কালীর পায়ে ছুঁইয়ে মহড়া শুরু হতো গিরিশ ঘোষের নাটকের, কোথায় রয়েছে ‘উত্তর কলকাতার গিন্নী’?

Kolkata's siddheshwari kali temple : কেউ বলত ব্ল্যাক প্যাগোডা, কেউ আবার নাম দিয়েছিল ‘মিত্রের প্যাগোডা’, খোদ উত্তর কলকাতার সনাতনী বাসিন্দা সিদ্ধেশ্বরী কালী, জানেন কোথায়?

ঘন জঙ্গলের চেহারা সময়ের সঙ্গে একটু একটু করে বদলেছে। সেই সঙ্গে বদলেছে ইতিহাসও। আনকোরা নতুন একটা শহর হয়ে উঠেছে কলকাতা। এই কলকাতার মধ্যেই লুকিয়ে থাকা আরেকটা যে কলকাতার সন্ধান কবি করেছেন তাতে রয়েছে অজস্র পড়া না পড়া গল্প। এই কলকাতা নামটির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে কালীর প্রসঙ্গ। তাই কালীকে কলকাত্তায়ালী বললে যে বিশেষ ভুল হয় না। শুধু তিলোত্তমা নয়, সারা বাংলা জুড়েই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এমন বেশ কিছু কালীর রহস্য যা আজও অবাক করে। সেই ইতিহাস শুনলে গায়ে কাঁটা দেয়। দেবীর রুদ্র মূর্তির ব্যাখ্যা মেলে বিভিন্ন প্রকারে। কলকাতার কালী বলতেই প্রথমে মাথায় আসে, কালীঘাট, দক্ষিণেশ্বর অথবা ঠনঠনিয়ার প্রসঙ্গ। কিন্তু ভক্তি এবং ভক্তের জোর ছড়িয়ে পড়ে আরও আরও। প্রচলিত কালী রূপের ধারণা বারবার ভেঙেচুরে যায় সেখানে। কোথাও আবার চেনা রূপেই বছরের পর পর বছর ধরে পূজিতা হন দেবী।

খোদ উত্তর কলকাতার সনাতনী বাসিন্দা সিদ্ধেশ্বরী কালী। বাগবাজার থেকে যে রাস্তাটা কুমোরটুলির দিকে চলে যাচ্ছে, সেখানেই দীর্ঘদিনের বাস। দক্ষিনেশ্বরের কালী মন্দিরের মতো প্রচার না পেলেও ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ নিয়মিত এই মন্দিরে আসতেন। শোনা যায়, শুধু তিনি একা নন, পাশাপাশি তবে ভক্তদেরও ভরসার জায়গা ছিল এই মন্দির। অতীতে এই অঞ্চল ছিল ঘন জঙ্গলে ঢাকা। যেখানে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার ঠিক পাশ দিয়েই বয়ে গিয়েছিল হুগলি নদী যদিও বর্তমানে নদীর ভাঙ্গন এবং নতুন গতিপথে আরও অনেকটা পশ্চিমে সরে গিয়েছে হুগলি নদী।

কথিত আছে, বহুকাল আগে হিমালয়ের গিরি কন্দরে তপস্যা করছিলেন কালীবর নামে এক সন্ন্যাসী। তিনি স্বপ্নাদেশ পান কলকাতার সংলগ্ন দক্ষিণবঙ্গে কোথাও সতীর অঙ্গ পড়েছে, এবং সেই অঙ্গ তুলে প্রতিস্থাপন করতে হবে। কালীবর নদীর পার বরাবর হাঁটতে হাঁটতে এখানে এসে একটি বেদি, কিছু ফুল ও হাড়গোড় পড়ে আছে দেখতে পান। কালীবর ভাবেন এই সেই স্থান। যেমন ভাবা তেমন কাজ, যথা সময়ে এখানেই বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার কাজ সম্পন্ন করলেন সন্ন্যাসী। পরে এক কাপালিকের হাতে নিত্যপূজার ভার দিয়ে তিনি চলে গেলেন তাঁর পূর্ব নির্ধারিত পথে।

আরও পড়ুন - প্রতিষ্ঠা করেন সাধক বামাক্ষ্যাপা, পাথর কিংবা মাটি নয়, বাংলার কোথায় রয়েছে এই কাঠের কালী?

আসলে এই জায়গাটা ছিল ডাকাতদের পুরনো আস্তানা। তারাই ডাকাতি করতে যাওয়ার আগে ফুল মালা চড়িয়ে যেত। এখানেই প্রথমে হোগলা পাতার একটি কুটির তৈরি করে তপস্যা শুরু করেন কালীবর পরবর্তীতে তার তপস্যায় তুষ্ট হয়ে মন্দিরের মূর্তি রূপে দেখা দেন দেবী। ঠিক তাই এই মায়ের নাম হয় সিদ্ধেশ্বরী। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলেও সন্ন্যাসী কালীবর প্রতিষ্ঠিত দেবী কালিকার সামনে দেওয়া হত নরবলি।

পরবর্তীকালে এই পাতার মন্দিরের প্রকৃত সুরক্ষার জন্য কুমোরটুলির বিখ্যাত মিত্র পরিবারের হাত ধরে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত হয় সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির। মূল প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন এই পরিবারেরই গোবিন্দ মিত্র নামে একজন। বর্তমান মন্দিরটিতে রয়েছে বেশ কয়েকটি ঘর এবং একটি বড় দালান। গর্ভগৃহের সামনেই অলিন্দ। আর তার সামনে চওড়া গাড়ি বারান্দা। স্মৃতিফলক দেখে জানা যায়, মন্দিরটির শেষ সংস্কার হয়েছে তিন বছর আগে, অর্থাৎ ২০১৯ সালে।

ইতিহাস এখানেই পাতা উল্টোতে দেয় না আমাদের। শোনা যায়, একসময় এই মন্দিরের দুয়ারে এসেই আকুল আকুতি জানিয়ে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন, ‘ওরে এই মা সকলের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেন। তোদের যা যা কামনা তাই তিনি পূর্ণ করতে পারেন’। তাঁর সঙ্গে আসতেন শিষ্যরাও। আরও শোনা যায়, একবার কেশবচন্দ্র সেন নাকি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন, তখন ঠাকুর তার সুস্থতার জন্য দ্বারস্থ হন এই সিদ্ধেশ্বরী কালীর। মন্দিরে এসে দেবীর কাছে ডাব-চিনি মানত করেন তিনি। তারপর সেরে ওঠেন কেশব সেন। এতে বিশ্বাস আরও জোরালো হয়। শিব যায় গিরিশচন্দ্র ঘোষ তাঁর নাটক রচনার পর আগে এই মন্দিরে এসে দেবীর পায়ে ছুঁইয়ে তারপর নাটকের মহড়া শুরু করতেন। তিনিই দেবী সিদ্ধেশ্বরীকে ভক্তিভরে ‘উত্তর কলকাতার গিন্নি’ বলেও ডাকতেন।

আরও পড়ুন - দুটো-চারটে নয়, হাজারটা হাত রয়েছে দেবীর! কেন দক্ষিণ ভারতেও এত জনপ্রিয় বাংলার এই কালী?

মন্দিরে দেবীর হাতে রয়েছে একটি খাঁড়া, তা ছাড়া আরও দুটি খাঁড়া আছে এখানে। তার মধ্যে একটি খাঁড়া দিয়ে আগে বলি হত। সেই খাঁড়া তোলা আছে। আর একটি প্রাচীন খাঁড়া আছে। বিশ্বাসের দৌড় যে সত্যিই অনেকখানি, তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই বোধ হয় এখনও এই খাঁড়া ধোয়া জল নিয়ে গিয়ে ঘরে রাখেন ভক্তরা। নিত্যপুজো ছাড়াও প্রতি অমাবস্যায় বিশেষ পুজো হয় এই মন্দিরে। কালী পুজো, রটন্তি কালী পুজো এবং ফলহারিণী কালী পুজোয় থাকে বিশেষ আয়োজন। এছাড়াও বৈশাখ মাসের বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন হয় দেবীর ফুলদোল। ওই দিন দেবীকে ফুলের সাজে সাজানো হয়।

শোনা যায়, একসময় এই দেবী মন্দিরের নাম ছিল নবরত্ন মন্দির। অক্টারলোনি মনুমেন্টের চেয়েও নাকি অনেক উঁচু ছিল এর চূড়া। সেটি ভেঙে পড়ে ১৮৪০ সালের ভূমিকম্পে। সেকালে সাহেবরা মন্দিরটিকে বলত ব্ল্যাক প্যাগোডা, কেউ বা নাম দিয়েছিল ‘মিত্রের প্যাগোডা’। সেই ইতিহাস আজও বিয়ে বেড়াচ্ছে এই অঞ্চল। কিছুটা ক্ষয়, আর অনেকটা অক্ষয় নিয়ে কলকাতার রোজনামচার সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে নিচ্ছে দেবী সিদ্ধেশ্বরী।

More Articles