'ইনসান কো ইনসান সমঝে!' শ্রমিকদের বাঁচানোর পুরস্কারমূল্য ফিরিয়ে যা চাইলেন ব়্যাটহোল মাইনার্সরা

Uttarakhand Tunnel Rescue: উত্তরকাশীর এই সুড়ঙ্গ থেকে উদ্ধারকাজ সফল হওয়ার পর যখন প্রত্যেক শ্রমিককে ৫০ হাজার টাকা করে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিং ধামি।

একে একে হাত তুলে দিয়েছিল সব যন্ত্র। ফুরিয়ে আসছিল প্রযুক্তি। ক্রমশ কমছিল আশা। সেই সময় সেই জন হেনরির মতোই হাতে হাতুড়ি তুলে নিয়েছিল একদল শ্রমিক। যাঁদের পরিচয় ব়্যাটহোল মাইনার্স বলে। ব়্যাটহোল মাইনিংয়ের কাজ যথেষ্ট ঝুঁকির বলে এ দেশে নিষিদ্ধ এই ধরনের কাজ। তবে ৪১ জন শ্রমিকের ওই বিপদের মুহূর্তে রক্ষাকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন তাঁরাই। নিজেদের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে ইঁদুরের মতো গর্ত খুঁড়ে খুঁড়ে ওই সুড়ঙ্গের ভিতরে ঢুকেছেন তাঁরা। হাতে যন্ত্র নিয়ে ভেঙে ভেঙে সাফ করে দিয়েছেন শ্রমিকদের বেরিয়ে আসার পথ। তাঁদের জন্যই ফের আরও একবার পৃথিবীর আলো জল বাতাস ফিরে পেয়েছেন ওই ৪১ জন শ্রমিক।

সেদিনের উদ্ধার অভিযানে হাত লাগিয়েছিলেন ১২ জন ব়্যাটহোল মাইনার্সদের একটি দল। মাত্র ৬০ মিলিমিটার চওড়া একটি পাইপের ভিতরে খুঁড়ে খুঁড়ে শ্রমিকদের কাছে পৌঁছনোর কাজটা সহজ ছিল না মোটেই। যেখানে আবার প্রতি মুহূর্তে ধসের ভয়। কিন্তু ৪১টি নিরপরাধ শ্রমিককে প্রাণে বাঁচানোর থেকে জরুরি সেসময় কিছুই ছিল না। তাই প্রাণের পরোয়া করার কথা মাথায়ও আসেনি সেসময় তাঁদের।

মুন্না কুরেশি, মনু কুমার, ফিরোজ কুরেশি, নাসির খান, যতীন, দেবেন্দ্র কুমার, ওয়াকেল হাসান, ইরশাদ আনসারি, রশিদ আনসারি, নাসিম মালিক, সৌরভ ও অঙ্কুর। ওই বারো জন ব়্যাটহোল মাইনার্স শ্রমিকদের দলে বেশিরভাগই দলিত, মুসলিম কিংবা অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি থেকে উঠে আসা মানুষ। প্রায় প্রতিটি পরিবারেরই বসবাস দারিদ্রসীমার নিচে। সুদিনের আশায়, আরও একটু ভালো থাকার আশায় তাঁরা প্রত্যেকে এসে পড়েছেন এই ঝুঁকির পেশায়। কেউ পড়েছে সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত তো কেউ মাধ্যমিকের চৌকাঠ থেকে ফিরেছেন। তবে মানবিকতার উপরে যে কোনও ধর্ম নেই, সেটুকু শিখে নিতে কোনও পুঁথিগত বিদ্যার প্রয়োজন হয়নি তাঁদের। জীবিকার প্রয়োজনে হাতে ছেনি হাতুড়ি তুলে নিতে হয়েছিল, দুটো পয়সার মুখ দেখবেন বলে। এদিকে ব়্যাটহোল মাইনিংয়ের কাজে বেতন খুবই সামান্য। এই সব পাইপের কাজে ১২ ঘণ্টা প্রতি মাত্র ৫০০ টাকা করে পান তাঁরা। কখনও বা তা-ও মেলে না। পরিশ্রমে শরীর ভেঙে আসে। তবু দু'টো টাকা পাওয়ার আশায় খেটে চলেন ওঁরা।

আরও পড়ুন: দেখা হল না ছেলের সঙ্গে! হাসপাতালে বসেই বাবার মৃত্যুসংবাদ পেলেন সুড়ঙ্গ-শ্রমিক

উত্তরকাশীর এই সুড়ঙ্গ থেকে উদ্ধারকাজ সফল হওয়ার পর যখন প্রত্যেক শ্রমিককে ৫০ হাজার টাকা করে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিং ধামি। এই টাকার জন্যই তো এত ঝুঁকি, এত পরিশ্রম! অথচ কী আশ্চর্য, একবাক্যে অত বড় অঙ্কের টাকা নিতে প্রত্যাখ্যান করে দিলেন ওই ব়্যাটহোল মাইনিং শ্রমিকের দল। ওই দলে থাকা বছর পঁয়ত্রিশের রশিদ বললেন, মজদুর ভাইদের তাঁদের মজদুর ভাইয়েরা বের করে এনেছে, তাতে আর অবাক কী! বরং এই প্রশংসা এই হাততালি পেয়ে অবাক তাঁরা, আপ্লুত। ওই সরু পাইপের মধ্যে ৬ ঘণ্টা একাটানা খননের কাজ করে গিয়েছেন উত্তরপ্রদেশের বাগপতের বাসিন্দা রশিদ। তাঁর মতোই ওই সুড়ঙ্গে উদ্ধারকাজে হাত লাগান বছর পঁয়তাল্লিশের ইরশাদ। এইসব পুরস্কারমূল্য বা প্রশংসা নয়, "ইনসান কো ইনসান সামঝে অর দেশ মে মহব্বত বনি রহে, বস ইতনি সি খোয়াইশ হ্যায়।" সত্যি কি খুব বেশি চেয়েছেন ইরশাদেরা? এই ছোট্ট স্বপ্নটুকুই তো দেখার কথা দেশের সমস্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের। অথচ এ দেশেই বারবার উস্কে উঠেছে ধর্মীয় রাজনীতি। মরতে হয়েছে আখলাক, পেহেলু খানদের। কখনও বা শেষ হয়ে যেতে হয়েছে রোহিত ভেমুলার মতো দলিত ছাত্রকে। বিভাজনের এই রাজনীতি তবু শেষ হয়নি। তবু এইসব বিপদের সময় কীভাবে যেন এই সমস্ত ধর্মাধর্মের উপর উঠে ভাবতে শিখে যায় মানুষ। এমনকী যারা ধর্মের ভিত্তিতে দেশ গড়ার কথা বলা বলে, তাঁরাও। বিশেষত প্রতিপক্ষ যদি প্রকৃতি বা পরিবেশের মতো সর্বশক্তিমান হয়। সে জন্য়ই তো বন্দি শ্রমিকদের উদ্ধারে সাহায্য়ের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন দলিতেরা, মুসলিম সংখ্যালঘু বা অনগ্রসর শ্রেণির একদল শ্রমিক।

‘Rat hole’ miners lauded for India tunnel rescue hope for greater recognition

 

প্রায় ২৬টি ঘণ্টা ওই সুড়ঙ্গের ভিতর হাতে করে খোঁড়া। এ যেন দুঃসাধ্য কাজ। সমস্ত আধুনিক মেশিন, যন্ত্রপাতি যেখানে হাত তুলে দেয়, সেখান থেকে শুরু হয় খেটে খাওয়া মানুষের ম্যাজিক। যেমনটা ঘটিয়েছেন ১২ জন ব়্যাটহোল মাইনিং শ্রমিক। ওই দলেই ছিলেন ফিরোজ কুরেশি। যাঁকে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে দেখা গিয়েছে শ্রমিকদের উদ্ধারের জন্য। জানান, "মানুষ আমাদের উপরে যে আশা,ভরসা করেছে, তাকে হারতে দিতে পারিনি।" সুড়ঙ্গের ভিতরে প্রতি পদে পদে অপেক্ষা করেছে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ। বিরাট পাথরের মধ্যে দিয়ে ড্রিল করতে করতে যাওয়া, ধস নামার ভয়। তবু হাতুড়ি থামাননি তাঁরা। শিল্পীর মতোই একনিষ্ঠ ভাবে ছেনি হাতুড়ি শেষপর্যন্ত রাস্তা করে দিয়েছে শ্রমিকদের বেরিয়ে আসার। তবু এমন ঘটনা যেন বারবার না হয়। সরকারের কাছে, প্রশাসনের কাছে এ যেন একান্ত অনুরোধ ফিরোজের। জানান, এমন বিপদের দিনে বারবার মানুষকে বাঁচাতে ছুটে আসবেন তাঁরা। তবে এমন বিপদ যেন কারওর না হয়, তা দেখার জন্য আবেদন করেন তিনি সরকারের কাছে।

১৭ দিন বাদে সুড়ঙ্গে থেকে বেরিয়ে ওই সব ব়্যাটহোল মাইনার্সদের জড়িয়ে ধরেছিলেন বন্দিরা। ধন্যবাদ জানিয়েছেন বারংবার। মুন্না, যতীন, নাসেররা তাঁদের জানিয়েছেন, "ঈশ্বর বাঁচিয়েছেন। ধন্যবাদ তাঁকে দাও।" তবু এই সাফল্য, সুড়ঙ্গ থেকে শ্রমিকদের একে একে বেরিয়ে আসা কাঁদিয়ে দিয়েছিল তাঁদের। ৩৩ বছরের মুন্না জানান, "যখনই খনির ভিতরে ক্লান্ত হয়েছি, ততবার মনে করেছি আমার দশ বছরের ছেলেটার মুখ। আসার আগে যে আমাকে বলে দিয়েছিল, ফিরতেই হবে আমাকে। ওই শ্রমিকদের নিরাপদে বের করে এনে ফিরে আসতে হবে নিজের পরিবারের কাছে।" গোটা উদ্ধারকাজ চলাকালীন বাড়ি থেকে আসা একটাও ফোন ধরেননি মুন্না। পাছে মনোঃসংযোগে ব্যাঘাত ঘটে। ১৫ বছর ধরে এই পেশায় রয়েছে মুন্না। একটা ছোটখাটো চাষের জমি রয়েছে তাঁদের। হয়তো তাতে চাষ করেই দিন চলে যেত তাঁদের। মুন্না ভাবেন, হয়তো এই দিনটা দেখার জন্যই তাঁদের এই পেশায় আসা!

আরও পড়ুন:মুড়ি আর পাথর চুঁইয়ে পড়া জল! সুড়ঙ্গের যে ভয়ঙ্কর যুদ্ধের কথা শোনালেন ঝাড়খণ্ডের রাজেন্দ্র

ওই বারো জনের ব়্যাটহোল মাইনার্স দলটিকে নেতৃত্ব দেন যিনি, সেই ৪৫ বছরের ওয়াকিল অনবরত সাহস জুগিয়ে গিয়েছেন তাঁর দলের সদস্যদের। শ্রমিকদের ফিরিয়ে আনার পর ওয়াকিল জানান, "ইদেও কখনও এত আনন্দ পাইনি, যা আজ পেয়েছি।" সুড়ঙ্গে বন্দি শ্রমিক উদ্ধারে সাফল্য আসতেই হিরোর মুকুট উঠেছে ওই সব ব়্যাটমাইনিং কর্মীদের মাথায়। ৩২ বছরের নাসির জানান, "কোনও নায়ক হিসেবে নয়, আমাদের মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হোক।" এই উদ্ধারকাজের স্মৃতি ফিকে হয়ে যাবে যখন, তখনও যেন কোনও নাসির, ফিরোজ বা আলমকে পাকিস্তানে চলে যাওয়ার কথা শুনতে না হয়।

এত বিরাট মাপের উদ্ধারকাজ দেশে আগে কখনও ঘটেছে বলে মনে পড়ে না। হাজার হাজার উদ্ধারকর্মী, স্থানীয় পুলিশ, দমকল, বিপর্যয় মোকাবিলা দল থেকে শুরু করে সেনা, এনডিআরএফ, দক্ষ সব ইঞ্জিনিয়ার, দেশ বিদেশ থেকে আসা বিশেষজ্ঞ দল। সকলের মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া আদৌ কি সম্ভব হত এই উদ্ধারকাজ! হয়তো না! তবে সেই যে বসে যাওয়া রথের চাকাকে নড়াতে শেষপর্যন্ত রশিতে হাত দিতেই হয়েছিল 'হাল লাঙল চরকা তাঁতের'। ওরাই যে চিরটাকাল মানুষের সমস্ত প্রয়োজনে "টানে দাঁড়, ধরে থাকে হাল"! আর এ সত্যের যে কোনও বিকল্প হয় না, তা ফের একবার প্রমাণ করে দিল সিল্কিয়ারার সুড়ঙ্গে বন্দি শ্রমিকদের উদ্ধারের ঘটনা। 'জয়-- মহাকালনাথের জয়!'

More Articles