ধর্ম যেন রাষ্ট্রের বেঁধে দেওয়া সেই ছুরিটি

Religion Fanatics of India: এই ধর্মরাষ্ট্র গড়ে তোলার সার্বিক ইচ্ছাটুকুর মধ্যেই প্রকট ভাবে লুকিয়ে রয়েছে স্বৈরাচারের বিষবাষ্প। যা সংঘ্যালঘুকে কোণঠাসা করতে শেখায়, দুর্বলকে পিষে দিতে শেখায় পায়ের নীচে।

ধর্ম। এই ধর্ম শব্দের উৎপত্তি আসলে 'ধৃ' ধাতু থেকে। যার অর্থ ধারণ করা। অর্থাৎ মানুষ তার জীবনে যত প্রকার বৈশিষ্ট্য ধারণ করে, সবই ধর্ম। না, শুধুমাত্র ঈশ্বরবিশ্বাস কিন্তু তার মধ্যে পড়ে না। একজন মানুষের শিক্ষা, পরম্পরা, আচার-বিচার, বিশ্বাস— সেই সমস্ত কিছুই তাঁর ধর্ম। কিন্তু ক্রমশ ধর্মের সেই বৃহত্তর অর্থ ছোট হতে হতে ঢুকে পড়ল ঈশ্বরচেতনার ছোট্ট বাক্সে। এবার পালা সেই চেতনার ছোট হওয়ার। ক্রমশ ঈশ্বরকে ভেঙে ভেঙে যে যার পছন্দমত আকারে, যে যার সুবিধামতো খাপে ঢুকিয়ে নেওয়ার পর্ব শুরু হল। অণু, পরমাণুর মতো ভেঙে ভেঙে জন্ম হল বহুশ্বরবাদের। ঈশ্বর ভাঙলেন, ধর্ম ভাঙল। যে যার মতো ধর্মাচারণকে বেছে নিল। তেত্রিশ কোটি দেবদেবী, অযুত নিযুত বিশ্বাস এবং সেই বিশ্বাস পালনের ঘনঘটাই ভারতবর্ষে মিলনের মধ্যে মহান হয়ে জেগে ছিল এতবছর।

১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি তারিখে যে সংবিধান কার্যকর হল স্বাধীন ভারতে, সেখানে ভারতকে বর্ণনা করা হল সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে। ধর্মনিরপেক্ষতার মানে কিন্তু ধর্মহীনতা নয়। বরং এমন এক দেশ, যেখানে মানুষ নিজের ইচ্ছামতো ধর্ম পালন, ধর্মাচারণের সুযোগ পান। এতদিন তা-ই পেয়েছেন অন্তত। যে কোনও ধর্মের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা দেশের সঙ্গে সেটাই মৌলিক তফাৎ ছিল ভারতের মতো দেশের। এখানে আরিফের পাশে বসে বর্ণপরিচয় পড়েছে অনির্বাণ, এ দেশে সলমার সঙ্গে হাত ধরে ঠাকুর দেখতে গিয়েছ সংযুক্তা। বড়দিনে জোসেফের সঙ্গে শান্তনুরা বো-ব্যারাকে গিয়েছে বড়দিন পালন করতে। শুধু হিন্দু-মুসলিম আর খ্রিস্টানই নয়। বরাবর এ দেশে বহু ধর্ম, বহু বিশ্বাসের মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে থেকেছেন। হ্যাঁ, অশান্তি কি হয়নি! হিংসা, দাঙ্গা অনেক কিছুই দেখেছে এ দেশের মানুষ। তার পরেও কোনও বিশেষ ধর্মের দেশ হিসেবে ভারতবর্ষকে ভাবার চেষ্টা হয়নি কখনও।

কিন্তু সেই বিশ্বাস হালে টলেছে। ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র বানানোর চেষ্টা চলেছে পুরোদমে। আর সেই চেষ্টায় সাফল্যের মাইলফলক হিসেবে দেখা হয়েছে অযোধ্যায় গড়ে তোলা রামমন্দিরকে। সেই রামমন্দিরের উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে গোটা দেশ সেজেছে। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং দেশবাসীকে অনুরোধ করেছেন অকাল দীপাবলি পালনের জন্য। সারা দেশ জুড়ে জ্বালানো হয়েছে প্রদীপ। সেই মন্দিরে রামলালার প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর হাতে। সেই অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন দেশের সমস্ত তাবড় ব্যক্তিত্বরা। যে যেমন ভাবে পেরেছেন, সেই মহোৎসবের সমুদ্রে বিন্দু বিন্দু জল ঢালার চেষ্টা করেছেন। রামমন্দিরের উদ্বোধন যেন জাতীয় অনুষ্ঠান কোনও! কিন্তু ভারত তো শুধুমাত্র হিন্দুরাষ্ট্র ছিল না কোনও কালেই। ইসলামপন্থী দেশগুলির মতো সেই কট্টর হাওয়া কোনওদিনই বয়ে যায়নি এ দেশের নদনদীর উপর দিয়ে। এত এত বিদেশি শক্তি বারবার এ দেশে এসেছে। তাদের কেউ এসেছে থাকতে, কেউ এসেছিল শাসন এবং শোষণটুকু করে ভারতের সম্পদটুকু নিয়ে নিজের দেশকে সম্পদময় করতে। সেই সমস্ত বিদেশি শক্তির সংস্কৃতি, বিশ্বাস, ধর্মের টুকরো টুকরো অংশ এসে মিশেছিল ভারতের মূলে। এ দেশ ফেরায়নি কোনও কিছুকেই। ভালোকেও সে নিয়েছে। গ্রহণ করেছে মন্দকেও।

আরও পড়ুন: রামমন্দির: গণতন্ত্রের কবরে ধর্মতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা

পাথরে পাথর ঠুকে যেদিন আগুন জ্বালাতে শিখেছিল মানুষ, সেদিনও তার ধর্ম ছিল। না, সেই ধর্ম হিন্দু, মুসলিম, শিখ, বৌদ্ধ কিংবা খ্রিস্টান নয়। বেঁচে থাকার প্রয়োজনে যে জীবনবৃত্তিকে আয়ত্ত করতে শিখল সে, তা-ই হয়ে উঠেছিল তার ধর্ম। তারপর গোষ্ঠীর প্রয়োজনে ক্রমশ তৈরি হল আলাদা আলাদা অনুশাসন। সেই বুঝি মানুষের প্রথম ক্ষুদ্র হয়ে বাঁচার শুরু। ক্রমে বৃহত্তর মানবধর্ম ভাঙতে শুরু করল আরও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ধর্ম, ক্ষুদ্র গোষ্ঠীতে। ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ হলে হিন্দুরাষ্ট্র, ইসলামরাষ্ট্র, খ্রিস্টানরাষ্ট্র তৈরি হবে হয়তো। যেমনটা কোনও কোনও দেশে হয়েওছে। কিন্তু তারপর সেই হিন্দুরাষ্ট্রও কি স্বয়ংসম্পূর্ণ হিন্দুরাষ্ট্র হয়ে থাকবে কোনওদিন, নাকি তা ভেঙে যেতে থাকবে আরও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠী, বিশ্বাসে। আর তারপর আরও খণ্ড হবে দেশ, ক্রমশ আরও ক্ষুদ্র। সেই ছবিটার কথা মনে করলে শিউরে উঠতে হয় বইকি। যাঁরা সাতপাঁচ না ভেবে এই ক্ষুদ্র থেকে অতিক্ষুদ্র দেশ, ভূখণ্ডের কথা কল্পনা করেন, মনে মনে প্রার্থনা করেন, তাঁদের কি ধর্মোন্মাদ বলবেন? বলবেন ধর্মান্ধ?

কার্ল মাক্স মনে করতেন, ধর্ম একটা আফিমের মতো। সেই আফিমের নেশা এত বছর ধরে ভালোই টের পেয়েছে মানুষ। বছর দশেকের মেয়েকে মৃত বৃদ্ধের চিতায় জ্বালিয়ে দেওয়ার জন্য তাই আফিমই লেগেছে। সেই আফিম যেমন আক্ষরিক, তেমনই প্রতীকীও। ধর্মের নামে, বিশ্বাসের নাম রক্ত ঝরানোর পরম্পরা তো কমবেশি সব ধর্মেই দেখা যায়। কখনও তা পরের, কখনও তা নিজেরও। 'বলি' থেকে শুরু করে 'কুরবানি', চড়কের মেলায় শরীরে বাণ ফোঁড়ানো কিংবা ঝাঁপ থেকে শুরু করে মহরমের মিছিলে নিজের শরীরকে রক্তাক্ত করার নজির কি আমরা বছরের পর বছর ধরে দেখিনি! কেরলের মেভেলিক্কারার ছেত্তিকুলাঙ্গারা একটি মন্দিরে 'চুরাল মুরিয়াল' নামে একটি বিশেষ প্রথা পালনের রীতি রয়েছে। যেখানে মন্দিরে আরাধ্য বিগ্রহ ভদ্রকালীকে শিশুর রক্ত আহুতি দেওয়া হয়। দশ বছরের কম বয়সী শিশুর গায়ে ফোঁটানো হয় অসংখ্য সোনার সূচ। সেই রক্তে দেবীর আরাধনা করা হয়। এই অমানবিক প্রথা চালু রাখতে শিশু কেনাবেচার মতো গুরুতর অপরাধ চলে কেরলে। দরিদ্র পরিবারের নাবালক ছেলেগুলিকে কিনে নেন অর্থবানেরা। এই প্রথাপালনে নাকি দেবীর আশীর্বাদ পাওয়া যায় বলে স্থানীয় বিশ্বাস। নিজের সন্তানের মঙ্গলকামনায় নৃশংস ভাবে বিদীর্ণ করে ফেলা হয় অন্য একটি শিশুকে। এদেরও যদি ধর্মোন্মাদ না বলেন, তাহলে কাকে বলবেন! আদালতের হাজারও নির্দেশেও যাদের টলানো যায় না।

Radical Hinduism and increasing religion fanatics in India by Sohini Das Robibarer Royak

এমন ধর্ম-আফিমের মাদকতা ছড়িয়ে রয়েছে গোটা ভারত জুড়েই। অন্ধ্রপ্রদেশের কুর্নুলের দেবরাগাট্টু মন্দিরে দশেরার রাতে ভক্তেরা সারারাত ধরে একে অপরকে লাঠি দিয়ে আঘাত করেন। খেলার নিয়ম একটাই, যতক্ষণ না মরে যাচ্ছো কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বীকে মেরে ফেলছো, ততক্ষণ এই খেলা চলবে। আগে এই খেলায় ব্যবহার করা হত কুড়ুল এবং বর্শার মতো ধারালো অস্ত্র। তবে ইদানীং কালে সেই অস্ত্র বদলে এসেছে লাঠি। হাজার হাজার স্থানীয় মানুষ এই লাঠির লড়াই করতে করতে মন্দিরের দিকে এগিয়ে যান। তাঁরা রক্তাক্ত হন, জখম হন। আর সেই বিজয় শোভাযাত্রা শেষ হয় দেবীকে রক্তাঞ্জলি দিয়ে। তামিলনাড়ুতে আবার 'অডবল' নামে একটি উৎসব খুব বিখ্যাত। যেখানে ভক্তেরা নিজেদের শরীর-ত্বক হুক-কাঁটা দিয়ে বিঁধিয়ে, সেই দিয়ে ট্র্যাক্টরের মতো ভারী জিনিস টেনে নিয়ে যান। কখনও আবার গলা কিংবা জিভ বিঁধিয়ে নেন ধারালো জিনিস দিয়ে। ঢাকের প্রবল গর্জনে ঢেকে যায় তাদের আর্তনাদ, যন্ত্রণায় কঁকিয়ে ওঠা। স্থানীয়দের বিশ্বাস, দেবতারা তুষ্ট হন তাতে।

যে ধর্মের অন্ধমোহ অনর্গল নিজেকে কষ্ট দেওয়া রপ্ত করতে শেখায়, সেই অন্ধ ধর্মবোধ যে সময় বুঝে অন্যের গলাতেও তরোয়াল বাগিয়ে ধরবে না, তা নিয়ে সংশয়মুক্ত হওয়া যায় কি! ক্রমাগত নিজের যা কিছু, তাকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করার যে তাগিদ, তা-ই আসলে বছরের পর বছর ধরে ঠেলে দিয়েছে অন্যপক্ষকে কোণঠাসা করার দিকে। যা কিছু আমার নয়, তাকে ছিনিয়ে নেওয়ার মধ্যে যে ক্ষত্রিয়বোধের জয়োল্লাস রয়েছে, তারই ফলাফল বোধহয় বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেওয়া কিংবা জ্ঞানবাপী মসজিদে শিবলিঙ্গের খোঁজ। ১২০৪ সালে তৎকালীন গৌড়বঙ্গ আক্রমণ করেছিল তুর্কিরা। বাংলার সমস্ত সাংস্কৃতিক শিকড় যারপরনাই নষ্ট করে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। নষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল বহু পুঁথি, সাহিত্যিক নিদর্শন। দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন অসংখ্য অভিজাত পণ্ডিত। ভাঙচুর করা হয়েছিল বহু মঠ-মন্দির-বৌদ্ধবিহার। তুর্কিদের সেই ধ্বংসলীলার সঙ্গে বাবরি ধ্বংসের সেই ভয়ঙ্কর দিনের তুলনা করা যায় না কি! না, তবে পার্থক্য একটাই। ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে ঘটা সেই ভয়ঙ্কর ধ্বংসাত্মক ঘটনা ঘটানোর জন্য কোনও বৈদেশিক শক্তির প্রয়োজন পড়েনি। বরং ধর্মনিরপেক্ষ, সার্বভৌম একটি দেশের মধ্যে থেকেই জেগে উঠেছিল এমন একটি সাম্প্রদায়িক শক্তি, যা অবলীলায় গুঁড়িয়ে দিয়েছিল মোঘল আমলের এক স্থাপত্য। দেশ জুড়ে জ্বালিয়ে দিয়েছিল আগুন। যার বলি হয়েছিলেন দেশের হাজার হাজার মানুষ। ভারতের ইতিহাসে এক অন্ধকারময় দিন ১৯৯২ সালের সেই ৬ ডিসেম্বর। তার প্রায় তিরিশটি বছর পর সেই মাটিতেই গড়ে উঠল রামমন্দির। উগ্র হিন্দুত্ববাদ, অসাম্প্রদায়িক ভারতের একটি মাইলফলক গড়ে দেওয়া হল যেন। দিন কয়েক আগেই যার উদ্বোধন হয়ে গেল মহা আড়ম্বরের মধ্যে দিয়ে।

Radical Hinduism and increasing religion fanatics in India by Sohini Das Robibarer Royak

২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর শীর্ষ আদালতের রায় গেল মন্দিরের পক্ষে। এমনকী ওই বছরেরই অগস্ট মাসে মন্দিরের শিল্যান্যাসও হয়ে গেল মহাধূমধামে। কিন্তু তার শুরুটা কিন্তু হয়ে গিয়েছে বহু আগেই। অনেকেই বলেন অটলবিহারীর বিজেপি জমানার সঙ্গে মোদি জমানার পার্থক্য প্রভূত। এমনকী উগ্র হিন্দুত্ববাদের ক্ষেত্রেও। অথচ তাঁর সময়েই গুঁড়িয়ে গিয়েছিল বাবরি মসজিদখানি। আর সেই জায়গাতেই মোদিজমানায় গড়ে উঠল সুবিশাল মন্দির। অর্থাৎ যে ব্যাটনখানি একদিন পরবর্তী প্রজন্মের হাতে তুলে দিয়েছিলেন অটল-আডবাণীরা, সেই লক্ষ্যপূরণ করতে শুধু সফলই হননি মোদি-শাহরা, দক্ষতার সঙ্গে ফিনিশিং লাইনের দড়িটিও ছুঁয়ে ফেলেছেন তাঁরা। বিগত বছর দশেক ধরেই আমরা জায়গায় জায়গায় হনুমান মন্দিরের রমরমা দেখেছি, রামনবমী পালনের ঘটা দেখেছি। যা আমাদের সংস্কৃতিতে ছিল না কোনওদিন, তাকেও উৎসবের আমেজে শামিল করে নিয়েছি আমরা। অবশ্য এমনটাই হয়ে এসেছে বছরের পর বছর ধরে। তবে তার মধ্যে এমন উগ্রতার রং মেশেনি কোনওদিন। যে রামকে নিয়ে দেশ জুড়ে এত মাতামাতি, তার সঙ্গে বাঙালির রামের আদল মেলেনি কোনওদিনই। বাঙালির রাম বরাবরই প্রেমিকপুরুষ, পরিবারের আদর্শ ছেলেটি। প্রজাপালনে যা কিছু প্রাণাধিপ্রিয়, তাকেও সে ছাড়তে পেরেছে অবহেলে। কিন্তু বাঙালির সেই প্রিয় রামের আদলটি বদলে গেল উগ্র হিন্দুত্ববাদের পাল্লায় পড়ে। যে রামায়ণ বাঙালির বড় কাছের, আদরের ছিল বরাবর, তাকে যেন বড় দূরের করে দিল এই সাম্প্রতিক এই উগ্র রামভক্তিবাদ।

Radical Hinduism and increasing religion fanatics in India by Sohini Das Robibarer Royak

'ভারত হিন্দুরাষ্ট্র হবে'। তার শুরুয়াত যেন এই রামমন্দির। আর এই ভাবনা ভারতের মতো 'নানা ভাষা নানা মত'-এর দেশে বড়ই ক্ষতিকর। দেশের একটা বড় গোষ্ঠী এই হিন্দুরাষ্ট্রের আফিমে মজে। নাহলে ভারতের চন্দ্রাভিযান সফল হওয়ার পরে অল ইন্ডিয়া হিন্দু মহাসভার জাতীয় সভাপতি দাবি করে বসেন, চাঁদকেই এবার হিন্দুরাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা হোক। হবে না-ই বা কেন! চাঁদের যে অংশে নামল চন্দ্রযান ৩-র ল্যান্ডার, সেই জায়গাটির নাম প্রধানমন্ত্রী দিয়ে বসলেন 'শিবশক্তি পয়েন্ট'। দেশের একাধিক ইসলামিক গন্ধযুক্ত জায়গার নাম পাল্টে ফেলা হচ্ছে ঝড়ের বেগে। ইলাহাবাদ হয়ে গেল প্রয়াগরাজ, আলিগড়ের নাম রাখা হল হরিগড়। জ্ঞানবাপী মসজিদ থেকে শুরু করে তাজমহল, প্রশ্নের মুখে একাধিক ইসলামিক স্থাপত্য। হিন্দুত্বের আফিম হাতে দিয়ে ভোট গোছাচ্ছে দেশের শাসক দল। মানুষ খাচ্ছেও। সোশ্যাল মিডিয়া ভেসে যাচ্ছে উগ্র হিন্দুত্ববাদী পোস্ট, ছবিতে। ক্রমশ কোণঠাসা হচ্ছে দেশের সংখ্যালঘুরা। অথচ যে রাজ্যের ভোটবাক্সে সংখ্যালঘুদের হাজিরা প্রয়োজন, সে রাজ্যের সেই কেন্দ্রে কিন্তু বুদ্ধি করে সংখ্যালঘু তাস খেলতে ভুলছে না মোদি সরকার। আর রাজনীতির খেলার মজাটা বোধহয় সেখানেই। এ দেশের বহু প্রান্তেই এখনও জাতিভেদ, বর্ণভেদ বড় সমস্যা। দলিত নিগ্রহ থেকে শুরু করে পিছিয়ে পড়া শ্রেণির মানুষদের দুর্দশার কথা কারওর অজানিত নয়। খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। বিরুদ্ধস্বর দেখলেই বলে বসা হত 'পাকিস্তানে যাও'। ধর্মের আফিমটুকু হাতে বাতাসার মতো গুঁজে দিয়ে ক্রমশ বিরুদ্ধস্বর মাত্রেই সংখ্যালঘু করে তোলার যে ট্রেন্ড চালু হয়েছে আজকের ভারতে, তা বড়ই বিপজ্জনক। আর সেই বিপজ্জনক ট্রেন্ডকেই এনআরসি, সিএএ - এনে সিলমোহর দিতে চান মোদি-শাহরা। সে যেন এই হিন্দুরাষ্ট্র স্থাপনেরই আরও একটি পদক্ষেপ। খুব ভালো করে দেখলেই বুঝতে পারবেন, এই ধর্মরাষ্ট্র গড়ে তোলার সার্বিক ইচ্ছাটুকুর মধ্যেই প্রকট ভাবে লুকিয়ে রয়েছে স্বৈরাচারের বিষবাষ্প। যা সংঘ্যালঘুকে কোণঠাসা করতে শেখায়, দুর্বলকে পিষে দিতে শেখায় পায়ের নীচে। যা রাষ্ট্রের ক্ষত্রিয়বোধের গায়ে বুলিয়ে দেয় এক অমোঘ আত্মশ্লাঘার পালক। যে শ্লাঘার জোরে গাজাকে নিমেষে মৃত্যুপুরী বানিয়ে দিতে দু'বার ভাবে না ইজরায়েল। যে অহংকারের বোধ আসলে যে কোনও শাসককে সর্বশক্তিমান ভাবতে শেখায়। যার জোরে একদিন হাজার হাজার ইহুদি বন্দিকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পুরে দিতে দ্বিধা করেনি জার্মান স্বৈরাচারী।

আরও পড়ুন:রাম ভগবান না কি ইতিহাসপুরুষ? যে প্রশ্ন গুলিয়ে দিচ্ছে রামমন্দির

আসলে ধর্মও একধরনের ক্ষমতার চাবি। ফ্যাসিবাদের হাতিয়ার, এমনকী আধুনিক যুদ্ধের নয়া অস্ত্র বললেও তাকে ভুল হবে না খুব একটা। কোনও রকম শক্তিপ্রয়োগ না করেই যাকে চাড়িয়ে দিতে হয় নাগরিকদের মধ্যে। আফিম তার কাজ শুরু করবেই। সময়মতোই 'ধর্মরাষ্ট্র' প্রতিষ্ঠা হবে। দেশে ' অচ্ছে দিন' আসবে। আর যেটা আসবেই, সেটা ভোট। বাংলার বহু এলাকাতেই এখনও 'মোরগ লড়াই' নামে এক খেলার চল রয়েছে। যেখানে মোরগদের খাবারদাবার খাইয়ে প্রস্তুত করানো হয় যুদ্ধের জন্য। সেই লড়াই দেখতে উপচে পড়ে মানুষের ভিড়। মানুষ বাজি ধরেন মোরগের উপর। মোরগ আপন স্বভাবে লড়াই করে। নখর চালায় প্রতিদ্বন্দ্বীর বুকে। কিন্তু সেই নখরের কতই বা জোর। কিন্তু এখানেই আসল খেলাটি খেলেন মোরগ-মালিকেরা। তাঁরা অতি সন্তর্পণে যুদ্ধবাজ মোরগের পায়ে লাগিয়ে দেন একটি করে ধারালো ছুরি। মোরগ জানে না, তার পায়ে বাঁধা রয়েছে বিশ্বের ধারালোতম অস্ত্রখানি, যা চিরে দেবে প্রতিদ্বন্দ্বী মোরগটির শরীর, বাইরে বের করে আনবে নাড়িভুড়ি। সে কিন্তু নখের আঘাতখানি বুরবাকের মতোই করে চলে উল্টোদিকের মোরগটির বুকে। ধর্ম যেন রাষ্ট্রের বেঁধে দেওয়া ওই ছুরিটি। ধর্মোন্মাদ জানেই না, কখন সে ধর্মের মোহে কেটে খণ্ড করে ফেলেছে দেশ, ভূখণ্ডখানি। ভুলে যায়, আসলে ধর্মনিরপেক্ষতা মানে নিজের ধর্ম পালনের স্বাধীনতা। আর সেই স্বাধীনতায় রাষ্ট্রের যে কোনও রকমের লাল চোখই অস্বস্তিকর।

তবে যে কোনও বিশ্বাসেরই তো একটা উল্টোপিঠ থাকে। তৈরি হতে থাকে বিরুদ্ধস্বর। আর যে কোনও গণতান্ত্রিক দেশে সেই বিরুদ্ধস্বর থাকাটা ভীষণ রকম জরুরি বলেই মনে করা হয়। এই যে চারদিকে উগ্র হিন্দুত্ববাদের বিপুল হাওয়া, অবধারিত ভাবেই তৈরি হয়েছে তারও একটা বিরুদ্ধমত। এবং সে বড় আশার কথাও বটে। কিন্তু সমস্যাটা বাঁধে তখনই, যখন সেই বিরুদ্ধস্বরও উগ্রতার পোশাক পরে ফেলে গায়ে। ক্রমশ উগ্র হিন্দুত্ববাদের 'অ্যান্টিডোট' হিসেবে তৈরি হচ্ছে না তো এক ধরনের উগ্রবাদ, যা আসলে জন্ম দিচ্ছে আরেক ধরনের ধর্মোন্মাদদের! যারা পক্ষ বেছে নেওয়ার জন্য যে এতটাই উদগ্রীব, যে তাতে শেষ হয়ে যাচ্ছে মানবতার মৌলিক ধর্মটিই। ধর্মের 'ধর্ম' ধারক হওয়াই। যে কোনও দেশে, যে কোনও রাষ্ট্রে তা চালকের আসনে বসে পড়লে সেটা যে কতটা বিপজ্জনক হতে পারে, তার প্রমাণ বোধহয় আফগানিস্তান, ইরানের মতো বহু দেশই। ভারতের পক্ষে সেই দৃশ্যটা খুব সুখকর হবে কি আদৌ?

More Articles