ইন্ডিয়া জোটের রাজ্যেই অত্যাচারিত মহিলারা? আসলে কতটা মহিলাদরদি বিজেপি?

Modi in Barasat: ২০২২-২০২৩ সালে প্রতিদিন গড়ে ছয়জন করে মহিলা ধর্ষিতা হয়েছেন গুজরাত রাজ্যে। আহমেদাবাদ শহরে প্রতিদিন একজন করে মহিলা ধর্ষিতা হন।

সন্দেশখালি যে বাংলায় লোকসভা ভোটের বড় ফ্যাক্টর হতে চলেছে তা প্রাক-ভোট প্রচারের প্রথম সভা, আরামবাগে এসেই স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি। বাংলাজুড়ে এখন রাজনৈতিক মহলে রোজই বড়সড় খবর। বুধবার বারাসত থেকেও একই বার্তা, মহিলাভোটকেই সবচেয়ে গুরুত্ব দিলেন মোদি। সন্দেশখালি প্রসঙ্গে তৃণমূলকে আক্রমণ করতে গিয়ে বুঝিয়ে দিলেন, যেখানে ইন্ডিয়া জোটের সরকার রয়েছে সেখানেই মহিলাদের উপর অত্যাচার সবচেয়ে বেশি! তাই ইন্ডিয়া জোটকে, খাতায় কলমে যার অংশ তৃণমূলও, পরাস্ত করতে হবে মহিলাদেরই। সত্যিই কি ইন্ডিয়া জোটের শরিক দলের রাজ্যগুলিতেই মহিলারা সবচেয়ে অত্যাচারিত, সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তাহীন? বিজেপি শাসিত রাজ্যে সবচেয়ে সম্মানিত মহিলারা? পরিসংখ্যান তো তেমন বলছে না।

মহিলাদের ক্ষমতায়ন নাকি মোদির গ্যারান্টি। কিন্তু তৃণমূল সরকারই মহিলাদের কল্যাণমূলক কেন্দ্রীয় প্রকল্প রাজ্যে চালু হতে দেয় না। যেমন বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও প্রকল্প চালু করতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু মোদির সরকার যে মহিলাদরদি তা প্রমাণ করতে নরেন্দ্র মোদি রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর কথা উল্লেখ করেছেন। দেশের রাষ্ট্রপতি একজন আদিবাসী মহিলা। তা নিশ্চয়ই, কিন্তু দ্রৌপদীর ভূমিকা কী? নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধন হোক বা রামমন্দিরে রামলালার প্রাণ প্রতিষ্ঠা- কেন দ্রৌপদী মুর্মুকে দেখা যায় না? রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ বলছেন, দ্রৌপদী মুর্মুকে রাষ্টপতি নির্বাচন করা আসলে আদিবাসী ভোট টানার কৌশল ছিল মোদির। তাতে আদিবাসীদের আখেরে কোনও কল্যাণ হয়নি। কোনও উন্নতি হয়নি দলিতদের বা মহিলাদের। খাতায় কলমে দ্রৌপদী রাষ্ট্রপতি হয়েছেন কিন্তু বহু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে তাঁর অনুপস্থিতি প্রমাণ করে দেয় আদিবাসী দ্রৌপদী অনিবার্য নন।

আরও পড়ুন- কাশ্মীর থেকে মণিপুর, ক্ষমতার হাতিয়ার যখন ‘ধর্ষণ’

মোদি বলছেন, ইন্ডিয়া জোট শাসিত রাজ্যেই মহিলারা লাঞ্ছিত। গুজরাতের রাজ্য সরকার সম্প্রতি বিধানসভায় প্রকাশ করেছে একটি প্রতিবেদন। তাতে দেখা যাচ্ছে, ২০২২-২০২৩ সালে প্রতিদিন গড়ে ছয়জন করে মহিলা ধর্ষিতা হয়েছেন সেই রাজ্যে। আহমেদাবাদ শহরে প্রতিদিন একজন করে মহিলা ধর্ষিতা হন। সে রাজ্যের সরকার জানিয়েছে, ধর্ষণের মামলায় ১৯৪ জন আসামি এখনও গ্রেপ্তারই হয়নি। গুজরাতে বিজেপিই শাসক।

গত বছরে মে মাসে নগ্ন করে মহিলাদের ঘোরানো হয় প্রকাশ্য রাস্তায়। জাতিদাঙ্গার মধ্যে পড়ে সবচেয়ে বেশি ভুগতে হয় মহিলাদেরই। এক দল অন্যদলের মহিলাদেরই ধর্ষণ করে 'শাস্তি' দিতে চায়। একাধিক ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের হয় মণিপুরে। মণিপুরে বিজেপিই শাসক।

২০২৩ সালের নভেম্বরে আইআইটি-বিএইচইউ প্রাঙ্গণে ২২ বছর বয়সি এক তরুণীকে গণধর্ষণের অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া তিন অভিযুক্তের মধ্যে দু'জন কুণাল পান্ডে এবং সক্ষম প্যাটেল বিজেপি আইটি সেলের বারাণসী ইউনিটের কো-অর্ডিনেটর ছিলেন, অন্য অভিযুক্ত অভিষেক চৌহানও একই ইউনিটের অংশ ছিলেন। উত্তরপ্রদেশ বিজেপি শাসিত রাজ্য।

উন্নাও ধর্ষণকাণ্ডে সাজাপ্রাপ্ত কুলদীপ সিং সেঙ্গার ছিলেন প্রাক্তন বিজেপি বিধায়ক। হাথরাস বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশেই অবস্থিত। সমস্ত রাজ্যের মধ্যে, আইপিসি এবং বিশেষ ও স্থানীয় আইনের অধীনে মহিলাদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ সংখ্যক নথিভুক্ত মামলা উত্তরপ্রদেশেই দেখা যায়। ২০২১ সালে উত্তরপ্রদেশে মহিলাদের বিরুদ্ধে ৫৬,০৮৩টি অভিযোগ নথিভুক্ত করা হয়েছে। ধর্ষণ, গণধর্ষণ সহ হত্যা বিভাগের উত্তরপ্রদেশে শুধু ২০২২ সালেই ৬২টি মামলা হয়েছে। পণের জন্য মৃত্যুর ক্ষেত্রেও এগিয়ে উত্তরপ্রদেশ।

তাছাড়া বিজেপি নেতাদের বিরুদ্ধে ধর্ষণ, শ্লীলতাহানির সরাসরি অভিযোগ বা ধর্ষকদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগও নতুন তো নয়। কিছুকাল আগেই রাজস্থান পুলিশ স্থানীয় ভারতীয় জনতা পার্টির এক নেতা এবং অন্য তিনজনের বিরুদ্ধে এক মহিলাকে গণধর্ষণ এবং তার নাবালিকা মেয়েকে শ্লীলতাহানির অভিযোগে মামলা দায়ের করে। আবাসিক প্রকল্পে একটি প্লটের চুক্তির বিষয়ে বিজেপি নেতা মোহন জাটের সঙ্গে দেখা করেছিলেন ওই মহিলা। বিজেপি নেতা ও তার সঙ্গে উপস্থিত বাকিরা তাঁকে যৌন নির্যাতন করে এবং তার নাবালিকা মেয়েকে শ্লীলতাহানি করে বলে অভিযোগ ওঠে।

আরও পড়ুন- পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বাকে গণধর্ষণ, বিলকিস বানো মামলার নেপথ্যে যে ভয়াবহ ইতিহাস

২০১৭ সালের মার্চ মাসে বিজেপি নেতা ভোজপাল সিং এবং তার দুই সহযোগীর বিরুদ্ধে মধ্যপ্রদেশের মোরেনায় বিপিএল কার্ড পেতে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরে এক দলিত মহিলাকে গণধর্ষণ করার অভিযোগে মামলা করা হয়েছিল।

সে বছরই ফেব্রুয়ারি মাসে গুজরাতের বিজেপি নেতা জয়েশ প্যাটেলের বিরুদ্ধে ২২ বছর বয়সী নার্সিং ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করা হয়।

গুজরাতেরই কচ্ছ জেলায় ২৪ বছর বয়সি এক মহিলাকে ১০ জনের গণধর্ষণের অভিযোগ ওঠে যার মধ্যে চারজন স্থানীয় বিজেপি নেতা ছিল।

২০১৬ সালের ডিসেম্বরে মধ্যপ্রদেশের বাইতুল জেলায় এক আদিবাসী মহিলা শ্লীলতাহানির মামলা প্রত্যাহার করতে অস্বীকার করায় স্থানীয় বিজেপি নেতা এবং তার পাঁচ সহযোগী মিলে তাঁকে গণধর্ষণ করে বলে অভিযোগ।

১০১৬ সালেরই নভেম্বরে ইন্ডিগো এয়ারলাইন্সের গোয়া-আমেদাবাদ বিমানে ১৩ বছরের এক কিশোরীকে শ্লীলতাহানির জন্য গুজরাতের স্থানীয় বিজেপি নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।

সে বছর জুলাই মাসে উত্তরাখণ্ড পুলিশ বিজেপি নেতা হরক সিং রাওয়াতের বিরুদ্ধে একজন ৩২ বছর বয়সি মহিলাকে ধর্ষণ ও হেনস্থার অভিযোগ দায়ের করে।

২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে দিল্লির একটি আদালত ফরিদাবাদের একটি হোটেলে এক মহিলাকে মাদক সেবন ও ধর্ষণের অভিযোগে গুরগাঁও থেকে বিজেপি নেতা উমেশ আগরওয়ালকে গ্রেফতার করে।

২০১৪ সালের অগাস্টে মধ্যপ্রদেশের বিজেপি নেতা হামিদ সরদার এবং একজন মহিলা সহ আরও পাঁচজনকে অসমের এক নাবালিকাকে যৌন নিপীড়ন ও পাচারের মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়।

২০১৩ সালের নভেম্বরে কর্ণাটকের চিকমাগালুর জেলায় এক মহিলাকে অপহরণ ও ধর্ষণের জন্য জেলার শৃঙ্গেরির বিজেপি নেতা ডি এন জীবরাজের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়।

২০১৩ সালের জুলাই মাসে মধ্যপ্রদেশের প্রাক্তন মন্ত্রী রাঘবজির বিরুদ্ধে তাঁর পরিচারিকা যৌন নির্যাতনের অভিযোগ আনেন।

সেবছরই প্রবীণ বিজেপি নেতা এবং মহারাষ্ট্রের তৎকালীন দলীয় মুখপাত্র মধু চভানের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। এমন আরও বহু বহু ক্ষেত্র প্রমাণ করে বিজেপির সরকারের অধীনে মহিলাসুরক্ষা আসলে ফাঁপা শব্দ। সন্দেশখালি এখন মহিলাদের আস্ত ভোটব্যাঙ্ক। তাই লোকসভাপর্ভ না মেটা অবধি এই টোপ দিয়ে ভোট টানার খেলা চলবেই। 

More Articles