নাদালের যাত্রাপথ এখন টেনিস ছাড়িয়ে জীবনযুদ্ধের অনুপ্রেরণা

'অবিশ্বাস্য', 'অপ্রতিরোধ্য', 'অতিমানবীয়', নাকি 'দ্য কামব্যাক ম্যান'। সম্ভবত সব ক'টি শব্দ সমান ভাবে প্রযোজ্য সদ্য অস্ট্রেলিয় ওপেন চ্যাম্পিয়ন রাফায়েল নাদালের নামের সঙ্গে। কিন্তু ২১তম গ্র্যান্ড স্ল্যাম জয়ের পর 'দ্য কামব্যাক ম্যান' ট্যাগ নাদালের নামের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে।

পেশাদারি টেনিস সার্কিটে  ৩৫ বছর বয়সটা অনেক বেশি। তারপরও স্পোর্টস সাইন্স, স্পোর্টস মেডিসিনের পাশাপাশি ফিটনেস ধরে রাখার যা সব উপায় এখন রয়েছে তাতে ওই বয়সে  দু' একটা গ্র্যান্ডস্লাম কেউ পেলে, তার মধ্যে আশ্চর্য হওয়া কিছু নেই। আমাদের ঘরের ছেলে লিয়েন্ডার তো ৪০ বছর বয়স পেরিয়েও দাপিয়ে বেড়িয়েছেন পেশাদার টেনিস সার্কিটে। তাই বয়স এখন শুধুই একটি সংখ্যা মাত্র। 

তাহলে নাদালের ২১তম গ্র্যান্ড স্ল্যাম জয়ের মধ্যে বিশেষত্বটা কোথায়? সেটা জানতে হলে ফিরে যেতে হবে ছ'মাস আগে। চোটের কারণে নাদালের তখন নিজের পায়ে ভর দিয়ে হাঁটার ক্ষমতাও ছিলনা। গত মরশুমে ছ'মাস চোটের কারণে কোর্টে নামতে পারেননি।  তারপর আক্রান্ত হয়েছিলেন মারণ ভাইরাস করোনায়। নাদাল নিজের মুখেই বলেছেন, ১০ মিনিট টানা অনুশীলন করার মত শারীরিক অবস্থা তখন তাঁর ছিল না। তখনকার নাদালকে দেখে কেউ ভাবতেও পারেননি বছরের প্রথম গ্র্যান্ডস্লাম অস্ট্রেলিয় ওপেনে তিনি কোর্টে নামতে পারবেন।

আরও পড়ুন-বাড়ি থেকে এয়ারপোর্ট যান জেটে চড়ে, জেনে নিন গৌতম আদানির সম্পত্তির পরিমাণ

কিন্তু নাদাল শুধু নামলেনই না, কোর্ট ছাড়লেন চ্যাম্পিয়ন হয়ে। পুরুষদের মধ্যে সর্বাধিক একুশটি গ্র্যান্ড স্লাম জিতে তৈরি করলেন অবিশ্বাস্য এক নজির। আর ফাইনালে তিনি ছাপিয়ে গেলেন নিজেকেও। ফাইনালের প্রতিপক্ষ দানিল মেদভেদেভের তার চেয়ে বয়সে দশ বছরের ছোট। প্রথম দু'সেটে পিছিয়ে পড়ে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা ধরে লড়াই করে ছিনিয়ে নিলেন অস্ট্রেলিয় ওপেন। এই সাড়ে পাঁচ ঘন্টায় নাদাল মেরেছেন তাঁর জীবনের সেরা কিছু ব্যাকহ্যান্ড এবং ফোরহ্যান্ড। সার্বিক ভাবে নাদাল ছাপিয়ে গেছে নিজেকে। শুধুমাত্র শারীরিক ভাবে নয় মানসিক ভাবেও প্রচন্ড শক্তিশালী না হলে এই অবিশ্বাস্য লড়াই করা যায় না, যা রবিবার মেলবোর্নে করে দেখালেন রাফায়েল নাদাল।

পাশাপাশি নাদালের ২১তম গ্র্যান্ডস্ল্যাম জয় তাঁকে শুধুমাত্র সংখ্যায় শীর্ষে পৌঁছে দিল না। তিনি তৈরি করলেন অন্য আরও একটি নজির। নাদালের সমসাময়িক দুই প্রতিপক্ষের দিকে তাকালে বোঝা যাবে কেন ১৩ বছর পর নাদালের দ্বিতীয় অস্ট্রেলিয় ওপেন চ্যাম্পিয়ান হওয়ার গুরুত্ব আলাদা। 

টেনিস দুনিয়ায় রজার ফেডেরার আর নোভাক জোকোভিচ হলেন রাফায়েল নাদালের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী। এই দুই টেনিস তারকা প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে কতটা উচ্চমানের তা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। বিশেষজ্ঞরা এই তিনজনের মধ্যে নাদালকে কিছুটা হলেও পিছিয়ে রাখেন। কিন্তু তাদের সঙ্গে লড়াই করে নাদাল এতদিন পর্যন্ত কুড়িটা গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতে রজার ফেডেরার এবং নোভাক জোকোভিচের সঙ্গে একই বেঞ্চে বসে ছিলেন। এবার তাদেরকেও পিছনে ফেলে দিলেন নাদাল। পুরুষদের টেনিসের শ্রেষ্ঠত্বের সিংহাসনে বসার পর নাদালকে অভিনন্দন জানাতে কার্পণ্য করেননি তাঁর দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীও। কুর্নিশ জানিয়েছেন নাদালের অবিশ্বাস্য লড়াইকে।

তবে সমালোচনাও আছে। নাদালের ২১ টি গ্র্যান্ড স্লামের মধ্যে ১৩ টি জিতেছেন ফরাসি ওপেন, যা নিয়ে টেনিস বোদ্ধারা তাকে কটাক্ষ করতে ছাড়েন না। নাদালকে তারা বলে থাকেন, শুধুমাত্র ক্লে কোর্টের রাজা। কিন্তু প্রতিভার মূল্যাঙ্কনের সময়ে সেই হিসাবে দেখলে জোকোভিচকেও সমালোচনার সামনে পড়তে হবে। কারণ, এই মুহূর্তে টেনিস বিশ্বের এক নম্বর প্লেয়ার জোকোভিচ ন'বার অস্ট্রেলিয় ওপেন আর তিনবার যুক্তরাষ্ট্র ওপেনে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। এই দুই প্রতিযোগিতা হয়ে থাকে হার্ড কোর্টে। ফলে নাদালের বিরুদ্ধে এই যুক্তি খাটে না। 

বরং ৩৫ বছর বয়স মাথায় টাক পড়তে শুরু করা নাদাল যে অবিশ্বাস্য সাফল্যকে ছিনিয়ে নিয়েছেন সেটা নিয়ে কথা বলা ভালো। সবকিছু বিচার করলে রাফায়েল নাদাল সম্পর্কে বলতে হয় তিনি একজন সত্যিকারের চ্যাম্পিয়ন। শুধুমাত্র টেনিস বিশ্বে নয় ব্যক্তিজীবনেও নাদালের লড়াই বহু বহু মানুষের অনুপ্রেরণা।

More Articles