মস্তান থেকে মন্ত্রী! দাঁড়িয়ে থেকে গোটা বাজার লুঠ করিয়েছিলেন রাজ্যের এই মন্ত্রী

Mastan Ram Chatterjee: হঠাৎ একদিন হুগলি জেলা থেকে একদল আদিবাসী মানুষকে সঙ্গে করে ক্যালকাটা সুইমিং ক্লাবে ঢুকে পড়লেন মন্ত্রী।

কেমন একটা ঝুঁকে সাইকেল চালাচ্ছে একজন। প্যাডেলে চাপ দিয়ে ক্রমাগত গতি তুলছে। আর পেছনে সটান দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। সাইকেলের পেছনের চাকার মাঝখানে একটা লোহার রড পা-দানির কাজ করছে। সেখানে বাঁ পা রাখা, আর ডান পা ভাঁজ করে রাখা চাকার উপরে মাডগার্ডে। এই ভঙ্গিতে সটান দাঁড়িয়ে রয়েছে ওই যুবক। তার এক হাত সাইকেল চালকের কাঁধে, আরেক হাত কোমরে। সাইকেলের পেছনের চাকার উপর এমন অননুকরণীয় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। মাঝেমধ্যেই সাইকেল থামছে কোনও জটলার সামনে, যুবকদের জটলা। সাইকেলে দাঁড়িয়েই কিছু নির্দেশ দিচ্ছে ওই যুবক। তারপরই হুসসস। সাইকেলে গতি বাড়িয়ে ধাঁ দুই চরিত্র। এই ভঙ্গিতেই চুঁচুড়া থেকে চন্দননগর, অলিগলি থেকে জিটি রোড। চলন্ত সাইকেলে চেপে যেন কোনও শাসক যাচ্ছে। চারদিক টহল দিয়ে দেখে নিচ্ছে এলাকার হাল হকিকত।

ব্রিটিশদের হাত থেকে ভারত স্বাধীন হলেও চন্দননগর তখনও ফরাসি উপনিবেশ। বাঙালিপাড়ার পাশেই একদিকে বহু ফরাসি পরিবার আর অন্যদিকে বড় বড় ব্যবসায়ী শেঠদের ঘরবাড়ি। ঘরবাড়ি বললে ভুল হবে। কারও দুর্গ তো কারও আবার প্রাসাদ। এরা সবাই জানে কে ওই সাইকেলে চেপে টহল দিচ্ছে। অল্প বয়স হলে কী হবে, পাতালপুরীর সেই যে হবু শাসক! তাই তাকে নজরেই রাখে চুঁচুড়া চন্দননগরের কর্তা ব্যক্তিরা এমনকী ফরাসি প্রশাসকরাও। গঙ্গাপাড়ের হাওয়া গায়ে মেখে সাইকেলের উপর দাঁড়িয়ে নিজের ডানা আরও ছড়িয়ে দিতে চায় যে যুবক, তার ভালো নাম রাম চ্যাটার্জি। খারাপ নামও রাম চ্যাটার্জি।

চুঁচুড়া চন্দননগর জুড়ে তার অবাধ রাজপাট ক্রমে গড়ে উঠছে। বাংলা জুড়েও পরিচিতি বাড়ছে। বাড়ছে বলি কেন! ইতিমধ্যেই বেড়ে গিয়েছে! তাকে নাকি বিধান চন্দ্র রায়ের বাড়ির সামনেও দেখা যায়। বিধানবাবুর বাড়ির পাশেই মলঙ্গা লেনের পাতালপুরীতেও পা রেখে ফেলেছে রাম। তবে না এই দাপট! সাইকেলের পেছনের চাকায় দাঁড়িয়ে উড়ুক্কু এক ডন। তবে ডনই বলো আর মস্তানই বলো, রাম চ্যাটার্জির গল্প এক অনন্য উপাখ্যান। এমন চরিত্র পাতালপুরী কেন, বাংলার সমাজজীবনে বোধহয় আর একটিও নেই। পাতাল থেকে স্বর্গ, সব জায়গায় একইরকমভাবে মাতিয়ে রাখা এক চরিত্র তিনি । বহুমাত্রিক তাঁর জীবনের আখ্যান।

আরও পড়ুন- যৌনকর্মী, বেপরোয়া প্রেমিকা! কে ছিলেন কলকাতার প্রথম মহিলা মস্তান নির্মলা দাসী?

দারিদ্র্যের পিছল পথ অনেক সময় পাতালপুরীর রাস্তা প্রশস্ত করে। রাম চ্যাটার্জির জীবনের প্রারম্ভিক আখ্যানও তার ব্যতিক্রম নয়। রাম চ্যাটার্জির মা অনিলা দেবী বিধবা হন ষোলো বছর বয়েসে। দুই মেয়ে আর এক ছেলে রাম। অনিলা দেবীর শ্বশুরবাড়ি চন্দননগরের গরবাটি অঞ্চলে। স্বামীর মৃত্যুর পর তিন সন্তানকে নিয়ে নিজেরই শ্বশুরকুলের আত্মীয়দের বাড়ি পরিচারিকার কাজ করতেন অনিলা দেবী। বিনিময়ে দু'বেলার আহার, পরনের কাপড়। মায়ের অসীম দুর্দশা দেখে বড় হয়ে উঠতে লাগে রাম। বাড়ির পাশেই গরবাটি স্কুলে ভর্তি হয়। স্কুলে যায়, লেখাপড়ায় তেমন মন-টন নেই। পেটের খিদেই যেন মেটে না, পড়ায় মন বসবে কোত্থেকে! ছোট ছেলে রাম। যে আত্মীয়ের বাড়ি দু'বেলা ভাত পায় সেখানে সমস্যাও অনেক, অনেক যাতনা! দু'বারের বেশি ভাত চাইলে শুনতে হয়, "তোর ওটা কি পেট না চামড়ার ব্যাগ!" লজ্জায় আধপেটা খেয়ে দিন যায় রামের। চোখের জল ফেলে মা। এভাবেই একদিন স্কুল থেকে নাম কাটা যায় ফি জমা না দেওয়ার কারণে। স্কুল নেই, বই নেই, খাতা নেই। রাম যেন মুক্ত বিহঙ্গ। হাত-পাগুলো আরও ছড়িয়ে যেতে চায়। যেন অনেক পথ পেরিয়ে যেতে চায় সে। এই সময়ই, চোদ্দ বছর বয়েসে জীবনের প্রথম চুরি করে রাম, তাও এক আত্মীয়ের নির্দেশেই। বাপহারা ছেলেটিকে দিয়ে চুরি করায় নিকট আত্মীয়। প্রায় অনাথের চোর হতে বাধা কোথায়? রামের সেই আত্মীয় রামকে পরামর্শ দেয়, রেল স্টেশনের গায়ে যে লোহার পিলারগুলো থাকে তা উপড়ে তুলে নিয়ে আসতে। গভীর রাতে রেলের সম্পত্তি প্রবল ভারী লোহার পিলার চুরি করে রাম। অন্ধকার জগতে এভাবেই তার পদার্পণ।

অনিলা দেবী

আসলে রেল লাইন, রেল স্টেশন লাগোয়া অঞ্চলে নানাবিধ দুষ্কর্মের ঘাঁটি গড়ে ওঠে। রেল লাইন, রেলের স্ক্র্যাপকে কেন্দ্র করে রামও হাত পাকিয়ে ফেলে দুষ্কর্মে। ক্রমেই সমবয়সীদের নিয়ে একটা ছোটখাটো গ্যাং তৈরি করে ফেলে সে। গ্যাংয়ের লিডার সেই রাম চাটুজ্জে আর তখন থেকেই তার সাইকেলের পেছন চাকার মাডগার্ডে পা রেখে উড়ুক্কু টহলদারিরও শুরু।

জুহুরির তো কখনও জহর চিনতে ভুল হয় না। চন্দননগরের আফিম ব্যবসায়ী কেষ্ট শেঠেরও রামকে চিনতে ভুল হয়নি । ডাকাবুকো ছোকরা, এই বয়সেই দলবল বানিয়ে বসেছে, তার উপর ব্রাহ্মণ সন্তান। আফিম ব্যবসায়ী কেষ্ট শেঠ দেখলেন অভুক্ত ছেলেটাকে পেট ভরে খাওয়ালে পুণ্য কমবেশি যা হওয়ার হবে, তার উপর লাভ হবে ষোলো আনা, একথা একেবারে নিশ্চিত। রামের বুকভরা সাহস ছিল, দলবল ছিল, কয়েকটা সাইকেল ছিল, কিছু চাকু-চেন ছিল। এবার এল এক বিরাট ধনী ব্যক্তির পৃষ্ঠপোষকতা। এবার একজন বিশিষ্ট বাহুবলী হওয়ার পথে রাম। এই সময় চন্দননগর শহর পরিচালনা করছে ফরাসি প্রশাসক মণ্ডলী। ব্রিটিশ ভারতের মধ্যে একচিলতে ফরাসি উপনিবেশ। একটু ডাকাবুকো ছেলে হাতে রাখা জরুরি। রামের উপর নজর গেল ফরাসি সাহেবদেরও। কেষ্ট শেঠের পাশাপাশি এবার ফরাসি সাহেবদেরও নেকনজরে রাম চ্যাটার্জি। এই পর্বে বহু ঘটনা ঘটে যাচ্ছিল রামের জীবনে । রেলে লাইন সারাই করার জন্য সাহেব মেকানিকদের নিয়ে ছোট কেবিন ঠেলে নিয়ে যেতে হতো অকুস্থলে। এই কেবিন ঠেলার জন্য কেবিনবয়ের কাজ জুটল রামের । বিধবা মাকে নিয়ে ততদিনে পাশেই একটা বাড়িতে উঠেছে রাম। চুঁচুড়া চন্দননগর চত্বরে যুবক রামের তখন ব্যাপক নামযশ। ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে কাজ করা বহু ভারতীয় বিপ্লবীরা শেল্টার নিতে যেত ফরাসি সরকারের অধীনে থাকা চন্দননগরে। তাদের মুখেও ফিরত ডাকাবুকো রামের নাম। সেই সূত্র ধরেই কলকাতার বউবাজার, তালতলা, শিয়ালদহ চত্বরের বহু সশস্ত্র বিপ্লবী গোষ্ঠীর কাছে আগেই পৌঁছে গিয়েছিল রামের নাম । রাম চ্যাটার্জি বলে যে এক চরিত্র চন্দননগর কাঁপাচ্ছে সেকথা বিলক্ষণ জানতেন অনেকে। রামের কাছেও খবর পৌঁছতো মলঙ্গা লেনের দুর্দান্ত বাহিনীর কথা। সেই বাহিনীর কমান্ডার গোপাল চন্দ্র মুখুজ্জের কথাও পাড়ি জমাচ্ছিল কলকাতা থেকে চন্দননগর আর চন্দননগর থেকে কলকাতায়। টুকরো গল্প পেরিয়ে এক চিরায়ত আখ্যান যেন জন্ম নেওয়ার প্রাক মুহূর্তে দাঁড়িয়ে। এসবের মধ্যেই তেতাল্লিশের মন্বন্তর পেরিয়ে সময় দ্রুত গড়িয়ে যাচ্ছিল । বাংলার মসনদে তখন শহিদ সোহরাবর্দি । ধর্মীয় মেরুকরণ তখন বাংলার সমাজজীবনে, রাজনৈতিক জীবনে। এরই মধ্যে গোপাল পাঁঠা উদ্যোগ নিয়েছেন এক প্রতিরোধ বাহিনী গড়ে তুলবেন। নামও রাখলেন সেই বাহিনীর — ভারত জাতীয় বাহিনী। খবরটা পেয়েই রামের মনে হলো, সময় এসে গেছে। তার উচিত গোপাল বাহিনীতে যোগদান করা। চন্দননগর থেকে কলকাতার মলঙ্গা লেনে এসে পৌঁছলেন রাম । নবাগতর হাতে অস্ত্র তুলে দিলেন গোপাল পাঁঠা। আর ছুরি-চাকু-চেন নয়। একেবারে স্টেনগান। যেন নবজন্ম হলো রাম চ্যাটার্জির ।

আরও পড়ুন- গোপাল পাঁঠা : হিন্দুত্বের তাস না কি কলকাতা কাঁপানো মস্তান?

কেবিন থেকে ক্যাবিনেট

ছেচল্লিশ সালের দাঙ্গার দিনগুলোতে রাম চ্যাটার্জি রয়েছেন কলকাতায়, কলুটোলার আফগান মস্তানদের বিরুদ্ধে রেজিস্সিট্যান্স গ্রুপের সক্রিয় সদস্য হিসেবে, গোপাল পা^ঠার ভারত জাতীয় বাহিনীর সঙ্গে। এই বাহিনীর অন্যান্য সদস্যদের মতো রামকেও প্রতিরোধের জন্য আগ্নেয়াস্ত্র দিচ্ছেন গোপাল। এরপর একদিন ছেচল্লিশ সালের অভিশপ্ত দিনগুলো পেরিয়ে যাচ্ছে কিন্তু কলকাতা পুরোপুরি শান্ত হচ্ছে না । কারণ কলকাতার পরই জ্বলে উঠছে নোয়াখালি। এর রেশ এসে পড়ছে কলকাতার পূর্ব প্রান্তে, বেলেঘাটায়। এই দীর্ঘ পর্ব জুড়ে রাম চ্যাটার্জি রয়েছেন কলকাতায়, ক্রিক রো-তে বন্ধু ভানু বোসের আশ্রয়ে। এই পর্বেই চন্দননগরের রাম চ্যাটার্জি কলকাতার গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রদের সঙ্গে মিশে যান যারা আগামী দিনে কলকাতার প্রথম সংগঠিত আন্ডারওয়ার্ল্ডের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠবে। এই রক্তাক্ত ও জটিল সময়ের মধ্যে দিয়েই এল স্বাধীনতা। চন্দননগরে ফিরে গেলেন রাম কিন্তু কলকাতার যোগাযোগ পুরোদমে থেকেই গেল। এরপর আমরা চন্দননগরেই ১৯৫০ সালের দাঙ্গায় আবার পাচ্ছি রাম চ্যাটার্জিকে। পাচ্ছি ভবানী দল নামের একটি সশস্ত্র গ্রুপের কমান্ডার হিসেবে। এই পঞ্চাশ সালে চন্দননগরের দাঙ্গায় রাম চ্যাটার্জির সঙ্গে সঙ্গেই নাম জড়িয়ে যাচ্ছে গোপাল পাঁঠারও। এই সময়ে ১৯৫০ সালের ৩১ মার্চ আর ১ সেপ্টেম্বর দু'দফায় গ্রেফতার হন রাম চ্যাটার্জি। প্রথম দফার জেলযাত্রা কয়েকদিনের হলেও দ্বিতীয় দফার জেলযাত্রা দাঁড়াল প্রায় এক বছর। ১৯৫২ সালের ২৮ জুলাই জেল থেকে ছাড়া পান রাম চ্যাটার্জি। তখন অনেক কিছুই বদলে গেছে। ১৯৫১ সালে প্যারিসে চুক্তির মধ্যে দিয়ে স্বাধীন হয়েছে চন্দননগর। ফরাসিরা একে একে ছেড়ে চলে গেলেন তাদের প্রিয় শহর। পড়ে রইলেন কয়েকঘর ফরাসি যারা বাংলার মায়া ত্যাগ করতে পারেননি । রাম জেল থেকে বেরিয়ে দেখলেন এক অন্য চন্দননগরকে।

স্বাধীনতার পরপরই অধুনা সশস্ত্র বিপ্লবী বাহিনীগুলি রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ করতে শুরু করল। এভাবেই কলকাতা তথা বাংলায় সংগঠিত মস্তানরাজের শুরু। সশস্ত্র হামলা, ডাকাতি শাসক দলের হয়ে ভোটে কাজ করা এসবই হয়ে দাঁড়ায় এই দলগুলোর মুখ্য কাজ। রাম চ্যাটার্জিও এই সম্প্রদায়েরই একজন, তবে লাল বাজারের হিস্ট্রি শিট খুঁজে তাঁর বিরুদ্ধে খুব সংগঠিত অপরাধের তালিকা খুঁজে পাওয়া যায় না। মূলত তার রাজনৈতিক প্রভাবের কারণেই হয়তো বা! এখানেই রামের গল্প গোপাল পাঁঠা, ভানু বোস, জগা বোস, জারবাতি সকলের থেকেই আলাদা। বাকি সবাইকে পাঁকে রেখে একমাত্র তিনিই পদ্ম হয়ে ফুটে উঠতে পেরেছিলেন।

বাকিদের ক্ষেত্রে অস্ত্র, কালীপূজা, জলসা, বাহুবল ভাঙিয়ে ক্ষমতাশালী ব্যক্তি হয়ে ওঠা এই গল্পগুলো ছিল কিন্তু রাম বাহুবলে আটকে থাকলেন না। নিজেই রাজনৈতিক দল করতে শুরু করলেন। ফরোয়ার্ড ব্লকের যুবনেতা হিসেবে নিজেকে মেলে ধরতে লাগলেন রাম। বাহুবল তো ছিলই, তার সঙ্গে একটু একটু করে যুক্ত হতে লাগল রাজনৈতিক প্রভাব। রাম চ্যাটার্জি হলেন গল্পের খনি। তাকে ঘিরে গল্পের শেষ নেই। ফরোয়ার্ড ব্লক করেন রাম। একবার দেওঘরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে দলের সর্বভারতীয় সম্মেলন। সদ্য স্বাধীন দেশ, নানা আর্থিক প্রতিকূলতা। রাজনৈতিক দল ও চাঁদা আর অনুদান নির্ভর। কিন্তু বহু মানুষ এসেছেন সম্মেলনে যোগ দিতে। খাবারের আয়োজন যা করা হয়েছে তার চেয়ে লোকসংখ্যা বেশি। খাবারে টান পড়ায় অসন্তোষ বাড়ছে ক্যাম্পে। নেতারা বিচলিত। এরই মাঝখানে হঠাৎই রাম বলে উঠলেন, "চিন্তার কিছু নেই। আমি এখুনি আসছি।" বলেই কয়েকজন শাগরেদকে ইশারায় ডাকলেন, "একবার এদিকে আয় তো।" নেতারা এটুকু বোঝেন, রাম যখন দায়িত্ব নিয়েছে কিছু একটা হবে। হলোও তাই। কয়েক বস্তা চাল নিয়ে হাজির রাম বাহিনী। খুব সুন্দর করে কাজ উৎরে গেল। পরে এক নেতা রামকে এক গাল হেসে জিজ্ঞাসা করেন,

"কী ব্যাপার বলুন তো! এই দুর্দিনে কোথা থেকে জোগাড় করলেন এত বস্তা চাল?" উত্তরে উদাসীনভাবে রাম চ্যাটার্জি বলেন, "আরে এত বড় একটা আশ্রম আছে, চালের অভাব হয় নাকি!"

রামের কথা শুনে প্রশ্নকর্তা চোখ কপালে তুললেন, "সে কী মশাই, কোন আশ্রম...আপনি কি ...অনুকূল?"

"হ্যাঁ হ্যাঁ ওই অনুকূল চন্দ্রের সৎসঙ্গ আশ্রমের কথাই বলছি," প্রশ্নের মাঝখান থেকে ধরে নিয়ে উত্তর দিলেন রাম।

"অ্যাঁ কী বলেন!"

এতে কী বলার আছে! এত মানুষ অভুক্ত। আশ্রমে এত চাল-আনাজ আছে। ছেলেদের সঙ্গে করে সব উঠিয়ে নিয়ে এলাম," নির্বিকার রাম চ্যাটার্জি । যিনি শুনছেন তিনি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। পার্টি কর্মীদের খাওয়ানোর জন্য ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের সৎসঙ্গ আশ্রম লুঠ করেছেন রাম ।

রাম চ্যাটার্জির এটাই স্ট্র্যাটেজি। মানুষকে খাওয়াতে হবে। যেখানে বা যাদের কাছে আনাজ-শস্য মজুদ আছে। লুঠ করে নাও। তারপর বিলিয়ে দাও। এই বঙ্গীয় রবিনহুড সংস্কৃতি জীবনের শেষ পর্যন্ত চালিয়ে গেছেন রাম। এমনকী মন্ত্রী হয়েও লুঠের রাস্তা ছাড়েননি। ১৯৬৯ সালে দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকারের আমলে প্রথম মন্ত্রী হন রাম চ্যাটার্জি। সেবার বন্যায় তারকেশ্বর ভেসে যায়। বন্যা দুর্গত অঞ্চলে মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছনরও কোনও অবস্থা নেই। কাল বিলম্ব করেননি রাম। মন্ত্রী হয়েছেন বলে কি বদলে গেছেন নাকি! সটান দলবল নিয়ে হাজির হলেন পোস্তা বাজারে। রাজ্যের মন্ত্রী দাঁড়িয়ে থেকে লুঠ করাচ্ছে গোটা বাজার। দিনের আলোয় ট্রাক ভরে সেই শস্য-আনাজ গিয়ে পৌঁছল তারকেশ্বরে। রামের কীর্তির মাশুল গুনল রাজ্য সরকার। পোস্তা বাজারের ব্যবসায়ীদের ক্ষতিপূরণের টাকা দিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার। কার কী বলার আছে! রাম এরকমই। আর তাকে কে-ই বা কী বলবে? স্বয়ং জ্যোতি বসুর হাত রামের মাথায়। মন্ত্রিসভায় মন্ত্রীদের মধ্যে এ নিয়ে কানাঘুষো, অসন্তোষ কিন্তু মুখে রা কাড়বার জো নেই কারও। জ্যোতি বসুর অভয় হস্তে রাম চাটুজ্যে যেন রাম রাজত্ব ফেঁদে বসেছেন — এমনটাই গুঞ্জন রাইটার্স জুড়ে।

আরও পড়ুন- থ্রিলার দেখে কিলার! যেভাবে কলকাতার ত্রাস হয়ে উঠেছিল ভোঁদা মস্তান

মুখ্যমন্ত্রী তাঁর নিজের ঘরে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করছেন। কারও ঢোকা বারণ। বেশ কয়েকজন মন্ত্রী বাইরে অপেক্ষা করছেন। রাম চ্যাটার্জি মুখ্যমন্ত্রীর ঘরের বাইরে আধিকারিকদের কাছে জিজ্ঞাসা করলেন, কারা আছে বৈঠকে? আধিকারিকরা জানালেন, বেশ কয়েকজন বড় ব্যবসায়ী। শুনে রাম বললেন "ওহ"! তারপর মুখ্যমন্ত্রীর ঘরের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেলেন। কী একটা জরুরি ফাইল সই করানোর আছে। বাকি মন্ত্রী এমনকী মুখ্যমন্ত্রীর নিজের দলের লোকেরাও বাইরে বসে। রামের সঙ্গে জ্যোতি বসুর এমনই ছিল সম্পর্কের রসায়ন। একবার জ্যোতিবাবু সিউড়ি থেকে ফিরছেন। গাড়িতে যেতে যেতে লক্ষ্য করলেন দেওয়ালে দেওয়ালে লেখা, "রাম চ্যাটার্জির চিন্তাধারা দিকে দিকে ছড়িয়ে দাও"। তখনকার সময়ে সাধারণত দেওয়ালে নকশাল পন্থীরা লিখত মাও সে তুং-এর চিন্তাধারা দিকে দিকে ছড়িয়ে দাও। তার জায়গায় স্বয়ং রাম চ্যাটার্জির নাম দেখে বেশ পুলক অনুভব করলেন জ্যোতিবাবু। রাইটার্সে ফিরে পরের দিনই তলব করলেন রাম চ্যাটার্জিকে।

এত্তেলা পেয়ে মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে পৌঁছলেন রাম

- আপনি কি আমাকে ডেকেছেন?

ফাইল দেখছিলেন জ্যোতিবাবু। ফাইলেই চোখ রেখে জিজ্ঞাসা করলেন,

- আপনার চিন্তাধারাটা ঠিক কী?

- বুঝতে পারলাম না। কীসের চিন্তা, কী বলছেন?

- ওই যে দিকে দিকে ছড়ানোর ব্যাপারটা...

- কী ছড়ানোর ব্যাপার?

- আপনার চিন্তাধারা দিকে দিকে ছড়াচ্ছেন

- কী বলছেন বলুন তো! (একটু হেসে)

- সিউড়ি থেকে ফিরছিলাম, দেখি দেওয়ালে লেখা রাম চ্যাটার্জির চিন্তাধারা দিকে দিকে...

জ্যোতি বসুর মুখে এসব শুনে প্রবল লজ্জা পেয়ে রাম বললেন

- আর বলবেন না ছেলেরা ভালোবেসে লিখেছে

- না না চিন্তাধারা ভালো! শুধু দিকে দিকে ছড়াবার আগে আমাকে একটু দিয়ে যাবেন

জ্যোতি বসুর কথায় লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে রাম চ্যাটার্জির। বললেন, "কী যে বলেন!" খুব লজ্জা পেয়ে মুখ্যমন্ত্রীর ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন রাম। নিজের ঘরে আধিকারিকরা আসবেন। বৈঠক আছে।

নির্ধারিত সময়ে আধিকারিকরা ঢুকলেন অসামরিক প্রতিরক্ষা দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী রাম চ্যাটার্জির ঘরে। অফিসারদের ঢুকতে দেখেই মন্ত্রী বলে উঠলেন, "আসুন স্যার আসুন।" আধিকারিকরা লজ্জিত। একজন বললেন, "আমাদের স্যার প্লিজ স্যার বলবেন না!"

শুনে মন্ত্রী পাল্টা বলছেন, "কেন? আপনারাই তো পার্মানেন্ট আমাদের চেয়ারটিই অনিশ্চিত।" এহেন কথার কী আর উত্তর দেবেন আধিকারিকরা। অগত্যা চেয়ার টেনে বসলেন সকলে। মিটিং শুরু হলো।

তবে মন্ত্রী হিসেবে প্রথম রাম চ্যাটার্জি নজর কেড়েছিলেন ক্যালকাটা সুইমিং ক্লাব কাণ্ডে। তখন ১৯৬৯ সাল। দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী তিনি। শুনলেন, অভিজাত ক্যালকাটা সুইমিং ক্লাবে সাধারণ ভারতীয়ের ঢোকা বারণ। ব্রিটিশ রাজত্ব গেলেও কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে এখনও পুরনো নিয়ম চলছে। মন্ত্রীমশাই ডাইরেক্ট অ্যাকশনে বিশ্বাস করেন। নিয়ম-নীতি-রীতি কিছুর তোয়াক্কা তেমন করেন না। যদি সাধারণ মানুষের বিরোধী কিছু হয় রাম অ্যাকশনে নেমে পড়বেন। আর হলোও তাই। হঠাৎ একদিন হুগলি জেলা থেকে একদল আদিবাসী মানুষকে সঙ্গে করে ক্যালকাটা সুইমিং ক্লাবে ঢুকে পড়লেন মন্ত্রী। ঢুকেই সঙ্গে নিয়ে আসা সমবেত জনতাকে নির্দেশ দিলেন, "তোরা সবাই জলে নেমে পড়। সুইমিং পুলে চান কর। অনেক দূর থেকে এসেছিস। একটু জিরিয়ে নে।" এভাবেই সেদিন কলকাতার অভিজাত ক্লাবের অসম্মান সূচক নিয়মের বিরোধিতা করেছিলেন রাম চ্যাটার্জি।

(চলবে)

More Articles