বিবেকানন্দর মন্ত্রোচ্চারণে বেলুড়ে সেদিন যেভাবে শুরু হয়েছিল উৎসব

Ras Festival: বেলুড় রাসবাড়ির ঐতিহ্যমণ্ডিত রাস উৎসবের কথা জানলে অবাক হতেই হয়‌।

পৃথিবীর সব স্তরের মানুষের মধ্যে ভালবাসা বিতরণের যাবতীয় কর্মকাণ্ড, একদিন ধীরে ধীরে ধর্মীয় ব্যঞ্জনার উৎসবে পরিণত হয়েছিল। যে ব্যঞ্জনায় কেবল মিলন ছিল না, ছিল শক্তি ও ভক্তির মিলিত আরাধনাও। তবে, এই সাজো সাজো রবের আরাধনার মত্ততা থেকে কিছু মানুষ আর কিছু তিথি প্রতিবারই নিজেদের বিযুক্ত করে, অন্তরাত্মার শুদ্ধিকরণের চেষ্টা করে গেছে নিজেদের মতো করে। তেমনই একটি বিশেষ তিথি হলো রাস, যার সূচনা হয় কার্তিক-পূর্ণিমা তিথিতে। সাধারণার্থে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে গোপী-দের নৃত্যযোগের রসউল্লাসকেই রাস বলে অভিহিত করি আমরা।

মূলত বৈষ্ণবীয় ভাবধারায় গড়ে উঠলেও, রাধাকৃষ্ণের এই মিলোনোৎসব বাংলার এক এক স্থানে, এক এক মতে পালন করা হয়। এই মতবিরোধ আমাদের মধ্যে যতটা না তাত্ত্বিক ভাবধারাকে ফুটিয়ে তুলতে সাহায্য করে, তার চেয়ে বেশি তৈরি করে ধর্মীয় দ্যোতনা, যার ফলে উৎসবের ক্ষেত্রগুলো ছোট হয়ে আসে, প্রাধান্য পায় নিজস্বতা।

ষোড়শ শতাব্দীর প্রারম্ভে নবদ্বীপে সূচনা হয় এই উৎসবের। এখানে রাধাকৃষ্ণের সঙ্গে নানা পৌরাণিক হিন্দু দেবদেবীর রূপকেও পূজিত হতে দেখা যায়। নবদ্বীপজুড়ে প্রায় প্রতিটি পুজোতেই শাক্ত রীতির পূর্ণ প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। অন্যদিকে, নদিয়ার শান্তিপুরের রাস মূলত শ্রীশ্রীঅদ্বৈতাচার্যর বৈষ্ণব রীতির মূল ভাবধারায় গড়ে উঠলেও, এখানে বৈষ্ণব ও শাক্ত এই দুইয়ের মিলনেই, রাসের প্রেমসাধনার ভক্তি আর লীলার ভাব, একসূত্রে মিলিত হতে দেখা যায়। যার ফলে তিনদিনব্যাপী এই উৎসবে এখানে বিগ্রহ বাড়ি এবং বারোয়ারি পুজোগুলির মধ্যে এই উভয় রীতিরই প্রকাশ দেখতে পাই আমরা। এর পাশাপাশি কোচবিহারের মদনমোহনতলার রাস এবং মণিপুরের রাস উৎসবও পরিচিত সকলের কাছেই।

আরও পড়ুন: কে বেশি প্রাচীন, শান্তিপুর না কি নবদ্বীপ? রাসযাত্রা ঘিরে একাধিক কাহিনি আজও অবাক করে

আজ বলব বেলুড় রাসবাড়ির ঐতিহ্যমণ্ডিত রাস উৎসবের কথা। তবে মূল উৎসব নিয়ে লেখার আগে এই পরিবারে রাসের দিনে ঘটে যাওয়া এক ঐতিহাসিক ঘটনার কথা বলি।

১৮৯৮ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি। বেলুড় মঠের অদূরে এক বিশাল বাগানঘেরা রাসবাড়ি ভরে গেছে শত শত মানুষের কলতানে। শোনা যাচ্ছে, ভেতরে নাকি স্বামীজি এসেছেন। একটু পরেই বক্তৃতা দেবেন। অসংখ্য মানুষ এক এক করে এগিয়ে আসছেন তাঁকে শুভেচ্ছাবার্তায় ভরিয়ে দিতে। ওদিকে বাগবাজার থেকে নৌকাযোগে এসে পড়েছেন স্নেহধন্যা ভগিনী নিবেদিতাও। উদ্দেশ্য, সকলে মিলে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের ৬৫তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন করা। সঙ্গে এই উদযাপনকে কেন্দ্র করে বহু সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছনো এবং মাধ্যমেই স্বামীজির আগামী কর্মসূচির লক্ষ্য স্থির করা। এত কিছুর আয়োজন যে স্থানকে ঘিরে, সেই গঙ্গাতীরের রাসবাড়ির কথা বলব আজ।

বেলুড়ের রাস

উত্তর কলকাতার সুবিখ্যাত শিবকৃষ্ণ দাঁ-র বাড়ির দুর্গাপুজোর কথা আমরা এতদিনে প্রায় প্রত্যেকেই জেনে গেছি। তবে দুর্গাপুজো ছাড়াও এই পরিবারের আরেকটি বিশেষ উৎসব হলো রাস, যে উৎসবকে কেন্দ্র করে বেলুড়ের রাসবাড়িতে প্রতি বছর কার্তিক-পূর্ণিমার দিন থেকে শুরু করে টানা ৩ দিনব্যাপী উৎসব পালন করা হয় মন্দির প্রাঙ্গণজুড়ে। বাংলার ১২৯৭ সালের ২১ জৈষ্ঠ‍্য, অর্থাৎ ইংরেজির ১৮৯০ সালের জুন মাসে এই রাসবাড়ি প্রতিষ্ঠা করেন শিবকৃষ্ণ দাঁ-র জ‍্যেষ্ঠপুত্র পূর্ণচন্দ্র দাঁ। মূলত রাধারমণ জিউ-র মন্দির নামে পরিচিত হলেও, বর্তমানে এই রাস বাড়ি দু'টি অংশে বিভক্ত, যার প্রথম অংশে মূল প্রবেশদ্বার থেকে একটু এগিয়েই রয়েছে রাধারমণ জিউর মূল নবরত্ন মন্দির, যা উচ্চতায় প্রায় ৪০ ফুট। এই মন্দিরের গর্ভগৃহে সারা বছর কাঠের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত থাকেন কষ্টিপাথরের বংশীধারী শ্রীকৃষ্ণ এবং রাধিকা। ঠিক এর পাশেই রয়েছে সুসজ্জিত পুনর্নির্মিত রাসমঞ্চ, যেখানে সারা বছর ধরেই দেখতে পাওয়া যায় শ্রীকৃষ্ণের অষ্টসখীদের এবং এর পাশেই রয়েছে নাটমন্দির। রাসমঞ্চের দু'পাশে দণ্ডায়মান দুই নহবতখানা আজও সেজে ওঠে উৎসবের দিনগুলোয়। সারাদিনের পূজার্চনার সঙ্গে সঙ্গে গঙ্গার পাড়ে বসে সানাইয়ের সুর ভেসে এলে মনে হয়, ওই বুঝি অন্তরাত্মা শুদ্ধ হলো সুরের সাধনায়। এই গঙ্গার পাড়েই রয়েছে এই পরিবারের নিজস্ব বাঁধানো ঘাট এবং তার ঠিক দু'পাশেই গড়ে উঠেছে ২১ ফুট উঁচু ছ'টি আটচালা শিব মন্দির গঙ্গার মুখোমুখি। ঠিক মন্দির প্রাঙ্গনের মাঝামাঝি স্থানে রয়েছে এক সুবৃহৎ ঘড়িস্তম্ভ। গঙ্গাবক্ষে সন্ধের আলো যখন ঝলমলিয়ে ওঠে রাসবাড়িজুড়ে, তখন ঘড়ির স্তম্ভের চতুর্দিক থেকে ঠিকরে আসা আলো দেখে হঠাৎ করে মনে পড়ে যায়, অতীতকালের রাজার বাড়ির ঠাকুরদালানের কথা।

প্রতি বছর কার্তিক-পূর্ণিমার তিথিতে নতুন করে সেজে ওঠে এই রাসবাড়ি প্রাঙ্গন। সেই উপলক্ষে প্রতি সন্ধ্যায় দোলার সিংহাসনে রাধারমন জিউ ও রাধিকাকে বসিয়ে ভক্তিগীত-সহযোগে মূল মন্দির থেকে প্রতিস্থাপন করা হয় রাসমঞ্চে। তারপরেই শুরু হয় সন্ধ্যারতি, বাজি পোড়ানো এবং রাসমঞ্চজুড়ে প্রদীপদানের উৎসব।

কোনও উৎসবই সম্পূর্ণ হয় না মেলা ছাড়া। তেমনই দাঁ-বাড়ির এই উৎসবকে কেন্দ্র করেও বেলুড়ের লালবাবা কলেজের নিকটবর্তী এই অঞ্চলও, হরেক পসরার নানান রঙে সেজে ওঠে প্রতিবার টানা সাতদিন ধরে। তবে, রাস উৎসবের পাশাপাশি এই মন্দিরে পালিত হয় ঝুলন ও জন্মাষ্টমীও।

দাঁ-বাড়ি

এই রাসবাড়ির (বর্তমান নাম রাসবাড়ি গার্ডেন হাউজ) আরেকটি অংশজুড়ে তৈরি হয়েছে সুসজ্জিত বিলাসবহুল হেরিটেজ হোমস্টে, সেখানে একদিকে যেমন রয়েছে থাকবার ও খাবার ব্যবস্থা, তেমনই অপর দিকে রয়েছে পিকনিক করার নানা আয়োজন। তাই ধর্মীয় উৎসব ছাড়াও যে কোনও সময়ে গঙ্গার পাড়ে দু'দিন হওয়া বদলাবার পরিকল্পনা থাকলে, যে কেউ আরামে কাটিয়ে আসতে পারেন এই গার্ডেন হাউজ থেকে। এই গার্ডেন হাউজে হাওড়া থেকে বালি হয়ে আসা ছাড়াও আরও একটি উপায় হলো বরাহনগরের কুটিঘাট থেকে জলপথে বেলুড়ে আসা।

রাসবাড়ির ভেতর যে স্থানে দাঁড়িয়ে স্বামীজি একদিন মন্ত্রোচ্চারণ করেছিলেন, সেখানেই আজ স্থাপিত রয়েছে তাঁর স্মরণে একটি মূর্তি। এমন এক ইতিহাস-সম্বলিত তীর্থস্থান, যেখানে বৈষ্ণবীয় ভক্তিরসের আরাধনা হয়ে চলেছে বিগত ১৩২ বছর ধরে ইতিহাসের এক বিশেষ মুহূর্তকে সাক্ষী নিয়ে, তেমন যুগ্ম নিদর্শন দেখলে আবারও নতুন করে বিস্মিত হতে হয় আমাদের সময়ের কাছে।

More Articles