ব্রিটিশদের যৌন চাহিদা মেটাতেই সোনাগাছি! ৪৩টি যৌনপল্লীর মালিক ঠাকুরবাড়ির এই মানুষটি

Dwarkanath Tagore and Kolkata Brothel: সেই সময় প্রায় ৪,৪৪৯ টি যৌনপল্লী ছিল, প্রায় ১২,৪০০ যৌনকর্মী থাকতেন সেইখান। এই জায়গাগুলির মধ্যেই অন্যতম সোনাগাছি।

কলকাতায় ঠাকুর পরিবারের প্রথম উদ্যোক্তা, অত্যন্ত ধনী এবং পুঁজিবাদী চরিত্র বললেই নাম আসে দ্বারকানাথ ঠাকুরের, সম্পর্কে বাঙালির নিভৃত প্রাণের ঈশ্বর রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরদা। তবে রবিঠাকুরকে নিয়ে যতখানি গর্ব বাঙালির, তাঁর ঠাকুরদাকে নিয়ে যারপরনাই অস্বস্তি! কলকাতার ‘রাজপুত্র’ দ্বারকানাথের সঙ্গে ব্রিটিশদের বন্ধুত্ব, বিপুল সম্পত্তির মালিক হওয়া, কোনও কিছুই পরাধীন ভারতের গর্ব হতে পারে না, এখনও এই বিশ্বাসেই আস্থা বাঙালির। দ্বারকানাথের যখন মাত্র ১৬ বছর বয়স, হঠাৎ করেই প্রয়াত হন বাবা। তাঁর বিশাল সম্পত্তি এবং পরিবারের সমস্ত দায়িত্ব রাতারাতিই এসে পড়ে নাবালক পুত্রের কাঁধে। এই প্রভূত পারিবারিক চাপের মুখে পড়েই সেই ১৬ বছর বয়সেই স্কুলের পাট চুকিয়ে দেন দ্বারকানাথ, এক প্রখ্যাত ব্যারিস্টার রবার্ট কাটলার ফার্গুসনের অধীনে শিক্ষানবিশ হিসেবে যোগ দেন তিনি।

এই ব্রিটিশ অ্যাডভোকেটের অধীনে থেকেই দ্বারকানাথ ঠাকুর স্থায়ী বন্দোবস্তের আইন শিখেছিলেন এবং সুপ্রিম কোর্টের সমস্ত বিধি, পদ্ধতি সম্পর্কেও শিখেছিলেন। তখন সুপ্রিম কোর্ট এই বাংলাতেই অবস্থিত। কেবল সুপ্রিম কোর্টের পদ্ধতিই নয়, সদর এবং কলকাতার জিলা আদালতেরও খুঁটিনাটিও শেখেন দ্বারকানাথ। ১৮১৫ সালের মধ্যে তিনি আইনি বিষয়ে যথেষ্ট অভিজ্ঞ হয়ে ওঠেন এবং ব্যারিস্টারিকেই পেশা করেন। সফলও হন। যদিও এর পাশাপাশি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হয়েও কাজ করতেন তিনি। এরই মধ্যে, বহরমপুর, পাণ্ডুয়া, কালীগ্রাম এবং শাহাজদপুরের চারটি জেলায় অনেক নতুন সম্পত্তিও কেনেন স্বারকানাথ, জমিদারির পরিসীমা বৃদ্ধি পায়। নুন এবং আফিমের বাণিজ্যের পাশাপাশি কয়লা খনি, রিয়েল এস্টেট ইত্যাদির সঙ্গেও জড়িত ছিলেন দ্বারকানাথ। বারো বছর ধরে দেওয়ান হিসাবে কাজ করেছিলেন তিনি। ব্রিটিশ-ভারতীয় সংস্থা, কার টেগোর অ্যান্ড কোম্পানির সূত্র ধরে বিশাল প্রতিপত্তি বাড়ে ঠাকুরবাড়ির এই ব্যক্তিত্বের। ততদিনে দ্বারকানাথের এক কন্যা এবং পাঁচ পুত্রও জন্মেছেন।

আরও পড়ুন- পুরস্কারের বোঝা থেকে ছুটি চাইতেন রবীন্দ্রনাথ

রামমোহন রায় এবং দ্বারকানাথ ঠাকুর ছিলেন ভালো বন্ধু। দ্বারকানাথের সহায়তাতেই রামমোহন রায় ব্রাহ্ম সভা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা পরে ব্রাহ্মসমাজ হয়ে ওঠে। দ্বারকনাথই ছিলেন ব্রাহ্মসভার অধ্যক্ষ। দ্বারকানাথের অবস্থান বা প্রতিপত্তি সমাজে কেমন ছিল তা বোঝা যায় তাঁর বিদেশ ভ্রমণ দেখেই। দ্বারকানাথ ইংল্যান্ডে যখন যান, সেখানে তাঁকে অভ্যর্থনা জানান ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী, রাজপুত্র, রানি, বোর্ড অব কন্ট্রোলের সভাপতি এবং ডাচরা। প্যারিসেও গিয়েছিলেন দ্বারকানাথ। ব্রিটিশদের সম্পদের পরিমাণ তখন বিপুল। সামান্য এক বাঙালি জমিদার দ্বারকানাথ কীভাবে প্রতিযোগিতায় টেক্কা দিলেন ব্রিটিশদের?

ব্রিটিশরা ভারতীয়দের নিকৃষ্ট ও অসভ্য বলে মনে করলেও দ্বারকানাথের ব্রিটিশ বন্ধুরা কিন্তু যথেষ্ট মান্যিগণ্যি করত তাঁকে। বাণিজ্য এবং অন্যান্য প্রয়োজনে দ্বারকানাথকে ঢালাও সাহায্য করতেন ব্রিটিশরা। এই বিপুল সম্পত্তি নিয়েই বেলগাছিয়ায় একটি রাজবাড়ি তৈরি করেন দ্বারকানাথ। এই বাড়ির চোখ ধাঁধানো বাগানে ব্রিটিশ বন্ধুদের নিয়মিত আনাগোনা লেগে থাকত। সমসাময়িক সংবাদপত্রগুলিতে দ্বারকানাথ ও ব্রিটিশদের সখ্য নিয়ে নিয়মিত লেখা বেরোত, ব্যঙ্গ ও সমালোচনাও ধেয়ে আসত সমাজ থেকেই।

১৮৫৩ সালের এক ব্রিটিশ সমীক্ষা জানাচ্ছে, সেই সময় প্রায় ৪,৪৪৯ টি যৌনপল্লী ছিল, প্রায় ১২,৪০০ যৌনকর্মী থাকতেন সেইখান। এই জায়গাগুলির মধ্যেই অন্যতম সোনাগাছি। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনী থেকে জানা যায়, দ্বারকানাথের মালিকানাধীন ছিল ৪৩ টি যৌনপল্লী। সোনাগাছির মতো বিখ্যাত যৌনপল্লীর বিকাশে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল দ্বারকানাথেরই।

বেশিরভাগ ব্রিটিশ, যারা বাংলায় এসেছিলেন, তারা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী হিসাবেই এসেছিলেন। অধিকাংশই ছিলেন তরুণ এবং অবিবাহিত। ব্রিটিশ এই কর্মীদের যৌন বিনোদন জোগাতে দ্বারকানাথ ৪৩ টি যৌনপল্লীর মালিকানা নেন। এই যৌনপল্লীগুলিতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, এক বা একাধিক ভারতীয় যৌনকর্মী এই জাতীয় ব্রিটিশ অভিজাত এবং কর্মচারীদের যৌনবিনোদন দিতেন। কেবল ব্রিটিশদেরই নয়, ধনী বাঙালি বাবুদেরও চাহিদা মেটাতেন তারা।

আরও পড়ুন- আপনারা যেখানে থাকেন, সেখানে প্রেম সম্ভব? প্ল্যানচেটে আত্মার কাছে জানতে চাইলেন রবীন্দ্রনাথ

তবে দ্বারকনাথের এই বিপুল প্রতিপত্তি ১৮৩৭ সালে ব্যাপক মন্দার মুখে পড়ে, ১৮৪০ এর দশক পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল এই মন্দা। বহু বহু ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়েন দ্বারকানাথ। সেই সব ঋণের পরিমাণ এতই বিপুল ছিল যে তাঁর পুত্র দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সেই ঋণ শোধ করতে হয়েছিল। বাবার ঋণ মেটাতেই প্রায় পুরো জীবন অতিবাহিত করে ফেলেন দেবেন্দ্রনাথ।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অবশ্য ঠাকুরদা দ্বারকনাথ ঠাকুর সম্পর্কে নিজের লেখায় বিশেষ উল্লেখ করেননি। শোনা যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দ্বারকানাথের বেশিরভাগ নথিই পুড়িয়ে ফেলেছিলেন। পরাধীন ভারতে, ব্রিটিশদের ব্যাপক অত্যাচারের মধ্যেও একজন ভারতীয় হিসেবে দ্বারকানাথের সঙ্গে ব্রিটিশদের এই সখ্য ভালোভাবে নেয়নি বাংলা, নেওয়ার কথাও না। কলকাতার প্রথম পুঁজিবাদী দ্বারকানাথের অবশ্য তাতে কিছু এসে যায়নি, লাভের দিকেই ছিল তাঁর সম্পূর্ণ মনোনিবেশ। একজন খাঁটি ব্যবসায়ী চরিত্রকেই আজীবন লালন পালন করেছেন দ্বারকানাথ, তার জন্য যতদূর যাওয়ার কথা, গিয়েছেন। নীতি-আদর্শের পথকে গুরুত্ব দেননি কখনই।

More Articles