প্রজ্ঞায় মাত গোটা বিশ্ব, বিস্ময়কিশোর হারিয়েছিল বিশ্বসেরা দাবাড়ু কার্লসেনকেও!
Praggnanandhaa: ২০১৬ সালে মাত্র ১০ বছর ৯ মাস বয়সে আন্তর্জাতিক মাস্টারের খেতাব জিতেছে চেন্নাইয়ের এই দাবাড়ু।
শিশুসুলভ মুখ। ইতিউতি চাহনি আর কপালে সাদা তিলক। দেখে বোঝার জো নেই এই ছেলের কী তীক্ষ্ণ বুদ্ধি! ভারত তথা বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল ১৬ বছরের এই কিশোর। আলোড়ন তৈরির নেপথ্যে রয়েছে দাবার চালে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নকে হারানোর কথা। ভারতীয় গ্র্যান্ডমাস্টার আর প্রজ্ঞানন্দ হারিয়ে দিয়েছিলেন বিশ্ব দাবা চ্যাম্পিয়ন ম্যাগনাস কার্লসেনকে। তাও আবার ৩৯ চালের মাথায়। আর তাতেই আশার সঞ্চার হয় ভারতীয় দাবাপ্রেমীদের মনে।
তবে কে এই বিস্ময় কিশোর তা জানতে ফিরে যেতে হবে আজ থেকে কয়েক বছর আগে। ২০০৫ সালের ১০ আগস্ট চেন্নাইয়ে জন্ম হয় আর প্রজ্ঞানন্দের। আত্মীয়- বন্ধুবান্ধব ভালোবেসে 'প্রাগ' ,'প্রগ্গু' বলে ডাকে। বাবা ব্যাংক কর্মচারী রমেশ বি এবং মা নাগলক্ষ্মীর দ্বিতীয় সন্তান আর প্রজ্ঞানন্দ। বড় মেয়ের টিভি দেখা নিয়ে খুবই চিন্তিত ছিলেন রমেশ এবং নাগলক্ষ্মী। মেয়ে সারাদিন বুঁদ হয়ে থাকত টিভিতেই। প্রজ্ঞার বাবা নিজেই সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, "বৈশালীর টিভি দেখার অভ্যাস কমাতেই ওকে দাবা শেখানো হয়। কিছুদিন পরে দেখি আমাদের দুই সন্তানই দাবা খেলায় আগ্রহ দেখাচ্ছে"। এয়ারথিংস মাস্টার্স অনলাইন র্যাপিড দাবা প্রতিযোগিতায় কার্লসেনকে হারিয়ে বিশ্ব দাবামহল আলোড়িত করে এই কিশোর।
তবে এই প্রথম নয়, আন্তর্জাতিক ম্যাচে জয় এসেছে অতীতেও। ২০১৩ সালে সাত বছর বয়সে অনূর্ধ্ব- ৮ ওয়ার্ল্ড ইউথ চ্যাম্পিয়নশিপ জেতে প্রজ্ঞা। এরপর ২০১৬ সালে মাত্র ১০ বছর ৯ মাস বয়সে আন্তর্জাতিক মাস্টারের খেতাব জিতেছে চেন্নাইয়ের এই দাবাড়ু। ২০১৮ সালে প্রজ্ঞা ভারতের দ্বিতীয় সর্বকনিষ্ঠ গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাবও জিতে নেয় প্রজ্ঞা। কিন্তু কে ভেবেছিল সে হারিয়ে দেবে কার্লসেনের মতো তারকা খেলোয়াড়কে?
২০১৩ সালে প্রথমবার বিশ্বখেতাব জিতেছিলেন ম্যাগনাস কার্লসেন। এরপর যতদিন গড়িয়েছে ক্রমশই ধরা ছোঁয়ার উর্ধ্বে নিয়ে গেছেন নিজেকে। পাঁচবার বিশ্বখেতাব জয়ের কীর্তি রয়েছে তাঁর ঝুলিতে। তা সত্ত্বেও কিস্তিমাত করেছে প্রজ্ঞানন্দ। অষ্টম রাউন্ডেই কার্লসেনের তরী ডুবিয়ে দেয় প্রাগ। এর আগে মাত্র দু'জন ভারতীয়ই হারাতে পেরয়েছেন কার্লসেনকে। বিশ্বনাথন আনন্দ এবং পি হরিকৃষ্ণ। কিন্তু এত অল্প বয়সে কোনও ভারতীয় এমনকী বিশ্বের কেউই কার্লসেনকে হারাতে পারেনি। এখানেই অনন্য প্রজ্ঞানন্দ। তবে শুধু কার্লসেন নয় বিশ্বের ছ’নম্বর লেভ অ্যারোনিয়ানকেও এই প্রতিযোগিতায় হারিয়েছে প্রাগ।
দাবার পাশাপাশি ছোট থেকেই দক্ষিণি সুপারস্টার রজনীকান্তের ভক্ত প্রজ্ঞা। অবসর কাটায় প্রিয় সুপারস্টারের সিনেমা দেখেই। প্রজ্ঞার রোল মডেল ভারতের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার বিশ্বনাথ আনন্দ। এই প্রতিযোগিতায় তাঁর মেন্টরও ছিলেন আনন্দ। কঠোর সাধনারই ফল এই কৃতিত্ব। যাতে অন্য কোনওদিকে মন না যায় তাই নেটমাধ্যম থেকেও দশহাত দূরে থাকে প্রজ্ঞা। বাবা রমেশবাবু জানিয়েছেন যে ছেলের ধ্যানজ্ঞান সবই দাবা। এমনকী ঘুমের মধ্যেও দাবা খেলে ছেলে।
গোটা বিশ্বের পাশাপাশি ইতিহাস সৃষ্টিকারী কিশোরকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন ভারতীয় ক্রীড়াতারকারা। উচ্ছসিত তাঁর কোচ বি আর রমেশও। ভারতীয় ক্রিকেটের লিটিল মাস্টার সচিন তেন্দুলকার অভিনন্দন জানিয়ে ট্যুইট করেন, "প্রাগের দারুণ এক অনুভূতি হচ্ছে নিশ্চয়ই। মাত্র ১৬ বছর বয়স এবং এই মুহূর্তে সবচেয়ে অভিজ্ঞতা এবং কৌশলী ম্যাগনাস কার্লসেনকে হারিয়ে দিল! তাও কিনা কালো ঘুঁটিতে, ম্যাজিকের মতো মনে হচ্ছে।"
প্রজ্ঞার মেন্টর বিশ্বনাথ আনন্দও উচ্ছসিত হয়ে সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, "ওর যে জিনিসটা আমার সবচেয়ে ভালো লাগে তা হলো ওর লড়াই করার ক্ষমতা। প্রতিপক্ষের আক্রমণ সহ্য করার পাশাপাশি কীভাবে প্রত্যাঘাত করতে হবে তাও ও জানে। প্রতিযোগিতার প্রথম দিনটি ওর খারাপ গেলেও পরের দু'দিন অবিশ্বাস্য দু'টি জয় জিনিয়ে নিয়েছে । ওর লড়াকু মানসিকতা সত্যিই দেখার মতো।"
কার্লসেনকে হারানোর ২৪ ঘণ্টা পরে প্রজ্ঞানন্দ নিজের চারটি ম্যাচের দু'টিতেই জিতেছে। একটি ড্র এবং অন্যটিতে হেরেছে রুশ সুপার গ্র্যান্ডমাস্টার ইয়ান নেপমনিয়াচচির বিরূদ্ধে। দুই ম্যাচে জয় ও একটিতে ড্রয়ের পরে বারো নম্বরে স্থানে ছিল এই কিশোর। তবে স্বপ্নভঙ্গও হয়। কার্লসেনকে হারিয়েও প্রতিযোগিতার নকআউট পর্বে আর খেলা হয়নি না তাঁর। রাউন্ড রবিন পর্বে এবার প্রথম আট জন খেলবেন। প্রাগ প্রতিযোগিতা শেষ করেন ১৯ পয়েন্টে এবং তাঁর স্থান হয় একাদশ। ১৫ টি ম্যাচের পাঁচটিতে জয়ী প্রজ্ঞা। ড্র করেছে চারটি ম্যাচে এবং হার ছ'টি ম্যাচে। তাই নক আউট পর্ব থেকে বাদ পড়ে যান প্রজ্ঞা। তবে কার্লসেনের বিরূদ্ধে সেই চমকে আজও মজে রয়েছেন দাবাপ্রেমীরা।