সতীর অঙ্গ থেকে বিচ্ছুরিত আলো দেখেছিলেন তান্ত্রিক, কিংবদন্তির ঠিকানা এই জেলা

বহু তন্ত্রসাধক এবং ব্রহ্মচারী এই শক্তিপীঠে এসেছেন।রত্নাবলী শক্তিপীঠের অন্যতম সাধক ছিলেন কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। তিনি এখানে তন্ত্রসাধনা করেছেন, মন্দিরের খুব নিকটেই অবস্থিত শ্মশানে। এই শক্তিপীঠ হিন্দুদের একটি অতি-পবিত্র স্থান...

৫১ সতীপীঠের অন্যতম রত্নাবলী সতীপীঠ। হুগলি জেলার খানাকুলে অবস্থিত। পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে খণ্ডিত সতীর দক্ষিণ স্কন্ধের অঙ্গ এখানে পতিত হয়েছিল। 'কাব্য মীমাংসা'-য় এই পীঠের উল্লেখ আছে। এখানকার অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন 'কুমারী'। এখানকার ভৈরব 'ঘণ্টেশ্বর'। এই শক্তিপীঠে দেবীর তুলনায় ভৈরবের প্রাধান্যই বেশি।

ভৈরব ঘণ্টেশ্বরের মন্দির আগে প্রতিষ্ঠিত হয় এখানে, এবং পরবর্তীকালে মাতৃমন্দির প্রতিষ্ঠা হয়। পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে বহুকাল পূর্বে খানাকুলের পাশের গ্রামের বাসিন্দা বটুক কারক নামে এক ব্যক্তির গরু এই অঞ্চলটিতে একটি শিমুল গাছের নিচে এসে দাঁড়িয়ে নিজে থেকেই রোজ দুধ দিত। ফলে গরুটি বাড়িতে আর দুধ দিত না। প্রত্যহ এই ঘটনা ঘটতে থাকার ফলে বটুক কারকের সন্দেহ হয়। তিনি একদিন চুপি চুপি গরুটিকে অনুসরণ করেন এবং শিমুল গাছের নিচে গরু দাঁড়িয়ে আপনা থেকেই দুধ দিচ্ছে, এটি লক্ষ করেন। এই দৃশ্য দেখে তিনি আশ্চর্য হয়ে যান। তখনই তিনি লোকজন এনে শিমুল গাছের গোড়ায় খুঁড়তে থাকেন এবং সেখান থেকে বেরিয়ে আসে একটি শিবলিঙ্গ। প্রচলিত জনশ্রুতি অনুসারে এই শিবলিঙ্গটিই 'বাবা ঘণ্টেশ্বর'। এই ঘটনাটি ঘটার কয়েকদিন পর স্বরূপনারায়ণ ব্রহ্মচারী (ইনি ছিলেন বর্ধমানের জমিদার পরিবারের বংশধর) খানাকুলে আসেন এবং একদিন গভীর রাত্রে তিনি দেখতে পান, শিমুল গাছের পাশে একটি জায়গা থেকে আলোর রশ্মি বেরিয়ে এসে জায়গাটিকে আলোকিত করে তুলেছে। সেখানে গিয়ে তিনি একটি পাথরের টুকরো দেখতে পান। তৎক্ষণাৎ তিনি ধ্যানে বসে স্তব করতে থাকেন এবং ধ্যানযোগে তিনি জানতে পারেন, সতীর দক্ষিণ স্কন্ধের অঙ্গ এখানে পড়ে আছে, এবং এই শিলাখণ্ডটিই দেবীর সেই অঙ্গ।

এরপর স্বরূপনারায়ণ ব্রহ্মচারী স্বপ্নাদেশ পান দেবী মূর্তি তৈরি করার জন্য। স্বরূপনারায়ণ ব্রহ্মচারী দেবী মূর্তি তৈরি করেন এবং প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী জীবন তিনি মায়ের সাধনায় এখানেই কাটিয়ে দেন এবং এই স্থানেই দেহত্যাগ করেন। কিন্তু সেই পাথরের টুকরোটি স্বরূপনারায়ণ ব্রহ্মচারী কোথায় রেখে গিয়েছিলেন, আজ পর্যন্ত তা জানা যায়নি এবং তিনি কাউকে বলেও যাননি। এখানে বর্তমানে এই শুধুমাত্র দেবী মায়ের মূর্তিটিই রয়েছে।

আরও পড়ুন: দেবীর কণ্ঠনালী থেকে বিষ্ণুর চরণ-চিহ্ন, বাংলার এই সতীপীঠে যেতেই হবে পুন্যার্থীকে

প্রথম দিকে দেবী মাতা ও ভৈরবের দু'টি মন্দিরই ছিল মাটির তৈরি, চালা ছিল তালপাতায় ছাওয়া। পরবর্তীকালে গ্রামবাসীরা মন্দিরের জন্য জমি দান করেন এবং পাকা মন্দির তৈরি করেন। মন্দিরগুলি প্রায় ৭০০ বছরের পুরনো। যেহেতু এখানে ভৈরব ঘণ্টেশ্বর প্রাধান্য পান, তাই ভৈরব ঘণ্টেশ্বরের মন্দিরটির আকারও বিশাল।

এখানে আছে একটি নাটমন্দির। দেবী মাতা এখানে কুমারী হিসেবে পূজিতা হন। তাই দেবী মাতার মন্দিরটি ছোট এবং ছিমছাম। মন্দিরের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে রত্নাকর নদী, দেবী এখানে কালী মূর্তিতে বিরাজিতা। এখানে দেবী মাতার রূপ হল চতুর্ভূজা, দিগম্বরী, মুণ্ডমালিনী এবং করালবদনী। দেবীর দুই বামহাতে খাঁড়া ও অসুরের মাথা এবং দুই ডানহাতে বর দানের ভঙ্গি ও অভয় মুদ্রা। দেবী মায়ের মাথায় মুকুট, গলায় হার। পায়ের নিচে শুয়ে আছেন দেবাদিদেব মহাদেব। প্রত্যেক সতীপীঠে একজন ভৈরব থাকেন এবং এই ভৈরব, মাতার স্বামী হিসেবে পরিগণিত হন। কিন্তু রত্নাবলীতে দেবী 'কুমারী'। মন্দিরের পাশ দিয়ে রত্নাকর নদ বয়ে যাওয়ার জন্য কেউ কেউ দেবীকে 'রত্নাবলী' নামে ডাকেন কিন্তু স্থানীয়দের কাছে তিনি 'মা আনন্দময়ী' নামেই পরিচিতা।

দেবী ও ভৈরবের মিষ্টি, ফলমূল ও অন্নভোগ-সহ নিত্যপুজো হয়। সন্ধ্যার সময় সন্ধ্যারতিটি হয় অত্যন্ত দর্শনীয়। দূরদূরান্ত থেকে লোকে আরতি দেখতে উপস্থিত হয় এবং বিভিন্ন উপাচার-সহ পুজোও দেয়। কথিত আছে, কুমারী মাতার কাছে মানত করলে সেই মানত পূরণ হয়। মানত পূরণ হওয়ার পর এখানে ছাগবলিও দেওয়া হয়। কার্তিক মাসের অমাবস্যায় কালীপুজো ও মাঘ মাসের রটন্তি চতুর্দশীতে দেবীর বিশেষ পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এখানে আশ্বিন ও চৈত্র মাসে বড় করে নবরাত্রি উৎসব পালিত হয়। এছাড়া চৈত্র মাসে শিবের গাজন, মহা-শিবরাত্রিতে বিশেষ পূজা অনুষ্ঠিত হয় ভৈরব ঘণ্টেশ্বরের মন্দিরে। নিয়ম করে এখানে এখনও গাজনে মূল সন্ন্যাসী হন বটুক কারকের পরিবারের সদস্যরা। শিবরাত্রিতে বাবা ঘণ্টেশ্বরের কাছে অনেক মানুষ আসেন অসুখ সারাতে। বেলপাতার বদলে নারকেলের উপাচার দিয়ে বাবার মানত করা হয়। এখানকার কুণ্ডের জল খুব পবিত্র। জনশ্রুতি শোনা যায়, এই কুণ্ডের জল খেয়ে অনেকের টিউমার সেরে গেছে।

বহু তন্ত্রসাধক এবং ব্রহ্মচারী এই শক্তিপীঠে এসেছেন।রত্নাবলী শক্তিপীঠের অন্যতম সাধক ছিলেন কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। তিনি এখানে তন্ত্রসাধনা করেছেন, মন্দিরের খুব নিকটেই অবস্থিত শ্মশানে। এই শক্তিপীঠ হিন্দুদের একটি অতি-পবিত্র স্থান এবং পুণ‍্যতীর্থ।

 

More Articles