অন্যজনের রবীন্দ্রগান
Rabindra Sangeet: রবিবার অন্য দিনের মতো ভিক্ষে পাওয়া যাবে না, তিনি জানেন। কিছুটা অভ্যেসবশেই গাইছেন তিনি। কোন আকাশের কথা বলছেন? যে জন্মান্ধ সে তো আকাশই দেখেনি। তাঁর মুক্তি কোন আকাশে?
বহু মানুষের আদর আর সম্মান আদায় করে নেওয়া গলায় রবীন্দ্রনাথের গান মর্মে ও কর্মে যে ভাবে ছাপ ফেলে যায় তাই নিয়ে মাঝেসাঝেই লিখি। সেইসব কিংবদন্তি গাইয়েদের বিষয়ে পড়ি। গল্প শুনি, যাঁরা জানেন তাঁদের থেকে। আসলে যে মন একটা গান ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনেকগুলি বছর, তার দিকে তাকাতেও ভালো লাগে। মাঝেমাঝে দেখি, একই গান জীবনের নানা বেলায়, একই লোক আলাদা আলাদা ভাবে গাইছেন। এই যে, গাছের মতো গানের দিকে তাকিয়ে জীবনের নানা বয়সে দাঁড়িয়ে আছে মানুষ, তা দেখে আমার স্নান হয়ে যায়। কিন্তু বলার সময়ে, লেখার সময়ে, এমনকী, শোনার সময়েও আমরা শুধু বড়দের কথাই বলি, কিংবদন্তিদের গাওয়া নিয়েই যত কথা। কিন্তু যে এমনি এমনি রবীন্দ্রনাথের গান গায়, রবীন্দ্রনাথের ভরসায় মঞ্চে ওঠে না, রয়্যালটি পায় না, বড়জোর ভিক্ষে করে, তাঁর রবীন্দ্রনাথের দিকে তাকানোই হয় না। সেই না চেনা ভাঙাপথের রাঙাধুলোয় তাকিয়ে আছি আজ।
ধুলো উড়িয়ে চলে যাচ্ছে করিমপুরের বাস। অন্তত ১২-১৪ বছর আগের কথা। গান শুনতে চলে যেতাম কখনও পাথরচাপুড়ি, কখনও আরংঘাটা, করিমপুর। সঙ্গে যেত দু'একজন বন্ধু। ভাবতাম আশ্চর্য গানপাগল মানুষদের শুনেই জীবন কেটে যাবে। এমনই এক দুপুরে করিমপুরের কাছে গোরভাঙায় মনসুর ফকিরের ছায়া সুনিবিড় উঠোনে বসে আছি। মনসুর আপনমনে গান গাইছেন। সম্বৎসর মেলামাঠে ঘুরে বেড়ানোর দরুণ সে গান আমার তখন ঠোঁটস্থ। গানের কথা-
নিতাইচাঁদের দরবারে একমন যার সেই যেতে পারে।
— একমন মানে হরিদাস, শত বেত্রাঘাতেও যে অটল। একমন মানে নিত্যানন্দ, যার মাথা মাধাইয়ের কলসির ঘা-এ ফেটে চৌচির, তবু সে বলছে, জগাই-মাধাই, হরিনামে জগৎ উদ্ধার, নাম করো, বেঁচে যাবে। এসব ভাবনায় ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে বেলা বেড়ে গেল। আক্কাশ ফকিরের গানও শুনতে চাই, তার ঘর এই গলিরই শেষ মাথায়, তাই উঠব উঠব করছি। মনসুরের বাবার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে আছি। যাওয়ার মুখে মনসুর বললেন, একটা রবীন্দ্রনাথের গান শুনবে? একটু থমকে গেলাম। কী গাইবেন উনি, হঠাৎ দ্রুত লয়ের কোনও লোকগানের আদলে তৈরি রবীন্দ্রগান গেয়ে কি আমার মনটাকে মেরে দেবেন এই বেলা! দুরাশায় তাঁর দিকে চেয়ে আছি। মনসুর গান ধরলেন।
না চাহিলে যারে পাওয়া যায়, না চাহিলে যারে পাওয়া যায়...
না চাইতেই পাওয়া যায় যাকে, সে কে! গান এগোয়, একটি করে প্রশ্ন সুরের পথে কাঁটার মতো রয়ে যায়। যার উত্তর আমি খুঁজে পাব কখনও, সহসা, আচম্বিতে, সম্পূর্ণ অন্য পরিস্থিতিতে, অথবা খুঁজে পাব না কখনও। যেমন এই প্রশ্নটির উত্তরের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল এমন আকস্মিকের খেলায়। মনসুরের গান শোনার দু'এক বছরের মধ্যেই। পুরুলিয়ার এক অজ-গ্রামে মধ্যরাতে ছৌ নাচ দেখছি। সঙ্গে দু'জন বন্ধু। হঠাৎ কী মনে হল, আমি উঠে গেলাম সেই ছৌ-এর চৌহদ্দি ছেড়ে। কিছুটা দূরে এগিয়ে গেলাম। জায়গাটা থেকে তখনও ছৌ-এর ছোট মাঠটা দেখা যাচ্ছে, বাজনার আওয়াজ ভেসে আসছে। কিন্তু সামনেটায় এত অন্ধকার যে এক হাত দেখা যায় না। হঠাৎই, চোখ গেল আকাশে। মনে হল আকাশের পায়ে লক্ষ ঘুঙুর। মনে হল তা ঝমঝমিয়ে বাজছে। তারাদের উপস্থিতিতে এমন বেকুব অতীতে তো কখনও হইনি। মনে হলো আমার অস্তিত্বকে ঘিরে বেড়াকীর্তন করছে তারারা। তখন, ঠিক তখনই, গান এভাবেই আসে, মনসুরের গলা মনে পড়ল-
না চাহিলে যারে পাওয়া যায়, তেয়াগিলে আসে হাতে,
দিবসে সে ধন হারায়েছি আমি-- পেয়েছি আঁধার রাতে॥
না দেখিবে তারে, পরশিবে না গো, তারি পানে প্রাণ মেলে দিয়ে জাগো--
তারায় তারায় রবে তারি বাণী, কুসুমে ফুটিবে প্রাতে॥
এই আকাশ আমি দেখিনি আগে। দিনের বেলায় এই আকাশ আমার সামনে ধরাও দেয়নি। আমি আজ, এইখানে তার প্রাণে নিজের প্রাণ মিলিয়ে, প্রায় অস্তিত্বহীন হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আমি অন্য কিছু দেখতে পাচ্ছি না। আর কোনও শব্দ কানে আসছে না। শুধু শুনতে পাচ্ছি তারায় তারায় তার বাণী, তার ঘুঙুরের ঝমঝম, এই গান অন্য কেউও শুনতে পাবে, হয়তো, ভোরের আলো ফোটার সময়ে। রবীন্দ্রনাথ নিজেও তো সেই মাহেন্দ্রক্ষণে আকাশের দিকে চেয়ে থেকেছেন, তার-ই বাণী শুনেছেন নিশ্চয়ই। এমন বৃহৎ-এর কাছে এলে, এমন মহতের কাছে এলে, মন মুক্ত হয়ে যায়।
আরও পড়ুন:কাঁদালে তুমি মোরে…
এর কত পরে, হঠাৎ আবিষ্কার করলাম, ৬ মাঘ ১২৯৭- এ লেখা 'ছিন্নপত্রাবলী'র একটি চিঠির অংশ। সেখানে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন-
"ভারতবর্ষের যেমন বাধাহীন পরিষ্কার আকাশ, বহুদূরবিস্তৃত সমতলভূমি আছে, এমন য়ুরোপের কোথাও আছে কিনা সন্দেহ। এইজন্যে আমাদের জাতি যেন বৃহৎ পৃথিবীর সেই অসীম ঔদাস্য আবিষ্কার করতে পেরেছে। এইজন্যে আমাদের পূরবীতে কিংবা টোড়িতে সমস্ত বিশাল জগতের অন্তরের হাহাধ্বনি যেন ব্যক্ত করছে, কারও ঘরের কথা নয়।"
জগতের অন্তরের হাহাধ্বনি। এই শব্দটিই কি ৩২ বছর পরে লেখা একটি গানে তারায় তারায় রয়ে যাওয়া বাণী হলে ফিরে এল! জগতের অন্তরের হাহাধ্বনি, না চাইলেও, তাকে শুনতে না চাইলেও সে ধরা দেবে, সহসা আমার পদতলে মাথা কুটবে একদিন, অথবা আমার সারাৎসার শুষে নিতে এগিয়ে আসবে! বিজ্ঞানের পথেও এক আশ্চর্য ব্যখ্যা নেই কি এর! জগতের অন্তর, একদম প্লাজমা স্তর থেকে একটি নাদ উঠে আসছে, এমন কথাই তো বিজ্ঞান বলে। ২.৯ মেগাহার্টজ থেকে ৪.৫ মেগাহার্টজ সেই নাদের বিস্তার। মানুষের কান যা শুনতে পায়, এই শব্দ তার থেকে প্রায় দশহাজার গুণ দুর্বল। কিন্তু তার মানে এই শব্দ নেই এমন নয়। আছে। আমরা শুনতে পাই না। ১৯৫০-এর দশক থেকে বিজ্ঞানীরা এই বিষয়ে কথা বলতে শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথ জগতের অন্তরের হাহাধ্বনির সন্ধান পেলেন কী করে! ভেবে পাই না।
মনে পড়ে এই গানটির পরের অংশ, মানে,
তারই লাগি যত ফেলেছি অশ্রুজল
— এই জায়গাটি গাইতে গিয়ে আমি মনসুরকে কাঁদতে দেখেছি। কেঁদে কিছুক্ষণ পরে লুঙ্গির খুটে চোখ মুছেছেন। কার জন্য তাঁর অশ্রজল ঝরছে কে জানে! একজন সাধারণ ফকির, একটু নামডাক হয়েছে, শহরে যাচ্ছেন, তিনি নিজের গৃহকোণে, বাবার কবরের পাশে বসে রবীন্দ্রনাথের গান গাইছেন, গাইতে গাইতে কাঁদছেন। এই দৃশ্যটি আমার মন থেকে কখনও যাবে না।
বহু বছর পর, ট্রেনে উঠে বসেছি, শিয়ালদহ নামব, রবিবারের দুপুর, শীতের নরম রোদ পড়ছে গায়ে, এক অন্ধ ভিখিরি, বৃদ্ধা, গায়ে মলিন শাড়ি, হাতে একটা লাঠি। খালি গলায় গাইতে গাইতে এগিয়ে এলেন আমার কম্পার্টমেন্টে। তাঁকে গাইতে শুনলাম,
আমার মুক্তি আলোয় আলোয়, এই আকাশে।
তিনিও জানেন আজ রবিবার। অন্য দিনের মতো ভিক্ষে পাওয়া যাবে না। কিছুটা যেন আলগোছে, নিজের জন্যে, অভ্যেসবশেই গাইছেন তিনি। আমি তাঁর গানের দিকে কান পেতে বসে আছি। কোন আকাশের কথা বলছেন? যে জন্মান্ধ সে তো আকাশই দেখেনি। তার মুক্তি কোন আকাশে? এই আকাশে, এই মানে কী, যার মধ্যে আছি, কীসের মধ্যে আছেন তিনি? গানের মধ্যে। এই গান তাঁকে ভাত দেয়, যারা গান শোনে দু'চার টাকা দেয়, তাই নিয়ে তিনি বাড়ি ফিরে যান। আজ রবিবার, অত লোক নেই, মানে টাকাও জুটবে না তেমন। তবু তিনি গাইছেন, কেন গাইছেন, গানের আকাশ তাকে মুক্তি দেয় বলেই গাইছেন! গানের আকাশে উড়াল দিতে দিতে একটা সময় দেহ মন ছাড়িয়ে তাঁর আমিটা মহাশূন্যে বেড়িয়ে যাচ্ছে। তখন মুক্তি। আমরা সবাই, যারা রবীন্দ্রনাথের গান শুনি, তারা জানি, শুনতে শুনতে শুনতে একসময় ঊর্ধ্বে চলে যায় মন। গানের কথায় সুরে, এই দেহ মনের খাঁচা থেকে পাখিটাকে ছুটি দেওয়ার নামই তো মুক্তি! ওই অন্ধ ভিখারিনী যখন খানিকটা মুখ তুলে গাইছেন,
দেহ মনের সুদূর পারে হারিয়ে ফেলি আপনারে, গানের সুরে, আমার মুক্তি ঊর্ধ্বে ভাসে
আমি শুনছি। শুনতে শুনতে আমার মন শরীর কিছুই আর ওই ট্রেন কম্পার্টমেন্টে থাকছে না। ছিটকে বেরিয়ে মহাশূন্যের দিকে চলে যাচ্ছে। সেদিন থেকে আমার মনে মুক্তির ছবি ওটাই।
আজ শেষ করব একটা অন্য গানের কথা দিয়ে। কিছুদিন আগে পুরী গিয়েছি, একটা গোটা দিন চৈতন্য গম্ভীরা, হরিদাসের সমাধিতে ঘুরে বেরিয়েছি। গম্ভীরা মানে সামান্য একটা ঘর, যার একটিই দরজা, একটি নীচু জানলা। আলোবাতাস প্রায় আসে না। চৈতন্য জীবনের শেষ দিনগুলি কীভাবে এখানে কাটালেন, এই ভাবনায় বিভোর হয়ে থেকেছে আমার মন। তারপর ফিরে এসেছি, কাজেকর্মে সেই স্মৃতি কিছুটা যেন চাপাও পড়ে গিয়েছে। রাতে রবীন্দ্রনাথের গান শোনায় বোন। আমি আবদার করি, বোন আবদার রাখে। এই সেদিন শুনতে চাইলাম, 'আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যকুল' গানটা। মায়ার খেলা-র গান। সে গাইল নিজের মতো করে।
আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল, শুধাইল না কেহ।
সে তো এল না যারে সঁপিলাম এই প্রাণ মন দেহ॥
সে কি মোর তরে পথ চাহে, সে কি বিরহগীত গাহে
যার বাঁশরিধ্বনি শুনিয়ে আমি ত্যাজিলাম গেহ॥
গানটা শুনতে শুনতে আমার চোখে স্পষ্ট হয়ে উঠল সেই গম্ভীরা। দেখতে পেলাম এক অশ্রুজলসিক্ত দীর্ঘকায় বাঙালি পুরুষ একটি অতি ছোট আলোবাতাসহীন ঘরে শুয়ে আছে। চিরবিরহী মানুষ, ঘর ছেড়েছেন প্রেমের তরে, সবাইকে কাঁদিয়ে এসেছেন দূরে, অনেক দূরে, কিন্তু যার বাঁশী শুনে এসেছেন, সে কী এল, সে তো এলো না, শুধু রয়ে গেল অনন্ত অপেক্ষা, হা কৃষ্ণ, আক্ষেপ। প্রাণ মন সঁপেছিলেন সেই কবেই। ছিল দেহটা। ক্রমে দেহতরীও তিনি ভাসিয়ে দিলেন অনন্তসমুদ্রে? মুক্তির দিকে?
আরও পড়ুন: শোকের বিগ্রহ
দেবব্রত বিশ্বাস আমার ঈশ্বর। গীতা ঘটকের গলায় এই বিশেষ গানটি কতবার শুনেছি। তবু, অখ্যাতজন, যে বা যারা রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে কোনো গন্তব্যেই যাবে না, তাদের গলায় রবীন্দ্রনাথের গান শুনে, আমার মন মনসুরের মতো, ওই অন্ধ ভিখারিনীর মতো, অথবা আমার বোনের মতোই মুক্তির দিকে, ক্রমে ঊর্ধ্বে চলে যাক, জীবন থেকে এর বেশি আর কী চাইব!