ইতিহাসের সত্য সামনে এলে তবেই ফিরবে বাংলাদেশের গণতন্ত্র
Bangladesh Quota Protest: এবারের ছাত্র আন্দোলনে সবথেকে বড় প্রাপ্তি নিঃসন্দেহে ইতিহাসের পুনর্মুল্যায়ন। এই বিনির্মাণের পরিসর তৈরি করতে দীর্ঘ সময় লেগে গেল।
ইতিহাস এভাবেই কখনও ফিরে ফিরে আসে। শুধু পাত্রপাত্রী, কাল, সময়, প্রেক্ষাপট বদলে যায়। তুমি যতই চেষ্টা করো না কেন, ইতিহাসের সত্য চিরকাল চেপে রাখা যায় না। পাকিস্তানের স্বৈরাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে লাগাতার আন্দোলন, সংগ্রাম করে শেষ পর্যন্ত জয় ছিনিয়ে নিয়েছিল পুর্ব বাংলার জনগণ। জন্ম নিয়েছিল স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ। বিনিময়ে দিতে হয়েছিল অজস্র প্রাণ। ভেসে গিয়েছিল হাজার হাজার পরিবার। ঊনসত্তর, একাত্তরের গণঅভ্যূত্থানের আখ্যান আজও অস্বীকার করে না বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম। বংশপরম্পরায় তারা শোনে মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের কথা। বাংলাদেশের এমন কোনও পাড়া, মহল্লা, অলিগলি, গ্রাম, মফস্বল নেই, যেখানে বসবাসকারী পরিবারগুলি কোনও না কোনওভাবে ১৯৭১ এর গণসংগ্রামে ক্ষতিগ্রস্ত হননি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ। সর্বস্তরের লড়াই। বছরের পর বছর যুদ্ধ শুধু আওয়ামী লীগ করেছে এই সম্পূর্ণ মিথ্যা ইতিহাস নির্মিত হয়েছে মূলত এপার-ওপারের তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের দৌলতে। তারা কখনও ভুলেও মওলানা ভাসানীর কথা বলেন না। যে বামপন্থী দলগুলো দেশের মধ্যে একাধিক গেরিলা ঘাঁটি গড়ে মুক্তিসংগ্রামে দুরন্ত ভূমিকা নিয়েছিল, তার কথা আওয়ামী লীগের এবং এদেশে তাদের সমর্থক গোষ্ঠী ভুলেও বলে না।
এবারের ছাত্র আন্দোলনে সবথেকে বড় প্রাপ্তি নিঃসন্দেহে ইতিহাসের পুনর্মুল্যায়ন। এই বিনির্মাণের পরিসর তৈরি করতে দীর্ঘ সময় লেগে গেল। ১৯৭১ থেকে ২০২৪ সাল বড় কম সময় নয়। নতুন ইতিহাসের পথ তো সহজ, গোলাপ বিছানো নয়। ফলে রক্ত, জীবন দিয়ে ছাত্রেরা পুরনো ইতিহাসের ভিতে নতুন আখ্যানকে সামনে এনেছে। যা কখনও, কোনওদিনই পৃথিবীর গণতন্ত্রপ্রিয় জনতা ভুলে যাবে না। নকশাল আন্দোলনের সময় এ দেশে যে মূর্তি ভাঙার রাজনীতি জন্ম নিয়েছিল, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। থাকবেও। কিন্তু যুক্তি হিসেবে যা বলা হয়েছিল তা গুরুত্বপূর্ণ। সরোজ দত্ত বলতেন, নতুন সমাজ গড়তে পুরনোকে চ্যালেঞ্জ জানাতে হবে। আমাদের রেনেসাঁ কালের যুগপুরুষদের খড় মাটি রঙ সরিয়ে তাদের আসল চরিত্র বের করে আনতে হবে। সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলতে হবে। কাউকে মহিমান্বিত করতে অপরের অবদান মুছে ফেলা ইতিহাস নয়, গালগল্প। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে বছরের পর বছর যে চেনা ন্যারেটিভ আমরা শুনতে অভ্যস্ত, এবারের আন্দোলনে সেই অভ্যাসকে ধাক্কা দিয়েছে বলেই পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাবু ভদ্দরলোকদের মধ্যে 'গেল গেল' রব উঠেছে। বাংলাদেশের শাসকেরা জানে, 'রাজাকার' শব্দ সামনে নিয়ে এলে এপারের ইসলাম ফোবিয়া জেগে উঠবে। মনুবাদী রাজনীতি সর্বশক্তি দিয়ে ওপারের যাবতীয় ইল্লতপনাকে আড়াল করবে , তাই ফ্যাসিবাদী আচরণকে রাজাকারদের ষড়যন্ত্র বলে আসল সমস্যা কে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা।
আরও পড়ুন: ১১ মাস জেলও খেটেছেন! তবু কেন বাংলাদেশের জনগণের মন রাখতে ব্যর্থ শেখ হাসিনা?
বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলছে, এরকম রাজনৈতিক হিংসা স্বাধীন দেশ সেভাবে দেখেনি। অবাক হয়ে মাঝেমধ্যে ভাবি, ১৯৭২- ৭৪ সালের বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা কেন সেভাবে হয় না! আর কেউ না জানুক, যে রাশেদ খান মেনন এখন শেখ হাসিনার অনুগামী হয়ে ছাত্র আন্দোলন দমন করতে রাস্তায় ট্যাঙ্ক নামাতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হিতোপদেশ দেন, তিনি তো জানেন কিভাবে ৭২-৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রিয় রক্ষী বাহিনী হাজার হাজার বাম কর্মী সমর্থকদের খুন করেছিল। কত কত পরিবারের উপরে চরম অত্যাচার করা হয়েছিল।
একের পর এক ঘটনা লেখা যায়, যা শুনলে অনেকের ভাবমূর্তি নিয়েই প্রশ্ন উঠে যাবে। বিরোধিতা করলেই বাচ্চা বুড়ো সবাইকেই 'রাজাকার' যারা বলেন, তাদের মনে পড়বে না হয়তো, কিন্তু অনেকে এখনও জানেন কীভাবে রক্ষী বাহিনী ও মুজিব বাহিনীর হাতে লাঞ্ছিত হতে হয়েছিল বিপুল সংখ্যক সাধারণ জনতাকে। একটা ঘটনা বলি, ১৯৭৪ সালের জানুয়ারি মাসে রক্ষীবাহিনী নকশালপন্থী নেতা শান্তি সেনের বাড়িতে গিয়ে তাঁকে না পেয়ে তার ষাটোর্ধ্ব স্ত্রী অরুণা সেন, ছেলের বৌ তরুণী রীণা ও পড়শী কিশোরী হনুফাকে ধরে নিয়ে যায়। অরুণা সেনকে ঠান্ডা জলে চুবিয়ে রাখা হয়। দুই তরুণীকে নানাভাবে অত্যাচার করা হয়। পরে এই ঘটনা সামনে আসার পর সমাজের নানা মহলে হইচই পড়ে যায়। আদালতে মামলা করলে পুরো বিষয়টি সামনে আসে। এরকম আরও অনেক নির্মম ঘটনা সাল, তারিখ, এলাকা বলে বলে প্রমাণ করে দেওয়া যায়। আওয়ামী লীগের আজকের চেহারা নতুন নয়। দীর্ঘদিন ধরেই তাদের ফ্যাসিস্ট সুলভ চেহারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে আড়ালে ছিল। মুক্তিযুদ্ধ কখনও কল্পনা করেনি, এই দেশ তাকে দেখতে হবে একদিন। ঋত্বিক ঘটক এক সাক্ষাৎকারে দুঃখ করে বলেছিলেন, "যে স্বপ্নের বাংলাদেশের কথা ভেবেছিলাম তার পরিনতি হতাশ করেছে আমাকে।" তিনি আরও বলেছিলেন, "মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই এখন ডাকাত হয়ে গেছে।"
আরও পড়ুন: অগণিত মৃত্যু, সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস! শাসক-বিরোধী সংঘর্ষে কতটা ক্ষয়ক্ষতি বাংলাদেশে?
সুতরাং মুক্তিযোদ্ধা ট্যাগ সরকার লাগিয়ে দিলেই সঙ্গে সঙ্গে তা মহান হয়ে যায়, এমনটা মোটেও না। ফলে মহান মুক্তিযুদ্ধের একমাত্রিক গল্প শুনতে শুনতে শব্দের গাম্ভীর্য নষ্ট হয়ে গেছে, এতে তো অবাক হবার কিছু নেই। ১৯৭৩ সাল থেকেই তো আওয়ামী লীগ ভোটে কারচুপি করে জিতছে। এ কে না জানে! বয়স্ক মানুষদের নিশ্চিত তা মনে আছে। রাশেদ খান মেনন, কীভাবে বরিশালে তাকে জয়ী ঘোষণা করেও হারিয়ে দেওয়া হয়েছিল, অনেকেই ভোলেননি। মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর বিরাট ভূমিকা ছিল তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার সরাসরি মদতে জেনারেল উবানের প্রত্যক্ষ দায়িত্বে যে মুজিব বাহিনী গড়ে উঠেছিল, তার ভূমিকা ঠিক কী ছিল, তা বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কাছেও পরিস্কার ছিল না। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তাজউদ্দীন আহমদকে কারা খুনের চেষ্টা করেছিল, তার নতুন করে তদন্ত হোক। বাংলাদেশের গণতন্ত্র সেদিনই ফিরবে, যেদিন চেপে রাখা ইতিহাস জনগণের সামনে আসবে। ফ্যাসিবাদ একদিনে জন্মায় না। তার শিকড় খুঁজতে হবে অতীতের কার্যকলাপের মধ্যে দিয়েই।