এই সমুদ্রতীরে কাদম্বরীর সঙ্গে শেষ ভ্রমণ রবীন্দ্রনাথের

'সব ঠাঁই মোর ঘর আছে'- বিশ্বভুবন ভ্রমণ করেছেন রবীন্দ্রনাথ, কিন্তু বারবার ফিরেছেন শিকড়ে।

 

দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে
একটি শিশিরবিন্দু

 


বাঙালির আধুনিক ভ্রমণের শখের একরকম গোড়ার দিকটিতেই ঠাকুর পরিবারকে রাখা যায়। ভ্রমণ ব্যাপারটা অবশ্য অনেক পুরনো। কিন্তু তখন প্রযুক্তি নেই, পৃথিবী নিয়ে তেমন ধারণাও নেই মানুষের। কাজেই ‘প্রাগৈতিহাসিক যুগে’ হাতে গোনা যে কয়েকজন লম্বা ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েছেন, ইতিহাস তাঁদের সসম্মানে মনে রেখেছে। ইংরেজরা এদেশ দখলের পর থেকে বিলাত ভ্রমণের ব্যাপারটা অভিজাত মহলে ধীরে ধীরে বাড়তে লাগল। তবে শুধুমাত্র এইজাতীয় 'স্ট্যাটাস' ভ্রমণে আটকে ছিলেন না দেবেন্দ্রনাথ। যত্রতত্র ভ্রমণ ছিল তাঁর নেশা। এই শখ রবীন্দ্রনাথের উত্তরাধিকারসূত্রেই পাওয়া। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বংশের ছোট ছেলেটি যেদিন স্কুলের বাঁধা-ধরা গণ্ডি ছাড়িয়ে পালিয়ে এসেছিল, সেদিনই হয়তো ভাগ্যদেবতা সহাস্যে তার কপালে ভ্রমণের অদৃষ্ট ছাপিয়ে দিয়েছিলেন। বছর বারো বয়সে যেদিন ‘রহস্যময়’ পিতার সঙ্গে সেই বালক পাড়ি দিল হিমালয়ের দিকে, জোড়াসাঁকোর চৌহদ্দির বন্ধনও তাঁর ঘুচে গেল। হিমালয় যাওয়ার আগে পিতার সঙ্গে বোলপুরে কিছুদিনের হল্ট। সেখানে নারকেল গাছের তলায় বসে লিখছেন ‘পৃথ্বীরাজের পরাজয়’। জীবনস্মৃতির প্রথম পাণ্ডুলিপিতে সেই কল্পনার কাব্যভাবুকতা নিয়ে রসিকতা করে লিখছেন, “মধ্যাহ্নে খোয়াইয়ের মধ্যে বুনো খেজুরের ঝোপ হইতে ছোট ছোট অখাদ্য খেজুর খাইয়া নিজেকে জনহীন মরুরাজ্যে পথহারা তৃষ্ণার্ত পথিক বলিয়া মনে হইত এবং সকালবেলায় নারিকেল-ছায়ায় খাতা কোলে করিয়া বসিয়া নিজেকে কবি বলিয়া সন্দেহ থাকিত না।” বয়সকালে সেই রোমান্টিসিজম যতই হাস্যকর ঠেকুক, অস্বীকার করার উপায় নেই, সেই ভ্রমণেই দেবেন্দ্রনাথকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল তাঁর।

 

এর প্রায় বছরপাঁচেক পরে সত্যেন্দ্রনাথ ভাইকে নিয়ে একটু উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। বিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে হতভাগা ঘরেই বসে আছে। এভাবে চলতে পারে? সত্যেন্দ্রনাথ বাবাকে বুঝিয়েসুঝিয়ে রাজি করলেন যে, রবি বিলেত যাবে, ব্যারিস্টারি পড়তে। জীবনে এই প্রথম বিলেত যাত্রা। এ-সময়টা রবির জীবনের ওপর মেজদার পরীক্ষানিরীক্ষার যুগ। বিলেত যাওয়ার মাসছয়েক আগে রবিকে মেজদা নিয়ে গেলেন নিজের কাছে। সত্যেন্দ্রনাথ তখন আমেদাবাদের সেশন জজ। শাহিবাগে তিনি যে বাসাটিতে থাকতেন, সেটি ছিল বাদশাহি আমলের এক বিরাট প্রাসাদ। স্বয়ং শাহজাদা খুরম, অর্থাৎ শাজাহান এই প্রাসাদ নিজের জন্য তৈরি করেছিলেন। প্রাসাদের সীমানার পাশে সবরমতী নদী বয়ে চলেছে। সেইদিকে মুখ করে প্রাসাদের একটা বিরাট খোলা ছাদ। জ্ঞানদানন্দিনী ছেলেমেয়েদের নিয়ে কিছুদিন আগেই চলে গিয়েছেন বিলেত। মেজদা কোর্টে বেরিয়ে যাওয়ার পর রবি সেই বিরাট বাড়িটিতে একা। এই একাকিত্ব জমাট বেঁধে বহুদিন মনের রসে জারিয়ে ‘ক্ষুধিত পাষাণ’-এর প্রেক্ষাপট গড়ে উঠবে ভবিষ্যতে। কিন্তু আপাতত বর্তমানের নির্জনতা রবিকে ঠেলে তুললে ইতিহাসের মণিকোঠায়। এই অতি-প্রাচীন বাড়ি, তার আনাচকানাচে কত বছরের ইতিহাস! কোথাও নহবতখানায় রোশনচৌকি বাজছে, কোথাও পাথরের রাস্তা ধরে চলে যাচ্ছে ঘোড়ার খুরের শব্দ, কোথাও বা চলছে ফৌজের কুচকাওয়াজ, অন্দরমহল পাহারা দিচ্ছে হাবসি খোজারা। এইসব দৃশ্য মানসপটে ফুটে উঠছে, আর একা একা এই বিরাট প্রাসাদে বিরল অভিজ্ঞতার সাক্ষী থাকছেন সতেরো বছর বয়সি রবীন্দ্রনাথ। জীবনস্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, সেই শাহিবাগ প্রাসাদের চূড়ার ওপরকার একটি ঘর ছিল তাঁর বরাদ্দ। সেই ঘরে একচাক বোলতা ছাড়া সঙ্গী আর কেউ ছিল না। রাতের অন্ধকারে এক-দু'টি বোলতা থেকে থেকেই তার বিছানায় এসে পড়ত। ফলে ঘুমের ঘোরে পাশ ফেরার অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখের হত না। তবে কামড়ের ব্যথাটুকুই তো আর সব নয়, জগদীশ ভট্টাচার্য বলছেন, “শুক্লপক্ষের গভীর রাত্রে সবরমতী নদীর তীরে সেই প্রকাণ্ড ছাদটায় যে-স্বপ্ন নেমে আসত তা কাব্যোন্মেষের পক্ষে কী পরিমাণ সহায়ক হত তা সহজেই অনুমেয়। ঐতিহাসিক স্মৃতি-বিজড়িত সেই প্রাসাদ চত্বরে কবিকণ্ঠে নেমে এল সুরের ঝরনাধারা। গীতিকবিতা রচনা করে কবি প্রথম সেই নিজের দেওয়া সুর তাতে যোজনা করলেন। জোড়াসাঁকোর কিশোর-কবি হলেন আমাদের নবীন সুরকার।” লেখা হল:

নীরব রজনী দেখ মগ্ন জোছনায়,
ধীরে ধীরে অতি ধীরে গাও গো!
ঘুমঘোরভরা গান বিভাবরী গায়,
রজনীর কণ্ঠ সাথে সুকণ্ঠ মিলাও গো!

 

গানটি পরে রূপান্তরিত হয়েছে বটে, কিন্তু রূপান্তরিত গানে আর সেই অভিজ্ঞতার লেশ থাকেনি। এই সময়ের রচনা সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, “বলি ও আমার গোলাপবালা' গানটিও এমনি আর এক রাত্রে লিখিয়া বেহাগসুরে বসাইয়া গুন গুন করিয়া গাহিয়া বেড়াইতেছিলাম।… আমার ছেলেবেলাকার অনেকগুলি গান এইখানেই লেখা।”

 

আরও পড়ুন: জমিদার রবীন্দ্রনাথ || হিন্দু আর মুসলমান প্রজাদের সেদিন এক আসনে বসিয়েছিলেন কবিগুরু

আমেদাবাদেই অন্নপূর্ণা তড়খড় বা আনা-র সঙ্গে অপরিণত প্রথম প্রেম। তারপর সতেরো বছর চার মাস বয়সে মেজদার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রথম বিলেতযাত্রা। ১৮৭৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর বম্বে থেকে ‘পুনা’ জাহাজ বম্বে থেকে ইংল্যান্ডের পথে রওনা হল। এডেন হয়ে সুয়েজ পৌঁছতে সময় লাগে সাকুল্যে এগারো দিন। ওভারল্যান্ড বা ‘ডাঙাপেরনো যাত্রী’ হওয়ায় লোহিত সাগরতীরে সেই সুয়েজ বন্দরে নেমে রেলপথে মিশর পেরিয়ে ভূমধ্যসাগরের বন্দর আলেকজান্দ্রিয়ায় যেতে হল। মিশরের ধুলোয় চুলের এমন অবস্থা রবীন্দ্রনাথ বলছেন, “চুলে হাত দিতে গিয়ে দেখি, চুলে এমন এক স্তর মাটি জমেছে যে, মাথায় অনায়াসে ধানচাষ করা যায়।” সেখান থেকে দিনচারেক পরে ‘মঙ্গোলিয়া’ স্টিমারে ইতালির ব্রিন্দিসি বন্দরে গিয়ে উঠলেন তাঁরা। ব্রিন্দিসি থেকে আল্পস পেরিয়ে ফ্রান্স, যদিও প্যারিসে একদিনের বেশি থাকতে পারেননি প্রথমবার রবীন্দ্রনাথ, তবে সেখানে টার্কিশ বাথ ও অঙ্গমর্দনের সুযোগ হয়েছিল। সে সম্পর্কে বলছেন, “টার্কিশ বাথে স্নান করা আর শরীরটাকে ধোপার বাড়িতে দেওয়া এক কথা।” ফ্রান্স থেকে ইংল্যান্ড। লন্ডনেও প্রথমবার ঘণ্টাখানেকের জন্য থাকা। জ্ঞানদানন্দিনী ছেলেমেয়ে নিয়ে মাইলপঞ্চাশেক দূরে সাসেক্সের সমুদ্রতীরে ব্রাইটন শহরে ছিলেন। সেখানেই ওঠা হল। ব্রাইটনের একটি স্কুলে প্রাথমিকভাবে ভর্তি হলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু জ্ঞানদানন্দিনীর স্নেহচ্ছায়ায় পড়শোনা বিশেষ এগোচ্ছে না। তা দেখে তখন তারকনাথ পালিত নামে মেজদার এক বন্ধু রবিকে ফের লন্ডনে নিয়ে এলেন। রিজেন্ট পার্কের সামনে একটি বাসায় তাঁকে একলা ছেড়ে দেওয়া হল। চলল সেখানে কিছুদিন ল্যাটিন শেখার চেষ্টাচরিত্র, পরের দিকে পরীক্ষার প্রস্তুতিও। হঠাৎ করেই ফের ডেভনশায়ারের টর্কি থেকে ডাক এল। জ্ঞানদানন্দিনী ব্রাইটন ছেড়ে সেখানে বাসা নিয়েছেন। মেজ বৌঠানের হুকুমে পড়াশোনা গুটিয়ে টর্কি এলেন রবি। পাহাড়, সমুদ্র, ফুলভরা প্রান্তর, পাইনবনের ছায়া– আর কী চাই? সুরেন্দ্রনাথের সঙ্গে দুষ্টুমি করে বেশ ভালোই কাটছিল। কিন্তু এরকম চললে ব্যারিস্টারি পড়ার কী হবে? বেগতিক দেখে আবার তাকে লন্ডন পাঠানো হল। এবার ডাক্তার স্কট নামের এক গৃহস্থের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করা হল। পালিত তাঁকে লন্ডন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি করে দিলেন। কিন্তু বিধি বাম। মাত্র তিনমাসের বেশি পড়তে পারলেন না। সত্যেন্দ্রনাথের ছুটি শেষ। তাঁকে ফিরতে হবে। দেবেন্দ্রনাথ চিঠিতে লিখলেন, রবিকেও সঙ্গে নিয়ে এসো। কেন এহেন আদেশ, তা জানা যায়নি। তবে রবি বিলেতে থাকুক, এই ব্যাপারটা দেবন্দ্রনাথের কোনওদিনই তেমন পছন্দ ছিল না। ১৮৮০ সালের ফেব্রুয়ারিতে সতেরো মাসের বিলেতবাস সেরে দেশে ফিরলেন রবি।

 

প্রথমবার বিলেত গিয়ে খুব হতাশ হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ভেবেছিলেন, “এই ক্ষুদ্র দ্বীপের এক প্রান্ত থেকে আর-এক প্রান্তে টেনিসনের বীণাধ্বনিতে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, যেখানেই থাকেন না কেন, গ্ল্যাডস্টোনের বাগ্মিতা, ম্যাক্‌স্‌মূলারের বেদ-ব্যাখ্যা, টিন্ড্যালের বিজ্ঞানতত্ত্ব, কার্লাইলের গভীর চিন্তা, বেনের দর্শনশাস্ত্র শুনতা পাবেন।” সেসব দিবাস্বপ্ন ভেঙে দেখলেন, মোটেও তেমন স্বর্গরাজ্য নয় বিলেত, যেমনটা ইংরেজরা প্রচার করে থাকে। যাই হোক, দ্বিতীয়বার বিলেত যাওয়া হল না সমস্ত প্রস্তুতি নিয়েও। ১২৮৮ বঙ্গাব্দের ৯ বৈশাখ জোড়াসাঁকো থেকে বেরলেন বিলেত যাওয়ার জন্য। সঙ্গে ভাগ্নে সত্যপ্রসাদ। কিন্তু মাদ্রাজের ঘাট অবধি পৌঁছেই এবারে ফিরতে হল। কারণ রবীন্দ্রনাথ খোলসা করতে চাননি। আসলে সত্যপ্রসাদের তখন সবেমাত্র বিয়ে হয়েছে। তাই ঘরের টান ভাগ্নের এত তীব্র হয়ে উঠল, যে মামা আর তাকে নিয়ে এগোতে সাহস করলেন না। অগত্যা ফিরতেই হল। এতে দেবেন্দ্রনাথ খুশিই হয়েছিলেন। জ্যোতিদাদার সঙ্গে রবির দার্জিলিং যাওয়ার কথা পাওয়া যায়, পাওয়া যায় সদলবলে কারোয়ারের সমুদ্রতীরে ঘুরতে যাওয়ার গল্পও। বম্বে প্রেসিডেন্সির দক্ষিণে কর্নাটের প্রধান শহর। “এই ক্ষুদ্র শৈলমালাবেষ্টিত সমুদ্রের বন্দরটি এমন নিভৃত এমন প্রচ্ছন্ন যে, নগর সেখানে নাগরীমূর্তি প্রকাশ করতে পারে নি। অর্ধচন্দ্রাকার বেলাভূমি অকূল নীলাম্বুরাশির অভিমুখে বাহু দুটি প্রসারিত করে দিয়েছে— সে যেন অনন্তকে আলিঙ্গন করে ধরবার একটি মূর্তিমতী ব্যাকুলতা। প্রশস্ত বালুতটের প্রান্তে বড় বড় ঝাউগাছের অরণ্য, এই অরণ্যের এক সীমায় একটি ক্ষুদ্র নদী তার দুই গিরিবন্ধুর উপকূলরেখার মাঝখান দিয়ে সমুদ্রে এসে মিশেছে।” এই ভ্রমণ কাদম্বরীর সঙ্গে রবির শেষ ভ্রমণ।

 

১২৯৪ বঙ্গাব্দের শেষ দিকে স্ত্রীর সঙ্গে গাজিপুর, ১৩০৫ বঙ্গাব্দে সপরিবারে শিলাইদহ– এই ধরনের নানা ছোটখাটো ভ্রমণ কবির জীবনজুড়ে। শিলং, মংপু রবিজীবনের বেশ আলোচিত অধ্যায়। রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভ্রমণের বেশিরভাগটাই বিংশ শতকে। ১৯১২ সালের ২৭ মে ইউরোপ-আমেরিকা ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন। সঙ্গে একগুচ্ছ রচনার ইংরেজি অনুবাদ। ‘গীতাঞ্জলী’-র ইংরেজি ভূমিকা লিখে দিলেন ইয়েটস্‌। লন্ডন থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ১৯ অক্টোবর পোঁছলেন। প্রায় বছরখানেক আমেরিকাতেই কাটান কবি। ১৯১৬-'১৭ ফের জাপান ও আমেরিকায় ভ্রমণ। ফ্রান্স, হংকং, চিন, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, ডেনমার্ক, সুইডেন, অস্ট্রিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া, আর্জেন্টিনা, ইতালি, নরওয়ে, হাঙ্গেরি, যুগোশ্লাভিয়া, বুলগেরিয়া, রুমানিয়া, গ্রিস, মিশর, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, জাপান, বার্মা, হল্যান্ড, সোভিয়েট রাশিয়া, ইরান, ইরাক, শ্রীলঙ্কা— সব মিলিয়ে প্রায় তেত্রিশটিরও বেশি দেশে ভ্রমন করেছেন। পরিচয় হয়েছে মুসোলিনি থেকে আইনস্টাইন, ইয়েটস থেকে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো, হেলেন কেলার– প্রমুখ নানা জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিত্বের সঙ্গে। যদিও রবীন্দ্রদর্শনের কিছুই নাকি বার্নাড শ বা বার্ট্রার্ন্ড রাসেল বুঝতে পারেননি। ঘটনাচক্রে দু'জনেই যে ইংরেজ– সেকথা মনে রাখা অত্যন্ত দরকার। রঁমা রঁলা প্রমুখের কাছে কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যভাবনা, রাজনীতি, বিশেষত জাতীয়তাবাদ-বিরোধী চিন্তা অত্যন্ত প্রশংসিত হয়েছিল। এমনকী, মুসোলিনির সঙ্গে পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায় তাঁর স্পষ্ট বক্তব্যের জন্যই। তার নেপথ্যে যদিও রঁমা রঁলার অবদান ছিল।

 

আমরা দেখেছি রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যব্যপী এই ভ্রমণের কী অমোঘ প্রভাব! ‘বলাকা’ থেকে ‘আফ্রিকা’— কীভাবে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা, দর্শন কবিকে ক্রমাগত ভেঙেছে, গড়েছে। আর এই যাবতীয় ভ্রমণের শুরুর বিন্দুটি রবির প্রথম বিলেতবাস, যা রবীন্দ্রনাথের পরিণত জীবনের ভ্রমণদর্শন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। জগদীশবাবু বলছেন, "রবীন্দ্রনাথ একটি বিশেষ দেশের বিশেষ কালের কবি হয়েও পরবর্তী জীবনে বিশ্বমানবের বাণীদূত, অর্থাৎ কবি-সার্বভৌমরূপে দেখা দিয়েছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার মাটিতে মহাকাল তাঁর ঘর বেঁধে দিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি সর্বদেশ ও সর্বকালের মানবসাধনতীর্থের পথে পথে মাধুকরীবৃত্ত কবি পরিব্রাজকে রূপান্তরিত হলেন। এই অর্থেই রবীন্দ্রনাথ বিশ্বকবি। বহির্ভারতে বিশ্বকবির প্রথম নীড় রচিত হয়েছে ব্রাইটন-লন্ডন-টর্কিতে। ‘উৎসর্গ’ কাব্যগ্রন্থে 'প্রবাসী' কবিতায় কবি বলেছেন:

সব ঠাঁই মোর ঘর আছে, আমি সেই ঘর মরি খুঁজিয়া
দেশে দেশে মোর দেশ আছে, আমি সেই দেশ লব যুঝিয়া।
পরবাসী আমি যে দুয়ারে চাই—
তারি মাঝে মোর আছে যেন ঠাঁই,
কোথা দিয়ে সেথা প্রবেশিতে পাই সন্ধান লব যুঝিয়া।
ঘরে ঘরে আছে পরমাত্মীয়, তারে আমি ফিরি খুঁজিয়া।।

 

পৃথিবীর দেশে দেশে নিজের দেশকে খুঁজে পাওয়া, প্রবাসের ঘরে ঘরে পরমাত্মীয়ের সন্ধান করা—কবিচেতনার এই নব-অভ্যুদয়ের প্রত্যূষলগ্ন হল প্রথম বিলাতপ্রবাসের সতেরো মাস।”
রবীন্দ্রনাথ জাতীয়তাবাদ-বিরোধী ছিলেন। এক দেশকে অন্যান্য দেশের থেকে বড় করে দেখানোর প্রয়োজন তিনি কখনও অনুভব করেননি। ‘মহিমান্বিত’ করার নেপথ্যে যে ঝোঁক, তা যে কেবলই অন্তঃসারশূন্য দেখনদারির, অপরকে তুচ্ছতাচ্ছিল্যের কৌশলমাত্র, প্রথম বিলেত গিয়েই সেই সত্য তিনি বুঝেছিলেন। তাই ভারতের দেশপ্রেমের দেখনদারিকে তিনি কোনওদিনই প্রশ্রয় দেননি। আর আজ, তার প্রায় এক শতাব্দী পর , ‘দেশপ্রেম’ নিয়ে এখনও বড়াই করছি আমরা? পিঠে মহিমার বোঝা নিয়ে আর যাই হোক, ভ্রমণ হয় না। তার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন একটি নির্ভার, নির্লিপ্ত আত্মা।

 

ঋণস্বীকার:
কবিমানসী, জগদীশ ভট্টাচার্য। প্রথম খণ্ড
জীবনস্মৃতি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

More Articles