নজরুলকে এখনও ভালো করে বুঝতে পারিনি আমরা: মারিয়া এলেনা বাররেরা-আগারওয়াল
বিশ্বের খুব কম চিন্তকই নজরুলের মতো ভাবতে পেরেছেন। তিনি দূরদ্রষ্টা, কারণ তাঁর বলা কথাগুলো তাঁর সমসাময়িক অনেকেই বুঝতে পারেননি। হয়তো এখনও আমরাও পেরে উঠিনি।
মারিয়া এলেনা বাররেরা-আগারওয়াল-এর পরিচিতি ও ভূমিকা:
মূলত কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও অনুবাদক। মারিয়ার জন্ম ১৯৭১ সালে ইকুয়েডরের-এর পেলিলেও শহরে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পড়াশুনা ইকুয়েডরে, আইনি পড়াশোনা করতে যান কিতো শহরে। দু-দু'টি মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেছেন ফ্রান্সে। আমেরিকা থেকেও তিনি আরও একটি মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। আপাতত থাকেন নিউ ইয়র্কে। পাঁচটি ( ফরাসি, পর্তুগেজ, ইংরেজি, ইতালিয় ও স্প্যানিশ) ভাষায় সাবলিল মারিয়া সাহিত্যের জগতে প্রবেশ করেন কৈশোরেই। তার মাতামহ ছিলেন লেখক ও বুদ্ধিজীবী। পারিবারিক ঐতিহ্যের সূত্রেই মারিয়া পেয়েছেন সাহিত্যপ্রীতি ও চর্চার অনুকূল পরিবেশ। ১৯৮৯ সালে তিনি ছোটগল্প লেখার প্রতিযোগিতায় ইকুয়েডরে অর্জন করেছিলেন প্রথম পুরষ্কার। যদিও পরবর্তীকালে কথাসাহিত্যের চেয়ে বরং অনুবাদ, প্রবন্ধ ও গবেষণাতেই তিনি হাত পাকিয়েছেন। তাঁর উচ্চতর শিক্ষা মূলত মেধাসত্ত্ব বিষয়ে। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১৩। ভারতীয় বিভিন্ন ভাষার সমসাময়িক সাহিত্য নিয়ে তাঁর অসীম আগ্রহ এবং চর্চাও করে চলেন প্রতিনিয়ত । এই উপমহাদেশের সাহিত্য কেবল তিনি অনুবাদই করেননি, লিখেছেন অসংখ্য প্রবন্ধও। লাতিন আমেরিকায় তিনি এখনও পর্যন্ত একমাত্র ও প্রথম নজরুল-অনুবাদক এবং নজরুল-বিশেষজ্ঞ। সম্প্রতি তার সামগ্রিক সাহিত্যিক কর্মকাণ্ড ও নজরুল বিষয়ে কথা হয় কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক এবং লাতিন আমেরিকান সাহিত্য ও বোর্হেস-বিশেষজ্ঞ রাজু আলাউদ্দিনের সঙ্গে। তাঁদের আলাপচারিতার পূর্ণাঙ্গ রূপটি এখানে পেশ করা হলো।
ইউরোপীয়, ল্যাটিন আমেরিকান ও ভারতীয় সাহিত্য, এই বিরাট এলাকা জুড়ে আপনার কাজ। এত কিছু থাকতে সাহিত্যের প্রতি এই আগ্রহটা গড়ে উঠল কেন?
সাহিত্য ছাড়া কখনও থেকেছি বলে মনে পড়ে না। আমার প্রথম কবিতা লেখা আট বছর বয়সে। প্রথম উপন্যাস পনেরোতে (সৌভাগ্যক্রমে তা এখনও অপ্রকাশিত)। আমার প্রথম ছোটগল্প লেখা সতেরোয়। বাবা-মা কখনও আমাকে কোনও বই কিনে দিতে আপত্তি করেননি। মধ্যবিত্ত পরিবারে সেটা তাঁদের পক্ষেও যে সবসময় সহজ ছিল,এমনটা নয়। তবু তাঁরা আমাকে বিশ্বাস করেছেন, এবং পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন যাতে আমি আমার পছন্দের বিষয় নিয়ে এগিয়ে যেতে পারি। গার্সিয়া মার্কেজের 'ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস অফ সলিটিউড’ পড়েছি নয় বছর বয়সে এবং দশ বছর বয়সে পড়া স্টেইনবেকের 'দ্য পার্ল ’, এমন অনেক বই-ই আমি ওই বয়সেই পড়ে ফেলেছিলাম। তবে যখন পেশা বেছে নেওয়ার সময় এল, আমি আইনকে বেছে নিলাম। এবং তার পিছনেও ছিল সাহিত্যই। পরবর্তীকালে সাহিত্যে কপিরাইটের উপরে স্পেশালাইজেশন করতে চেয়েছিলাম তখন থেকেই।
আমি বিশ্বাস করি, এ সবই সম্ভব হয়েছে আমার পরিমণ্ডলের জন্য। আমি ভাগ্যবান যে আমি এমন একটি বাড়িতে বড় হয়েছি, যেখানে সাহিত্য ও কবিতা হয়ে উঠেছিল জীবনের অন্যতম অঙ্গ। আমার দাদু ছিলেন কবি ও বুদ্ধিজীবী। দিদার হাত ধরে আবৃত্তির ধারায় ঢুকে পড়েছিলেন মা। বাবার ছিল ইকুয়েডরের সঙ্গীত পাসিইয়্যোস (Pasillos)-এর প্রতি গভীর ভালোবাসা। আমার ছোটবেলা ও কৈশর জুড়ে ছড়িয়েছিটিয়ে ছিল সেই সব দুঃখের গান। হামবোল্টের একটা লেখায় একবার পড়েছিলাম, কীভাবে দুঃখের গান শুনে খুশি হন ইকুয়েডরিয়ানরা! আর সেই সব গানের অনেকগুলিই কিন্তু আমাদের শ্রেষ্ঠ সব কবিদের লেখা। সেখান থেকে দেখতে গেলে বাংলার সঙ্গে আমাদের সংস্কৃতির মিল অনেকটাই।
আপনি একটি দুর্দান্ত গবেষণামূলক কাজ করেছিলেন সুরেশ বিশ্বাস নামে এক বাঙালিকে নিয়ে। প্রথম ভারতীয়, যিনি ব্রাজিলের সেনাবাহিনীতে লেফটেন্যান্ট হন। আপনি কীভাবে জানলেন তাঁর বিষয়ে?
সুরেশ বিশ্বাসের কথা প্রথম জানতে পারি দু'টি সূত্রে। সে সময় আমি যতটা সম্ভব বাংলা সাহিত্য পড়ার চেষ্টা করছি। আসলে কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য অনুবাদে হাত দিয়েছি তখন। সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদাসমগ্র ( 'দ্য অ্যাডভেঞ্চার অব ফেলুদা')-র মতো প্রিয় বইগুলি বারবার পড়ছি। সেই সঙ্গে প্রীতিকুমার মিত্রের 'দ্য ডিসেন্ট অব কাজী নজরুল ইসলাম' বইটিও পড়েছি খুঁটিয়ে। এই দু'টি বইতেই ব্রাজিলের বিশ্বাসের উল্লেখ পাই। তার আগে সুরেশবাবুর কথা শুনিনি। ইচ্ছা হল, তাঁর সম্পর্কে আরও জানতে।
ইউরোপ ও দক্ষিণ আমেরিকায় বিশ্বাসের সময় সম্পর্কে অল্প কিছু তথ্য পাওয়া যায় বটে, তবে তা খুবই সামান্য। তাঁর জীবনীতে তাঁর সম্পর্কে যে তথ্যগুলি রয়েছে, তার একমাত্র উৎস তাঁর চিঠি। সেই চিঠিপত্র ঘেঁটে পাওয়া তারিখগুলোকে সাজিয়ে আমি তাঁর ভ্রমণের একটি সম্ভাব্য কালপঞ্জী তৈরি করেছিলাম। ভাগ্যক্রমে আমি পোর্তুগিজ ও স্প্যানিশ, দু'টি ভাষাই জানতাম। ফলে আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের আর্কাইভ ঘেঁটে প্রকাশিত লেখাপত্রগুলো পড়তে অসুবিধা হয়নি। আমার গবেষণায় এমন সব তথ্য উঠে এল, যা নিয়ে এর আগে কখনও কোনও কাজ হয়নি। লায়ন সিং ট্যামারের যেমন বিশেষ পারদর্শিতা ছিল বাঘ-সিংহের উপরে, তেমনই দু'টি মহাদেশে নিজের ছাপ রেখে গিয়েছিলেন বিশ্বাস। তার মিলিটারি কর্মজীবনও ছিল মনে রাখার মতো। সব মিলিয়ে এক বর্ণময় চরিত্র ছিলেন সুরেশ বিশ্বাস। যাঁর কথা মানুষের আরও বেশি করে জানা উচিত ছিল।
আরও পড়ুন: ‘হ্যামলেট’-এর মতোই আমরা প্রত্যেকে চাইছি প্রতিশোধ: কৌশিক সেন
আপনার গবেষণা সামনে আসার আগে আমরা ভাবতাম সেনোবিয়া কাম্প্রুবি ও হুয়ান রামন হিমেনেসই প্রথম, যাঁরা স্প্যানিশ ভাষায় রবি ঠাকুর অনুবাদ করেছিলেন। কিন্তু আপনার গবেষণা বলছে, ব্লানসে সাকারিয়ে নামে আরও একজন ছিলেন, যিনি ওই স্প্যানিশ দম্পতিরও আগে রবিঠাকুর অনুবাদে হাত দেন। দয়া করে আপনার আবিষ্কারের বিষয়ে বলুন।
সেটা ২০০৩ সালের কথা। কবিগুরুর যেসব লেখালেখিগুলোর স্প্যানিশ অনুবাদ হয়েছিল, সেগুলো সম্পর্কে কৌতূহল জেগেছিল আমার। এর ফল হিসেবে ২০০৪ সালে নামে একটি পত্রিকা 'Letras Libres' পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ প্রকাশ পায় যেখানে আমাদের গ্রন্থাগার ও বইয়ের দোকানগুলোয় পাওয়া রবীন্দ্রনাথের রচনার স্প্যানিশ অনুবাদ ইংরেজি জানা সেনোবিয়া কাম্প্রুবি ও হুয়ান রামোন হিমেনেসের যৌথ উদ্যোগে হয়েছে বলে উল্লেখিত হয়েছে। ২০১৮ সালের দিকে আমি ওই অনুবাদগুলির সময়কাল নির্ধারণের জন্য সেগুলি ঘাঁটা শুরু করি। নোবেল পুরস্কার ঘোষণার আগে আগে কবিগুরুর গীতাঞ্জলি বিষয়ক গ্রন্থালোচনায় রামন পেরেস দে আইয়ালাকে চারটি কাব্যচূর্ণ অনুবাদের কৃতিত্ব দেয়া হয়। আলোচনাটি মাদ্রিদের La Tribuna পত্রিকায় তাঁর নিয়মিত কলাম 'তাবলা রাসা'-তে অন্তর্ভুক্ত যা বেরিয়েছিল ১৯১৩ সালের ২২ অগস্ট। কাম্প্রুবির প্রথম ভার্সনটি প্রকাশিত হয় নোবেল পুরস্কার ঘোষণার পরে, ১৯১৪ সালের মার্চ মাস নাগাদ মাদ্রিদের 'La Lectura'-য় তা প্রকাশিত হয়েছিল।
আয়ালাই যে প্রথম, তা আমি মেনেই নিতে পারতাম। কিন্তু কিছু একটা ছিল, যা আমাকে বারবার বলছিল, স্পেনের বাইরে বেরিয়ে গবেষণা করতে। আমার মনে হয়েছিল রবিঠাকুরের মতো প্রতিভা কিছুতেই দক্ষিণ আমেরিকার কাছে অচেনা, অজানা থাকতে পারে না। দেখা গেল, তেমনটাই সত্যি। স্প্যানিশ ভাষার সত্যিকারের প্রথম রবিঠাকুর-অনুবাদক ব্লানচে সাকারিয়ের তথ্য আবিস্কারে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি। ১৯১৩ সালের ৬ অগস্ট গীতাঞ্জলি নিয়ে প্রথম একটি সমালোচনা প্রকাশ করেছিলেন তিনি হাভানার 'El Diaro de la Merina-য়। সাকারিয়ের নামটা কিন্তু আমার কাছে নতুন ছিল না। কিউবার মহান কবি ও স্বাধীনতা সংগ্রামী হোসে মার্তির কথা সকলেই জানেন। তাঁর ভক্তেরা সকলেই জানেন তাঁর 'El Marti que yo conoci (যে মার্তিকে আমি জানতাম) বইটির কথা। কীভাবে সত্য ও সুন্দরের বিষয়ে নিজের অন্তর্দৃষ্টিকে ফুটিয়ে তুলেছেন, তার কথা না বললেই নয়। তাঁর এই যে ভাবনা, তার খুব কাছাকাছি ভাবনাকে সাহিত্যকে ফুটিয়ে তুলেছেন আরও দুই কবি। আর তাঁরাই মিলিয়ে দিয়েছিলেন সমস্ত দেশকালের ব্যবধান।
সাকারিয়ের সমালোচনার বিষয়বস্তু ও ধরনটাই ছিল একেবারে আলাদা। বাকিদের সমালোচনাগুলো ছিল খানিকটা ধন্ধমূলক। যেমন ধরুন, হ্যাঁ, ওঁর লেখা কবিতা দারুণ। কিন্তু ওঁর ইওরোপীয় বংশোদ্ভূত না হওয়াটা সামান্য সমস্যার বটে। আইয়ালাও কিন্তু তাঁর লেখায় উল্লেখ করতে ভোলেননি যে প্রাচীন যুগের কবিদের মতো রবিঠাকুর শুধু একজন কবি নন, একজন সঙ্গীতজ্ঞও বটে। আবার পশ্চিমি মানদণ্ডে কবির সৃষ্টিকে মাপা থেকেও নিজেকে বিরত রাখতে পারেননি তাঁরা। সাকারিয়ের সমালোচনা ছিল এর থেকে ব্যতিক্রমী। রবীন্দ্রনাথের অন্তর্ভাবনাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করেছিল তাঁর অনুবাদ। মুক্ত কণ্ঠে তাঁর কাজ ও সংস্কৃতির প্রশংসা করতে অসুবিধা হয়নি সাকারিয়ের। তাঁর অনুবাদ জুড়েও ছিল সেই ছাপ। প্রথম রবীন্দ্রনাথের অনুবাদক হিসেবে সাকারিয়ের ভূমিকা নিয়ে সম্প্রতি খানিক গবেষণা করছি আমি। এ নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখছি, যা জায়গা পাবে কিউবার সাহিত্য ও ইতিহাস নিয়ে লেখা আমার একটি বইতে।
একসময় স্পেন ও লাতিন আমেরিকায় একটা বিশেষ জায়গা জুড়ে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আপনার কী মনে হয়, এখনও কি স্প্যানিশভাষীদের কাছে রবিঠাকুর ততটাই গুরুত্বপূর্ণ?
রবিঠাকুর এখনও প্রাসঙ্গিক। যদিও এটাও ঠিক যে বিশ শতকের প্রথম কয়েক দশকে রবিঠাকুরকে নিয়ে প্রকাশনার দুনিয়ায় যে উৎসাহ ছিল, তার থেকে দূরে সরে এসেছি আমরা। তবে স্প্যানিশভাষীদের বইয়ের বাজারে কিন্তু এখনও রয়ে গিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। স্পেন এবং ল্যাটিন আমেরিকার বইয়ের দোকানের ওয়েবসাইটগুলি ভালো করে খুঁটিয়ে দেখলে দেখবেন, মেক্সিকো শহরে, এমনকী মাদ্রিদ, বোগোটাতেও রবিঠাকুরের বইয়ের চাহিদা বিস্তর। হার্ডকভার, পেপারব্যাক সংস্করণ- দুই-ই মেলে পাল্লা দিয়ে। সম্প্রতি কিতো গিয়েছিলাম। সেখানে মাত্র দু'টি বইয়ের দোকানে ঢুঁ মারা সম্ভব হয়েছিল। সেই দু'টি দোকানেই তাঁর বই ছিল, এবং তা বিশেষ ভাবে প্রদর্শনও করা ছিল। এর চেয়ে আনন্দের আর কী-ই বা হতে পারে, পাঠক আমাদের ভাষায় তাঁর কাজ আবিষ্কার করছেন, তাঁর প্রশংসা করছেন। সত্যি কথা বলতে, তাঁর সমসাময়িক বহু স্প্যানিশভাষী স্থানীয় কবি বা অনুবাদিত সাহিত্যিকই ততটা আদৃত নন।
প্রথম বার নজরুলের নির্বাচিত কবিতা ও গদ্যের স্প্যানিশ অনুবাদ কিন্তু আপনার উল্লেখযোগ্য কাজগুলির মধ্যে একটি। হুইটম্যানের কবিতার সঙ্গে নজরুলের 'বিদ্রোহী' কবিতার তুলনা করেছেন আপনি লিখেছেন: “Su rebeldia proyecta, por tanto, aspectos inexistentes en Whitman.” - এই ব্যাপারটা নিয়ে আমাদের একটু আলোকপাত করুন।
নজরুলকে সম্পূর্ণভাবে বুঝতে হলে তাঁর সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, কোন সময়ের মধ্যে দিয়ে তিনি গিয়েছেন, সেটা বোঝা দরকার সবার আগে। তাঁদের সময়টা ঠিক কেমন ছিল, তা নিয়ে আমরা মনে মনে একটা ধারণা তৈরি করে নিই। আরও খারাপ ব্যাপার হল, এটা ভেবে বসি যে ওঁদের সময়টা আমাদের মতোই। আর এখানেই আমরা ভুলটা করে বসি। হুইটম্যান ছিলেন আমেরিকার নাগরিক। তিনি জীবদ্দশায় রাষ্ট্রের দেওয়া সমস্ত সুবিধা, সমস্ত অধিকার ভোগ করতে পেরেছিলেন। রাজনৈতিক মত প্রকাশের স্বাধীনতাও পেয়েছিলেন। লেখা এবং প্রকাশনা, দু'টোই ছিল তাঁর ধরাছোঁয়ার মধ্যে। হ্যাঁ, এটা ঠিক কথা, প্রচুর বাধা ও বিতর্কের মুখে পড়তে হয়েছে তাঁকেও। তবে নিজভূমে স্বাধীনতার স্বাদ থেকে বঞ্চিত, বলা ভালো পরবাসী হয়ে থাকতে হয়নি তাঁকে।
নজরুলের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ছিল ঠিক বিপরীত। ব্রিটিশদের হাত ধরে যে বর্ণবিদ্বেষী, শোষনমূলক একটি ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রযন্ত্র তৈরি হয়েছিল এ দেশে, সেখানে ভারতীয় বুদ্ধিজীবীদের স্বাধীনভাবে ভাবনাচিন্তা করার সেই পরিসরটাই ছিল না। নিজের দেশের স্বাধীনতার অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলেন তাঁরা। বিশেষত বাংলায় গোটা জনসংখ্যার উপরে যে সংগঠিত অত্যাচার শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলেছে, যেভাবে তাঁদের আত্মসম্মান, যৌথতারবোধ ও সাংস্কৃতিক গর্বকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে, তা বোধহয় ব্যাখ্যাতীত। যদিও এর ছোঁয়াচ ও ক্ষতি অনেকাংশেই এড়াতে পেরেছিলেন দেশের অভিজাতরা তাঁদের ক্ষমতা, অর্থের জোরে। কিন্তু যাঁরা সাধারণ মানুষ, যাঁদের খুঁটির জোর ততটা ছিল না, তাঁদের এই শোষণ-নিপীড়ন সহ্য করে যেতে হয়েছে প্রতিনিয়ত। নজরুলের হয়ে ওঠা কিন্তু সেই সব সাধারণ মানুষের মধ্যে থেকে। তাঁকে যে পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে, তা হুইটম্যানের মতো কবির কাছে অকল্পনীয়। তাই নজরুলের বিদ্রোহের ধরন হুইটম্যানের থেকে আলাদা। তাঁর পরিস্থিতি আরও জটিল, আরও কঠিন। শুধুমাত্র ব্যক্তিগত স্তরে নয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক স্তর থেকেও।
শুধু কবিতা নয়, তাঁর গদ্যকেও সমান ভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন আপনি। বিশেষত 'রাজবন্দির জবানবন্দি' লেখাটিকে। এ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ণ একেবারে নতুন এবং মৌলিক। আপনার লেখায় আমরা পেয়েছি, "নজরুল নিজেকে সবসময়ে একজন বৈশ্বিক নাগরিক হিসেবে তুলে ধরেছেন। যার মধ্যে কোনও কুসংস্কার বোধ নেই, কোনও রকমের অসহিষ্ণুতা নেই। একটি নিরপেক্ষ জায়গা থেকে দাঁড়িয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ার কথা বলেন তিনি। নজরুল মনে করতেন, ভারত যদি হত ঔপনিবেশিক শক্তি আর ব্রিটেন উপনিবেশ, তাহলে ব্রিটিশদেরও ভারতের মতোই রুখে দাঁড়ানোই উচিত কাজ হত।
আমি মনে করি, 'রাজবন্দির জবানবন্দি' নজরুলের রাজনীতিবোধ ও দর্শনগত দিক দিয়ে একটি মাস্টারপিস। ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে একটি ব্যাপারে আমরা কিন্তু সবসময়েই পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে যাই, যে কার এটা প্রাপ্য আর কার এটা প্রয়োজন। আমাদের পারিপার্শ্বিকতা, মতামত আমাদের মধ্যে থেকে চিন্তা করার সেই ভারসাম্যটুকু নষ্ট করে দেয়। সাম্যের ছদ্মবেশে ভুল পরিণামকেই ন্যায্য বলে তুলে ধরে। নজরুল তাঁর ২৩ বছর বয়সেই এই সমস্ত পক্ষপাতিত্ব থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পেরেছিলেন। গাইতে পেরেছিলেন 'সাম্যের গান'। তিনি লিখেছেন, তিনি বিশ্বাস করেছেন এবং তা করেও দেখিয়েছেন। বিশ্বের খুব কম চিন্তকই এই কাজ করতে পেরেছেন। তিনি দূরদ্রষ্টা, কারণ তাঁর বলা কথাগুলো তাঁর সমসাময়িক অনেকেই বুঝতে পারেননি। হয়তো এখনও আমরাও পেরে উঠিনি। পৃথিবীর বর্তমান অবস্থাই তার প্রমাণ।
নজরুল বা অন্য কোনও বাংলা সাহিত্যিককে নিয়ে নতুন কোনও কাজের পরিকল্পনা ঘুরছে মাথায়?
নজরুলের প্রবন্ধের উপর একটি খণ্ড তৈরি করছি। আশা করছি, আগামী বছরই প্রকাশ করতে পারব সেটি। তাছাড়া আমার এক কবি-বন্ধুর গদ্য অনুবাদ করছি। পরবর্তীকালে নজরুলের উপন্যাস নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা আছে। স্প্যানিশ ভাষায় এ এখনও সম্পূর্ণ অনাবিষ্কৃত এক আকড়।
সম্প্রতি ভারত ও বাংলাদেশের নজরুলের লেখা একটি বৈপ্লবিক গান কারার ওই লৌহ কপাট নিয়ে বেশ বিতর্ক হয়। গানের সুর সম্পূর্ণ ভাবে পাল্টে দেওয়ার অভিযোগে উঠেছে প্রখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক এ আর রহমানের বিরুদ্ধে। আর এই ঘটনাতে ফের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসে গিয়েছেন নজরুল। যদিও নতুন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তাঁর কাজের মূল্যায়ণ বাকি রয়ে গিয়েছে আজও। কী বলবেন এ ব্যাপারে?
আমি শুনেছি বিতর্কের ব্যাপারটি। নজরও রেখেছি বিষয়টিতে। একদল সমালোচক দাবি করেছেন, নজরুল বিশুদ্ধবাদী ছিলেন। নিজের কাজ নিয়ে পরীক্ষানিরিক্ষা তিনি পছন্দ করতেন না। অধ্যাপক নাশিদ কামাল যেমন লিখেছেন, এমন কিছু সাক্ষ্যপ্রমাণ রয়েছে, যা নিশ্চিত করে দেয় যে কবি চাইতেন না, তার গান কোনও ভাবে বিকৃত হোক। দশকের পর দশক ধরে 'কারার ওই লৌহ কপাট' গানটির সেই জায়গা অক্ষুন্ন ছিল। আসলে গানটি বাংলার প্রাণে গাঁথা হয়ে গিয়েছে। রহমানের মতো সঙ্গীতপরিচালককে এমন একটি ঐতিহ্য ভাঙতে দেখতে দুঃখ হয় বইকি। যদিও সিনেমার প্রযোজকদের বিবৃতি থেকে মনে হয়, তাঁরা হয়তো প্রথম থেকেই চেয়েছিলেন গানটিকে ঘিরে বিতর্ক হোক। কার্যত এমনই একটি চুক্তি তাঁরা করতে চেয়েছিলেন, যেখানে গানটির কথা সম্পূর্ণ নতুন একটি সুরের সঙ্গে ব্যবহার করা যাবে। অবশ্যই কবির পরিবারের কাছে বিষয়টা খুব একটা স্বস্তির হয়নি। আসলে কপিরাইট আইন ব্যাপারটা সাধারণের পক্ষে বোঝা বেশ কঠিন। পুরোপুরি কপিরাইট দিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটাও বাস্তবে সবসময়ে সম্ভব হয় না। নতুন সুরের গানটি যে আসল গানের পাশে একেবারেই দাঁড়াতে পারেনি, তা তো আলাদা করে বলে দিতে হয় না। তবে একটাই ভালো কাজ হয়েছে এতে। নজরুলের যে ঐতিহ্য, তা নিয়ে ফের নাড়াঘাঁটা হয়েছে এই বিতর্কের কারণে।
স্প্যানিশ ভাষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইন্ডোলজিস্টদের মধ্যে আপনি অন্যতম। বাংলার সাহিত্যিক ও শিল্পীদের নিয়ে অসংখ্য আর্টিকেল, গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখেছেন। ইউরোপীয় সাহিত্য থেকে শুরু করে লাতিন আমেরিকা ও ভারতীয় সাহিত্য, সব কিছুই ধরা রয়েছে আপনার বই 'La Flama y el Eco'-তে। স্প্যানিশ-বিশ্বে বাংলা সাহিত্যের অবস্থানটা ঠিক কোথায়?
আপনি প্রশংসার ব্যাপারে বেশ দরাজ। আমি সম্প্রতি ইকুয়েডরে গিয়েছিলাম, ইকুয়েডরিয়ান অ্যাকাডেমি অব ল্যাঙ্গুয়েজে আমার অ্যাডমিশন সেরিমনিতে যোগ দিতে। সেখানে গিয়ে বুঝতে পারি, উপমহাদেশের প্রতি আমার এই আগ্রহ আমার কাজকে অনুপ্রাণিত করেছে , প্রভাবিত করেছে। প্রায় পঁচিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে আমাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। এই উপমহাদেশ নিয়ে গবেষণা ও লেখালিখি যে আমার জন্য কতটা আনন্দের, বোঝাতে পারব না। পাশাপাশি এই কাজটার প্রতি আমি দায়বদ্ধ। কারণ এমন সুযোগ সকলে পান না। আমি বিশ্বাস করি, ভারত ও বাংলাদেশের সাহিত্যিক সম্পদ দিয়ে নিজেদেরকে সমৃদ্ধ করার এটাই একটা সুযোগ। যখনই এমনটা হয়েছে, তখনই তার ফলাফল হয়েছে যুগান্তকারী। পাবলো নেরুদা-সহ আমাদের বহু মহান কবির মধ্যেই কিন্তু রয়ে গিয়েছে কবিগুরুর প্রভাব। শ্রী অরবিন্দর কাজ, তার আদর্শের প্রভাব গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রালের দর্শনে প্রভাব ফেলেছে। বিক্রম শেঠের 'আ স্যুটেবল বয়'-র প্রভাব পড়েছে আমাদের এখনকার সমস্ত গল্পকারদের মধ্যেই। ভারতীয় সাহিত্যের গুরুত্ব বাড়ছে। তবে যে হারে বাড়া উচিত ছিল, সেই হারে বাড়েনি। এখনও পর্যন্ত উপমহাদেশের সাহিত্যের সঙ্গে আমাদের সাহিত্যের তেমন সরাসরি যোগ নেই। যেসব কবি-সাহিত্যিক ও তাঁদের লেখাকে ইউরোপ ও আমেরিকা গ্রহণ করেছে, তাঁদের সাহিত্যই আমাদের কাছে এসে পৌঁছচ্ছে। এই জায়গাটাতেই বদল আসা প্রয়োজন।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশ নিজের জায়গা ধরে রাখতে পেরেছে; পশ্চিমবঙ্গ পারেনি : কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়
আপনার কী মনে হয়, অনুবাদ ছাড়া দুই মহাদেশের মধ্যে সাহিত্যিক যোগাযোগ তৈরির উপায় কী? কী পরামর্শ দেবেন?
একমাত্র উপায়, আমরা কী পড়ব, আমাদের মননকে কোন সাহিত্য সমৃদ্ধ করবে, তা বেছে নেওয়ার জন্য ইউরোপ ও আমেরিকার প্রতি নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। তাদের অনুমোদনের জন্য অপেক্ষা না করেই সরাসরি সম্পর্ক তৈরি করতে হবে এক ভাষার সঙ্গে অন্য ভাষার, এক উপমহাদেশের সাহিত্যের সঙ্গে অন্য উপমহাদেশের সাহিত্যের। প্রথমত, দু'দেশের সাংস্কৃতিক বিনিময় বাড়ানোর জন্য উদ্যোগী হতে হবে কূটনীতিক স্তর থেকে। দু'দেশেরই সরকারি ও সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে পারষ্পরিক যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে, যাতে বিভিন্ন অনুবাদ ও সংস্করণ পৌঁছে দেওয়া যায় একে অপরের কাছে। দ্বিতীয়ত এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটা, সেটা হল বেসরকারি সংস্থাগুলিকেও একত্রিত করতে হবে, যাতে তৃণমূল স্তর থেকেই সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক সম্পদকে লালন করা যায়। ধীরগতিতে হলেও ইতিমধ্যেই সেই কাজ হচ্ছে। আশা রাখি, সকলে চেষ্টা করলে একদিন ঠিক এই উদ্দেশ্যে সফল হতে পারব আমরা।
তর্জমা: সোহিনী দাস