শিশুদের কাছে বিজ্ঞানকে সহজ করে তুলেছিলেন, বাঙালি মনে রাখেনি গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যকে

তাঁর লেখা সব বয়সের, সব ধরনের মানুষের কাছেই ছিল অত্যন্ত সুখপাঠ্য। আর সেই কারণেই বিজ্ঞান-প্রচারক হিসেবে তাঁর কৃতিত্ব বর্তমানেও আমাদের কাছে প্রাসঙ্গিক।

‘পিঁপড়ের বুদ্ধি’। স্কুল পাঠ্যবই-এর এই গল্পের সঙ্গে হয়তো অনেক বাঙালিরই পরিচয় আছে। কিন্তু গল্পের লেখক? তাঁকে কি বাঙালি মনে রেখেছে? সামনেই আসছে তাঁর জন্মদিন। তাই আজকের লেখাটি সেই বিস্মৃতপ্রায় বিজ্ঞানী গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যকে নিয়ে। তাঁর গবেষণা মূলত কীটপতঙ্গ ও উদ্ভিদ নিয়ে। তাঁকে আধুনিক ভারতে কীটবিদ্যার (Entomology) জনক বলা হয়। তাঁর গবেষণার গুরুত্ব ছাড়াও বাঙালির হয়তো তাঁকে মনে রাখা উচিত ছিল কয়েকটি কারণে। প্রথমত, তিনি প্রাতিষ্ঠানিক বিজ্ঞানশিক্ষা গ্রহণ না করেও একজন সফল বিজ্ঞানী। দ্বিতীয়ত, তিনি গবেষণার পাশাপাশি বিজ্ঞান বিষয়টিকে বিজ্ঞানী মহলের বাইরে জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দীর্ঘ প্রচেষ্টা করেছিলেন। তৃতীয়ত, তিনি আজীবন মাতৃভাষা বাংলায় বিজ্ঞানচর্চা করেছেন।

আগামী ১ আগস্ট গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যর ১২৭তম জন্মদিন। ১৮৯৫ সালে ব্রিটিশ ভারতের অবিভক্ত বাংলার ফরিদপুর অঞ্চলের লোনসিং গ্রামে তাঁর জন্ম হয়। বাল্যকাল থেকেই তিনি পারিপার্শ্বিক প্রকৃতি, গাছপালা, পোকামাকড় সম্পর্কে কৌতূহলী ছিলেন। স্কুলজীবন শেষ করে ১৯১৩ সালে তিনি ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু, অর্থাভাবের কারণে অচিরেই তাঁর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। পরিবারের অভাব-অনটন মেটাতে অল্প বয়সে গ্রহণ করেন শিক্ষকতার চাকরি। এই সময় থেকেই সমসাময়িক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের দিকেও আকৃষ্ট হন তিনি। রচনা করেন বেশ কিছু পালাগান, সারিগান ইত্যাদি লোকগীতি। পাশাপাশি কয়েকটি পত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গেও যুক্ত হন। পরবর্তীকালে, বেঙ্গল চেম্বার অফ কমার্সে টেলিফোন অপারেটরের চাকরি নিয়ে তিনি কলকাতায় চলে আসেন।

১৯১৮ সালে ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে জলাভূমিতে পচা গাছপালার আশ্চর্য আলো বিকিরণক্ষমতা, অর্থাৎ ভৌতিক আলেয়ার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ‍্যা উপস্থাপিত করেন তিনি। এই প্রবন্ধের সূত্র ধরেই আচার্য জগদীশচন্দ্রর সঙ্গে তাঁর পরিচয়। এই সাক্ষাৎই তাঁর জীবনে নতুন অধ্যায়ের সূচক। জগদীশচন্দ্রর তত্ত্বাবধানে ১৯২১ সালে তিনি বসু বিজ্ঞান মন্দিরে গবেষণার কাজে সহকারী হিসেবে নিযুক্ত হন এবং ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত তিনি সেখানেই কর্মরত ছিলেন। বসু বিজ্ঞান মন্দিরে গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় ফোটোগ্রাফি, ছবি আঁকা, ডায়াগ্রাম তৈরি প্রভৃতি কাজ তিনি করতেন। পাশাপাশি এই প্রতিষ্ঠানেই ব্যক্তিগত উদ্যোগে গাছপালা, মাকড়সা, পিঁপড়ে, ব্যঙাচি, মৌমাছি ইত্যাদি কীটপতঙ্গের জীবনচক্র ও জৈবিক কার্যকলাপের ওপর গবেষণা চালিয়ে যান।

আরও পড়ুন: বিজ্ঞান জগতে অমার্জনীয় অপরাধ, আপত্তি তুলেও সরব হননি সত্যেন্দ্রনাথ

শুধুমাত্র কীটপতঙ্গের জীবনধারা নয়, তিনি প্রাণীমনস্তত্ব (Ethology; study of animal Behaviour) নিয়েও কাজ করেন। এই কাজের ক্ষেত্রেও আমাদের দেশে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। ১৯৩০-এর পরবর্তী সময় তাঁর পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত হতে থাকে। পিপঁড়ে ও মৌমাছির মতো সামাজিক পোকামাকড়ের মধ্যে রানি কীভাবে লার্ভার খাদ্য পরিবর্তন করে তার গোষ্ঠীতে অন্যান্য রানি, পুরুষ অথবা কর্মী তৈরি করে সেই ঘটনাটি গোপালচন্দ্র পর্যবেক্ষণ করেন। তাঁর এই কাজ বোস ইন্সটিটিউট-এর জার্নাল ‘ট্রানজাকশন’-এ প্রকাশিত হয়। ব্যঙাচির শরীরে পেনিসিলিন নামক অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করে তিনি দেখান যে, পেনিসিলিন ব্যঙাচির পূর্ণাঙ্গ ব্যাঙে রূপান্তর প্রক্রিয়াকে ব্যহত করে। যদিও এমন আশ্চর্য আবিষ্কারের প্রাপ্য সম্মান তিনি পাননি কোনওদিনই।

book cover

'করে দেখ' বইয়ের প্রচ্ছদ

বিজ্ঞানী পরিচয়ের বাইরে গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যর সবথেকে বড় পরিচয়, তিনি একজন দক্ষ লেখক ও বিজ্ঞান প্রচারক। ১৯৪৮ সালে সত্যেন্দ্রনাথ বসু যখন ‘বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ’ তৈরি করেন, তখন তিনি সেই কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন এবং একনিষ্ঠভাবে বিজ্ঞান পরিষদের মুখপত্র ‘জ্ঞান ও বিজ্ঞান’-এ সম্পাদনার কাজ করতেন। তাঁর বিজ্ঞান-বিষয়ক প্রবন্ধগুলি 'জ্ঞান ও বিজ্ঞান', 'প্রবাসী', 'দেশ', 'যুগান্তর', 'সাধনা', 'সন্দেশ' ইত্যাদি পত্রিকায় ছাপা হয়। বঙ্গদেশের বিভিন্ন পোকামাকড়ের প্রাঞ্জল বর্ণনা রয়েছে তাঁর লেখা ‘বাংলার কীটপতঙ্গ’ বইটিতে। এই বইটি রচনার জন্য তিনি ১৯৭৫ সালে ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’ পান। তাঁর লেখনশৈলীর অন্যতম বৈশিষ্ট হল সহজ-সরল ভাষা ও বিষয় উপস্থাপনার সাবলীল ভঙ্গি।

book cover

শিশু-কিশোরদের প্রিয় ছিল এই বই

তাঁর লেখা সব বয়সের, সব ধরনের মানুষের কাছেই ছিল অত্যন্ত সুখপাঠ্য। আর সেই কারণেই বিজ্ঞান-প্রচারক হিসেবে তাঁর কৃতিত্ব বর্তমানেও আমাদের কাছে প্রাসঙ্গিক। শিশু ও কিশোরদের মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতা তৈরির জন্য তাঁর রচিত কয়েকটি বই হল- ‘করে দেখ’, ‘বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞান সংবাদ’, ‘প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ’, ‘আমার দেখা পোকামাকড়’ ইত্যাদি। তিনি নিজেও যেমন লিখতেন, তেমনই বিজ্ঞান বিষয়ে অনুসন্ধিৎসু ব্যক্তিদের বাংলায় বিজ্ঞান চর্চার জন্য উৎসাহিত করতেন। ‘ভারতকোষ’ নামক বাংলায় একটি বিশ্বকোষ রচনার সঙ্গেও তিনি জড়িত ছিলেন। তাঁর আত্মজীবনীর নাম ‘মনে পড়ে’। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান রচনা ও বিজ্ঞান প্রচারে তাঁর অবদানের জন্য ১৯৬৮ সালে তিনি ‘আনন্দ পুরস্কার’-এ ভূষিত হন। ১৯৮১ সালে ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালকাটা তাঁকে সাম্মানিক ডিএসসি ডিগ্রি প্রদান করে। ওই বছরেই ৮ এপ্রিল কলকাতায় তাঁর জীবনাবসান হয়। তাঁর মৃত্যুর চল্লিশ বছর পরেও, মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান নতুন প্রজন্মের কাছে শিক্ষনীয়।

Gopalchandra Bhattacharya

বিজ্ঞান প্রচারে তিনি ছিলেন নিরলস

২০০৫ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার বাংলায় বিজ্ঞান প্রচারের কাজে যুক্ত বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সম্মান জানাতে ‘গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য স্মৃতি পুরস্কার’ নামক একটি বার্ষিক পুরস্কার প্রবর্তন করে। তাঁর চিন্তাধারাকে জনমানসে পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে গড়ে উঠেছে ‘গোপালচন্দ্র বিজ্ঞান প্রসার সমিতি’। ‘বাংলার কীটপতঙ্গ’ বইটির দে’জ পাবলিশিং কর্তৃক মুদ্রিত প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় বিজ্ঞানী অসীমা চট্টোপাধ্যায় প্রকৃতিবিজ্ঞানী গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যের বিজ্ঞানচর্চা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “তিনি যে পঞ্চাশ বছরেরও অধিককাল মাতৃভাষায় বিজ্ঞানসাহিত্যের সেবা করে আসছেন, তাতে তাঁকে এ যুগের অন্যতম পথিকৃৎ বললে অত্যুক্তি হয় না।"

 

More Articles