দেশের হয়ে ব্যাট ধরেননি কখনও, তাঁর নামেই রঞ্জি! কে এই রাজা?
Ranji Trophy: মজার ব্যাপার, যে মহারাজা রঞ্জিতসিংজির ভারতীয় ক্রিকেটে এত রমরমা, তিনি ভারতের হয়ে ক্রিকেট খেলেননি কস্মিনকালেও।
ক্রিকেটপ্রিয় দেশ। একেবারে বিদেশি এই বাইশগজের খেলা যে কবে কখন দেশবাসীর মনে পাকাপাকি জায়গা করে নিল, তা বলা কঠিন। ক্রিকেট আজ আর শুধু জনপ্রিয়তম খেলার নাম নয়, একই সঙ্গে আম ভারতীয়ের এক আবেগের জায়গাও বটে। প্রিয় খেলা, প্রিয় খেলোয়ারের জন্য উন্মাদনার কোন জায়গায় পৌঁছে যেতে পারে দেশবাসী, তা চোখে না-দেখলে বিশ্বাস করা মুশকিল।
ভারতবর্ষ খেলার দেশ। আজ থেকে নয়, প্রাচীন কাল থেকেই এ দেশের বাসিন্দারা খেলাধুলোপ্রিয়। কুস্তি, শতরঞ্জ, হাডুডু, পাশা, কত খেলাই যে ভারতের ইতিহাস জুড়ে ছেয়ে রয়েছে, তা গুনে শেষ করা কঠিন। যুগ যুগ ধরে ভারতে এসেছে নানা ঔপনিবেশিক শক্তি। তারা যেমন ভারতকে শোষন করেছে, শাসন করেছে, লুঠ করেছে ভারতের সম্পদ, তেমনই দিয়েও গিয়েছে নিজেদের সংস্কৃতির খণ্ড খণ্ড অংশ। সেভাবেই ভারতে এসেছে নানা বিদেশি খেলাধুলাও। কোনও কোনও ক্ষেত্রে দেশজ খেলাকেও ছাপিয়ে গিয়েছে সেইসব খেলাগুলির জনপ্রিয়তা। যেমন ধরুন, ক্রিকেটের কথাই। ব্রিটিশ শক্তির হাত ধরেই ভারতে ঢুকে পড়েছিল ক্রিকেট। তার পর ছিনিয়ে নেয় ভারতের জনপ্রিয়তম খেলার শিরোপা।
আরও পড়ুন: ক্রিকেটের শেষ ঈশ্বর, আমজনতার শেষ ভরসা সচিনই?
আমরা চোখ মেললেই ইদানীং আন্তর্জাতিক ক্রিকেটই দেখি শুধু। হালে অবশ্য জায়গা করে নিয়েছে আইপিএল বা টি-টোয়েন্টি নামক বাহারি এবং বিনোদনমূলক খেলাটি। তবে তার গায়েও লেগে থাকে আন্তর্জাতিক ছোঁয়াচ। তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট বাদ দিলেও আন্তর্দেশীয় ক্রিকেটের ইতিহাসও কিন্তু কোনও অংশে খাটো নয় এ দেশে। যারা একটু আধটু ক্রিকেট সম্পর্কে খবর রাখেন, তাঁরা কমবেশি সকলেই রঞ্জি ট্রফির নাম শুনেছেনই। একটা সময় পর্যন্ত ভারতীয় ক্রিকেট দলে সুযোগ পেতে হলে রঞ্জি ছিল প্রবেশদ্বার। সৌরভ, সচিন থেকে বিরাট কোহলি, রঞ্জি খেলেননি এমন ভারতীয় ক্রিকেটার খুঁজে পাওয়া কঠিন।
অনেকেই জানেন, এই রঞ্জি ট্রফির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে জাম নওয়ানগর জাম সাহেব রঞ্জিতসিংজির নাম। তবে এই জাতীয় স্তরের এই প্রথম শ্রেণির চ্যাম্পিয়নশিপটির ভাবনা আদতে ছিল বিসিসিআইয়ের প্রতিষ্ঠাতা এ.এস ডি মেলো-র। ১৯৩৪ সালের জুলাই মাসে শিমলায় বৈঠক চলাকালীন প্রথম এই রঞ্জি চ্যাম্পিয়নশিপের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করে ফেলে বিসিসিআই। সে সময় টুর্নামেন্টটির নাম ছিল অবশ্য 'দ্য ক্রিকেট চ্যাম্পিয়নশিপ ইন ইন্ডিয়া'। পরে পাটিয়ালার মহারাজা ভূপিন্দর সিং এই টুর্নামেন্টের ট্রফিটি দান করেন। পরবর্তীকালে টুর্নামেন্টটির নাম রাখা হয় রঞ্জিতসিংজির নামে। যিনি ভারতীয় ক্রিকেটের জনক বলে ইতিহাসে পরিচিত হয়ে রয়েছেন। এ পর্যন্ত গল্পটা অনেকেরই জানা।
কিন্তু মজার ব্যাপার, যে মহারাজা রঞ্জিতসিংজির ভারতীয় ক্রিকেটে এত রমরমা, তিনি ভারতের হয়ে ক্রিকেট খেলেননি কস্মিনকালেও। সে সময় ভারতে রাজত্ব করছে ব্রিটিশ শক্তি। তাদের হাত ধরেই ভারতে এসে পৌঁছেছিল বাইশ গজের এই খেলা। এ দেশে ক্রিকেট মানেই তখন ইংরেজদের পক্ষে খেলা। মহারাজা রঞ্জিত সিং খেলতেন টেস্ট ক্রিকেট। ১৮৯৬ সাল তেকে ১৯০২, এই সময়টায় ইংল্যান্ডের হয়ে টানা ক্রিকেট খেলেন তিনি।
সাসেক্সের হয়ে ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট খেলতেন রঞ্জিত সিং। বলাই বাহুল্য, সেই সময়ের সাপেক্ষে দুর্দান্ত খেলতেন রঞ্জিত। ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে তাঁর গড় রান ছিল ৫৬। রানের খিদে ছিল তাঁর মারাত্মক। ব্যক্তিগত সেরা রান ছিল তাঁর ২৮৫। আজকের দিনেও যে সংখ্যাটায় পৌঁছনো ক্রিকেটারদের জন্য খুব একটা সহজ নয়। তাঁর প্রথম ম্যাচ ছিল ইংল্যান্ডের হয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে। ম্যাচ অস্ট্রেলিয়ার পকেটে গেলেও ৬২ এূং ১৫৪ রানে অপরাজিত থেকে ছিলেন রঞ্জিত সিং। আদতে সেই প্রথম ম্যাচেই জাত চিনিয়ে দেন রঞ্জিত সিং। ইংরেজদের খেলোয়ার চিনতে ভুল হয়নি। আরও একটি ম্যাচে শতরান করেন রঞ্জিত। তাঁর সংগ্রহে মোট রান এক হাজারের কাছাকাছি। গড় ওভার ৪৪। ক্রিকেটের ময়দানে নিজস্ব একটি স্টাইলের জন্ম দিয়েছিলেন রঞ্জিত। আর তাই তাকে করে তুলেছিল ক্রিকেটের তৎকালীন সুপারস্টার।
শরীরের রাজরক্ত প্রকাশ পেত বাইশ গজেও। সেই একইরকম রাজকীয়তা নিয়েই ব্যাট ধরতেন তিনি। ১৯৩২ সালে প্রথম বার টেস্ট ক্রিকেটের জগতে পা রাখল ভারত, আর ১৯৩৩ সালে ইহলোক ছাড়লেন রঞ্জিত। নিজের দেশের হয়ে ক্রিকেট আর খেলা হল না তার। তবে ভারত যে টেস্ট ক্রিকেটের বাউন্ডারিতে পা রাখতে পারল, তার পিছনে কম কৃতিত্ব ছিল না এই মানুষটার। ভারতীয়রাও যে ক্রিকেট খেলতে পারেন, তা ইংরেজদের সামনে তুলে আনতে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি মহারাজাকে। অবশেষে এল সাফল্য। কিন্তু দেশের হয়ে ব্যাট ধরা হল না আর রাজার।
১৯৩৪-৩৫ সাল নাগাদ দেশে প্রথম বার অনুষ্ঠিত হল প্রথম রঞ্জি ট্রফি টুর্নামেন্ট। রঞ্জিত সিং রইলেন না। কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে থেকে গেলেন এই মহারাজা। সেই ম্যাচে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বম্বে। বম্বের খেলোয়ারদের হাতে উঠেছিল মহারাজা রঞ্জিত সিং নামাঙ্কিত ট্রফি।
আরও পড়ুন: ক্রিকেট-দুনিয়ায় আজও বিতর্কিত ‘মানকরিং’ আউট! কোন ইতিহাস রয়েছে আড়ালে
সেই থেকে আজ পর্যন্ত চলে আসছে আন্তর্দেশীয় এই রঞ্জি ট্রফি টুর্নামেন্ট। যেখান থেকে উঠেছে ভারতের সেরার সেরা সমস্ত ক্রিকেটার। ফুটবলে বিশ্বমঞ্চে জায়গা করতে পারেনি ভারত। কিন্তু বাইশ গজের লড়াইয়ে যেভাবে আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রতিনিয়ত লড়ছে, জিতছে ভারত, তার অনেকটাই কৃতিত্ব কিন্তু বর্তায় ইতিহাসের এই মানুষটির ঘাড়ে। ক্রিকেট আর দেশপ্রেম আজ অনেকটাই এক নিক্তিতে মাপা হয়। তাতে পুরোপুরি ভুল নেই হয়তো। কিন্তু দেশ কাল সময় ভেদে খেলার জন্য়ই খেলা, তার সূচনা বোধহয় কোথাও হয়ে গিয়েছিল মহারাজা রঞ্জিত সিংয়ের হাত ধরেই।