চুলের তেলে থামল ঘূর্ণিঝড়! জগদীশচন্দ্র বসুর কল্পবিজ্ঞানের গল্প বিস্ময় জাগায় আজও

Acharyya Jagadishchandra Bose: চাঁদের বিপরীত পিঠে দক্ষিণ অর্ধে প্রায় ৯১ কিলোমিটার আকারের সেই গর্তের নাম 'বোস'।

হেমেন্দ্রমোহন বসু বাংলার একজন বিখ্যাত ব্যবসায়ী ছিলেন। ১৮৯৬ সালে নতুন পণ্য 'কুন্তলীন' নামে মাথার চুলের তেল বিক্রির প্রচারের জন্য তিনি এক নতুন পন্থা অবলম্বন করেছিলেন। তিনি এক ছোট গল্প লেখার প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিলেন। সেই প্রতিযোগিতায় সকলের অংশগ্রহণ করার অনুমতি ছিল এবং বিজেতার জন্য বিশেষ পুরস্কারের বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। সেই ছোট গল্পের প্রতিযোগিতার একটিমাত্র শর্ত ছিল যে, গল্পের মধ্যে সেই চুলের তেলের কথা লিখতে হবে অথবা তেলটিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দিতে হবে। স্বাভাবিকভাবেই প্রতিযোগিতায় বহু গল্প জমা পড়েছিল। যেই গল্পটা সর্বশ্রেষ্ঠ গল্প হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল, তার পটভূমিকায় এক ব্যক্তি কলকাতাকে তছনছ করে দিতে পারা একটি ঝড়কে সেই চুলের তেলের ব্যবহার করে থামিয়ে দিয়েছিল। সেই গল্পের নাম ছিল 'নিরুদ্দেশের পথে'। এই গল্পটিকে আধুনিক ভারতে লেখা শুরুর দিকের কল্পবিজ্ঞানের গল্পের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গল্প হিসেবে গণ্য করা হয়। পটভূমি পড়ে গল্পটিকে সম্পূর্ণ আজগুবি বলে মনে হয়। যদিও কল্পনার সাহায্য নিলেও লেখক এই গল্প থেকে বিজ্ঞানকে ছুটি দিয়ে দেননি। বিজ্ঞানের বহু ছোট অথচ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই গল্পের মধ্যে ছিল। এই গল্পের লেখক ছিলেন আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু। পরবর্তীকালে এই গল্পটিকেই ঘষামাজা করে সম্ভবত তিনি তার 'অব্যক্ত' গ্রন্থের 'পলাতক তুফান' গল্পটা লিখেছিলেন, কারণ এই দু'টি গল্পের বহু মিল রয়েছে।

আরও পড়ুন: তিনি না থাকলে জানাই হত না সমুদ্র তলদেশকে! প্রথম মহিলা ভূতত্ত্ববিদের লড়াই আজও অন্তরালে

আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর নাম বললে সাধারণ মানুষের মনে তাঁর বিজ্ঞানী সত্তার কথাই সর্বাগ্রে উঠে আসে। 'গাছের প্রাণ আছে' প্রমাণ করেছিলেন জগদীশ বসু, একথা আজ সর্বজনবিদিত। যে বিজ্ঞানী এমন এক প্রাকৃতিক সত‍্য তুলে আনছেন, তাঁর যে প্রকৃতির প্রতি প্রেম থাকবে, তা স্বাভাবিক। ১৯১৫ সালে বিক্রমপুরে আয়োজিত এক সভায় জগদীশচন্দ্র বসু বলেছিলেন যে, তিনি ছোটবেলায় পাখি, জীবজন্তু, গাছ এবং পরিবেশের বহু গল্প শুনেছিলেন। সেই গল্পগুলি শোনার ফলেই প্রকৃতির কাজ করার ধরন সম্পর্কে তাঁর আগ্রহ জন্মেছিল।

বেতার আবিষ্কার করে হয়তো নোবেল পেতে পারতেন জগদীশ বসু, কিন্তু কিছু ষড়যন্ত্রের কারণে তিনি ব্রাত্য থেকে গিয়েছিলেন। বেতার আবিষ্কারের কৃতিত্ব অথবা বেতার আবিস্কারের পুরস্কার, কোনওটাই তিনি পাননি। যদিও বেতার আবিষ্কারের ক্ষেত্রে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দীর্ঘদিন কেউ অবহেলা করতে পারেনি। তাই চাঁদের একটি গর্তের নাম তাঁর নাম অনুসারে দেওয়া হয়েছে। চাঁদের বিপরীত পিঠে দক্ষিণ অর্ধে প্রায় ৯১ কিলোমিটার আকারের সেই গর্তের নাম 'বোস'। জগদীশচন্দ্র বসুর নোবেল না পাওয়া অথবা ভারতীয় হওয়ার কারণে বিদেশে তাঁকে গবেষণাগার ব্যবহার করতে না দেওয়া সম্পর্কে আপামর বাঙালির আক্ষেপ থাকলেও তাঁর কিছু কৃতিত্ব সম্পর্কে বাঙালি খুব একটা আলোচনা করে না। জগদীশচন্দ্র বসু প্রথম এশিয়ার মানুষ হিসেবে একটি আমেরিকান পেটেন্ট পেয়েছিলেন। তাঁকে নাইটহুড দিয়ে ভূষিত করা হয়েছিল। ভারতে গবেষকদের আধুনিক পদ্ধতিতে গবেষণার জন্য তিনি ১৯১৭ সালে বসু বিজ্ঞান মন্দির স্থাপন করেছিলেন। এই গবেষণাগারে বর্তমানে বহু গবেষক নিজেদের গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।

জগদীশচন্দ্র বসুর বিজ্ঞানের প্রতি অবদানের কথা আলোচনা হলেও সাহিত্যের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান সম্পর্কে খুব একটা আলোচনা হয় না। তাঁর সাহিত্যের ক্ষেত্রে কোথাও বিজ্ঞান এবং সাহিত্য মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। মাথার চুলের তেল দিয়ে ঘূর্ণিঝড় থামানোর পিছনে একটা বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ছিল। তাঁর লেখা 'নিরুদ্দেশের পথে' গল্পে বাটারফ্লাই এফেক্টের মতো বিষয় দেখতে পাওয়া যায়। প্রায় নগণ্য একটা পরিবর্তন সময়ের সঙ্গে ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে যাওয়ার ফলে যে পরবর্তী ক্ষেত্রে কত বড় পরিবর্তন ঘটাতে পারে, সেই প্রমাণ এই গল্পে পাওয়া যায়। ১৯৩৭ সালে ২৩ নভেম্বর গিরিডিতে জগদীশচন্দ্র বসু শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।

তথ্য ঋণ: ফ্যাক্টর ডেইলি, এবিপি লাইভ

More Articles