র্যাগিং চলছে, চলবে...
Ragging in Educational institutions: খবর আসে। ছেলের মাথা কামিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাবা ভোরের ট্রেনে করে ছেলের কাছে আসে। খবর আসে। ছেলেকে ল্যাংটো করে ঘোরানো হয়েছে। ছেলে মরে গেছে। মা-বাবাও মরে যায়। দেহদুটো শুধু থাকে।
কারণ সে নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে। কারণ সে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরা অধ্যাপকের স্নেহধন্য। কারণ সে মানেই ভালো রেজাল্ট। কারণ সে সব জানে। কারণ সে নিবিড় পড়ুয়া। কারণ সে রাজনীতি বোঝে। কারণ বড়রা আজকাল বলছে, সে গুণী। সে অনর্গল ইংরেজি বলে। সে বলা-কওয়ায় মুগ্ধ করে দিতে পারে মানুষকে। কারণ সে ক্রমে কেউকেটা হয়ে উঠছে।
তাই সে পারে।
উদ্ধত হতে পারে৷ তোমাকে মানুষ মনে না করতে পারে। থুতু দিতে পারে তোমার গায়ে যখনতখন৷ কৃমিকীট ভেবে টিপে মেরে ফেলতে পারে। ফেসবুকে দল বেঁধে ট্রোল করতে পারে৷ হেয় করতে পারে যখনতখন, লোক জুটিয়ে মস্করা করতে পারে তোমায় নিয়ে। তোমার পিতৃশ্রাদ্ধ করতে পারে। যাকে তাকে যখনতখন অশিক্ষিত বলতে পারে বুক বাজিয়ে। তার কর্তৃত্ব মানতে বাধ্য করতে পারে। না-মানলে মরতেও বাধ্য করতে পারে।
আরও পড়ুন: শোকের বিগ্রহ
কারণ ওরা, মানে, সে এবং তার মতো অনেকে একজায়গায় হলেই শুরু দাদাতন্ত্র। সেখানে ওরাই সংবিধান। ওরা হোস্টেলের বাবা। ত্রাস। মেরুদণ্ডে ঠান্ডাস্রোত বইয়ে দেবে চাইলেই। ওরা ক্ষমতার কাছাকাছি। ওদের অনেক অভিজ্ঞতা। সমাজবদল, আচ্ছে দিন, ওরাই আনবে। ওদের কেউ চটায় না। ওরা ইশারায় কথা বলে। ওরা পার্টি। সিপিএম। তৃণমূল। বিজেপি। ওরাই প্রতীক। ওরা আলফা-মেল। সমাজে, পরিবারে, রাষ্ট্রে এমন পুরুষই তো কাঙ্খিত। যে কাঁদে না, কাঁদায়।
তাই ওরা পারে।
স্বাভাবিকতার দূত তোমায় রাতে উলঙ্গ করে হোস্টেল ঘোরাতে পারে৷ উইকেটের উপর পায়ুছিদ্র রেখে গোটা শরীরের ভর দিতে বাধ্য করতে পারে। নীলছবি দেখিয়ে পুরুষাঙ্গের সারবত্তার প্রমাণ চাইতে পারে। তুমি সমকামী নও, তুমি মরণে-আমরণে 'বামপন্থী', তুমি অনুগত ক্রীতদাস হয়ে থাকবে, এই প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিতে পারে।
কারণ সে নামকরা। ধরা যাক, নামকরা সাংবাদিক। নেতাদের প্রিয়। বসের কাছাকাছি। খুব দমকচমক। কারণ সে অনেকদিন। কারণ সে ফার্স্ট লিড। কারণ সে কালচার। কারণ সে মাসে তিন লাখের প্যাকেজ। অনেক ঘাটে জল খেয়েছে।
তাই সে পারে।
তোমার লেখায় পেচ্ছাপ করে দিতে পারে। রোজ অপমান করতে পারে। তোমার পদবির ইতিহাস নিয়ে মস্করা করতে পারে। তোমার জেলা থেকে আসা নিয়ে হিহিহোহো পারে। তোমার উচ্চারণ নিয়ে বিদ্রুপ,পারে। তোমায় রাতবিরেতে অফিসগ্রুপে খিস্তি, পারে। ভিন্নমত হলেই তোমায় 'নকশাল' বলতে পারে। তোমায় বালী/ সুগ্রীব জাতীয় ডাকনাম দিতে পারে। রাস্তায় দেখা হলে তোমাকে সে নামে ডাকা হবে। তোমার বান্ধবীর সামনেও। তুমি নিজেকে ভুলে গিয়ে যাতে ওই ডাকনামেই নিজেকে চিনতে শুরু করো, তা নিশ্চিত করে দিতে পারে সে। চিরতরে তোমার লেখা বন্ধ করে দিতে পারে। নিজেকে নিয়ে লজ্জিত তুমি, বাঁচবে না মরবে, সে তোমার ব্যাপার।
মরতে দম লাগে। তাই তুমি বাঁচো। দাদাগিরির সামনে মরে বাঁচো। অপমানের ভয়ে কাঁটা হয়ে। মাথা নীচু করে। শুয়ে থাকো গুটিসুটি মেরে। তুমি আজকাল কোথাও যেতে চাও না। বাড়িতেও ফিরতে চাও না জানি। ঘষে ঘষে বাঁচো। পায়ে পড়ে বাঁচো। 'সরি' বলো দোষ না করেও। অভ্যেস করে নাও আজ্ঞেমাজ্ঞে বলে কোনওমতে থাকার। সারাক্ষণ কৃতজ্ঞ থাকো, হুজুর মাইবাপ- ভাবখানা ধরে রাখো। অপমানের জায়গাটা ঢেকেঢুকে রাখো। বড় কলেজে এসেছ, বড় কাগজে এসেছ, তুমি, দোবরের চ্যাং, জেলার মাল। তুমি টক খোঁজো রেস্তোরাঁয়, তুমি টুম্পা। আজ থেকে তুমি নীরবে সইতে শেখো। সহ্য করো। সহ্য করা শিখে নিলেই বুকের পাথর নেমে যাবে।
খেলা ঘুরে গেলে তোমারও সময় আসতে পারে। তখন তুমিও চালিয়ে খেলো। এই অপমানের বদল নিয়ে নিও।হিসেব ফিরিয়ে দিও কোনো নবীনকিশোরকে। প্রমাণ চেয়ে নিও তার দাঁড়ায় কিনা, সে সমকামী কিনা। অপমানের বরফিল বলটা যেন ক্রমে বড় হয়। যেন ক্রমে আরও আরও আরও বড় হয়। ওদিকে মন দিলে চলবে না। মার দিতে হবে। দুমড়েমুচড়ে দিতে হবে। পারলে সহ্য করুক। লড়াই শিখে নিক। অসহ্য হলে মরুক।
কীভাবে লড়বে? একজন কবি। আমার প্রিয়। তাঁকে এক বড় লেখক লোক জুটিয়ে অপমান করত। বলত কীরে নমস্কার করলি না আজ? কবি রোজ পায়ে ঢিপ। নমস্কার। ক্লান্ত। মন ভেঙে যায়। এর লেখা ভালবেসেছিলাম! এমন মানুষ! কবি ক্লান্ত হয়ে ভাবে। তারপর একদিন রাস্তায় চোখাচোখি হলে, সকলের সামনে গলা তুলে বলে, কই আজ নমস্কারটা নেবেন না?
কিস্তিমাত।
একজন সাংবাদিক, ঘাড় গুঁজে কাজ করে ডেস্কে। বসের স্নেহধন্য তাঁর সাথে রাস্তার কুকুরের মতো আচরণ করে। সাংবাদিকটি ভাবে, এটাই আমার প্রাপ্য। প্রাপ্যের ভারে তার পিঠ বেঁকে যায়। চাকরি রাখতে হবে। হুজুর মাইবাপ মাথা আপনি যে ভাবে কাটুন। কাটা মাথা একদিন বেঁকে বসে। বলে আর যাব না ও অফিস। তারপর কেটে গিয়েছে অনেকদিন। অসম্মান থেকে দূরে সরে এসে সে সাহস পেয়েছে সামান্য। নতুন চাকরিও জুটে গেছে। অ্যাসাইনমেন্টে হঠাৎ দেখা দু'জনের। বাবুটি লঘুচালে, বলে, কী রে তুই এখানে? তুই বলাটা বাবুদের অধিকার। চাকরটির আর ভয় নেই। চাকরি হারানোর ভয় নেই, চালডাল না-জোটার ভয় নেই, অপমানের ভয় নেই। সে সোজা হয়ে বলে, কাজে এসেছি, তুমি যে কাজে এসেছ, সে কাজেই। এই প্রথম সে সোজা হয়ে দাঁড়াল যেন। আজ তার ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে অপমান ধুয়ে যাচ্ছে বৃষ্টিতে।
একজন ছাত্র। ইন্ট্রোর নামে হুজ্জুত দেখে শুরুতেই মারে। মারের আগেই মার দেখে দাদারা ভয় পেয়ে যায়।
কিন্তু সবাই পারে না।
নিজেকে কুড়িয়েবাড়িয়ে জড়ো করতে পারে না। জামা খুলে ইন্ট্রো দিতে হবে, এ কেমন কথা! শিক্ষকরা সব জেনে চুপ করে থাকবে, এ কেমন কথা! ছেলেটি ভাবে। ছেলেটি বন্ধুদের সাহায্য চায়। বড় শহরে এসে, বড় কলেজে এসে এভাবে জিভ তেঁতো হয়ে যাবে, সে বুঝতে পারেনি। ইংরেজি বলতে না পারার হীনমন্যতা এমন দৈত্য হয়ে যাবে, সে ভাবেনি। তার সব হিসেব গুলিয়ে যায়, কান্না পায়। মাকে ফোন করে ছেলেটি কাঁদে। মা-ই ছেলেকে পড়তে পাঠিয়েছে। মা মুখে বলে একদিন দু'দিন হবে, ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু দুরাশায় বুক কাঁপে মায়ের। ছেলেটার কিছু হবে না তো?
আরও পড়ুন: ‘কালো কিন্তু ভালো খেলে ছেলেটা’
খবর আসে। ছেলের মাথা কামিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাবা ভোরের ট্রেনে করে ছেলের কাছে আসে। খবর আসে। ছেলেকে ল্যাংটো করে ঘোরানো হয়েছে। ছেলে মরে গেছে। মা-বাবাও মরে যায়। দেহদুটো শুধু থাকে।
ফেসবুকে রেগে যায় সাধারণ লোক। ট্রেনে বাসে লোক বলাবলি করে, কাজটা ভালো হলো না। সেদিন, অনেক দিন পর শহরে বৃষ্টি হয় খুব। খানিকক্ষণেই রাত নামবে। শুরু হবে র্যাগিং।