বঞ্চিতদেরই শাস্তি, অত্যাচারীদের পুরস্কার! রাম মন্দিরের রায়ে ঠিক কী প্রমাণ করেছিল সুপ্রিম কোর্ট?
Babri Masjid Demolition and Ram Mandir Verdict : আদালত মন্দির ভেঙে মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছিল এমন যুক্তি প্রত্যাখ্যান করেছিল।
দেশ মন্দির চায়, না মসজিদ চায়, না সাধারণ মানুষের মৌলিক প্রয়োজনের কোনও কিছু সেই রায় দেওয়ার দায়িত্ব ছিল দেশের শীর্ষ আদালতের। অযোধ্যায় যে বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলা হয়েছিল, সেই বিতর্কিত জায়গা আসলে কাদের, এই নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলেছিল। অবশেষে দেশের শীর্ষ আদালত ২০১৯ সালের নভেম্বরে চূড়ান্ত রায়ে জানায় হিন্দুদের ভাগেই যাবে জমি। জমিতে অতঃপর যে রামমন্দিরই গড়া হবে এই নিয়ে কোনও দ্বন্দ্ব আর রইল না। অর্ধ-নির্মিত সেই রাম মন্দিরে রামের প্রাণ প্রতিষ্ঠা হচ্ছে, আর চিতা জ্বলছে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির।
সেই সময় দেশের প্রধান বিচারপতি ছিলেন রঞ্জন গগৈ। এই জমি বিরোধটিকে হিন্দু এবং মুসলিম দ্বন্দ্ব হিসাবে চিহ্নিত করেই রঞ্জন গগৈয়ের সুপ্রিম কোর্টের প্যানেল, বিচারপতি এস এ বোবদে, চন্দ্রচূড়, অশোক ভূষণ এবং এস আব্দুল নাজির ওই সমগ্র এলাকাটিই হিন্দুদের হাতে তুলে দেন। ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির জয় হয়। বৃহত্তর সংঘ পরিবারের পাশাপাশি গত কয়েক দশক ধরে রাম মন্দিরের মূল উদ্যোক্তা তারাই। হিন্দুদের পক্ষে কেন এই রায় দেওয়া হলো তা বোঝার জন্য, ২০১০ সালের এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়ের প্রেক্ষাপটে সুপ্রিম কোর্টের রায়কে বোঝা দরকার। হিন্দু পক্ষের দু'টি মূল বিরোধের জায়গা ছিল যে, বাবরি মসজিদটি সেই স্থানেই অবস্থিত যেখানে রাম জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং আগে সেখানে একটি রাম মন্দিরই ছিল, তা ভেঙে ফেলে বাবরি নির্মিত হয়েছিল।
বিচারপতি সুধীর আগরওয়াল এবং শর্মার রায়ে হিন্দুদের এই দুই নীতিকেই মান্যতা দেওয়া হয় এবং বলা হয় মসজিদটি ইসলামিক নীতির লঙ্ঘন করেছে। এই বিষয়র উপর ভিত্তি করে হাইকোর্ট জমিটিকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করে। এই তিনভাগে ভাগের বিষয়টি প্যানেলের তৃতীয় বিচারক বিচারপতি এসইউ খানও মেনে নেন যিনি তাঁর নিজের রায়ে একটি ভিন্ন যুক্তি উপস্থাপন করেছিলেন।
আরও পড়ুন- মোদির রামরাজ্যে ঠিক কেমন আছেন সাধারণ মানুষ?
রাম লালা মূর্তির স্থানটি (১৯৪৯ সালের ২২ ডিসেম্বর রাতে গোপনে ওই প্রাঙ্গণে স্থাপন করা হয়েছিল) রাম লালা বিরাজমান দলকেই দেওয়া হয়। অর্থাৎ রাম লালাকে জায়গাটি দেওয়া হয়। নির্মোহী আখড়ার পাওয়ার কথা ছিল সীতা রসোই এবং রাম চবুতরা। আর উত্তরপ্রদেশ সুন্নি সেন্ট্রাল ওয়াকফ বোর্ড, যেটি ১৯৪৪ সাল থেকে এই জমির মালিক ছিল, তাদের বাকি জমি পাওয়ার কথা ছিল। তিন পক্ষই এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে। এলাহাবাদ হাইকোর্ট হিন্দুদের প্রতিটি বিরোধিতাই গ্রহণ করে কিন্তু তারা সম্পূর্ণ জমি চেয়েছিল, তা আদালত দেয়নি। সুপ্রিম কোর্ট হিন্দুদের প্রতিটি বিরোধই প্রত্যাখ্যান করে কিন্তু হিন্দুরা যা চেয়েছিল তা দিয়ে দেয়।
রামের জন্মস্থান ইস্যুতে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বলা হয়, "বিশ্বাসের ভিত্তিতে জমির মালিকানা স্থাপন করা যাবে না... বিরোধটি স্থাবর সম্পত্তি নিয়ে। আদালত বিশ্বাস বা ভাবাবেগের ভিত্তিতে মালিকানা নির্ধারণ করে না, প্রমাণের ভিত্তিতে করে। আদালত মন্দির ভেঙে মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছিল এমন যুক্তি প্রত্যাখ্যান করেছিল। আদালত জানায় অন্তর্নিহিত কাঠামোর ধ্বংসের কারণ সম্পর্কে কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় না, মসজিদ নির্মাণের জন্য আগের কাঠামো ভেঙে ফেলা হয়েছে কিনা তারও প্রমাণ নেই। আদালত স্বীকার করে যে ঔপনিবেশিক আমলে মুসলিমদের উপাসনালয় ছিল সেখানে। তবে মুসলিমরা মসজিদ পরিত্যাগ করেছিল বা নামাজ পড়া বন্ধ করে দিয়েছিল এমন কোনও প্রমাণ নেই। বরং মৌখিক প্রমাণ এটাই বলে যে সেখানে নামাজ পড়া হতো।
আদালতের রায়ে বারবার অবৈধ অনুপ্রবেশ এবং শত্রুতামূলক কর্মকাণ্ডের জন্য হিন্দু পক্ষকেই দায়ী করা হয়েছে। ১৯৩৪ সালে মসজিদের ক্ষতি, ১৯৪৯ সালে মসজিদের পবিত্রতা নষ্ট করে মুসলিমদের ক্ষমতাচ্যুত করা এবং ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বাবরি ধ্বংস করা। এই কর্মের ফলস্বরূপ, মুসলিমদের ভুলভাবে এমন একটি মসজিদ থেকে বঞ্চিত হয়েছে যা ৪৫০ বছরেরও বেশি আগে নির্মিত হয়েছিল।
এতদূর পড়ে মনে হবে এ তো মুসলিমদের পক্ষেই বলা হয়েছে, অবিচারের কথাই বলা হয়েছে। কিন্তু আদালত তার রায়ে এই 'ভুলভাবে বঞ্চিত' মুসলিমদের কাছ থেকে জমি কেড়ে নেওয়ার এবং মসজিদের ক্ষতি, ধ্বংসের জন্য দায়ীদেরই জমিটি দেয়। অর্থাৎ যারা বঞ্চিত, যারা আক্রমণের শিকার তারা কিছুই পেল না, পেল অত্যাচারী, অপরাধীরাই! কেন?
আরও পড়ুন- রামরাজ্যের নারী ও নারীর রামরাজ্য
আদালত বলে, ১৮৫৭ সালের আগে জায়গাটির যে মুসলিম মালিকানাই ছিল তার প্রমাণ অপর্যাপ্ত। ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশদের আউধ অধিগ্রহণের আগে হিন্দুদের উপাসনালয় প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনার প্রমাণেরই প্রাধান্য রয়েছে। ষোড়শ শতাব্দীতে নির্মাণের তারিখ থেকে ১৮৫৭ সালের আগে ওইখানে যে মুসলিমদেরই একচেটিয়া দখলে ছিল তার কোনও প্রমাণ মুসলিমরা দিতে পারেনি। তাই হিন্দুদের মালিকানার দাবির বিষয়ে যে প্রমাণগুলি রয়েছে তা মুসলমানদের দেওয়া প্রমাণের চেয়ে বেশি যুক্তিযুক্ত।
মসজিদটি মুঘল যুগে নির্মিত হয়েছিল। ১৮ এবং ১৯ শতকের ভ্রমণকাহিনি এবং ইতিহাসে এর উল্লেখ করা হয়েছিল। বহু শতাব্দী ধরে এই মসজিদ ভালোভাবেই সংরক্ষিত ছিল। এই সময়কালে মুসলিম রাজাদেরই শাসিত এলাকায় এর অবস্থান ছিল। ব্রিটিশ শাসনের উত্থানের পর ১৯ শতকের মাঝামাঝি ব্রিটিশ কর্মকর্তারা মুসলিমদের উপাসনার স্থান হিসাবেই এই জায়গাটিকে নথিভুক্ত করে। । কিন্তু ১৮৫৭ সালের আগে যে মুসলমানদেরই ওই এলাকার একচেটিয়া অধিকার ছিল তার প্রমাণ কম। নির্মোহী আখড়া বা রাম লালার প্রতিনিধি বা রাজনীতিবিদ ও মিডিয়ায় তাদের সমর্থকদের কেউই কিন্তু যুক্তি দেয়নি যে মসজিদটি নির্মিত হওয়ার সময় থেকে বিবাদের সময় পর্যন্ত মুসলিমদের অধীনে ছিল না ওই জমি। সেই রায়ে জমিটি হিন্দুদের পক্ষেই যায়।
এই রায় দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে চিরতরে বদলে দিয়েছে এমনটা বললে খুব একটা ভুল বলা হয় না আর। ক্ষমতাসীন বিজেপি কেন এই মন্দির উদ্বোধনকে দেশের নতুন জন্ম বলছে তা জানার আর বাকি থাকে না। বিজেপি নিজের নির্বাচনী ইস্তেহারে যে দাবি করেছিল তা সম্পূর্ণ করেছে। দেশ রামমন্দির পেয়েছে, দেশ ধর্মনিরপেক্ষতা হারিয়েছে।