যায়, দোলে যে ঢেউ খেয়ে।
একটু ক্ষয়ে ক্ষতি লাগে, একটু ঘায়ে ক্ষত জাগে--
ওরই পানে দেখছি আমি চেয়ে॥
এখানে দুই আমির উপস্থিতি থাকলেও বোর্হেসের মতো কোনও দ্বন্দ্বময়তা তিনি সৃষ্টি করেন না, করেন না কোনও নাটকীয়তার অবতারণা। যদিও দু'জনের পার্থক্য সম্পর্কে তিনি আমাদেরকে ঠিকই সজাগ রাখছেন বর্ণনার মাধ্যমে। শেষ স্তবকে তিনি স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিচ্ছেন “এই-যে আমি ঐ আমি নই,”। এটা ঠিক, বোর্হেস দুই আমির যে-নাটকীয়তা ও দ্বন্দ্বময়তা সৃষ্টি করেছেন এবং পরস্পরের সম্পর্ককে যেরকম গোলকধাঁধাময় এক আবহ তৈরির মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন তা কাব্যগুণে অনেক বেশি আকর্ষণীয়। এরই সঙ্গে ইতিহাস, ঐতিহ্য, সময় আর অনন্তের ইশারা এমন এক কূটাভাসিক আভরণে উদ্ভাসিত যে মনে হচ্ছে—রবীন্দ্রনাথের ভাষায়—“ও যে সচল ছবির মতো”। অন্যদিকে, রবীন্দ্রনাথে দুই আমি কাব্যের আকৃতি নিয়ে হাজির হলেও, তা অনেকটাই ভাষ্যময় সরলতা আর প্রত্যক্ষতায় সমতল বলে মনে হবে আমাদের কাছে। বোর্হেস এই তুলনায় বরং সর্পিল; বক্ররেখায় তিনি দুই আমিকে তুলে ধরেন। তবে দু'জনের হাতেই দুই আমির গড়ন শেষ পর্যন্ত বৃত্তাকার—এক ‘আমি’র বিন্দুটি গিয়ে যুক্ত হয় অন্য ‘আমি’র সঙ্গে। শৈল্পিক গড়নে দু'জনের এই ভিন্নতা ছাড়া, সারাৎসারে দু'জনই ছিলেন ভাবনার যমজ সন্তান।
তথ্যসূত্র:
কবির নাম ও সর্বনাম, রণজিৎ গুহ
Octavio Paz: Homage to the Poet, Kosrof Chantikian, Kosmos, USA, 1980, P-161
Book of imaginary being, Jorge Luis Borges
The Lesson of the Master, Norman Thomas Di Giovanni
The Self and Othre, Jorge Luis Borges
In Praise of Darkness, Jorge Luis Borges
Borges : A Reader, Jorge Luis Borges, Edited by Emir Rodriguez Monegal and Alastair Read
Hojas de Hierba, Walt Whitman, Trducido por Jorge Luis Borges
Borges y Mexico , Miguel Capistran
Twenty four Conversations with Borges, Roberto Alifano
গীতিবিথীকা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শেষ সপ্তক, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
The Gold of the Tiger, Jorge Luis Borges
জগত কুটির, অমর্ত্য সেন
English Writings of Tagore, (Volume 2), Rabindranath Tagore
The Aleph and Other Stories 1933-1969, Jorge Luis Borges
মানসী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নৈবেদ্য, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মহুয়া, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
গীতবিতান, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
Labyrinths, Jorge Luis Borges
পত্রপুট, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
A Personal Anthology, Jorge Luis Borges
কথা ও কাহিনী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
Borges y Mexico, Miguel Capistran