৬৮-তেও অনন্ত যৌবন! ছাই থেকে যেভাবে বারবার জেগে উঠেছেন রেখা...

Evergreen Rekha: মণীশ মালহোত্রার ডিজাইন করা প্রতিটি পোশাকেই উজ্জ্বল হয়ে উঠেছেন রেখা। কার্যত আগুন ঝরিয়েছেন। তাকানো থেকে শুরু করে শরীরের প্রতিটি ভঙ্গি, কোথাও বয়সের ছাপ নেই।

ছেলের কাছে যৌবন ভিক্ষা করেছিলেন বৃদ্ধ রাজা যযাতি। আসলে অখণ্ড যৌবন তো সকলেই চান। কিন্তু মেলে না। বয়স বাড়তে না বাড়তে শরীরে চেপে বসে নানা রোগ, চামড়া কুচকে যায়। হাতে পায়ে এঁটে বসে গেঁটে বাত। উঠতে ব্যথা, বসতে ব্যথা। আসলে শরীরের চেয়েও দ্রুত ফুরিয়ে যায় মন। পকেটে পয়সা থাকলে অনন্ত যৌবন রূপ ধরে রাখার নানা ব্যবস্থা চিকিৎসা শাস্ত্রে রয়েছে। রয়েছে নানাবিধ ট্রিটমেন্ট, প্লাস্টিক সার্জারি। কিন্তু মন! তাকে কোন ওষুধে টাটকা রাখা যায়, তার ফর্মুলা লেখা নেই কোনও তাবড় চিকিৎসক-বিশেষজ্ঞের কাছে। আর সেখানেই ধাক্কা খেয়ে যায় 'এজ ইস জাস্ট আ নাম্বার'-এর ধারণা। 'বয়স সংখ্যা মাত্র।' এমনটা আমরা আখছার বলি বটে। তবে সত্যি হজম হয় কি! তিরিশ পেরোলেই চেপে ধরে বলিরেখা, আরেকটু এগোলেই কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মিডলাইফ ক্রাইসিস, আরও একটু পথ হাঁটতে না হাঁটতেই যৌবনের শিশি খালি। তখন পড়ে থাকে মধুমেহ, উচ্চ রক্তচাপের মতো এমন কত প্রৌঢ়ত্বের সখা।

আরও পড়ুন: নায়িকা আসে, নায়িকা যায়, বলিউডি সাম্রাজ্যে নিজের রাজত্ব আজও অটুট রাখেন শাহরুখ খান

কিন্তু কেউ কেউ পারেন। তাঁরা যেন অন্য গ্রহের মানুষ। বয়সের ব্যাধি, বলিরেখা, কোমরের বাত তাঁদের ছোঁয় না, বরং তাঁদের মাথার চারধারে বনবন করে ঘোরে দৈব এক গ্ল্যামারের 'অওরা'। ষাট পেরিয়েও অবলীলায় নাচের বোলে বেঁধে ফেলেন যাঁরা মঞ্চ। কোমরের ঝটকানিতে তুচ্ছ করে দেন সংখ্যার হিসেব। শাড়ির রং, অলঙ্কারের ঘটা সাফ জানিয়ে দেয়, বিকেল আসতে এখনও অনেক দেরি হে ছোকরা! সকলে নন, এমন কেউ কেউ পারেন। ঠিক যেমনটা পেরেছেন রেখা। ৬৮ বছর বয়সে এসে Vogue ম্যাগাজিনের কভার পেজ আলো করে বসলেন তিনি। হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছেন। সত্তরে পড়তে ঠিক বছর দুয়েক বাকি। এই বয়সে হাতে ওষুধের স্ট্রিপ বা প্রেশার মাপার যন্ত্র নয়। বরং শরীরি ভঙ্গিতে তৈরি করলেন ম্যাজিক। এই প্রথমবার ভোগ ম্যাগাজিনের কভারগার্ল হলেন রেখা। Vogue Arabia-র কভারে ফের নিজেকে অপরূপা প্রমাণ করলেন বর্ষিয়ান এই অভিনেত্রী।

কোনওটায় জরির টুপি-সহ লম্বা জরির পোশাক, জরোয়ার গয়না তো মিশরীয় রানির বেশ। কখনও বা মাথায় ময়ূরের পেখমের মতো মুকুট, আর তার সঙ্গে মানানসই সোনালি পোশাক। কখনও বা আরবের রানির সাজ। মণীশ মালহোত্রার ডিজাইন করা প্রতিটি পোশাকেই উজ্জ্বল হয়ে উঠেছেন রেখা। কার্যত আগুন ঝরিয়েছেন। তাকানো থেকে শুরু করে শরীরের প্রতিটি ভঙ্গি, কোথাও বয়সের ছাপ নেই। তিনি যেন সেসবের উর্ধ্বে। এই প্রথমবার নয়, বারবার তা তিনি প্রমাণ করেছেন। ২০১৪ সালের পর তেমনভাবে তাঁকে পর্দায় দেখা না গেলেও বহু অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানের মঞ্চে একই রকম গ্ল্যামার নিয়ে হাজির থাকতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। এক পা- দু'পা করে বয়স বেড়েছে। কিন্তু তাঁর লাবণ্যে কমতি পড়েনি এতটুকু।

এই অফুরন্ত রূপ, অনন্ত যৌবনের রহস্যটা কী? অনেকেই বলবেন, নানা ধরনের আধুনিক বিউটি ট্রিটমেন্ট। কিন্তু আটষট্টিতেও যে মনোবল, যে অন্তর্শক্তি, যে শরীরি ভাষা নিয়ে তিনি ক্যামেরার সামনে হাজির হন, তাকে আত্মবিশ্বাস ছাড়া আর কী বলবেন। এমন কোনও দাওয়াই কি এখনও আবিষ্কৃত হয়েছে, যা এই আত্মবিশ্বাসের চাবিকাঠি হতে পারে। অথচ কোনও কালেই সোনায় মোড়া ছিল না তাঁর জীবন। বেঁচে থাকার প্রতি পর্যায়ে যে প্রত্যাখ্যান, বিশ্বাসভঙ্গের মধ্যে দিয়ে তাঁকে যেতে হয়েছে, অন্য কারওর ক্ষেত্রে তা হলে কী হত বলা যায় না। কিন্তু সেই সমস্ত যন্ত্রণাকে জারণ করে নিজের প্রাণশক্তির থলিতে যেন পুরে নিয়েছিলেন রেখা।

ভানুরেখা জেমিনি গণেশন। এই নাম সঙ্গে করেই পৃথিবীতে এসেছিল মেয়েটি। কিন্তু বয়স যত বেড়েছে তাঁর জীবনের একেকটা পর্বের মতোই খসে খসে গিয়েছে নামের একেকটা অংশ। অভিনয় করতে এসে তেলুগু অভিনেত্রী পুষ্পাভেল্লির ভালো লাগল জেমিনি স্টুডিওর মালিক এস এস ভাসানকে। কিন্তু তিনি বিবাহিত এবং বেশ কয়েকটি সন্তানের পিতা। প্রেম করা গেলেও তাই পুষ্পাভেল্লিকে নিজের পরিচয় দিতে রাজি ছিলেন না ভাসান। এদিকে, পুষ্পাভেল্লিও কম উচ্চাকাঙ্ক্ষী নন। সে সময় তাঁর আলাপ হল রসায়নের লেকচারার রামাস্বামী গণেশনের সঙ্গে। ভাগ্যপরীক্ষা করতে তখন অভিনয়ের জগতে এসেছেন তিনি। ভাসানের একটি ছবিতে একসঙ্গে অভিনয় করলেন রামাস্বামী ও পুষ্পাভেল্লি। দু'জনের মধ্যে যে কিছু একটা রন্ধন চলছে তা ভালোই বুঝতে পেরেছিলেন ভাসান। বড় ছবির শর্তে পুষ্পাভেল্লিকে সরিয়ে আনার চেষ্টাও করেছিলেন, তবে অভিনেত্রী বেছে নিলেন রামাস্বামীকেই। জেমিনি স্টুডিও ছাড়লেন রামাস্বামী, কিন্তু জেমিনিকে ছাড়লেন না। নাম পাল্টে হলেন জেমিনি গণেশন। ক্রমে তামিল সিনেমার বড় নাম হয়ে উঠলেন তিনি। জেমিনি আর পুষ্পাভেল্লি এদিকে ততদিনে জনপ্রিয় জুটি। সর্বত্র একত্রে দেখা যেতে লাগল তাঁদের। এদিকে ভাসানের মতোই জেমিনিও বিবাহিত। শোনা যায়, গোপনে মন্দিরে গিয়ে বিয়ে সেরেছিলেন জেমিনি আর পুষ্পাভেল্লি। অবশ্য তার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়। ভাসানের জীবনেও পুষ্পাভেল্লি ছিলেন দ্বিতীয় মহিলা, জেমিনির জীবনে এসেও সেই জায়গার কোনও পরিবর্তন হল না। এর মধ্যেই ১৯৫৪ সালে জন্মাল তাঁদের প্রথম সন্তান ভানুরেখা।

ছোট থেকেই বাবার স্নেহ পাননি ভানুরেখা। বরং যেখানেই গিয়েছেন, লোকে তেরছা চোখে তাকিয়েছে তাঁর দিকে। স্কুলে দেখেছেন, সৎবোনেদের স্কুলে পৌঁছে দিচ্ছেন বাবা, কিন্তু সেই স্নেহের পরশ থেকে বরাবর বঞ্চিত থেকেছেন তিনি। মায়ের ছিল রেস খেলার বিপজ্জনক অভ্যাস। রোজগারের সমস্ত টাকাই তার পিছনে উড়িয়ে ফেলতেন তিনি। তাছাড়া বাড়িতে ছেলেমেয়েদের সময় দেওয়ার মতো সময় কোনওদিনই পুষ্পাভেল্লির ব্যস্ত হাতে ছিল না। মায়ের পায়ের নূপুরের হাল্কা টুংটাং শব্দটুকু শুনেই  ঘুমোতে হয়েছে ভানুরেখা ও তার ভাইবোনেদের। প্রত্যাখ্যান, অবহেলার জীবনে পড়াশোনায় মন বসত না তার। একবার স্কুলের পরীক্ষায় খুব কম নম্বর পেয়ে দুম করে একটা চরম পথ বেছে নিল ছোট্ট মেয়েটি। ডাক্তারদের বহু চেষ্টায় প্রাণ ফিরল খুদে শরীরে। ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন পুষ্পাভেল্লি। মেয়েকে বকলেন না, মারলেন না। বরং দেখিয়ে দিলেন তিনটি পথ, পড়াশোনা, অভিনয় কিংবা বিয়ে। যে কোনও একটি বেছে নিতে হবে তাকে। ততদিনে ভানুরেখা বুঝে গিয়েছেন, পড়াশোনা হবে না তাঁর দ্বারা। বিয়ের প্রশ্নই ওঠে না। বাকি রইল অভিনয়। সে বিষয়ে তখনও তেমন আগ্রহ ছিল না তাঁর। তবু বছর তেরোর মেয়েকে হাত ধরে মা পৌঁছে দিলেন বলিউডের দরজায়। জেমিনি ও পুষ্পাভেল্লির মেয়ে হওয়ায় একফোঁটা অতিরিক্ত সুবিধা পাননি তিনি। বরং সম্মুখীন হতে হয়েছে অসুবিধার। বারবার সমস্ত দরজা থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে ফিরেছেন তিনি। শ্যামলা বরণ দক্ষিণী কন্যার বলিউডে অভিনয়ে সুযোগ পাওয়া এতই কি আর সহজ নাকি! দক্ষিণী ছবিতে ছোটখাটো রোল মিললেও মেয়েকে নিয়ে পুষ্পাভেল্লির স্বপ্ন ছিল অনেক বড়। অবশেষে বিভিন্ন দরজায় দরজায় ঘুরে মরার পর নাইরোবির এক ব্যবসায়ী এবং প্রোডিউসার কুলজিতের চোখে পড়ে যান ভানুরেখা। শ্যামলা গড়ন, টানা টানা চোখ-সব কিছুই যেন টেনেছিল কুলজিৎকে। তবে দুর্বলতা একটাই, এ মেয়ে যে এক বিন্দুও হিন্দি জানে না। কিন্তু দুর্দান্ত স্মৃতিশক্তি ছিল ভানুরেখার। একবার দেখলেই সব মুখস্থ করে ফেলতে পারতেন তিনি। আর তার জোরেই পাশ করে গেলেন কুলজিতের সামনে। পাঁচ বছরের জন্য ভানুরেখাকে কনট্র্যাক্টে সই করালেন তিনি।

অভিনয়ের সুযোগ এল বটে। তবে পথটা কুসুম বিছানো ছিল না। রেখা নিজেই জানিয়েছেন, "বম্বে ছিল জঙ্গলের মতো। আর সেখানে নিরস্ত্র আমি হেঁটে চলছিলাম। সম্ভবত জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সময় ছিল সেটা। কৈশর না পেরনো একটি মেয়ের সুযোগ নেওয়ার জন্য সবাই মুখিয়ে ছিল প্রতিটা মুহূর্তে।" না, এক বিন্দু মিথ্যা বলেননি তিনি। গায়ের রং নিয়ে খোঁচা তাঁকে প্রতিমুহূর্তে সহ্য করতে হয়েছে। তার উপর ছিল কলাকুশলীদের লোলুপ দৃষ্টি। 'আনজানা সফর' নামে একটি ছবির শুটিংয়ে তাঁকে জোর করে চুম্বন করলেন সুপারস্টার বিশ্বজিৎ। অথচ এ বিষয়ে কিচ্ছুটি জানানো হল না রেখাকে। বিশ্বজিৎ পরে জানান, পরিচালক-প্রযোজকদের নির্দেশেই এই কাজ করেছিলেন তিনি। এদিকে ভানুরেখার বিরুদ্ধে তাঁরা অভিযোগ আনলেন, সব আগেভাগে তাঁকে জানিয়েই দৃশ্যের শুটিং হয়েছিল। ইন্ডাস্ট্রির এই ভয়াবহ রূপ বছর চোদ্দর মেয়েটিকে বাকরুদ্ধ করে দিয়েছিল। কম দিনের মধ্যেই 'ডেসপারেট' খেতাব জুটে গেল তাঁর কপালে। কেউ নাম দিল তাঁর 'সাহসী', তো কেউ বলল 'সেক্স কিটেন'। যে বঞ্চনা নিয়ে তাঁর ছোটবেলা কেটেছে, এখানে এসেও কিছু তফাৎ হল না। কিন্তু দিনে দিনে আরও সাহসী হয়ে উঠল মেয়েটি। ততদিনে নামের গোড়া থেকে খসে গিয়েছে ভানু অংশটি। এখন তিনি রেখা, শুধুই রেখা।

ক্রমে খ্যাতির পারদ চড়তে লাগল। প্রথম থেকেই বলিউডে প্রথাভাঙা তিনি। তাঁর গায়ের রং থেকে চোখের দৃষ্টি, দৃপ্ত শরীরের ভঙ্গি, সাহসিকতা সব কিছু মিলিয়ে বলিউড খুঁজে পেল এক অন্য ধরনের নারীসত্তাকে। রেখা ততদিনে খ্যাতির শীর্ষে, বন্ধুমহল মারফৎ আলাপ হল মুকেশ আগরওয়ালের সঙ্গে। মুকেশ মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ী পরিবারের ছেলে। কম বয়সেই পড়াশোনা থেকে মন যায় অন্য দিকে। নানা জায়গায় ভাগ্যপরীক্ষা করেছেন, তবে কোনও কিছুতেই শিকে ছেঁড়েনি তাঁর। ১৯৭০-এর দিকে এসে হাত লাগান কিচেনওয়্যারের ব্যবসায়। মুকেশ ছিলেন রেখার ডাইহার্ড ফ্যান। মুকেশ সর্বদাই বড় বড় মানুষদের সঙ্গে মিশতে ভালোবাসতেন। তথাকথিত 'এলিট' শিরোনামে ঢোকার প্রচেষ্টার কোনও অভাব ছিল না তাঁর। বলিউডের অনেকের সঙ্গেই হৃদ্যতা ছিল মুকেশের। কিন্তু ছেলে হিসেবে মুকেশকে মন্দ লাগেনি রেখার। আলাপ ক্রমে গড়ায় প্রণয়ে। সেখান থেকে বিয়ে। 

বরাবরই মানুষ চেনেন বলে দাবি করতেন রেখা। কিন্তু নিজের বেলায় সে কথা খাটল না। ভাগ্যদেবতা রেখার ললাটে সুখ লিখে পাঠাননি যে। প্রথম কয়েকটা দিন অবশ্য ভালোই কেটেছিল তাঁর। মুকেশের দাদা-বৌদির সঙ্গেও ভালোই মিশে গিয়েছিলেন রেখা। লন্ডনে হানিমুন, বম্বেতে বাংলো, এসবের মধ্যেই রেখা বুঝতে পারেন, সব কিছু ঠিক সুরে বাজছে না। মুকেশ যেন অন্য মানুষ। সারাদিন বিভিন্ন রকম ওষুধে ডুবে থাকতেন মুকেশ। হতাশা, বিষন্নতা তো ছিলই। একটা সময় পরে অতিষ্ট হয়ে উঠলেন রেখা। অল্পদিনেই তিনি বুঝতে পারলেন ক্রনিক ডিপ্রেশনের রোগী মুকেশ। আর এই সমস্যা তাঁর পারিবারিক। সে সময়ে খ্যাতির মধ্যগগনে রেখা। ফলে তাঁর পক্ষে মুকেশের পাশে বসে তাঁর মনের চিকিৎসা করা সম্ভব ছিল না। বিয়ের এক বছর না ঘুরতেই ফলে সম্পর্ক ক্রমে গড়াল বিচ্ছেদের দিকে। সমস্ত রকম যোগাযোগ বন্ধ করে দিলেন রেখা। আর এই ধাক্কাটা হজম হল না মুকেশের। তিনি বেছে নিলেন আত্মহননের পথ। তবে এই প্রথম নয়। এর আগেও একাধিক বার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন মুকেশ। এবার তিনি সফল।

কিন্তু এই গোটা ব্যাপারটাই গেল রেখার বিরুদ্ধে। তখন সোশ্যাল মিডিয়া না থাকলেও 'মিডিয়া ট্রায়াল' কিন্তু  চলত তখনও। গোটা দুনিয়ার চোখে এক মুহূর্তে 'ভিলেন' হয়ে গেলেন রেখা। শুধু মুকেশের পরিবার বা বন্ধুবান্ধব নয়। রেখাকে কোণঠাসা করেছিল ইন্ড্রাস্ট্রির লোকেরাও। সুভাষ ঘাই থেকে দীপ্তি নাভাল, অনুপম খের,বাদ যাননি কেউই। 'ব্ল্যাক উইডো' থেকে 'ডাইনি', কী শুনতে হয়নি তাঁকে। ১৯৯০-এ মুকেশের মৃত্যুর পরের বছরই মাকে হারান রেখা। পর পর দুটি মৃত্যু ভিতরে ভিতরে খুব একা করে দিয়েছিল তাঁকে। তবে দমেননি রেখা। নিজের সমস্ত শক্তিকে তিনি ভরপুর কাজে লাগিয়েছেন নিজের কাজে। ভিতরে ভিতরে পুড়েছেন, কষ্ট পেয়েছেন। কিন্তু ফিনিক্সের মতো ফের ছাই থেকে জেগে উঠেছেন রেখা।

'উৎসব' বা 'উমরাও জান' থেকে 'ইজাজত', 'খুবসুরত' থেকে 'সিলসিলা'- একের পর এক ছবিতে নিজেকে প্রমাণ করেছেন রেখা। যে কোনও চরিত্রে তিনি যে সাহসী এবং অনোন্যা, তা বুঝিয়ে দিয়েছেন বারবার। তবু প্রত্যাখ্যান তাঁর পিছু ছাড়েনি। 'সিলসিলা' ছবির পরে অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে তোলপাড় পড়ে যায় বিশ্বে। এদিকে অমিতাভ তখন বিবাহিত। এ নিয়ে এখনও আলোচনা-জল্পনার শেষ নেই। তখনও  ছিল না। আশ্চর্যের ব্যাপার, ভাসান বা জেমিনির জীবনে যেভাবে দ্বিতীয় নারী হয়ে থেকে গেলেন মা পুষ্পাভেল্লি, রেখার জীবন যেন তারই রদেভু। একই ভাবে অমিতাভের জীবনেও প্রত্যাখ্যাত হয়ে রয়ে গেলেন তিনি। তবু তা নিয়ে কোনও দিন ঢাক ঢাক গুড় গুড় ছিল না রেখার। বরং প্রতিটি দৃশ্য, প্রতিটি পর্বে জীবনকে একই রকম ভাবে বুক ঠুকে মোকাবিলা করেছেন তিনি।

কাঞ্জিভরমের সাজ, গয়না, মাথা ভর্তি সিঁদুর, বরাবর চিরযৌবনা রেখা। কেউ বলেছেন, অমিতাভের কথা ভেবেই সিঁথি রাঙান রেখা, কেউ বা কটূ মন্তব্যও করেছেন। তবে সপাটে রেখা জানিয়েছেন, সিঁদুরে তাঁকে সুন্দর লাগে, তাই প্রসাধনী হিসেবে তিনি সিঁদুর পরেন। হ্যাঁ, সনাতন বিশুদ্ধবাদী অথচ হিপোক্রিট সমাজের চোখে চোখ রেখে এ কথা বুক ঠুকে বলতে পেরেছেন তিনি। আর এখানেই রেখা আলাদা।

আরও পড়ুন: গান প্রতি ১৫ টাকা! গানের চাবুকে বলিউড শাসন করেছিলেন সামসেদ বেগম

১৯৯৪ সাল নাগাদ বাবা জেমিনির কাছ থেকেও মেলে স্বীকৃতি। তা-ও আবার এক হল লোকের সামনে ফিল্মফেয়ারের মঞ্চে। রেখাকে মেয়ের স্বীকৃতি দেন জেমিনি। তাঁর হাত থেকেই পুরস্কারও গ্রহণ করেন। শুধু তা দেখার জন্য বেঁচে ছিলেন না পুষ্পাভেল্লি। কিন্তু এই স্বীকৃতি আদৌ কি উপশম! না, তা নিয়ে ভাবেননি রেখা। যার জীবনটাই কাছের মানুষের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যানে ভরা, ওইটুকু স্বীকৃতি কি সেই শূন্যতায় মাটি ফেলতে পারে। বরং জীবনকে জমিয়ে বেঁচেছেন রেখা। সমস্ত যন্ত্রণাকে টিপ করে পরেছেন ললাটে।

একটা সময় পর্যন্ত বদ্ধমূল ধারণা ছিল, নায়িকার পুঁজি তাঁর রূপ, তাঁর সৌন্দর্য এবং অবশ্যই তাঁর যৌবন। বয়স এসে দাঁড়ালেই 'দেহ পট সনে নট সকলই হারায়।' তাই সময়ের পরে পর্দা থেকে মুখ লুকিয়ে নেন এক সময়ের চূড়ান্ত সফল নায়িকা। জীবনে আর একবারও জনসমক্ষে আসেননি তিনি। এমনকী মৃত্যুর পরেও জানা যায়নি, বয়সেও ঠিক কতটা সুন্দরী, কতটা গ্ল্যামারাস ছিলেন তিনি। আর তার ঠিক বিপরীত মেরুতে জেগে থাকেন রেখারা। যাঁরা সত্তরের দোরগোরায় পৌঁছেও নিজেকে বাজিয়ে দেখতে, খতিয়ে দেখতে ভয় পান না। বরং প্রতিমুহূর্তে নিজেকে ছুঁড়ে দেন নতুন নতুন পরীক্ষার মধ্যে। প্রমাণ করে যান, তিনি ফিনিক্স। প্রমাণ করে যান, 'এজ ইজ জাস্ট আ নাম্বার'।

More Articles