আবহাওয়ার দোষ নাকি শাসকের অবহেলা? কেন হু হু করে প্রাণ নিচ্ছে ডেঙ্গু?

Dengue Outbreak in Kolkata: ডেঙ্গুর এরকম রূপ হয়তো অনেকদিন দেখেনি মানুষ। হঠাৎ এখন এই উপদ্রবের কারণ কী?

দৈর্ঘ্যে মেরেকেটে চার থেকে সাত মিলিমিটার। কালো শরীরের ওপর সাদা সাদা দাগ। ভালো নামটিও বেশ বাহারি, এডিস ইজিপ্টাই। অথচ ছোটখাট প্রাণীটিই এখন গোটা পশ্চিমবঙ্গের ‘ত্রাস’। আম জনতার কাছে এর পরিচিতি এখন ‘ডেঙ্গু মশা’ হিসেবে। ক্রমাগত বাড়তে থাকা ডেঙ্গুর থাবা আতঙ্কে ফেলে দিয়েছে ঘরে ঘরে। একটু আলো পড়লেই জানলা দরজা বন্ধ করে একেবারে বন্দি হয়ে যাওয়া, ঘুমোতে যাওয়ার আগে দেখে নেওয়া মশারিটা ঠিকঠাক গোঁজা হয়েছে কিনা। ২০২০-র পর গোটা জগতটাই একরকম আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে আছে। তার ওপর পশ্চিমবঙ্গে ডেঙ্গুর এমন বাড়বাড়ন্ত। স্বাভাবিকভাবেই নতুন করে আতঙ্ক বাড়ানোর জন্য যথেষ্ট। অবশ্য বঙ্গবাসীর কাছে এই রোগ নতুন কিছু নয়। এর আগেও বহুবার ডেঙ্গুর আক্রমণ সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু মাঝখানে বেশ কয়েক বছর খানিকটা ঠিক হয়ে গিয়েছিল। এরকম বিধ্বংসী রূপ হয়তো অনেকদিন দেখা হয়নি। তাহলে ২০২২-এর শেষের দিকে এসে হঠাৎ কেন এমন উপদ্রব? 

এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে কিছু ব্যাপার একটু জেনে নেওয়া ভালো। ডেঙ্গু উৎপত্তির দিকেই একটু যাওয়া যাক। মূলত যে সমস্ত জায়গায় জল জমে থাকে, সেখানেই ডেঙ্গুর মশা অর্থাৎ এডিস ইজিপ্টাই বংশবিস্তার করে। পড়ে থাকা কাপ, টব, গর্ত, ছাদ, টায়ার ইত্যাদি জায়গার বদ্ধ জল এই মশার জন্য আদর্শ। অন্যদিক থেকে দেখলে, যদি নিকাশি ব্যবস্থা খারাপ বা অকেজো হয়ে পড়ে, তাহলে সেসব ড্রেনগুলিতেও জল জমে থাকলে মশার উপদ্রব বাড়ে। ফলস্বরূপ, ডেঙ্গুর ছড়াছড়ি।

আরও পড়ুন : ইউনিসেফের বিস্ফোরক রিপোর্ট! কয়েক বছরেই তাপপ্রবাহের বলি হবে শিশুরা

এখান থেকেই কয়েকটা জায়গায় একটু আসা যাক। কেন বাড়ছে ডেঙ্গু? এর আগে মূলত বর্ষাকালেই আমরা ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে দেখেছি। কেবল কলকাতা নয়, গোটা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে শহর, মফস্বল, গ্রামে জল জমার সমস্যা সামনে আসে। মানুষের যাতায়াতের অসুবিধা তো হয়ই। সেইসঙ্গে অনেকদিন ধরে জমা জল থাকার দরুণ মশার উপদ্রবও বাড়ে। সেইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে ডেঙ্গুর উৎপাত। কিন্তু এবছর বর্ষার ঘাটতি আমরা সবাই লক্ষ্য করেছি। কিন্তু ডেঙ্গুর উপদ্রব শুরু হয়েছে দুর্গাপুজোর সময়টায়। এখনও রোগের প্রকোপ অব্যাহত। পাশাপাশি মৃত্যুও হয়েছে অনেকের। তবে আক্রান্তের সংখ্যা অনেকটাই বেশি। ১২ নভেম্বরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শুধু কলকাতা শহরেই ৬০৫২ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন। বর্ষা পেরিয়ে শরৎ, হেমন্তে এমন বাড়বাড়ন্তের কারণ কী?

মূলত তিনটি কারণের দিকে একটু নজর দেওয়া যাক। প্রথমত, আবহাওয়া পরিবর্তন। রোগ বিস্তার, রোগের ভয়াবহতা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ যে ক্রমপরিবর্তনশীল জলবায়ু ও বিশ্ব উষ্ণায়ন, সেটা স্বীকার করে নিয়েছেন অনেক বিজ্ঞানীই। সম্প্রতি এবিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা হু(WHO)। চলতি বছর জানুয়ারিতে এনিয়ে একটি বিশেষ আর্টিকলও প্রকাশ করেছে তারা। হু-এর দাবি, বিগত কয়েক বছরে গোটা বিশ্বজুড়ে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা বাড়ছে। আর সেই গানপয়েন্টের একেবারে সামনে দাঁড়িয়ে আছে এশিয়ার দেশগুলি। এবং এর জন্য জলবায়ু পরিবর্তন ও উষ্ণায়ন দায়ী।

আরও পড়ুন : চিকিৎসকের মুখোমুখি: ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে যে পদক্ষেপ এখনই প্রয়োজন

রকফেলার ফাউন্ডেশনের গবেষকরা এবিষয়েই একটি আর্টিকল প্রকাশ করেছেন। গবেষণা বলছে, একটু গরম ও স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়াই ডেঙ্গু মশাদের জন্য আদর্শ। সেইসঙ্গে আরও একটি ব্যাপার আছে। এডিস মশকীরা জমা জলেই ডিম পাড়ে। তারপর ওই জল শুকিয়ে গেলেও সমস্যা নেই। শুখা অবস্থায় ওই ডিম কয়েক মাস অবধি টিকে থাকতে পারে। আবার জল পেলে সেসব সতেজ হয়ে যায়। এবার জলবায়ুর খামখেয়ালিপনার কারণে ঋতু পরিবর্তনেও অনেক বদল দেখা যাচ্ছে। গ্রীষ্ম-বর্ষা-শীতের স্বাভাবিক হিসেবও যাচ্ছে গুলিয়ে। সেইসঙ্গে উষ্ণায়নের কারণে ঝড়, নিম্নচাপ, ঘূর্ণিঝড়ের মতো বিষয়ও আরও ঘন ঘন হচ্ছে। সব মিলিয়ে অবস্থা এডিস ইজিপ্টাই মশাদের অনুকূলেই যাচ্ছে। মনে করে দেখুন, পুজোর ঠিক আগেই নতুন ঘূর্ণিঝড়ের আগমন ঘটেছিল। তারপরেও জারি ছিল ঝড়-বৃষ্টির পরিস্থিতি। রকফেলার ফাউন্ডেশনের গবেষকদের আশঙ্কা, কেবল ডেঙ্গু নয়, মশাবাহিত রোগ সহ অন্যান্য অসুস্থতাও জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেদের থাবা বৃদ্ধি করবে।

আরও পড়ুন : উপসর্গ বদলাচ্ছে ডেঙ্গু! জমা জলেই কি তবে লুকিয়ে কলকাতার সর্বনাশ?

ডেঙ্গুর ভয়াবহতার দ্বিতীয় কারণ, সরকারি অব্যবস্থা। কেবল কলকাতা নয়, বোলপুর থেকে ব্যারাকপুর, পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ জায়গায় জমা জলের সমস্যা প্রবল। দিনের পর দিন জল জমে থাকায় মশাবাহিনীর সংসারও বাড়তে থাকে। সেইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিকাশি অব্যবস্থা। কোনও জায়গায় ড্রেন একপ্রকার বন্ধ হয়ে আছে। নোংরা আবর্জনা পড়ে স্বাভাবিক নিকাশি নালাও খারাপ হয়ে আছে। ফলে বৃষ্টি পড়লে জল নালা দিয়ে বেরোতে পারছে না। কোনওক্রমে জল বেরোলেও, নিকাশি দুরবস্থার জন্য ড্রেনে জমে থাকছে জল। বারবার বলা সত্তেও সরকারের ভ্রুক্ষেপ নেই কোনও কিছুতেই। কোনও জায়গায় মশা নিরোধক স্প্রে দেওয়া হচ্ছে, কোনও জায়গায় হচ্ছে না। সম্প্রতি এই গলদের বিষয়টি একপ্রকার স্বীকার করে নিয়েছেন কলকাতা পুরসভার ডেপুটি মেয়র অতীন ঘোষ। তাঁর বক্তব্য, পুরসভার পক্ষ থেকে তিনমাস আগে, অর্থাৎ আগস্ট-সেপ্টেম্বর নাগাদ কাউন্সিলরদের সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল। ডেঙ্গু রোধে যাতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়, সেই কথাও নাকি বলা হয়েছিল। কিন্তু সেখানেই থেকে যায় গলদ। কাউন্সিলররা যে ঠিকমতো কাজ করেননি, মানছেন অতীনবাবুও। এটা খোদ কলকাতার কাহিনি। বাকি রাজ্যের অবস্থা তাহলে নিশ্চয়ই আন্দাজ করা যায়!

সেইসঙ্গে উঠে আসছে আরও একটি প্রসঙ্গ। মানুষের সচেতনতার অভাব, এবং সরকারের পক্ষ থেকে তা নিয়ে দায়িত্ব নিতে না পারার ব্যর্থতা। যত দিন যাচ্ছে, কলকাতায় হাইরাইজের সংখ্যা বাড়ছে। এখন মফস্বল, গ্রামেও সেই ঝড় এসে লেগেছে। ফাঁকা জমি দেখলেই সেটা চলে যাচ্ছে প্রমোটারদের দখলে। কোথাও বাড়ি হচ্ছে, কোথাও আবার ফাঁকা জমি পড়ে আছে দিনের পর দিন। রাস্তাঘাট সবই হচ্ছে, কিন্তু জল যাওয়ার রাস্তা কি সঠিকভাবে তৈরি হচ্ছে? ডেপুটি মেয়র অতীনবাবুও বারবার এই দিকটার কথা উল্লেখ করেছেন। উল্লেখ করেছেন নির্মীয়মাণ বাড়ির প্রসঙ্গ। চারিদিকে নোংরা, আবর্জনা, বালতি, গর্ত; সেখানে জমে থাকছে জল। পুকুর বুজিয়ে তৈরি হচ্ছে ফ্ল্যাট। আইনি জটিলতায় বা অন্য কোনও কারণে সেই পুকুর অর্ধেক বুজিয়ে রেখে দেওয়া হচ্ছে। অবরুদ্ধ হচ্ছে জল। ফলত, বাড়ছে মশাবাহিত রোগ। বাড়ছে ডেঙ্গু। অন্যদিকে, ফাঁকা, পরিত্যক্ত খালি জমি অকারণেই ফেলে রেখেছেন অনেকে। সেখানেই ময়লা আবর্জনা ফেলছেন স্থানীয়রা। পরিত্যক্ত সেই জমিতে বৃষ্টি পড়লেই জমছে জল। এক্ষেত্রে মানুষকে সচেতন করার কাজ করার দায়িত্ব তো প্রশাসনের। স্থানীয় পুরসভা, পঞ্চায়েতের পক্ষ থেকে প্রতিনিধিরা গিয়ে ডেঙ্গু রোধে প্রচার করবেন, সেটাই স্বাভাবিক। ডেঙ্গুর লক্ষণ কী, কী ব্যবস্থা নেওয়া উচিত, প্রতিরোধ কী করে করা যাবে ইত্যাদি বিষয়গুলি জানলে মানুষেরও সুবিধা হয়। কিন্তু সেই প্রচারের ঘাটতি যে থেকে যাচ্ছে, সেটা হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গেলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে। অনেক সময় রোগ নির্ণয়ে দেরি হয়ে যাচ্ছে। ফলে অনেকটা দেরিতে হাসপাতালে পৌঁছচ্ছেন আক্রান্তরা। অনেক সময় সেই হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্রও ডেঙ্গুর আঁতুড়ঘর হয়ে ওঠে। হাসপাতালে গেলেই দেখা যায়, দিনেদুপুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রমাণ সাইজের মশা। সরকারি, বেসরকারি সব জায়গায় মোটামুটি একই ছবি।

আরও পড়ুন : হু হু করে বাড়ছে মানসিক অসুখে আক্রান্ত! কোন চরম পরিণতির দিকে এগোচ্ছে ভারত

২০২০, ২০২১-র করোনা অতিমারির পর গোটা পৃথিবীতে একটাই শব্দ ঘুরে বেড়াচ্ছে, ‘নিউ নর্মাল’। নতুন করে সবকিছুর মূল্যায়ন করার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। এই জায়গায় দাঁড়িয়ে চিকিৎসক, গবেষকরাও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তাঁরা বলছেন, করোনা এসে আমাদের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ধাক্কা দিয়ে গিয়েছে। সেইসঙ্গে এই ২-৩ বছর করোনার ভ্যাকসিনের জন্যই সবাই তৎপর থেকেছে। অন্যান্য রোগগুলির ভ্যাকসিন খানিক পিছিয়ে গিয়েছে। হু-র আশঙ্কা, হামের মতো রোগও মারণ থাবা দিতে পারে। ইতিমধ্যেই ভারতের বিভিন্ন জায়গায় হামের উপদ্রব শুরু হয়েছে। এদিকে বাংলায় চলছে ডেঙ্গু-প্রবাহ। নিকাশি অব্যবস্থা, জমা জলের সমস্যা থেকে আদৌ কি মুক্তি মিলবে? সমস্ত খবরের চ্যানেল, সংবাদপত্রের প্রধান ফোকাস পয়েন্ট দুর্নীতি। পঞ্চায়েত ভোটের আগে তা নিয়েই শাসক-বিরোধী তরজা লেগেই আছে। সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য কি তাহলে কোনও গুরুত্ব পাবে না? উত্তর খুঁজছি আমরা। তারও আগে, সবাই মিলে ডেঙ্গু নিয়ে সচেতন হই। নিজেদের স্বাস্থ্যের কথা ভেবে, নিজেদের জন্য।

More Articles